
Home যোগাযোগ (Communication) > প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থা- আপডেট চলছে
এই পৃষ্ঠাটি মোট 97495 বার পড়া হয়েছে
প্রাচীন যোগাযোগ ব্যবস্থা- আপডেট চলছে
সুচনা ঃ- বৃহত্তর যশোর জেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থা পাশ্ববর্তী জেলাসমূহের চাইতে ভাল। নৌ, সড়ক, লে ও আকাশ পথের ব্যবস্থা থাকলেও বর্তমানে নদীগুলি ভরাট হয়ে যাওয়ায় সড়ক পথেই বৃহত্তর যশোরে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। যশোরে ১,০৫২.৯৪ কিঃ মিঃ সড়ক পথ রয়েছে। তন্মধ্যে প্রায় ৪০২.০৫ কিঃ মিঃ জেলার সবকয়িটি মহকুমা ছাড়াও অধিকাংশ থানার সাথে জেলা সদরের এবং বাইরে সড়ক যোগাযোগ রয়েছে। যশোরের উল্লেখযোগ্য সড়ক পথগুলি হচ্ছে-যশোর ঢাকা যশোর-খুলনা যশোর-কুষ্টিয়া, যশোর-বেনাপোল, যশোর-লক্ষীপাশা। অভ্যন্তরীন বিমান যোগাযোগের ক্ষেত্রেও যশোর অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
প্রাচীনতম সড়ক ঃ- জেলায় প্রাচীনতম সড়কটি ভৈরব নদীর তীর বরাবর নির্মিত। পঞ্চদশ শতাব্দীতে খান জাহান আলি উক্ত সড়ক নির্মাণ করেন। তিনি যখন দক্ষিণাঞ্চলে সুন্দরবন অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছিলেন, সেসময় রাস্তাটি নির্মাণ করেন। এ প্রসঙ্গে খান বাহাদুর এম, এ, মোমেনের উক্তি উল্লেখযোগ্য, .............জেলার প্রায় সর্বত্র প্রশস্ত সড়কসমূহের যেগুলোর অস্তিত্ব আজও বিদ্যমান রয়েছে, সেগুলোর নির্মাণকার্যের জন্য খান জাহান আলীই কৃতিত্বের অধিকারী। পঞ্চদশ শতাব্দীতে তিনি জেলার অভ্যন্তর দিয়ে সুন্দরবন অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন। খান জাহান আলী দক্ষিণের স্থানসমূহের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে জৈনপুর থেকে মুরালী আগমন করেন এবং দক্ষিণ অভিমুখে অগ্রসর হন। স্থানীয় প্রশস্ত সড়ক এবং পনপথসমূহের অধিকাংশই তিনি নির্মাণ করেন। এই প্রাচীনতম সড়কটি ১৬২৬ সালে প্রকাশিত ভ্যালেন্টিরিন এর মানচিত্রে বর্তমান (বর্ধমান ভারতে) থেকে যশোর জেলায় মধ্য দিয়ে ঢাকা চিহ্নিত রয়েছে।
অষ্টদশ শতাব্দীর সড়কসমূহ ঃ- ১৭৬৪ থেকে ১৭৭২ সালের মধ্যে রেনেল, মার্টিন এবং রিচার্দস যে সকল মানচিত্র অংকণ করেছেন তাতে দেখানো হয়েছে যে, জেলর গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ যেমন- নলডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মোহাম্মদপুর, মাগুরা, মীর্জানগর এবং মহেশপুর থেকে বিভিন্ন দিকে সড়কের বিস্তার ঘটেছে। নলডাঙ্গা থেকে তিনটি সড়কের একটি মুরালী, অন্যটি কুষ্টিয়া এবং