
Home মাগুরা জেলা / Magura District > মহম্মদপুর / Mohammadpur
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100072 বার পড়া হয়েছে
মহম্মদপুর / Mohammadpur
মহম্মদপুর
Mohammadpur
সতেরো শতাব্দীতে যখন ঢাকার নবাব ইব্রাহীম খাঁ দুর্বল হস্তে রাজদণ্ড ধারণ করেন, তখন যশোরের এক কায়স্থ ঘরের সন্তান ভূষণায় এক স্বাধীন রাজ্যের স্বপ্ন দেখছিলেন। এর রাম রাজা সীতারাম রায়। সীতারাম সম্বন্ধে অনেক অদ্ভূত অদ্ভূত কাহিনী ছড়ানো আছে ভূষণা অঞ্চলে। তা’ জনশ্রুতি মাত্র। ওয়েস্টল্যাণ্ড সাহেব অনেক পরিশ্রম করে তার সম্বন্ধে প্রকৃত তথ্য কিছু কিছু উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সীতারামের আদি নিবাস ছিল বীরভূম জেলায়। তিনি জাতিতে উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ ছিলেন। তার পিতা উদয় নারায়ণ প্রথমে রাজমহলে নবাব সরকারের অধীনে কাজ করতেন। পরে তিনি ভূষণায় সাজোয়াল পদ প্রাপ্ত হন। তার স্ত্রীর নাম দয়াময়ী। কাটোয়ার অন্তর্গত মহীপতি গ্রামে পিত্রালয় ছিল। সম্ভবতঃ ১৬৫৮ খৃষ্টাব্দে সীতারাম সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। উদয় নারায়ণ পরবর্তীকালে একটি তালুকের মালিক হন। মধুমতি নদীর অপর পারে হরিহর নগর গ্রামে সীতারামের ভ্রাতা লক্ষ্মীনারায়ণের বংশধরেরা আজও বাস করছেন। সীতারামের মাতা দয়াময়ী তেজস্বিনী মহিলা ছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, তিনি অল্প বয়সে একটি খড়ের সাহায্যে একদল ডাকাতকে পরাভূত করেছিলেণ। মহম্মদপুরে তার নামানুসারে “দয়াময়ী” নামে আজও একটি স্থান পরিদৃষ্ট হয়। সীতারামের রাজত্বকালে এখানে বারোয়ারী উৎসব অনুষ্ঠিত হত।
সীতারাম প্রথম জীবনে ঢাকায় বিদ্যা-শিক্ষা অর্জন করেন। তিনি বিদ্যা-শিক্ষার সংগে সংগেও অস্ত্র বিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। শিক্ষা সমাপন্তে ভূষণায় এসে তিনি প্রথম জলদস্যুদের দমন করতে মনোনিবেশ করেন। তার উপযুক্ত সংগী ছিল মেনাহাতী। তার প্রকৃত নাম রামরূপ ঘোষ। কেহ কেহ বলেন মৃন্ময় ঘোষ। ইনি ছিলেন দক্ষিণ রাঢ়ীর কায়স্থ সন্তান। মেনাহাতীর অর্থ হলো ছোটখাটো হস্তী। তার বিশাল বপুর জন্যেই এই নামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন। কথিত আছে যে, মেনাহাতী অক্ষয় কবচের অধিকারী ছিলেন। কোনরূপ অস্ত্র দ্বারা তাকে পরাভূত করা যেত না।
সীতারাম যখন ভূষণায় ছিলেন, তখন ভূষণা ও দক্ষিণ অঞ্চলে অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। একদিকে জলদস্যুদের অত্যাচার, অন্যদিকে রাজ্যমধ্যে অরাজকতা। তিনি দিল্লীর বাদশাহের কাছ থেকে দক্ষিণ বঙ্গ আবাদের জন্যে জায়গীর প্রাপ্ত হন। এই সময় বাংলাদেশের কিছু কিছু ভূস্বামী বাদশাহের দরবারে রাজকর দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সীতারাম তাদেরকে যুদ্ধে পরাস্ত