
Home ঝিনাইদহ জেলা / Jhenidah District > নলডাঙ্গা রাজবংশ / Naldanga dynasty
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99760 বার পড়া হয়েছে
নলডাঙ্গা রাজবংশ / Naldanga dynasty
নলডাঙ্গা রাজবংশ
Naldanga dynasty
যশোর জেলায় যে কয়টি রাজবংশের পরিচয় পাওয়া যায়, তার মধ্যে নলডাঙ্গা রাজবংশ অন্যতম। এই রাজবংশের আদি প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বিষ্ণুদাস হাজরা। ফরিদপুর জেলার তেলিহাটি পরগনার ভাবরাসুর গ্রামে আখণ্ডল বংশে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বিষ্ণুদাস হাজরা প্রথম জীবনে কি করতেন জানা যায় না। কথিত আছে, বিষ্ণুদাস প্রবীণ বয়সে সন্ন্যাস গ্রহণ করে যশোরের ব্যাঙ নদীর তীরে ক্ষেত্রগুণি গ্রামের এক নির্জন বনের মধ্যে তপস্যা করতেন। একদা বাংলার এক সুবাদার ঢাকা থেকে রাজমহলের পথে ব্যাঙ নদী দিয়ে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে খাদ্যসংকট দেখা দেয়। তিনি অনুচরদের পাশ্ববর্তী গ্রাম ও জলের মধ্য থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্যে প্রেরণ করেন। জঙ্গলের মধ্যে তাদের সহিত বিষ্ণুদাসের সাক্ষাৎ হলে, তিনি তাদের খাদ্যের ব্যবস্থা করে দেন। সুবাদার তার কার্যে খুশী হয়ে নিকটবর্তী পাঁচটি গ্রাম তাকে দান করেন। বিষ্ণুদাসের এক পুত্র ছিল, তার নাম শ্রীমস্ত দেবরায়। তিনি ভাবরাসুরা থেকে তাকে পাঁচটি গ্রাম দেখাশোনার জন্যে নিয়ে আসেন। শ্রীমন্ত ছিলেন বীরপুরুষ ও বিষয়ী ব্যক্তি। কি করে সম্পত্তি রক্ষা ও বৃদ্ধি করতে হয় তা’ তার অজানা ছিল না। সে সময় দেশে পাঠান শক্তি হীনবল হয়ে পড়েছিল। মোগলেরা একের পর এক যুদ্ধে পাঠানদের পরাজিত করে বাংলাদেশ অধিকার করছে। চারদিকে অরাজকতা, দেশের শাসনব্যবস্থা এক রকম ভগ্নপ্রায়। শ্রীমন্ত এ সুযোগ হেলায় হারাতে চাইলেন না। তার শরীরে প্রচুর শক্তি ছিল। তিনি নিজের জমিদারী বাড়াবার জন্যে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি গ্রহণ করলেন। সেই সময় যশোর জেলার কোটচাঁদপুর এলাকায় পাঠানদের জমিদারী ছিলো। তারা বাস করতেন স্বরূপপুর গ্রামে। শ্রীমন্ত তাদের জমিদারী বাহুবলে অধিকার করে নেন। একে একে তিনি এইভাবে মামুদশাহী পরগনার অধিকাংশ দখল করে নেন। তখন মোগল সুবাদার তার কার্যে খুশী হয়ে রণবীর খাঁ উপাধি প্রদান করেন, তখন এ দেশীয় জমিদারদের কাছে সৈন্য সাহায্য চাইলে রণবীর খাঁ তাকে সহায়তা করেছিলেন। রণবীরের মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র গোপী মোহন জমিদারী পরিচালনা করতেন। গোপী মোহনের পর চণ্ডিচরণ দেব রায় প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলেন। তার অধীনে অনেক সৈন্য-সামন্ত ছিল। তার সৈন্যদলে ফিরিঙ্গিদের অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন। ১৬৪৩ খৃষ্টাব্দে চণ্ডিচরণ পাশ্ববর্তী জমিদার রাজা কেদারেশ্বরের জমিদারী দখল করে নেন। এই জমিদারী দখল