
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > জকি মাহমুদ / Jockey Mahmud (Probable- 19 century, the 1st Period)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99844 বার পড়া হয়েছে
জকি মাহমুদ / Jockey Mahmud (Probable- 19 century, the 1st Period)
জকি মাহমুদ
Jockey Mahmud
Home District: Narail, Kalia
ভূমিকাঃ
জকি মাহমুদ সাবেক পূর্ব যশোরের অন্যতম ভূস্বামী জোতদার ও নীলবিদ্রোহী হিসেবে সুপরিচিত। তার রাজোচিৎ ধ্যান-ধারণা, দান ও আভিজাত আজো কিংবদন্তী হয়ে টিকে আছে।
জন্ম ও শৈশবঃ
জকি মাহমুদ ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম পদে বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার প্রাচীন কেলাবাড়ি বা বর্তমান কলাবাড়ি গ্রামের দশানি-মোল্যাপাড়ার প্রাচীন জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুবিখ্যাত জমিদার ও ছিয়াত্তরের মন্বন্তর বিদ্রোহী কোরেশ মাহমুদ। পলাশি যুদ্ধের ৪০/৫০ বছর পরে জকি মাহমুদের জন্ম হলেও তিনি প্রাচীন ভূস্বামী পরিবারের আভিজাত্য ও বিলাসিতার মধ্যে বেড়ে ওঠেন। প্রাচীন দলিল দস্তাবজের ওপর জকি মাহমুদের বাংলায় স্বাক্ষর পাওয়া যায়। ১৮৫১ ও ১৮৬১ সালের দুটি ইজারা দলিলে জাকি মাহমুদের বাংলায় স্বাক্ষর বিদ্যমান। বাল্য বয়সেই তিনি সে যুগের রাজভাষা ফার্সি ও বাংলা ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করেন। জকি মাহমুদ, জকি মোল্যা, জকি মিয়া ও মোহাম্মদ জকি নামেও পরিচিত।
কর্ম ও পারিবারিক জীবনঃ
জকি মাহমুদ পূর্ব পুরুষের সাড়ে সাত শত টাকার গ্রন্থিদারি বা জাঁতিদারি বা জোতদারির অর্ধেকাংশের ভাগিদার ছিলেন। কারণ তাঁর একমাত্র ভাই সুরতি উল্লাহর অকাল প্রয়াসে তিনিই একমাত্র উত্তরাধিকারি পিতা কোরেশ মাহমুদের। জোতদারিই ছিল তাঁর উপার্জনের ও আভিজাত্যের উৎস। [জকি মাহমুদ পরিণত বয়সে কেলাবাড়ি বা কলাবাড়িয়া নদীর পশ্চিম পারের শক্তিমান গ্রন্থিদার বা গাঁতিদার শেখ মোলামের কন্যা মুসাম্মাত আজিজন নেছাকে বিয়ে করেন। এছাড়া অতি বৃদ্ধ বয়সে (প্রায় আশি বছর বয়সে) মহান পরিদর্শনে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেখানে এক দরিদ্র প্রজার কুমারী কন্যা তাকে সেবা করায় তিনি সুস্থ হন। অনুরোধে সেই কুমারীকে তিনি বিয়ে করেন। জকি মাহমুদ এই শ্বশুর পক্ষকে আর্থিক ও জমিজেরাও দিয়ে সাহায্য করেন এবং তাদের মালিক বা মল্লিক উপাধি দেন। আজো সেই জনগোষ্ঠী মল্লিক পদবি নিয়ে টিকে আছে। [জকি মাহমুদের প্রথম পক্ষের স্ত্রী আজিজনের গর্ভের সন্তানেরা হলেনঃ ১. তাহের ২. মদনি ৩. গগন ৪.উমেদ এবং ২ কন্যা। দ্বিতীয় পক্ষের সন্তানেরা হলেনঃ ১.বেদন ২.ছদন ৩.সবুর ও ইসমাইল।
নীলবিদ্রোহের নেতাঃ
ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশ দশকে নীল কঠিয়াল এমএন কামিন ডাবলাপ কেনাবাড়িতে নীলকুঠি স্থাপনের প্রস্তাব দেন। সেই সঙ্গে বলা হয় জকির ইজারা ভুক্ত তরফ কেনাবাড়িতে স্কুল ও রাস্তা তৈরী করো দেবে ডানলাপ সাহেব। জকি মাহমুদ, তার শ্বশুর শেখ গোলাম ও গোলামের ভ্রাতুসূত্র শেখ গোলাম আকবর সহ স্থানীয় গ্রন্থিদারেরা ডাবলপকে কুঠি নির্মাণের অনুমুতি দেন। কেনাবাড়ি কুঠির নীলকুঠিয়া এমএন কামিন ডাবলপ তাঁর কথা রাখেন নি। তখন তরফের বিভিন্ন স্থানে নীল চাষ হত। বর্তমান কলাবাড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে দক্ষিণ দিকের নীলকুঠি পর্যন্ত সমস্ত এলাকায় নীলচাষ হত। একদিন নীলচাষের মধ্যে এক কৃষকের গরু প্রবেশ করে। এই চাষী ছিল শেখ গোলাম আকবরের লোক। এরপর স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে ডাবপের পক্ষের লোকদের গোলযোগ হয়। পূর্বের শর্ত অনুসারে জকি মাহমুদ প্রথম দিকে সাহেব সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তার স্ত্রী আজিজন নেছার উদ্দ্যোগে চাচাতো ভাই শেখ গোলাম আকবরকে এক দলভুক্ত করেন।
১৮৪২ সালে কেলাবাড়িতে কৃষক বিদ্রোহ দেখা দেয়। এই বিদ্রোহের নেতা হলেন জকি মাহমুদ ও শেখ গোলাম আকবর। জকি ও গোলাম আকবরের কৃষক বাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে হাতি, ঘোড়া ও বন্দুক ব্যবহার করেছিলেন জকি ও গোলাম আকবরের বাহিনীতে ঘোড়া ও বন্দুকের ব্যবহার ছিল। কৃষক বাহিনীর অপ্রতিশোধ হামলায় নীলবাহিনী পরাজিত হয়। নীলবাহিনীতে ছিল বুনোবাগদি লাঠিয়াল ও হাটবাড়িয়া জমিদারদের দেয়া স্থানীয় লাঠিয়াল। ছিরামদি ও বিরামদি নামের হাটবাড়িয়া দুই লাঠিয়াল বন্দী হয়। এরা ছিল সহোদর, এদের আসল নাম জরিপ ও করিম। বেয়াদবির কারণে পরবর্তীকালে এরা নিহত হয়। ডানলপ জকি ও শেখ গোলাম আকবরের কাছে ক্ষমা চেয়ে কুঠি ত্যাগ করেন। কালের সাক্ষী হয়ে আজো তরফ কেলাবাড়ির নীলকুঠি ধ্বংসাবশেষ বিদ্যমান। এই কুঠির বর্তমান নাম কলাবাড়িয়া গাজির কুঠি। উল্লেখ্য, প্রায় ১ শত বছর আগে কেলাবাড়ি কলাবাড়িয়া নামে পরিচিত পায়।
অন্যান্য কর্মকান্ডঃ
জকি মাহমুদ অজস্র শক্তিমান ও দয়ালু ছিলেন। তিনি প্রতিবারে সাধারণ মানুষের সাহায্যের জন্য নিজ অর্থ ব্যবস্থা করতেন। মুসাফির খানা রেখেছিলেন জমিদার কাচারি ‘রঙ মহলের’ পাশে। পুঁথি পাঠ, উৎসব আনন্দ, নৌকাবাইচ, ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রত্যক্ষ অংশ নিতেন।
শত্রু দমন বিশ্লেষণঃ
ডাকাতি বিতাড়নের জন্য অশ্বারোহী লাঠিয়াল ও ছিপ নৌকার জন্য লাঠিয়াল কাহিনী রেখেছিলেন। গৃহকর্ম ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রজাদের মধ্যে প্রচুর চাকরান জমি বিতরন করেছিলেন জকি মাহমুদ।
একবার জকি মাহমুদের ভাইপো আবশাদকে চোর খালিতে খাজনা আদায়ে মতভেদ হওয়ায় ধরে নিয়ে যায় বর্তমান লোহাগড়া উপজেলার কোটাকোলের সরকার তালুকদারেরা। জকি মাহমুদ এই সংবাদ শোনা মাত্র নিজস্ব ছিপ নৌকায় লাঠিয়াল পাঠিয়ে আরশাদকে উদ্ধার করেন।
উনবিংশ শতাব্দীর নির্যাতিত মুসলিম সমাজের একজন নেতা হিসেবে নিজেকে গন্য করেন। তিনি ঢাকার মিরপুরে শাহ আলীবাগদাদির উত্তর বংশবীর ফরিদপুরের বোলমালদিয়ায় জমিদার সৈয়দ সরোয়ারজানে ডহাতি সৈয়দ বেনজিরের সঙ্গে কন্যা হায়াতুন্নেছাকে বিয়ে দেন। এছাড়া তিনি বর্তমান ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায় হিডিয়াডাঙ্গা গ্রামের সোদ ওমেদ আলি মিরের কন্যা আয়তন নেছার সঙ্গে নিজ পুত্র মর্দান মিয়ার বিয়ে দেন। এইভাবে জকি মাহমুদ সামাজিক আধিপত্য ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
জকি মাহমুদের প্রপৌত্র আর রাজ্জাক মিয়া ছিলেন জকির জমিদারি এটেস্টের শেষ উত্তরাধিকারী। উল্লেখ্য, গত শতাব্দীর পঞ্চাশ দশকে পূর্ব পাকিস্তান সরকার দেশের জমিদারি প্রথা বাতিল করে। সত্তর দশকের অন্যতম কবি মহসিন হোসাইন জকি মাহমুদের প্রপৌত্র আবদুর রাজ্জাক মিয়ার অন্যতম পুত্র।
সম্পাদনা:
কবি মোহসিন হোসাইন