
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > জাহান্দার শাহ ও ওয়ালি মাহমুদ শাহ / Jahandar Shah and Wali Mahmood Shah
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99935 বার পড়া হয়েছে
জাহান্দার শাহ ও ওয়ালি মাহমুদ শাহ / Jahandar Shah and Wali Mahmood Shah
|
জাহান্দার শাহ ও ওয়ালি মাহমুদ শাহ Jahandar Shah and Wali Mahmood Shah |
‘বাংলার সুলাতানের মন্ত্রী পির খানজাহান পূর্ব বাংলাতে যিনি করেন অভিযান। বিভিন্ন অঞ্চল জয় করি অবশেষে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগিলেন বাগেরহাট এসে। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা জাহাদার খান ওয়ালি খান নামে তদীয় সন্তান। খুলনার দক্ষিণ অঞ্চল করিয়া বিজয় উত্তর দিকেতে ক্রমে অগ্রসর হয়। কালিয়ার পাশে ছিল কালীনদী নাম, তার পূর্ব দিকে কেলাবাড়ি করেন নির্মাণ। সাড়ে চার শত বছর হইয়াছে গত কেলাবাড়ি কলাবাড়িয়া নামে পরিচিত। তার বংশধরেরা মিয়া,মোল্যা,মুন্সি নামে, এখনো করিছে বাস কলাবাড়িয়া গ্রামে। (নড়াইলের চারণকবি বিপিন সরকারের রচনা থাকে) |
১৪১১ সালে বাঙালির জনপ্রিয় ও যোগ্য স্বাধীন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ নিহত হন। সুলতানকে হত্যার পেছনে হাত ছিলো ভাতুড়িয়ার জমিদার রাজা গনেশের। ‘ঈশান নাগরের’ রচিত ‘অদ্বৈতপ্রকাশ গ্রন্থের বক্তব্য তেমনিঃ
যেই নরাসিংহ নাড়িয়াল বলি খ্যাত,
সিদ্ধ শ্রোত্রিয়াখ্য অরু ওঝার বংশজাত।
..............................................
যাহার মন্ত্রনা বলে শ্রী গণেশ রাজা,
গৌড়িয়া বাদশাহে মারি’ গৌড়ে হইল রাজা।
পান্ডুয়ার বিখ্যাত দরবেশ আলাওয়াল হক সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের শিক্ষক ছিলেন। সুলতান আজম শাহের দুই সহপাঠি ছিলেন আলাওল পুত্র নুর কুতুবে আলম ও আযম খাঁ। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ সোনারগাঁয়ের শাসক থাকাকালে আযম খাঁ তাঁর সেনাপতি ছিলেন। গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ নিহত হলে আজম খাঁ গৌড় পণ্ডুয়ার শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। তিনি স্বনামে স্বাধীন সুলতানের মতো মুদ্রাংকন করেন। আজম খাঁনের এই মুদ্রাংকন ছিলো সে সময়ের জন্য সাহসি ভুমিকা। গণেশের বিরুদ্ধে এটা ছিলো একটি রাজনৈতিক প্রস্তর আঘাত ও ন্যায়ের পক্ষের প্রতিবাদ। আজম খাঁ বা শায়খ আজম ‘কুতুব উদ্দিন আজম শাহ’ নাম ধারণ করেন। কারণ গণেশ ও তার সমর্থকেরা ইতোমধ্যে আজম শাহের এক পুত্রকে নিহত করেন।
১৯৮৭-১৯৮৮ সালে সিলেটের বিয়ানি বাজারে এক সমৃদ্ধ মুদ্রা ভান্ডার আবিষ্কৃত হয়েছে। এখানে ২০টি মুদ্রা পাওয়া যায় কুতুবউদ্দিন আজম শাহের নামের। ইতোপূর্বে এই সুলতানের নাম কারো জানা ছিলোনা। মুদ্রা বিশেষজ্ঞ রেজাউল করিম ঐ মুদ্রার গায়ে আরবিতে লেখা বাক্যের পাঠোদ্ধার করেছেন: ‘আল্লাহর খলিফার (প্রতিনিধির) দক্ষিণ হস্ত মুমিনদের নেতার (আমিরুল মু’মেনিন) সাহায্যকারী ইসলাম ও মুসলমানদের সহায়তাকারী (আল্লাহ তার রাজত্ব) দীর্ঘ স্থায়ী করুন।’