তৃতীয়টি মহেষপুরের দিকে বিস্তৃত। রেনেলের মানচিত্র থেকে জানা যায় যে, কৃষ্ণনগর ও মোহাম্মদপুরের সাথেও ঝিনাইদহের সড়ক যোগাযোগ ছিল। মোহাম্মদপুর ছিল রাজা সীতারাম রায়ের রাজধানী। মোহাম্মদপুর থেকে ছয়টি রাস্তার উদ্ভব। তন্মধ্যে একটি পূর্বদিকে মুকসূদপুর, দিগনগর, কবিরাজপুর এবং হবিগঞ্জের (ফরিদপুরে) মধ্য দিয়ে বাখরগঞ্জ জেলার গৌরনদী পর্যন্ত এবং অপর একটি ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। তৃতীয়টি উত্তরদিকে ভূষনাকে যুক্ত করেছে। চতুর্থ রাস্তাটি গিয়েছে গোপালগঞ্জ (ফরিদপুর)। পঞ্চম রাস্তা পশ্চিমদিকে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একটি নলডাঙ্গায় এবং অপরটি খাজুড়া হয়ে যশোরে গেছে। ষষ্ঠ রাস্তার নাম যশোর কলকাতা সড়ক। যশোর, মুরালী, মোহাম্মদপুর, মহেশপুর এবং মীর্জানগরের সাথে জেলার অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহ সড়কপথে যুক্ত ছিল।
অষ্টদশ শতাব্দীর শেষের দিকে সড়ক যোগাযেগ সম্পর্কে এল, এস, এস, ও ম্যালী লিখেছেন, ‘‘অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে জেলায় সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা পূর্ববর্তী দুইশত বছরের মত একই থাকে, বিশেষ কোন রাস্তাঘাট ছিল না বলা যায়। এর কারণ সম্ভবত: জেলার নদীগুলো যাতায়াতের জন্য খুব উপযোগী ছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে কলকাতা থেকে একি সড়ক যশোরের উপর দিয়ে ঢাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আসলে এটি ছিল একটি নামমাত্র রাস্তা যার উপর দিয়ে শুধুমাত্র দেশী যানবাহনের চলাচল সম্ভব হতো।’’ উক্ত যশোর-কলকাতা সড়কটির জন্য দৈর্ঘ্য ছিল ৬৭.৬২ কিঃ মিঃ। ১৯৭৫ সালে অবশ্য ঝিনাইদহের উপর দিয়ে যশোর থেকে কুমারখালী এবং চৌগাছা থেকে খুলনা পর্যন্ত পর্যন্ত সড়ক নির্মিত হয়।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধের সড়কসমূহ ঃ- এল, এস, এস, ও’ম্যালী আরো উল্লেখ করেছেন ১৮০২ সালে এ জেলায় সড়ক হিসাবে গণ্য করা যায় এমন পর্য্যায়ের সড়ক ছিল মাত্র ৩২ কিঃ মিঃ এবং উল্লেখযোগ্য নদীসমূহের উপর কোন সেতু ছিল না। উনবিংশ শাতাব্দীর প্রথমার্ধে কালী প্রসাদ রায়কায়েকটি সেতু নির্মাণ করেন। তিনি কালী পোদ্দার নামেই সমধিক পরিচিত ছিলেন এবংযশোরের নিকটেই বাস করতেন। যশোর থেকে গঙ্গানদী পর্যন্ত একটি সড়ক নির্মাণ করার জন্য তিনি উদ্যেগ গ্রহণ করেন। সড়কটি সম্পন্ন করার জন্য পথিমধ্যে কায়েকটি নদীর উপর সেতু নির্মাণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় এবং তিনি যশোর থেকে ২.৪০ কিঃ মিঃ পূর্বে নীলগঞ্জে ভৈরব নদীর উপর দিয়ে প্রথম সেতু নির্মাণ করেন। অত:পর তিনি ঝিকরগাছা ও বনগারের (বর্তমানে ভারতে) মধ্যবর্তী এলাকায় কপোতাক্ষ নদ এবং ইছামতি নদীর উপর আরও ২/৩টি সেতু নির্মাণ করেন। এতদ্বাতীত, আরও কয়েকটি সড়কের তিনি নির্মাতা। তন্মধ্যে বনগাও থেকে চাকদহ পর্যন্ত নির্মিত সড়কটি খুব গুরুত্বপূর্ণ।
