
Home ঝিনাইদহ জেলা / Jhenidah District > মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ঝিনাইদহ / Glorious Liberation of Jhenaidah
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99729 বার পড়া হয়েছে
মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ঝিনাইদহ / Glorious Liberation of Jhenaidah
মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ঝিনাইদহ
Glorious Liberation of Jhenaidah
১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর ঝিনাইদহে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি

ঝিনাইদহ
যুদ্ধ হলো শুরু: ২৬ মার্চ রাতে যশোর সেনানিবাস থেকে পাক বাহিনী ঝিনাইদহ অতিক্রম করে কুষ্টিয়াতে গিয়ে জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন ও মোহিনী মিলে অবস্থান নেয়। পাক সেনাদের আক্রমণের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। ওই রাতে ঝিনাইদহ ট্রেজারি লুট করে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় ছাত্র যুবকদের হাতে। নেতৃত্ব দেন সংসদ সদস্য জে কে এম আজিজ, আব্দুল মজিদ, ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম, নূরুন্নবী সিদ্দিকী, সিরাজুল ইসলাম, তত্কালীন এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন ও এসডিও নেফাউর রহমান। কুষ্টিয়া পাক সেনা ঘাঁটি আক্রমণের জন্য ঝিনাইদহ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের পাঠানো হয়। আর গাড়াগঞ্জে কুমার নদের ব্রিজের দু'পাশে গভীর খাদ কেটে তার উপর চাটাই বিছিয়ে আলকাতরার প্রলেপ দিয়ে নকল রাস্তা বানানো হয়। ৩০ মার্চ রাতে কুষ্টিয়া থেকে যশোর সেনা নিবাসে পালানো সময় এক কোম্পানী পাক সেনা ওই ফাঁদে পড়ে। চারিদিকে গগন বিদারি জয়বাংলা শ্লোগানে তারা দিশেহারা হয়ে বনে লুকিয়ে পড়ে। পরদিন সকালে জনতা দা-কুড়াল দিয়ে প্রায় ৫০ জন পাক সেনাকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে। বন্দি হয় পাক লেফটেন্যান্ট আতাউল্লা খান। এ যুদ্ধ জয়ের খবর বিদেশি মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচার পায়।
১ এপ্রিল যশোর থেকে পাক সেনারা ঝিনাইদহের দখল নিতে আসে। বিষয়খালীতে বেগবতী নদীর ব্রিজের উপর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রতিহত করে। পাক সেনারা যশোর সেনা নিবাসে ফিরে যায়। ১৫ এপ্রিল ফের যশোর থেকে পাক সেনাদের বিশাল বাহিনী ঝিনাইদহের দখল নিতে আসে। বিষয়খালীতে দু' পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। ১৬ এপ্রিল পাক সেনারা ঝিনাইদহ দখলে নিয়ে হত্যা জ্বালাও পোড়াও শুরু করে।
গণহত্যা: ঝিনাইদহ দখলের পর পাক সেনারা ক্যাডেট কলেজে ঘাঁটি গেড়ে বসে। কৌশলগত দিক থেকে তাদের কাছে ঝিনাইদহের অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সহযোগিতায় দালাল জুটে যায়। পাক সেনাদের গণহত্যায় সহযোগী ছিল রাজাকার ও দালালরা। গ্রামে গ্রামে তারা চড়াও হয়ে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়, লুটপাট শেষে বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে শৈলকুপায় এসে বাড়ি-ঘরে লুটপাট চালানোর পর ৬ জনকে একসাথে গুলি করে হত্যা করে তারা।
১৯৭১-এর ১ জুলাই ভোরে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা শৈলকুপা থানার বসন্তপুর, জয়ন্তিনগর ও ছোট বোয়ালিয়া গ্রাম ঘিরে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধাদের খোঁজে বাড়ি বাড়ি তল্লাশী চালায়। কাউকে না পেয়ে নারী ধর্ষণ শুরু করে। পরে তারা লোকজন ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ১৯ জন শহীদ হন। আহত হন আরো ২০-২৫ জন। ২৬ নভেম্বর রাতে শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামেও গণহত্যা চালায় তারা। এদিন পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা হত্যা করে ২৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ ২৯ জনকে। ২৬ অক্টোবর হরিণাকণ্ডু উপজেলার বাগআঁচড়া ঘাট দেখিয়ে দেওয়ার কথা বলে পাবনার একদল মুক্তিযোদ্ধাকে কুষ্টিয়ার বিত্তিপাড়ায় পাক সেনাদের হাতে তুলে দেয় দালালরা। নির্মমভাবে হত্যা করা হয় তাদের। এ রকম আরো অনেক গণহত্যার ঘটনা ঘটে গোটা জেলা জুড়ে। সব তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি আজও।