আজম খাঁ বা কুতুবউদ্দিন আজম শাহ সোনারগাঁও হতে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে যান সেই স্থানটির নাম হয় খলিফাতাবাদ। তিনি সঙ্গে নিয়ে যান আযম শাহের পরিবার পরিজনকে। তার এক শিশু পুত্র সুলতান নাসিরউদ্দিন পরে গণেশের বংশধরদের পতনের পরে গৌড় পান্ডুয়ার সিংহাসনে আসীন হন। আজম খাঁ তার পালিত সুলতানের দেওয়ান বা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে খলিফাতাবাদ বা বাগেরহাটে ফিরে আসেন। ‘সুলতান কুতুবউদ্দিন আজম শাহ’ বা আজম খাঁ তার প্রাপ্ত রাজকীয় উপাধি ও পির পরিচয়ে বেঁচে আছেন, পির খান জাহান আলি নামে। খান জাহান দীর্ঘদিন খলিফাতাবাদ সরকারের শাসক ছিলেন। তার এক সহোদর ছিলেন জাহানদার খাঁ বা জামদার খাঁ বা জানদার খাঁ। এই জাহানদার খাঁ বর্তমান গোপালগঞ্জ, নড়াইল, মাগুরা ও খুলনা জেলার কিছু এলাকার সরকার-ই-লস্কর ছিলেন। তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। কিংবদন্তি আছে, খান জাহান অপুত্রক থাকায় জাহান্দারকে আশির্বাদ করেছিলেন, তার যেন বংশবৃদ্ধি ঘটে এবং তার বংশধরেরা যে-যে স্থানে থাকবে সামাজিক ও রাষ্টিয় প্রতিপত্তি লাভ করবে। জাহান্দারের ৫ পুত্রের নাম জানা যায়, এরা হলেন, ১. সিপাতুল্লাহ মিয়া ২. জিয়াউল্লাহ মিয়া ৩. ওয়ালি মাহমুদ শাহ প্রমুখ। আবদুল্লাহ মিয়াও জিয়াউল্লাহর বংশধরেরা গোপালগঞ্জ জেলার বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। জাহান্দারের কবর এখন গোপালগঞ্জ জেলার গোপীনাথপুরের পশ্চিমপাড়ার মিয়া বাড়িতে অবস্থিত। নানা পথ পরিক্রমার পরে জাহান্দার পুত্র ওয়ালি মাহমুদ শাহ বা ওয়ালি মাহমুদ খাঁ ফরিদপুরের বিভিন্ন এলাকায় পিতা জাহান্দারের সঙ্গে সামরিক অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। কারণ তখনো বহু প্রত্যন্ত এলাকায় মুসলিম শাসন ও প্রতিপত্তি লাভ হয়নি। তাই প্রশাসক হিসেবে সেখানে সুলতানি শাসন কায়েম ও খাজানা আদায় করা ছিলো তাদের রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব। লোহাগড়া উপজেলার মহিশাপাড়া হয়ে তিনি গিয়েছিলেন বর্তমান মাগুরা জেলার মুহম্মদপুর উপজেলায়। এখানেই তার নামীয় স্থান হলো মামুদপুর। স্থানীয় লোক মুখ থেকে জানা যায়, এই স্থানে ওয়ালি মাহমুদ শাহ রহমাতুল্লাহ অলাইহে ধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন। প্রকৃত পক্ষে ওয়ালি মাহমুদ শাহ একাধারে সাধক ও সেনাধ্যক্ষ ছিলেন। অঞ্চল বিজেতা ও ধর্ম প্রচারক হিসেবেই তার পরিচিতি রয়েছে। তার সঙ্গে ছিলো সামরিক শক্তি। এখানের কাজ শেষে ওয়ালি মাহমুদ গিয়েছিলেন বর্তমান নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলার শিবপুর এলাকায়, পরবর্তীকালে এই শিবপুর বিরান এলাকায় পরিণত হয় এর নাম হয় বারোকুড়ো। শিবপুর গ্রামটি ছিলো সেকালের প্রাচীন কালিগঙ্গা নদীর পূর্বতীর এলাকায়। সেকালে কালীগঙ্গা নদীর একটি শাখা বয়ে যেতো কালিয়া হয়ে আরো পূর্ব দিকে কালীনগর লক্ষাপাশা ও বর্তমান কলাবাড়িয়ার উত্তর পাশ্ব দিয়ে। আরেকটি শাখা লক্ষ্মীপাশার চাঁদেরদহ বা চান্দের দোয়া থেকে দক্ষিণ দিকে বর্তমান বড়নালের মধ্য দিয়ে বয়ে যেতো আজো তা বড়ো নালের খাল হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষা করছে। ওয়ালি মাহমুদ শাহ শেষোক্ত কালীগঙ্গা বা কালীগাঙ্গ নদীর দক্ষিণ শাখার পূর্ব দিকে কেলাবাড়ি স্থাপন করেন। কেলা-ই-বাড়ি শব্দ থেকে কেলাবাড়ি শব্দটি এসেছে। কেলাবাড়ি স্থাপন করা হয়েছিলো ২৭ বিঘা জমির উপর। স্থানটি নলিয়া নদীর পশ্চিম তীর সংলগ্ন। কেলাবাড়িকে লোকে বলতো ‘ঠাকুরভিটে’। ঠাকুর তুর্কি শব্দ। অর্থ হলো, প্রভু, রাজা কিংবা সম্মানিত ব্যক্তি। এই প্রভু হলেন, ওয়ালি মাহমুদ। ওয়ালি মাহমুদ শাহ প্রথম বিয়ে করেছিলেন ফরিদপুরের বোয়ালমারি উপজেলার শিরগ্রামে। পরবর্তী বিয়ে করেন কেলাবাড়ি সংলগ্ন জনৈক বাগোলের কন্যাকে। ওয়ালি মাহমুদের প্রথম পক্ষের একমাত্র সন্তান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বা নাসির মাহমুদ। বাগোল কন্যার গর্বে ওয়ালি মাহমুদের আরো দুই পুত্রের জন্মগ্রহণের কথা জানা যায়। তারা হলেন যথাক্রমে ১. কাদের মাহমুদ ও ২. রওশন মাহমুদ।
প্রচীন দলিল দস্তাবেজ ও জনশ্রুতি থেকে জানা যায় কেলাবাড়ি কেন্দ্রীক জোতদারি ইংরেজ আমলের শেষ দিকে ছিলো সাড়ে ৭শত টাকার মহাল। যেখানে নড়াইলের জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা রামরূপের প্রথম জমিদারির বিখ্যাতমহাল আলাদাপুর ছিলো মাত্র ১৩৫ টাকার মহাল।
ওয়ালি মাহমুদের প্রথম পুত্র নাসির মাহমুদ তার সৎ দুই ভাই কাদের মাহমুদ ও রওশন মাহমুদকে কেলাবাড়ির মূল ভিটি ছেড়ে দিয়ে ডিহি কেলাবাড়ির সর্ব উত্তরে ডাঙ্গার ভেতরে বসত বাড়ি নিমার্ণ করেন। নাসির মাহমুদের ৪ পুত্র সন্তান যেস্থানে বসতবাড়ি নিমার্ণ করেন সেস্থানটি পরবর্তীকালে ‘দশানি-মোল্যাপাড়া’ নামে পরিচিতি পায়।
জাহান্দার ও ওয়ালি মাহমুদ শাহের বংশধরেরা বিভিন্ন এলাকায় লস্কর, খাঁ, মিয়া, মুন্সি ও মোল্যা পদবিতে ভূষিত হয়ে আছেন। বৃহত্তর যশোর, খুলনা, ফরিদপুর ও বরিশাল জেলায় জাহান্দার খাঁ ও ওয়ালি মাহমুদের বংশধরেরা ছড়িয়ে আছে।
যেসব গ্রন্থের সহযোগিতা নেয়া হয়েছে: ১. নড়াইলের ইতিহাস- মমতাজুর রহমান ও শরিফ আঃ হাকিম সম্পাদিত ২. বাগেরহাটের পির খানজাহান ও তার উত্তরাধিকার -মোঃ রফিকুল হক আকন্দ ৩. নড়াইল জেলা সমীক্ষা ও স্থাননাম-মহসিন হোসাইন ৪. মোহম্মদপুর উপজেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য-সালাউদ্দিন আহমদ মিন্টন।
গ্রন্থনা: মহসিন হোসাইন