১৮৪৮ সালে তিনি বার্ষিক ৩০১ টাকা আয়ের ভূ-সম্পত্তি জেলার সড়ক মেরামত করার কাজে প্রদান করেন। অধিকন্তু তিনি ঝিকরগাছার নিকট কপোতাক্ষ নদের উপর সেতু নির্মাণের জন্য ১৮,০০০.০০ টাকা দান করেন। ঝিকরগাছার নিকট সেতু নির্মাণের জন্য তিনি ৯,০০০.০০ টাকা দান করেছিলেন। ১৮৪৬ সালে সরকার তৎসঙ্গে সমপরিমাণ টাকা প্রদান করে সেতুটির নির্মাণ কার্য সম্পন্ন করেন। কিন্তু সে বৎসরই †m‡Þ¤^i মাসে দুর্গা পূজার উৎসব উপলক্ষ্যে বহুলোকের সমাগম হওয়ার দরুণ সেতুটি ভেঙ্গে যায় এবং পুন:নির্মাণের জন্য প্রায় দশ হাজার টাকা ব্যয় হয়। বনগায়ের নিকট সেতু নির্মাণের জন্য কালীপ্রসাদ বাবু ১৮,০০০ টাকা দান করেছিলেন। সরকার এ স্থলেও সমপরিমাণ অর্থ সংযোগ করে উক্ত সেতুটির নির্মাণ কার্য সম্পন্ন করেন। এই সেতুটি নির্মিত হয় ১৮৬৪ সালে। সেই সময়ে যশোর থেকে গঙ্গানদী পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটিতে যে ভাংগন দেখা দেয় সরকার সেটির মেরামত কার্যও সম্পন্ন করেন।
১৮৭৫ সালের সড়কসমূহ ঃ- ডব্লিউ ডব্লিউ, হান্টার ১৮৭৫ সালের কয়েকটি প্রধান সড়কের নাম উল্লেক করেছেন, সর্বমোট দৈর্ঘ্য ছিল ৪২৫.০৪ কিঃ মিঃ। সড়কসমূহের নাম ও দৈর্ঘ্য যেমন-
(১) যশোর -ঝিনাইদহ সড়ক ৪৫.০৮ কিঃ মিঃ, (২) চুড়ামণকটি-চাঁদপুর সড়ক ৩৩.৮১ কিঃ মিঃ, (৩) যশোর-খুলনা সড়ক ৫৯.৫৭ কিঃ মিঃ, (৪) ঝিনাইদহ-মাগুরা সড়ক ২৭.৩৭ কিঃ মিঃ, (৫) মাগুরা-বিনোদপুর সড়ক ৯.৬৬ কিঃ মিঃ, (৬) বিনোদপুর-নাহাটি-সিঙ্গিয়া সড়ক ২৪.১৫ কিঃ মিঃ, (৭) চৌগাছা-ত্রিমোহনী সড়ক ৪৮.০৩ কিঃ মিঃ, (৮) যশোর-খাজুয়া সড়ক ১২.৮৮ কিঃ মিঃ, (৯) যশোর-নারিকেল বাড়িয়া সড়ক ২৪.১৫ কিঃ মিঃ, (১০) রাজাহাট-কেশবপুর সড়ক ২৭.৩৭ কিঃ মিঃ, (১১) পালুঘাট-দোদারিয়া সড়ক ১৬.০১ কিঃ মিঃ, (১২) সিঙ্গিয়া-বাসুন্দিয়া সড়ক ৩.২২ কিঃ মিঃ, (১৩) সিঙ্গিয়া-আয়মারা সড়ক ৩.২২ কিঃ মিঃ, (১৪) কেশবপুর-ত্রিমোহনী সড়ক ৪.০৫ কিঃ মিঃ, (১৫) যশোর-গাদাখালী সড়ক ১৬.০১ কিঃ মিঃ, (১৬) কালীগঞ্জ-নারায়নপুর সড়ক ২২.৫৪ কিঃ মিঃ, (১৭) বিনোদপুর-মোহাম্মদপুর সড়ক ১২.৮৮ কিঃ মিঃ, (১৮) ঝিনাইদহ-কাচিরকোহ সড়ক ২২.৫৪ কিঃ মিঃ, (১৯) শৈলকুপা-গাদখালী সড়ক ৪.৮৩ কিঃ মিঃ, (২০) নড়াইল-ঘোড়াখালী সড়ক ৩.২২ কিঃ মিঃ।