করে বাদশাহের প্রিয়পাত্র হন। ক্রমান্বয়ে নিজের বুদ্ধি ও শক্তির বলে নিজের জমিদারীর সীমানা বৃদ্ধি করেন। বাংলার নবাব তার কার্য দক্ষতা দেখে “রাজা” উপাধি প্রদান করেন। ভূষণার রাজকার্যে বিঘ্ন ঘটায় তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেন মহম্মদপুরে। এই অঞ্চলটি তখন ছিল দুর্ভেদ্য অঞ্চল। দক্ষিণে আদিগন্ত প্রসারিত সুন্দরবন। চতুর্দিকে পরিবেষ্টিত পদ্মর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখা।
প্রবাদ আছে যে, একদিন সীতারাম ঘোড়ায় চড়ে এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তার ঘোড়ার পা মৃত্তিকা গর্ভে আটকা পড়ে। বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও ঘোড়ার পা মৃত্তিকা গর্ভ থেকে উঠাতে পারলেন না। তখন তিনি উপায়ান্তর না দেখে লোকজন ডেকে এনে স্থানটি খনন করতে গিয়ে দেখতে পান যে, মৃত্তিকার নিম্নে একটি মন্দির চূড়াচক্রে তার ঘোড়ার পা আটকে গিয়েছে। এই স্থানটি খনন করে তিনি আবিষ্কার করে ছিলেন একটি দেব মন্দির। এই দেব মন্দিরে তিনি পেয়েছিলেন একটি লক্ষ্মী নারায়ণের বিগ্রহ। এই স্থানটিকে শুভলক্ষণ মনে করে সীতারাম এখানে নিজের বাস-ভবন নির্মাণ করেন। পরবর্তীকালে এখানে রাজধানী স্থাপন করেন।
কোন কোন ঐতিহাসিকেরা মতপ্রকাশ করেছেন, রাজা সীতারাম স্বাধীন চেতা রাজন হয়েও মুসলিম শাসক গোষ্ঠীর সন্তুষ্টি বিধানের জন্যে স্বীয় কাজে যাতে বাধা সৃষ্টি না হয় তার জন্যে রাজধানীর নাম মহম্মদপুর রাখেন। মহম্মদপুরের প্রকৃত নাম মাহমুদপুর। স্থানীয় লোকেরা এখনো মহম্মদপুরকে মাহমুদপুর বলে অভিহিত করে থাকে। স্থানীয় প্রবাদ, মহম্মদ শাহ নামক এক ফকিরের নামানুসারে এর নাম মহম্মদপুর। সীতারাম নিজের জমিদারী রক্ষার্থে সৈন্যবাহিনী গঠন করেছিলেন। তখনকার দিনে বাংলার অধিবাসীরা লাঠি ও তলোয়ারের ব্যবহার জানতো। কতকগুলো উপযুক্ত যুদ্ধ ব্যবসায়ী লোক সংগ্রহ করে বিরাট এক সৈন্যবাহিনী গঠন করেন। তারপর মহম্মদপুরে দুর্গ নির্মাণ করেন। এই দুর্গ ছিল চতুষ্কোণ। বাইরে ক্রোশাধিক পরিমাণে এর বিস্তৃতি ছিল। ভিতরে নগর প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্গ প্রাচীরের বাইরে ছিল গড়খাই।
অল্পদিনের মধ্যেই মহম্মদপুরের বেশ শ্রীবৃদ্ধি সাধন হয়। বিভিন্ন স্থান হতে রাজকর্মচারীরা এসে বসতি স্থাপন করে এখানে। সীতারাম পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা দেখে রাজ্য শাসনের নামে রাজ্য বিস্তার করতে লাগলেন। রাজায় প্রজায় যদি অসদ্ভাব হয়, সীতারাম অমনি অপরের জমিদারী দখলে শক্তি প্রয়োগ করেন। একে একে পার্শ্ববর্তী সকল জমিদারদের উপর হামলা করে তাদের জমিদারী নিজের এলাকাভুক্ত করেন। উত্তরে পদ্মা পর্যন্ত অনেক পরগনা-নসিরশাহী, নসরতশাহী, মহিমশাহী, বেলগাছী প্রভৃতি এবং পদ্মনদীর উত্তর পার্শ্বস্থ কিছু কিছু এলাকা হস্তগত করেন। দক্ষিণেও