পাল্টা আক্রমণ: ঝিনাইদহ পাক সেনাদের দখলে চলে যাওয়ার পর দলে দলে ছাত্র যুবকরা ভারতে গেরিলা ট্রেনিং নিতে যেতে শুরু করেন। জুলাই মাসে তারা দেশে ফিরতে থাকেন। পাল্টা আঘাত হানতে শুরু করেন পাক সেনাদের অবস্থানের উপর। আগস্ট মাসের প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা শৈলকুপা থানা দখল করেন। এ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন পাক দালাল নিহত হয়। আবাইপুরে মুক্তিযোদ্ধারা স্থায়ী ক্যাম্প গড়ে তোলেন। ৩০ আগস্ট পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আবইপুর আক্রমণের জন্য এগুতে থাকে। এ খবর পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা নদী পার হয়ে আলফাপুর খালের পাড়ে অবস্থান নেন। পাকসেনারা নদী পার হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অ্যাম্বুশে পড়ে। সকাল ১০ টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে প্রায় ৫০ জন পাক সেনা ও রাজাকার নিহত হয়। এদিকে ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে মহেশপুর উপজেলার হুসোরখালীতে ক্যাম্প স্থাপন করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ খবর চলে যায় দত্তনগন কৃষি খামারে অবস্থিত পাক সেনা ক্যাম্পে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে দত্তনগন থেকে পাকসেনারা হুসোরখালী আক্রমণ করে। যুদ্ধে ২৫-৩০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয়। ১৪ অক্টোবর শৈলকুপার আবাইপুরে পাকসেনাদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৪১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাক সেনাদেরও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়।
চূড়ান্ত জয়: ডিসেম্বর মাসে পুরাপুরি যুদ্ধ শুরু হলে পাকসেনারা আতংকিত হয়ে পড়ে। ৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ঝিনাইদহ শহরের উপকণ্ঠে পৌঁছে যায়। মুক্তি বাহিনীও পাশাপাশি অবস্থান নিয়ে শহর ঘেরাও করে ফেলে। ৬ ডিসেম্বর সকালে পাক বাহিনীর অবস্থানগুলোতে মিত্র বাহিনী গোলা বর্ষণ শুরু করে। দুপুর হতেই পাক বাহিনী ঝিনাইদহ ছেড়ে মাগুরার দিকে পালিয়ে যায়। হানাদারমুক্ত হয় ঝিনাইদহ। মুক্তির আনন্দে মানুষ ঘর থেকে বেরিয়ে বিজয় উল্লাস করতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধারা কেমন আছেন: স্বাধীনতার ৪২ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই আজ বেঁচে নেই। যারা আছেন, বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় তেমন কোন কাজ করতে পারেন না তারা। চরম আর্থিক সংকটে হিমসিম খাচ্ছেন অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা। ঝিনাইদহে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম প্রধান সংগঠক ও দু'বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য জে কে এম আজিজও আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। কেউ তার খোঁজ রাখে না। তাতে তার দুঃখ নেই। তার আনন্দ-দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং গণতন্ত্রের পথে এগুচ্ছে। তিনি রাষ্ট্রের কাছ থেকে কোন সুযোগ সুবিধা প্রত্যাশা করেন না। তার একটাই দুঃখ, বর্তমানে সমাজে অমুক্তিযোদ্ধারা মুক্তিযোদ্ধা সেজে সুযোগ সুবিধা নিচ্ছে।