উল্লিখিত সড়কসমূহের মধ্যে শুধুমাত্র যশোর-গাদখালী সড়কটি গণপূর্ত দফতর কতৃক রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো। অন্যান্য সড়ক খেয়া তহবিলের তত্বাবধানে ছিল। যশোর পৌর এলাকা এবং অন্যান্য মহকুমা শহরের সড়কসমূহ এই তালিকাভুক্ত ছিল না।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকের সড়ক ঃ- উল্লিখিত সড়ক ব্যতীত ১৯২০-২৪ সালের আরও কয়েকটি সড়কের নাম এম, এ, মোমেন উল্লেখ করেছেন। (১) কোট চাঁদপুর-কৃষ্ণাগঞ্জ (মাছদিয়া রেলষ্টেশনের নিকটবর্তী সড়ক ১৪.৪৯ কিঃ মিঃ বিস্তৃত। এর একটি শাখা মহেশপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। (২) ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা সড়ক ১৯.৩২ কিঃ মিঃ দীর্ঘ। এই সড়কদ্বয়ের অবস্থা উন্নতমানের ছিল এবং তাতে ভারী যানবাহন চলাচল করতো। (৩) খাজুরী-সড়ক (যশোর-মাগুরা) ১৮৭৪-৭৫ সালে কয়েক দিনের মধ্যে পাকা করিয়ে নেয়া হয়। যশোর সদরের সংগে মাগুড়া মহকুমা সদরের যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে এটি করা হয়। তবে খাজুরা থেকৈ মাগুড়া পর্যন্ত ৩০.৫৯ কিঃ মিঃ কাঁচাই ছিল এবং বর্ষাকালে যানবাহন চলার অনুপযোগী ছিল। (৪) কালীগঞ্জ-কোটচাঁদপুর সড়কটি ১২.৮৮ কিঃ মিঃ দীর্ঘ এবং এটি যশোর-কিশেনগঞ্জ (বর্তমানে ভারতে) সড়কটি অংশ বিশেষ ছিল।
১৯২০ সালে জেলায় যে সব কাঁচা রাস্তা বিদ্যামান ছিল খান বাহাদুর এম, এম, মোমেন সে সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন যে, ‘‘জেলায় অনেক কাঁচা সড়ক বিচক্ষণ পরিকল্পনায় নির্মিত হলেও তাদের রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার দরুণ সড়কসমূহ বৎসরের অনেক সময় ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।’’ কেশবপুর-চুড়ামনকাটি সড়কটি আভ্যন্তরীণ যাতায়াতের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তবে ৬৪.৪ কিঃ মিঃ কিালোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সড়কটি মাত্র ৩.২২ কিলোমিটার পথ পাকা ছিল এবং এটি এমন অবস্থার উপনীত হয়েছিল যে, কেবলমাত্র শুস্ক আবহাওয়ার সময়ে ব্যবহার করা যেত। ঝিনাইদহ থেকে মাগুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ককবার্ণের সড়কটিরও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, তথাপি ঝিনাইদহ থেকে এই সড়কের ৫.৬৩ কিলোমিটার পথ কেবল পাকা ছিল। অবশিষ্ট ২১.৭৩ কিলোমিটার কাঁচা ছিল এবং বর্ষাকালে অত্যন্ত কর্দমাক্ত হয়ে পড়তো।