তার রাজ্যসীমা বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। উজানীর রাজাদের জমিদারীও তার দখলে আসে। মোগল দরবারে রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করে দিয়ে তিনি নিজেকে স্বাধীন নরপতি বলে ঘোষণা করেন। ক্রমে ভূষণার ফৌজদারের সহিত তার বিবাদ বেধে উঠলো। নবাব মুর্শীদ কুলি খাঁ ফৌজদারকে আদেশ দিলেন সীতারামের বিদ্রোহ দমন করবার জন্যে। বারাসীয়া নদীর তীরে ক্ষুদ্র এক যুদ্ধে ভূষণার ফৌজদার আবু তোরাপ নিহত হলেন। সীতারাম ভূষণা অধিকার করলেন। আবু তোরাপ নিহত হলে নবাব মুর্শীদ কুলি খাঁ এর চরম প্রতিশোধ নেবার জন্যে বক্স আলী খাঁ নামক জনৈক ব্যক্তিকে ভূষণার ফৌজদার করে পাঠালেন। নিকটবর্তী জমিদার ও দিঘাপাতিয়ার জমিদার দয়ারামকে সীতারামের দমনের জন্যে আদেশ প্রেরিত হলো। জমিদারেরা তার প্রতি পূর্ব থেকেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদেরও জমিদারীর কিছু কিছু অংশ সীতারাম জোরপূর্বক দখল করে নিয়েছিলেন। সংগ্রাম সিংহ, দয়ারাম প্রভৃতি মোগল সৈন্যাধ্যক্ষেরা বক্স আলীর সংগে যোগ দিলেন। মধুমতী তীরে জোর লড়াই শুরু হলো। সীতারাম তার সুদক্ষ সৈন্যবাহিনী নিয়ে ভূষণা প্রতিরোধ করতে লাগলেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে সীতারামের জয় হলো। কিন্তু ভূষণা দুর্গ নবাব সৈন্য অবরোধ করে রাখলো। দুর্গ দ্বার রুদ্ধ করে সীতারাম দুর্গের অভ্যন্তর থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করতে লাগলেন। ফৌজদার ক্রমান্বয়ে আরো শক্তিশালী সৈন্যবাহিনী মোতায়েন করে সীতারামের অবস্থা সঙ্কটময় করে তুললেন। দুর্গের সবগুলি যোগাযোগ ব্যবস্থা নষ্ট করে দেওয়া হলো। বেশ কিছুকাল দুর্গের মধ্যে এইভাবে অবরোধে থেকে সীতারাম অতিষ্ঠ হয়ে উঠলেন। ক্রমান্বয়ে দুর্গের মধ্যে দেখা দিতে লাগলো বিশৃঙ্খলা। রসদও ফুরিয়ে যাবার মত হলো। দুর্গের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতার পরিচয়ও পাওয়া যেতে লাগলো। উপায়ান্তর না দেখে একদিন রাত্রে অন্ধকারে সীতারাম তার কিছু সংখ্যক সৈন্যসহ মহম্মদপুরের দিকে পলায়ন করলেন। নবাব সৈন্যরাও তার পিছু অনুসরণ করলো।
ভূষণায় যখন সীতারামের সংগে নবাব সৈন্যদের তুমুল সংঘর্ষ চলছিল, তখন মহম্মদপুর দুর্গের রক্ষার ভার ছিল সেনাপতি মোনাহাতীর উপর। সীতারাম প্রকল্প করেছিলেন যে, মহম্মদপুরে গিয়ে মেনাহাতীর সংগে মিলিত হয়ে নতুন উদ্যমে যুদ্ধকার্য চালিয়ে যাবেন। ভূষণা দুর্গ নিরাপদ ছিল না। যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে ঘোরালো হয়ে উঠছিল।