করাকালে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল, তাতে চণ্ডিচরণ একশত যুদ্ধ নৌকা মোতায়েন করেছিলেন। রাজা কেদারেশ্বর পরাজিত ও নিহত হন। চণ্ডিচরণ দেব রায় হলেন নলডাঙ্গা রাজবংশের প্রথম সম্মানিত রাজা। চণ্ডিচরনের মৃত্যুর পর তার পুত্র ইন্দ্র নারায়ণ রাজা হয়েছিলেন। তিনি একটি সুন্দর পঞ্চরত্ন মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। এই মন্দিরের বাইরের মাপ ৩৯ ফুট ৩ ইঞ্চি x ৩৯ ফুট ৩ ইঞ্চি। দেবীর নাম ইন্দ্র নারায়ণের নামানুসারে “ইন্দ্রেশ্বরী” রাখা হয়েছিল। ইন্দ্রনারায়ণের পুত্র সুর নারায়ণ দেবীপূজার নিয়মপদ্ধতি প্রণয়ন করেছিলেন। ১৬৮৫ খৃষ্টাব্দে সুর নারায়ণের মৃত্যু হলে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র উদয় নারায়ণ জমিদারী পরিচালনার ভারপ্রাপ্ত হন। তিনি ছিলেন বিলাসী প্রকৃতির লোক। বিষয়কার্যে মনোযোগ না দেবার দরুণ জমিদারীর রাজস্ব নবাব সরকারে বাকি পড়েছিল। তার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামদেব রায় উদয়নারায়ণের প্রতি খুশী ছিলেন না। তিনি বাংলার নবাবের সহিত গোপন ষড়যন্ত্র ভ্রাতার বিরুদ্ধে সেনাপতি শমসের খাঁর সহিত যোগ দিয়ে রাজতক্তে বসিয়েছিলেন। তারই আমলে ভূষণার সীতারাম মোগলেন বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। সীতারাম বাহুবলে পাশ্ববর্তী রাজা ও জমিদারদের রাজ্য দখল করতে থাকেন। রামদেবের অধিকৃত মামুদশাহী পরগনা ছিল ভূষণার অধীন। সীতারাম যখন মামুদশাহীর অধিকাংশ অধিকার করেন, তখন রামদেব নিজের জমিদারী রক্ষার্থে তার সংগে সন্ধি করতে বাধ্য হন। এই সময় নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ। রামদের নানা কারণে এই সময় নবাব সরকারে রাজস্ব দিতে না পারায় নবাব সরকারের বিষদৃষ্টিতে পড়েছিলেন। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ ছিলেন কঠোর প্রকৃতির লোক। যারা নবাব সরকারে রাজস্ব দিতে পারতেন না, তাদেরকে তিনি শাস্তি দিতে কুণ্ঠিত হতেন না। মুর্শিদাবাদের একটি পুতিগন্ধময় খাতে রাজস্ব দিতে অসমর্থ জমিদারদের বৈকুণ্ঠ বাসের ব্যবস্থা করতেন। নবাব সীতারামের বিদ্রোহ দমনকালে রামদেবকে তার পক্ষভুক্ত থাকায় রুষ্ট হয়েছিলেন। রামদেব নবাব সরকারকে এ ব্যাপারে কোন সাহায্য করেননি। বরাবরই একটি বিরোধিতার মনোভাব নিয়েছিলেন। ভূষণার ফৌজদার আবু তোরাপ সীতারামের হস্তে নিহত হলে নবাব বক্স আলী খাঁকে ভূষণায় প্রেরণ করেন। সেই সংগে নবাব মহম্মদপুরের পার্শ্ববর্তী জমিদারদের উপর এক পরওয়ানা জারি করে বলেন যে, সবাই যেন ফৌজদারকে সাহায্য করেন। পার্শ্ববর্তী জমিদারেরা যাতে সীতারামকে রসদ সাহায্য না করে এবং সীতারাম কারো জমিদারীর ভিতর দিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে, তার আদেশ জারী হয়। এ ব্যাপারে কেউ শিথিলতা প্রদর্শন করলে তার জমিদারী বাজেয়াপ্ত করা হবে। রিয়াজ এ সম্বন্ধে লিখেছেন: The Nauab issued mandates to the Zamindars of the environs insisting on their not suffering Sitaram to escape across their frontiers, and also threatening that should the latter effect his escape across the frontiers of any one, only he would be ousted from his Zamindari, but be punished. (Riyaz, P-166)
