
Home মাগুরা জেলা / Magura District > শ্রীপুরের বিরাট রাজা / Birat King of Sreepur (Hossain Uddin Hossain)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100011 বার পড়া হয়েছে
শ্রীপুরের বিরাট রাজা / Birat King of Sreepur (Hossain Uddin Hossain)
শ্রীপুরের বিরাট রাজা
Birat King of Sreepur
শ্রীপুর যশোর জেলার মহকুমার একটি প্রাচীন স্থান। এই গ্রামটি এক সময় বিরাট রাজার রাজধানী হিসাবে পরিচিত লাভ করেছিল। বিরাট রাজার রাজ্যসীমা কোন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তা’ জানা যায় না। উত্তর বঙ্গের পার্বতীপুরের অনতিদূরে প্রাচীন বাংলার একটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। কথিত আছে, এখানে নাকি বিরাট রাজার সীমান্তরক্ষী দুর্গ ছিল। এই দুর্গে বিরাট রাজার সেনাপতি ও শ্যালক কীচক বাস করতেন। দুর্গটির আকৃতি সমচতুষ্কোণ ও পরিমাণ ফল প্রায় অর্ধমাইল। দুর্গের পরিখা ও প্রাকার জঙ্গলে সমাচ্ছন্ন ছিল। পার্বতীপুর থানার সন্নিকটে একটি প্রাচীন বৃক্ষের তলদেশে একটি প্রস্তর নির্মিত লাঙ্গল ও কৃষিকার্যের উপযোগী প্রস্তর নির্মিত আরও কয়েকটি দ্রব্য দেখতে পাওয়া যায়। প্রচলিত আছে যে এগুলি কীচকের নিধনকর্তা ভীমের পরিত্যক্ত বস্তু। অনুমান করা যায়, শ্র্রীপুরের বিরাট রাজা পাল রাজবংশের কোন অধঃস্তন পুরুষ। শ্র্রীপুর যে এক সময় পাল রাজবংশের প্রতিষ্ঠিত অন্যতম নগর ছিল, তার কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া গেছে।
মহাভারতে এক বিরাট রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। মহাভারতোক্ত বিরাট রাজা ও শ্রীপুরের বিরাট রাজা পৃথক ব্যক্তি। তুর্ক-আফগান আমলে শ্রীপুরে বিরাট রাজা রাজত্ব করতেন।
গুরব মিশ্রের স্তম্ভলিপিতে জানা যায়, মহারাজ ধর্মপালের পুত্র মহারাজ দেবপাল বিন্ধ্যা পর্বত থেকে হিমালয় পর্যন্ত এবং পূর্ব সমুদ্র থেকে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত— সমস্ত ভূ-ভাগ অধিকার করেছিলেন। দক্ষিণ বাংলা তার রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। এই সময় শ্রীপুর অঞ্চল পাল রাজবংশের অন্যতম নগর হিসাবে গড়ে উঠে। পাল বংশীয় রাজারা ছিলেন প্রধানত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা বাংলার এমন কোন স্থান নাই যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রেরণ করেননি। শ্রীপুরে সেই সময় গড়ে উঠেছিল বৌদ্ধ সংঘারাম।