সীতারাম মহম্মদপুরে পলায়ন করে স্ত্রী-পরিজনদিগকে স্থানান্তরিত করতে লাগলেন। এই সময় জনৈক বিশ্বাঘাতক কর্মচারী মুনীরামের গুপ্ত পরামর্শানুযায়ী সেনাপতি মেনাহাতী অতর্কিতভাবে দোল মঞ্চের নিকট দিয়ে যাবার সময় শত্রু সৈন্য কর্তৃক আহত হয়ে বন্দী হলেন। সাতদিন পর্যন্ত তাদের হস্তে নিদারুণ নির্যাতনের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১৭১৪ খৃষ্টাব্দে তার মৃত্যু হয়। শত্রু সৈন্যরা তার মৃতদেহ হতে মস্তক কেটে নিয়ে মুর্শীদাবাদে নবাব দরবারে পাঠিয়ে দেয়। মানুষের মাথা যে এত বড় হতে পারে, তা' দেখে নবাব মুর্শীদ কুলি খাঁ বিষ্ময় প্রকাশ করেন এবং বলেন যে, এইরূপ মহাবীরকে হত্যা না করে জীবন্ত ধরে আনা উচিৎ ছিল। নবাব মেনাহাতীর মাথাটি সসম্ভ্রমে মহম্মদপুরে ফিরিয়ে দেন। ইতিমধ্যে সেনাপতির মস্তকহীন দেহ যথারীতি সৎকার করে অস্থি সমাহিত করা হয়। মস্তকটি মুর্শীদাবাদ থেকে ফেরত এলে তথায় সমাহিত করে সীতারাম একটি উচ্চ সমাধিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়ে দেন। মহম্মদপুরের কাষ্ঠঘর পাড়া থেকে ভূষণার দিকে যে রাস্তাটি গেছে, তারই উপর মেনাহাতীর সমাধিস্তম্ভ ছিল। বর্তমানে তার কোন চিহ্ন নেই।
মেনাহাতীর মৃত্যুর পর সীতারাম প্রাণপণে নবাব সৈন্যদের বাধা দিতে লাগলেন। দীর্ঘক্ষণ লড়াইয়ের পর তিনি আর নবাব বাহিনীর গতিরোধ করতে পারলেন না। বন্যার স্রোতের ন্যায় তারা দুর্গের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে লাগলো। শত চেষ্টা করেও সীতারাম ব্যর্থ হলেন। চারদিক শত্রুরা পরিবেষ্টন করে ফেললো। যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হয়ে তিনি মুর্শীদাবাদে প্রেরিত হলেন। তাকে মুর্শীদাবাদে সংগে করে নিয়ে গিয়েছিলেন দয়ারাম। পথিমধ্যে দিঘাপাতিয়ায় যাবার কালে তাকে নাটোর রাজবাঢ়ীর কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়। সীতারাম যে কক্ষে ছিলেন, আজও অবধি সে কক্ষ আছে।
মুর্শীদাবাদে কয়েক মাস বন্দী অবস্থায় থাকার পর তাকে নবাব মৃত্যুদন্ডে দণ্ডিত করেন। কেহ কেহ বলেন, তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। মুর্শীদাবাদে গঙ্গার তীরে তার শ্রাদ্ধ করা হয়েছিল।
কথিত আছে, দয়ারাম চিহ্ন হিসাবে সীতারামের সুন্দর বিগ্রহ দিঘাপাতিয়ায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তার পাদদেশে খোদিত আছে, “দয়ারাম বাহাদুর”। দিঘাপাতিয়ার রাজবাড়ীতে এই মূর্তি রক্ষিত ছিল।
মহম্মদপুরে সীতারামের বহু কীর্তিরাজি বিদ্যমান। এই সব কীর্তির মধ্যে প্রাচীন দুর্গের ধ্বংসাবশেষ, রামসাগর, সুখসাগর ও কৃষ্ণসাগর নামক দীঘি, দোল মঞ্চ ও রাজভবনের ধ্বংশাবশেস, সিংহ দরজা, মালখানা, দশভূজা মন্দির, লক্ষ্মী নারায়ণের অষ্টকোণ মন্দির ও কৃষ্ণজীর মন্দির উল্লেখ্যযোগ্য।