ঝিনাইদহ-শৈলকূপা সড়কটি পুরাতন ও কাঁচা ছিল। শৈলকূপায় ৪.০২ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত গারাপোতা থেকে রাস্তাটি সরাসরি নদীয়া জেলার (বর্তমানে ভারতে) কুমারখালীতে চলে যায়। এটা পাবনা সড়ক নামে পরিচিত ছিল এবং এই সড়কের যশোরের অংশ ২২.৫৪ কিলোমিটার দীর্ঘ।
হাটখালিশপুর থেকে মহেশপুর পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটি বর্ষাকালে যানবাহন চলাচলের অযোগ্য হয়ে যেত। চৌগাছা থেকে বুয়াতলী হয়ে মহেশপুর পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কটিরও অনুরূপ অবস্থা ছিল।
যশোরের শাশা থেকে বৃহত্তর খুলনার কলারোয়া পর্যন্ত সড়কটির বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কলারোয়া সড়কের সাথে সংযুক্ত যাবদপুর-সামতা সড়কটির গুরুত্ব কম ছিল না, খুলনার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অংশটিতে প্রচুর যানবাহন চলাচল করতো। তবে এ দুটি রাস্তা শুধুমাত্র শুস্ক আবহাওয়ায় ব্যবহৃত হতে পারতো।
জেলায় আরও কায়েকটি উল্লেখযোগ্য সড়কের মধ্যে রয়েছে (১) বিনোদপুরের মধ্য দিয়ে বিস্তৃত মাগৃড়া-মোহাম্মদপুর সড়ক, (২) যশোর-ফরিদপুর সড়ক (রাস্তাটি তারাগঞ্জ, বাঘেরপাড়া, নারিকেলবাড়িয়া,সালিখিয়া, নাহতা এবং বোয়ালমারী হয়ে ফরিদপুর পর্যন্ত), (৩) যশোর-লোহাগড়া সড়ক (এটি তারাগঞ্জ,নড়াইল, লক্ষীপাশা হয়ে মধুমণি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত), (৪) নড়াইল-মাগুরা সড়ক (হবিপাড়া, রাজাপুর এবং বিনোদপুরের সংযোগকারী)।
সড়কসমূহের দৈর্ঘ্য ঃ- ১৯২৪ সাল পর্যন্ত জেলার সড়কসমূহের (কাঁচা এবং পাকা) মোট দৈর্ঘ্য ছিল ২,৪৮৭.৪৫ কিলোমিটার। জেলার প্রতি ৫.১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকার জন্য ১.৬১ কিলোমিটার সড়ক ছিল। খান বাহাদুর এম, এ, মোমেন-এর মতে সড়ক সম্পর্কিত এই হার বাস্তবিকই অনেক বেশি, এবং সড়ক সংখ্যা বেশি হলে সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে যশোর জেলা সমগ্র প্রদেশে শীর্ষস্থানীয় হতে পারতো।
জেলা বোর্ডের সড়কসমূহ ঃ- ১৯১২ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ডের ২০৬.০৮ কিলোমিটার পাকা এবং ৭৪২.২১ কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা ছিল। এছাড়াও ছিল অনেকগুলো গ্রাম্য সড়ক যেগুলোর দৈর্ঘ্য ছিল সর্বমোট ৭৯৬.১১ কিলোমিটার। কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়কের পরিচয় নিম্নরূপ ঃ