পাল রাজবংশের অন্যতম রাজা মহীপালের পরে এদেশে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার ও প্রতিপত্তি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেন রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হবার সংগে সংগে ব্রাক্ষণ্য ধর্মের সহিত বৌদ্ধ ধর্মের সংঘর্ষ শুরু হয়। পাল রাজত্বের পতনের শেষ দিকে রাজ্যের চতুর্দিকে অরাজকতা দেখা দেয়। বিরাট রাজা সেই সময় শ্রীপুরে এসে বসতি স্থাপন করেন। এই পাল বংশের রাজত্বকাল ৪০০ বছরের অধিক ছিল। মদনপালের পতনের পর বিজয় সেনের আমলে যশোর-খুলনা অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত রাজ্য ছিল। বিজয় সেন ছিলেন গোঁড়া হিন্দু। তিনি পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন না। তাই যেখানে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার ও প্রতিপত্তি দেখেছিলেন, সেখানেই হেনেছিলেন মারণাস্ত্র। শশাঙ্কের পর সেন রাজবংশীয়রা যেভাবে বৌদ্ধ ধর্মকে নিশ্চিহ্ন করতে তৎপর হয়েছিলেন, অন্য কোন বংশীয় রাজনরা তা করেন নাই।
যশোর জেলার উত্তরাংশে সেন রাজত্বে বৌদ্ধদের প্রতিপত্তি একই ধারায় ছিল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উভয় ধর্মের সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টাও কম হয়নি। কিন্তু তা অধিককাল স্থায়িত্ব লাভ করেনি। পরবর্তীকালে মুসলিম বিজেতারা এই ধর্ম বিরোধ ও সংঘর্ষের সুযোগে বাংলাদেশ আক্রমণ করে। বাংলার ভূ-খণ্ডে যখন মুসলিম বিজেতাদের রণদামামা বেজে উঠেছিল, তখন শ্রীপুরে বৌদ্ধ এই রাজা জীবিত ছিলেন, তা’ এখানকার জনশ্রুতিতে পাওয়া যায়।
বিরাট রাজার রাজপ্রাসাদ ছিল রাজাপুর গ্রামে। এই গ্রাম আজ অবধি আছে। রাজপুরীর বিরাট ধ্বংসস্তুপ ধুলোয় বিলীয়মান হয়ে গেছে। রাজার ধনাগার, নাট্যশালা, কয়েদখানার ধ্বংসাবশেষের চিহ্ন আজ অবধি বিদ্যমান। চাবি নগরে ছিল বিরাট রাজার ধনাগার।
রাজার অনেক হস্তী সৈন্য ছিল। যেখানে হস্তির আস্তানা ছিল, সে গ্রামের নাম পিলখানা। কথিত আছে, বিরাট রাজার অসংখ্য গাভী ছিল। তিনি দুধ ভক্তি করতেন। রানী ছিলেন তাম্বুল ভক্ত। গোয়াল পাড়া গ্রামে থাকতো রাজার অসংখ্য দুগ্ধবতী গাভী। সেই জন্যে এর নাম হয় গোয়ালপাড়া। রানীর তাম্বুলেন ক্ষেত ছিল বিরাট এলাকা ব্যাপী। সম্বৎসর এই ক্ষেতে প্রচুর পরিমাণে তাম্বুল উৎপাদন হতো। তাম্বুল সংরক্ষণের জন্যে এক শ্রেণীর লোক রাজার অধীনে ছিল। তাদেরকে বলা হতো বারুই। এই বারুইদের জন্যে রাজা একটা নির্দিষ্ট স্থান করেছিলেন বসবাসের জন্যে, সে স্থানটিক বলা হয় বারুই পাড়া। বারুই পাড়া আজ অবধি একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বিরাট রাজার স্মৃতি বহন করে গ্রাম দুটি প্রাচীন দিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শ্রীপুর নামেও একটা ইতিহাস আছে। রাজমহিষীর নাম ছিল শ্রী। এই শ্রী থেকে উৎপত্তি হয়েছে শ্রীপুর। রাজমহিষীর নামকে চিরস্থায়ী করে রাখবার জন্যে শ্রীপুরের পত্তন করা হয়েছিল। আজ রাজাও নেই, রানীও নেই। কিন্তু তাদের নামের প্রতিষ্ঠিত স্থানগুলি কালের কপোল তলে শত উত্থান-পতনের মধ্য দিয়েও অমর হয়ে আছে।