মহম্মদপুরের দুর্গটি প্রায় সমচতুষ্কোণ; এর প্রধান প্রবেশ দ্বার পূর্ব দিকে অবস্থিত। সুদূর অতীতে এই দুর্গের চারদিকের খাত দিয়ে মধূমতির স্রোত বয়ে যেত। সাগর দীঘিটি দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৫০০ ফুট ও প্রস্থে ৬০০ ফুট। এর জল এখনো বেশ নির্মল। সুখসাগরের মধ্যে একটি দ্বীপ আছে। কৃষ্ণসাগর দীঘিটি মহম্মদপুর দুর্গের দক্ষিণ-পূর্বদিকে কানাই নগর গ্রামে অবস্থিত। এই দীঘিটির দৈর্ঘ্য ১০০০ ফুট এবং প্রস্থ ৩০০ ফুট। এই গ্রামে সীতারামের প্রতিষ্ঠিত হরেকৃষ্ণ বিগ্রহের একটি পঞ্চ রত্ন মন্দির আছে। মন্দিরটি অতি সুন্দর কারুকার্যময়। এটিই হচ্ছে সীতারামের সর্বাপেক্ষা বৃহৎ ও উচ্চ মন্দির। মন্দির গাত্রে কৃষ্ণ বলরাম ও নানা দেব-দেবীর ছবি আছে। এগুলি সুন্দর ও নিখুঁতভাবে চিত্রিত। দশভূজা মন্দিরে লেখা আছে-মহীভূজ রস ক্ষেনী শকে দশভূজা লয়ং, অকারী শ্রী সীতারাম রায়েন**মন্দিরয়। এই চিহ্ন হতে বুঝা যায় ১৬২১ শক বা ১৬৯৯-১৭০০ খৃষ্টাব্দ।
পূর্বদিকে মন্দির গাত্রের কারুকার্য সর্বাপেক্ষা সুন্দর। গর্ভগৃহে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। এই জন্যে স্থানটির নাম হয়েছে কানাই নগর বা যদুপতি নগর। এখানে অষ্টপ্রহর হরিনাম কীর্তন হত। নবগঙ্গা নদীর তীরে রায় গ্রামে মেনাহাতীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামশঙ্কর নারায়ণ বিগ্রহের জন্যে একটি সুন্দর জোড়-বাংলা মন্দির ও একটি সুন্দর শিব মন্দির প্রতিষ্ঠিত করেন। শিব মন্দিরে যে শ্লোক উৎকীর্ণ আছে, তাতে জানা যায় যে, মেনাহাতীর মৃত্যুর ১০ বছর পরে এই মন্দিরটি নির্মিত হয়েছে। এই গ্রামে রামশঙ্করের বংশধরেরা বাস করতেন। সীতারামের দুটি বড় কামানের নাম ছিল কালে খাঁ ও ঝুমঝুম খাঁ। সীতারাম দুর্গ ও নগর পত্তনের পর কুশলী শিল্পী এনে প্রয়োজনীয় হাতিয়ার প্রস্তুত করেছিলেন।
সীতারামের অধীনে একদল বেলদার সৈন্য ছিল। তাদের সংখ্যা ছিল ২২০০ জন। এরা যুদ্ধের সময় ছাড়া অন্য সময়ে জলাশয় খনন করতো। কথিত আছে, এই সব খচিত জলাশয়ের জলে প্রতিদিন সীতারাম স্নান করতেন।
সীতারামের সৈন্যদলে অনেক মুসলমান ছিল। তিনি মুসলমান সেনাপতিদের “ভাই” বলে সম্বোধন করতেন। তার সৈন্যদলে হিন্দু-মুসলমানে কোন ভেদাভেদ ছিল না। তিনি সবাইকে প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করেছিলেন। এই অঞ্চলের গ্রাম্য গানে ও গাঁথায় তার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
যদুনাথ ভট্টাচার্য রচিত “সীতারাম রায়” নামক একটি গ্রন্থে লিখিত আছে:
“শুন সবে ভক্তি ভাবে করি নিবেদন।
দেশ গাঁয়েতে যা হইল শুন দিয়া মন॥
রাজাদেশে হিন্দু বলে মুসলমানে ভাই।
কাজে লড়াই কাটাকাটির নাহি বালাই॥
হিন্দু বাড়ীর পিছে কাশন মুসলমানে খায়।
মুসলমানের রস পাটালী হিন্দু বাড়ী যায়॥
রাজা বলে আল্লা হরি নহে দুই জন।
ভজন পূজন যেমন ইচ্ছা করুকগে তেমন॥
মিলে মিশে থাকা সুখ, তাতে বাড়ে বল।
ডরেতে পালায় মগ ফিরিঙ্গীরা খল॥
চুলে ধরে নারী লয়ে চড়তে নারে নায়য়।
সীতারামের নাম শুনিয়া পলাইয়া যায়॥
“শুন সবে ভক্তি ভাবে করি নিবেদন।
দেশ গাঁয়েতে যা হইল শুন দিয়া মন॥
রাজাদেশে হিন্দু বলে মুসলমানে ভাই।
কাজে লড়াই কাটাকাটির নাহি বালাই॥
হিন্দু বাড়ীর পিছে কাশন মুসলমানে খায়।