(১) যশোর-ঝিনাইদহ সড়ক (কালিগঞ্জ হয়ে), দৈর্ঘ্য ৪৫.০৮ কিলোমিটার, সড়কটি পাকা। কালিগঞ্জ এবং ঝিনাইদহে সড়কের পরিদর্শন বাংলো ছিল। (২) যশোর-কেশবপুর সড়ক (রাজাহাট হয়ে) সড়কটি পাকা এবং দৈর্ঘ্য ৩৩.৮১ কিলোমিটার। মনিরামপুরে সড়কটির জন্য একটি পরিদর্শন বাংলো ছিল। (৩) যশোর-আফরা সড়ক, ১৯.৩২ কিলোমিটার,পাকা। (৪) ঝিনাইদহ-মাগুরা সড়ক ২৭.৩৭ কিলোমিটার (৫) যশোর-খুলনা সড়ক-এ তালতলা এবং সিঙ্গিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। (৬) ঝিনাইদহ-বাড়াই সড়ক, দৈর্ঘ্য ২০.১২ কিঃ মিঃ। সড়কটি চুয়াডাঙ্গা রেল ষ্টেশন পর্যন্ত বিস্তৃত। (৭) কালীগঞ্জ-কোটচাঁদপুর সড়ক, ১৬.১০ কিলোমিটার।
রেলপথ ঃ- বৃহত্তর যশোর জেলায় রেলপথের দৈর্ঘ্য ১০৫.০৫ কিলোমিটার। বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে (বৃটিশ আমলের একটি বেসরকারী কোম্পানী) ১৮৮৪ সালে কোলকাতা-যশোর রেলপথ নির্মাণ করে। যশোর জেলায় এটাই প্রথম রেলপথ। রেলপথটি জেলার অভ্যন্তরে তালতলাহাট থেকে যশোর হয়ে কলকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত। তালতলাহাট (খুলনা থেকে ৩৮.৭৪ কিলোমিটার) দূরবর্তী থেকে উক্ত রেললাইনের ষ্টেশনসমূহের দুরত্ব ছিল নয়াপাড়া ৩.০৫ কিলোমিটার, চেংগুটিয়া ৮.২৫ কিলোমিটার, মেহেরুল্লানগর ৩০.০৩ কিলোমিটার, বড় বাজার, ৪৫.৬৯ কিঃ মিঃ, মোবারকগঞ্জ ৫৭.৯৬ কিলোমিটার, সুন্দরপুর ৬৩.৯২ কিলোমিটার এবং কোটচাঁদপুর ৭০.২৫ কিলোমিটার।
যশোর-বেনাপোল রেলপথ নির্মিত হয় ১৮৮৪ সালে। এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ৪২.০৩ কিলোমিটার। যশোর থেকে উল্লেখযোগ্য রেল ষ্টেশনসমূহের নাম এবং দূরত্ব নিম্নে প্রদত্ত হইল ঃ
ঝিকরগাছা ঘাট ১৪.৪৯ কিলোমিটার, গাদখালী ১৯.৩২ কিলোমিটার, নাভারণ ২৫.৭৬ কিলোমিটার এবং বেনাপোল ৩৩.৯৮ কিলোমিটার। এই দুইটি রেলপথ ব্রডগেজ। ১৯৫১ সালে যশোর দর্শনা রেলপথ নির্মিত হয়। এর দৈর্ঘ্য ৪৯.২৩ কিলোমিটার।
জলপথ ঃ- বৃহত্তর যশোর জেরর পূর্বাঞ্চলের নদী সারা বৎসর নাব্য থাকে। পশ্চিমাঞ্চলের নদীসমূহ সাধারণত: অগভীর। তাই কেবলমাত্র বর্ষাকালে ছোট ছোট নৌযান এইসব নদীপথে চলাচল করতে পারে। জেলার পূর্ব সীমানা দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদী যোগাযোগ ব্যবস্থায়একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নদীটি সারা বৎসর দেশী নৌকার জন্য নাব্য থাকে এবং সুন্দরবনে যাতায়াতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। কুমার নদী শীতকালে বহুস্থানে গুকিয়ে যায়। তখন গরারগঞ্জ, সালকোপা এবং ফাজিলপুর নামক স্থানসমূহে খুব সহজে নদীটি পায়ে হেটে পার হওয়া যায় এবং ফলে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জুন থেকে আগষ্ট পর্যন্ত কুমার নদী নাব্য থাকে। তখন কুষ্টিয়া থেকে মাগুরা পর্যন্ত