শৈলকুপা উপজেলার বাগুটিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জাহান আলি এতদিন ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন বৃদ্ধ হয়ে পড়ায় ভ্যান চালানোর শক্তি তার নেই। অতি কষ্টে বর্তমানে তার দিন চলছে বলে জানালেন শৈলকুপা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট কমান্ডার রহমত আলি মন্টু। মালিথিয়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা অজিত কুমার কামলার কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। ঝিনাইদহে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাও আছে অনেক। জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার গোলাম মোস্তফা লোটন জানান, সরকারি গেজেটে নাম আছে এমন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১৮শ ৩৩ জন। মুক্তিবার্তায় নাম আছে দু'শতাধিক। এর মধ্যে প্রায় ৭শ' জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে তারা প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নন। তিনি জানান, যাচাই বাছাইয়ের পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের নাম জানা যাবে।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা: ঝিনাইদহ মুক্তিযোদ্ধা পার্কে নির্মিত স্মৃতি সৌধের ফলকে লেখা রয়েছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের নাম। এরা হচ্ছেন- বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান, বীর প্রতীক সিরাজুল ইসলাম, ফুল মিয়া, তাইজ উদ্দিন আহমেদ, খলিলুর রহমান, কওসার আলি জোয়ার্দ্দার, আব্দুর রশিদ, কামাল উদ্দিন, মোহাম্মদ আলি, আবুল হাশেম, সদর উদ্দিন, আকবর মোল্লা, দুলাল চন্দ্র সূত্রধর, খায়রুল হোসেন জোয়ার্দ্দার, আব্দুল বারিক শেখ, সোবহান শেখ, সৈয়দ আলি শেখ, হামেদ আলি শেখ, বাবর আলি মালিতা, মাহতাব মল্লিক, হারেজ উদ্দিন, নজির উদ্দিন বিশ্বাস, লতাফত হোসেন জোয়ার্দ্দার, সরাফত হোসেন, বশির উদ্দিন, আবুল কাশেম, মীর রজব আলি, আমজাদ আলি, আব্দুল গফুর, আব্দুল করিম, তাইজ উদ্দিন, বাবর আলি শেখ, আনসার উদ্দিন বিশ্বাস, গোলাম মোস্তফা, আব্দুল জলিল, মোহন কুমার দাস, আব্দুল কুদ্দুস, আব্দুল মালেক, শরিফুল ইসলাম, দাউদ আলি জোয়ার্দ্দার, গোলাম হায়দার, জাহাঙ্গীর আলম, আতর আলি মীর, আজিজ উল্লা, আব্দুল মালেক, জাকির হোসেন, আফসার উদ্দিন বিশ্বাস, ওসমান আলি লস্কর, আবুল কাশেম, মহসিন আলি, মহর আলি মিয়া, সিপাহি বশির উদ্দিন, সিপাহি সোহরাব হোসেন, সিপাহি আফসার উদ্দিন, খোন্দকার আমির হোসেন, শেখ আবুল ফজল, তমিজ উদ্দিন, আবুল হোসেন, আলি আহম্মদ, তবদিল হোসেন মোল্লা, সানাউর রহমান, আইয়ুব হোসেন শেখ, রওশান আলি বিশ্বাস, সেকান্দর আলি, শামসুল হক, মফিজুর রহমান, বাচ্চু মিয়া শাহাজাহান, তোফাজ্জল হোসেন, ময়ন উদ্দিন, আব্দুল হাই, ইসরাইল হোসেন, শহিদুল ইসলাম, আব্দুল বকুল বিশ্বাস, মকসেদ আলি, নুরুদ্দিন বিশ্বাস, আদিল উদ্দিন, লুত্ফর রহমান, আবু তালেব, গোলাম কুদ্দুস, আলিম উদ্দিন মিয়া, আবুল হোসেন মন্ডল, শরিফ মোঃ আব্দুল আলিম, ইউসুফ আলি মিয়া, দিদার আলি, সৈয়দ আলি, মহব্বত হোসেন, শামসুল আলম খান, শমসের আলি, আব্দুল খালেক, মাছিম বিশ্বাস, দুধ মল্লিক, নিরঞ্জন কুমার সাহা, তফেল জোয়ার্দ্দার, রওশন আলি মিয়া, কুবাদ আলি, চেতন আলি মন্ডল, শাহাজাহান মন্ডল, ইকবাল হাসান খান, আবু জাফর, আলিম উদ্দিন খান, রফিকুল ইসলাম, কুতুব উদ্দিন, শাহ আহমেদ, মোঃ আলি, মোছাক মন্ডল, আলিম উদ্দিন, লাল চাঁদ খান, আবুল কাশেম, খোন্দকার নুরুল ইসলাম, আবুল কালাম আজাদ, জামাত আলি, আবুল হোসেন, গোলাম মুহম্মদ ও কামরুল হক। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এ তালিকার বাইরেও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আছেন।