মুসলমানের রস পাটালী হিন্দু বাড়ী যায়॥
রাজা বলে আল্লা হরি নহে দুই জন।
ভজন পূজন যেমন ইচ্ছা করুকগে তেমন॥
মিলে মিশে থাকা সুখ, তাতে বাড়ে বল।
ডরেতে পালায় মগ ফিরিঙ্গীরা খল॥
চুলে ধরে নারী লয়ে চড়তে নারে নায়য়।
সীতারামের নাম শুনিয়া পলাইয়া যায়॥
সীতারামের পতনের পর নাটোরের রামজীবন ও রঘুনন্দন বিশেষভাবে পুরস্কৃত হন। এই উপলক্ষে দয়ারাম জমিদারীপ্রাপ্ত হন। রঘুনন্দন নবাব সরকারের অধীন একজন বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন। তার প্রতিপত্তি ছিল। তারই প্রচেষ্টায় ভূষণা-মহম্মদপুর তার ভাই রায় জীবনের নামে বন্দোবস্ত হয়েছিল। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ বাংলাদেশের বিদ্রোহ দৃঢ় হস্তে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭২২ খৃষ্টাব্দে নবাব সরকারকে তেরটি চাকলায় বিভক্ত করেছিলেন। প্রত্যেক চাকলার শাসনকার্য পরিচালনা করতেন একজন ফৌজদার। ফৌজদারের অধীনে নানা কর্মচারী থাকত। নবাবের এই নতুন সংস্করণের পর একটা চাকলা হয়েছিল ভূষণা। কিন্তু এর অধীনস্থ অনেক স্থান নাটোরের জমিদারের অন্তর্ভূক্ত হয়। এই সময় দিল্লীর সম্রাট ছিলেন ফররুক শিয়র। জমিদারদের সনদে তারই মোহরাঙ্কিত ছিল। রঘুনন্দন অতি সামান্য অবস্থা থেকে নিজের প্রতিভাবলে বড় হয়েছিলেন। দয়ারাম ছিলের রঘুনন্দনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দীঘাপাতিয়া রাজবংশের তিনিই পুর্বপুরুষ। রামজীবনের মৃত্যুর পর দয়ারাম জমিদারীর কার্যভার গ্রহণ করেন। তৎকালে জমিদারদের উপর অনেক কিছুই দায়িত্ব থাকতো। পুলিশের তত্ত্বাবধায়ক, ফৌজদারী ও দেওয়ানী সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমায় বিচারের ভার তাদের উপর ন্যস্ত ছিল। রামজীবনের পৌত্র রামকান্ত বড় হয়ে বিষয় কার্য পরিচালনায় হাত দেন। কিন্তু তিনি ছিলেন অতিশয় ধর্মানুরাগী। অল্প বয়সে তার মৃত্যু হলে তার পত্নী রাণীভবানী জমিদারীর দায়িত্বভার নিজের হাতে নেন। ভূষণার জমিদারীতে যে রাজস্ব আদায় হতো, তা’ ঠিক মতো আদায় না হবার দরুন নবাব সরকারের রাজস্ব যোগানো ছিল কঠিন ব্যাপার। পরবর্তীকালে অসুবিধা বিধায় রাণীভবানী ইজারা দেওয়া শুরু করেছিলেন। রাণীভবানীর নিকট হতে যে সব ব্যক্তিরা ইজারা নিয়েছিলেন, নড়াইলের জমিদার বংশের প্রতিষ্ঠাতা কালিশ ঙ্কর রায়ের নাম তাদের মধ্যে অন্যতম। ভূষণায় ইংরেজ সরকারের প্রথম আমলে আদালত ছিল। রাজশাহীর সুপারভাইসরের তত্ত্বাবধানে এই আদালত উঠে যায়। কিন্তু তখনো এখানে রাজশাহীর সুপারভাইসরের এক সহকারী থাকতেন। সুপারভাইসর থাকতেন নাটোরে। সরকারী কাগজপত্র থেকে দেখা যায়, ভূষণায় অধিক পরিমাণে কর ধার্য হয়েছিল, যার ফলে এখানে একজন কালেক্টর নিয়োগ করতে হয়। ১৭৯৩ খৃষ্টাব্দে ভূষণা যশোর জেলাভূক্ত হয়েছিল।
তথ্যসূত্র: যশোরাদ্য দেশ
লেখক: হোসেন উদ্দিন হোসেন