বৃহদাকার নৌ চলাচল অব্যাহত থঅকে। পরবর্তী মাসগুলোতে নদীর বুকে চর পড়ে নৌ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঝিনাইদহ থেকৈ মাগুরা পর্যন্ত শুধুমাত্র বর্ষাকালে তিনমাস নদীতে নৌকা চলাচল করতে থাকে। ঝিনাইদহের পর নদীটি আদৌ নাব্য নয়। মাগুরা থেকে বিনোদপুর পর্যন্ত শীতকালে নৌকা চলাচল সম্ভব হয় না এবং স্টীমার চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। চিত্রা নদী খাড়গোদা থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত নাব্য নয়, কিন্তু ঘোড়াখালী থেকে ভাটি এলাকায় গাজীরহাট পর্যন্ত নৌকা চলাচলের যোগ্য থাকে। চিত্রা নদী গাজীর হাটের নিকট আত্রাই নদীর সাথ মিলিত হয়েছে। কপোতাক্ষ নদেও অনুরূপভাবে চর পড়ে নৌ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কেবল বাঘা থেকে ঝিকরগাছা পর্যন্ত নদীপথে সারা বৎসর ছোট ছোট নৌকা চলাচল করতে পারে। ঝিকরগাছা থেকে উত্তরদিকে চৌগাছা পর্যন্ত ছোট নৌযান চলাচলের যোগ্য থাকে। কিন্তু চৌগাছার পরে শীতকালে নৌ চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। কেশবপুরের পশ্চিমে ভাদ্র নদী শুকয়ে গেলেও আলতাপোল থেকে ভাটি এলাকয় সারা বৎসর নাব্য থাকে। এ পথ দেশী নৌকা এমনকি যন্ত্রচালিত ছোট নৌযানও চলাচল করার জন্য উপযোগী। নদীটি সুন্দরবনে এঁকে বেঁকে প্রবেশ করেছে। হাটবারে ধান বোঝাই বিরাট নৌকা উক্ত নদীপথে খুলনার দিক থেকে কেশবপুরে আগমন করে থাকে। হরিহরা নদীতে চর পড়ে গেছে। কেবলমাত্র কেশবপুর থেকে আলতাপোল পর্যন্ত অংশটি নৌ চলাচলের যোগ্য। আলতাপোল এসে নদীটি ভাদ্রের সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ভৈরব নদীতে দক্ষিণদিক থেকে আফ্রাঘাট পর্যন্ত ৬ ফুট গভীর খোল বিশিষ্ট যন্ত্রচালিত নৌযান চলাচল করতে পারে। শাকসবজী, তরমুজ, নারিকেল, আনারস ইত্যাদি ভর্তি ছোট-বড় নানা আকারের নৌকা বাসুন্দিয়া বাজারে দেখা যায়।
১৯২০ সালে জেলায় নিম্নোক্ত ষ্টীমার সার্ভিসগুলো চালু ছিল। যেমন-
১। মাগুরা সার্ভিস-খুলনা থেকে ভৈরব,মজিদখালী, চিত্রা এবং নবগঙ্গা হয়ে বিনোদপুর পর্যন্ত।
২। খুলনা কালিয়া-নড়াইল সার্ভিস ভৈরব, সাতাই, বাংকোনা, নবগঙ্গা এবং চিত্রা নদীপথে লোহাগড়া হয়ে খুলনা থেকে রূপগঞ্জ পর্যন্ত।
৩। খুলনা-বোয়ালমারী সার্ভিস ভৈরব এবং আঠারো বাকী নদী দিয়ে খুলনা থেকে বোয়ালমারী এবং মোহাম্মদপুর থেকে নদিয়ারচাঁদঘাট পর্যন্ত।
৪। বোয়ালমারী-কুষ্টিয়া সার্ভিস মধুমতি এবং গড়াই নদীপতেথ বোয়ালমারী থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত।
৫। ঝিকরগাছা এবং কপিলমুনি সার্ভিস-কপোতাক্ষ নদ দিয়ে ঝিকরগাছা থেকে কপিলমুনি পর্যন্ত।