ইতিহাসে আছে, রামপালের অভিষেক কালে পাল রাজগণের অধিকার ভাগীরথী ও পদ্মার মধ্যস্থি ‘ব’ দ্বীপে সীমাবদ্ধ ছিল। বরেন্দ্রভূমি ও গৌড় সিংহাসন ছিল তখন দিব্যকের ভ্রাতুষ্পুত্র ভীমের অধিকারে। রামপাল পিতৃরাজ্য পুনরাধিকার করবার জন্যে সামন্ত রাজগণের সাহায্য নিয়ে নৌ-সেতু দ্বারা ভাগীরথী পার হয়ে ভীমকে পরাজিত ও নিহত করে গৌড় অধিকার করেন। রামপালের মৃত্যুর পর কুমারপাল গৌড়ের সিংহাসনের অধিকারী হন। তার অল্পকাল রাজত্বের মধ্যেই ওড়িষ্যা রাজ অনন্ত বর্মা চোড় গঙ্গ ভাগীরথী তীরবর্তী ভূ-ভাগ অধিকার করেন এবং কর্ণাট দেশীয় চন্দ্রবংশীয় ব্রক্ষ্ম ক্ষত্রিয়ং সামন্ত সেনের পৌর বিজয় সেন রাঢ় অধিকার করেন। কুমারপাল দেবের পর তার শিশু পুত্র তৃতীয় গোপাল দেব রাজা হন। তিনি গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা নিহত হলে রামপালের কনিষ্ঠ পুত্র মদনপাল দেব গৌড় সিংহাসনে আরোহণ করেন। মদনপাল দেব তার অষ্টম রাজ্যাঙ্কে বিজয় সেন কর্তৃক গৌড় হতে বিতারিত হন।
বিরাট রাজার পতন হয়েছিল জনৈক মুসলমান শাসনকর্তার হস্তে। কে সেই মুসলিম শাসনকর্তা তা’ ইতিহাসে অজ্ঞাত।
স্থানীয় জনশ্রুতি আছে, জনৈক মুসলিম শাসনকর্তা বিরাট রাজার রাজ্য আক্রমণ করলে তুমুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে বিরাট রাজা প্রচুর শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন। মুসলিম শাসনকর্তা তার রাজধানী অবরোধ করলে রাজধানীর মধ্যে জলকষ্ট দেখা দেয়। তবুও রাজা বিরাট বশ্যতা স্বীকার না করে যুদ্ধ করতে থাকেন। রাজধানীর মধ্যে ছিল একটি কূপ। এই কূপের জল পান করে তিনি যুদ্ধে আহতদের সুস্থ করে তুলতেন। এই কূপ-মধ্যস্থিত জলে ছিল অলৌকিক ক্ষমতা। একবার আহতদের পান করাতে পারলে সে সুস্থ ও সবল হয়ে উঠতো। মুসলিম শাসনকর্তা কূপের অলৌকিক ক্রিয়ার কথা শুনে জনৈক অনুচরকে হিন্দু সাধুর বেশে রাজধানীতে প্রেরণ করে গো-মাংস নিক্ষেপ করে আসতে আদেশ করেন। অনুচরটি গোপনে কূপের মধ্যে গো-মাংস নিক্ষেপ করে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ‘মাজুদা’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। এই ঘটনার পর রাজা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। তারপর থেকে এই যুদ্ধক্ষেত্রের নাম হয় ‘মাজুদিয়া’। স্থানীয় লোকেরা আজও সেই যুদ্ধক্ষেত্রটিকে মাজুদিয়া রণক্ষেত্র বলে পরিচয় দেয়। রাজধানীর মধ্যে যেখানে সেই অলৌকিক কূপ ছিল, তার নাম জীবন কূপ। কূপটি এখন ভরাট হয়ে গেছে। এই কূপের উপর অটল মৌন প্রহরীর মতো আজ দাড়িয়ে আছে বহু কালের বিরাট একটি বট বৃক্ষ। মহাকালের কত বোবা কাহিনী তার পরতে পরতে লেগে আছে, তা’ কে জানে?
তথ্যসূত্র: যশোরাদ্য দেশ
লেখক: হোসেন উদ্দিন হোসেন