১৯৭১ সালে বৃহত্তর যশোর জেলার মধ্য দিয়ে খুলনা-বরিশাল-ঢাকা (নারায়নগঞ্জ সার্ভিস নামেএকটি ষ্টীমার সার্ভিস চালু ছিল। ষ্টিমার শুধুমাত্র জেলার নড়াইল মহকুমার (সে সময়ের) টোনা-কালিয়াতে থামতো।
হ্যালিফেক্স ক্যানেল ঃ- হ্যালিফেক্স ক্যানেল দৈর্ঘ্য মাত্র অর্ধ মাইল হলেও এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই খঅলটি মধমতির সাথে টোনার নিকট নবগঙ্গাকে সংযুক্ত করেছে। নবগঙ্গা নদীর উত্তর অঞ্চলে চর পড়ে শুস্ক হয়ে যাওয়ায় নৌকা চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। ফলে ১৯০১ সালে জেলা বোর্ড এই হ্যালিফেক্স খালটি ১৭ হাজার টাকা ব্যয়ে খনন করে। স্থানীয় নামেই খালটি টোনা খাল নামে পরিচিত ছিল। কারণ মধুমতি নদীর তীরে বড়দিয়া এবং নবগঙ্গার তীরে টোনা নামক স্থানে খালটি নদী দ্বয়কে সংযুক্ত করেছে। কিন্তু ১৯০২ সালে তদানিন্তন জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট এ জি, হ্যালিফেক্স আই, সি, এস, এর নামানুসারে খালটি ‘হ্যালিফেক্স কাট’ নামকরণ করা হয়। এটি চালু হওয়ার পর থেকে নদী পথে জেলার যোগাযোগ ব্যবস্থা ব্যাপক ভাবে প্রসার লাভ করে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি হয়। খালটি মারফত মধুমতি নদীর পানি প্রায় ভরাট হয়ে যাওয়া নবগঙ্গায় আসে বিধায় পূর্বাঞ্চলের জেলাসমূহের সংগে নৌপথে যাতায়াত সুবিধাজনক হয়েছে। খালটি বর্তমানে নবগঙ্গা ও মধুমতি নদী হয়ে খুলনা বরিশাল ষ্টিমার পথের একটি অংশ বিশেষ। খননের পর থেকেই খালের অনেক উন্নতি সাধন করা হয়েছে। বিস্তার ও গভীরতা বৃদ্ধির কারণে খালটি বর্তমানে পলল সমৃদ্ধ নদীর বৈশিষ্ঠধারী হয়েছে। প্রথমে ৬০ ফুট প্রস্থ নিয়ে খালটি খনন করা হয়। বর্তমানে এটির প্রস্থ ৪০০ ফুট। এই খাল দিয়ে মধুমতি নদীর কম প্রবাহের সময়কার দুই তৃতীয়াংশ পানি প্রবাহিত হওয়ায় নবগঙ্গা নদীর অবস্থা ব্যাপক ভাবে উন্নতি লাভ করে। হ্যালিফ্যাক্স খাল থেকে জেলর পূর্ব সীমানায় অবস্থিত মানিকদহ পর্যন্ত মধুমতি নদীর ১৯.৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ বক্ষদেশে চর পড়ে যায়। ফলে সাবেক পূর্ব পাকিস্তান অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল কর্তৃপক্ষকে মধুমতি নদীর সকল অংশ নাব্য রাখার প্রয়োজনে ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর দশ লক্ষ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। অনুরূপ ব্যবস্থা গৃহীত ন হলে নদীটি কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ ভরাট হয়ে যেত।