নবাবী পরওয়ানা পাওয়া সত্ত্বেও রাজা রামদেব নবাবের সৈন্যদলকে সাহায্য করলেন না। তিনি বরং তলে তলে আত্মরক্ষার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলেন। নিজ রাজ্য রক্ষার্থে বিপুল পরিমাণে সৈন্য বৃদ্ধি করতে লাগলেন। এ ব্যাপারে অর্থ খরচ করতেও কৃপণতা করলেন না। বক্স আলী খাঁ যখন ফৌজদার হয়ে আসেন, তখন তার সহকারীরূপে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদের সুবাদারী সৈন্যের অধিনায়ক সংগ্রাম সিংহ ও জমিদারী ফৌজের কর্তা দয়ারাম রায়। দয়ারাম ছিলেন দিঘাপাতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জমিদারী বন্দোবস্ত প্রভৃতির ব্যাপারে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁকে সাহায্য করে তার প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন।
সীতারামের সাথে নবাবী ফৌজের সংঘর্ষকালে পাশ্ববর্তী সকল জমিদারেরা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলেন, শুধু এলেন না রামদেব রায়। তিনি নীরবে নবাবী সৈন্য ও সীতারামের সৈন্যের যুুদ্ধের অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন। অবশেষে সীতারামের পরাজয় হলে রামদেব ভীত ও নিজেই আসন্ন বিপদের কথা উপলব্ধি করলেন। কার্যেও তাই হলো। রাজধানী মুর্শিদাবাদে তলব পড়লো রামদেব রায়ের। রামদেব নবাবের তলবে সাড়া দিলেন না। বাধ্য হয়ে নবাব তাকে ধরে নিয়ে যাবা জন্যে বহু সৈন্য প্রেরণ করলেন। মুর্শীদাবাদের পুতিগন্ধময় বৈকুণ্ঠে শাস্তির ভয়ে পালিয়ে গেল রামদেব রায়। নবাবের সৈন্যরা তাকে ধরতে না পারায় রাজ্যমধ্যে যথেষ্ট উৎপাত করা আরম্ভ করলো। রামদেব এই ভাবে পালিয়ে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। অবশেষে তিনি নিজেই হাজির হলেন মুর্শিদাবাদে। শাস্তি পাবার ভয়ে স্বেচ্ছায় সমস্ত জমিদারী ত্যাগ করলেন। পরে নবাবের অনুগ্রহে তিনি আবার মাসুদশাহী পরগনার নতুন বন্দোবস্ত পেলেন। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৭২২ খৃষ্টাব্দে। নবাব তাকে আশ্বাস দিলেন যে, তার বকেয়া রাজস্ব কিস্তিতে কিস্তিতে পরিশোধ করে দিতে হবে। কথিত আছে, রাজা রামদেবের পুনঃ জমিদারী প্রাপ্তির মূলে ছিলেন তার নবাব দরবারে নিযুক্ত আম মোক্তার কৃষ্ণচন্দ্র দাস। মাগুরা মহকুমার অন্তর্গত নান্দুয়ালী গ্রামে তার বাড়ি ছিল। রামদেব রায় পরবর্তীকালে কৃষ্ণচন্দ্রকে যথেষ্ট ভূমি দান করেছিলেন। ১৭২৭ খৃষ্টাব্দে রামদেবের মৃত্যু হলে তার পুত্র রঘুদেব রায় রাজ্যের কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। সুজাউদ্দীন যখন বাংলার নবাব, তখন একটি সরকারী পরওয়ানা অমান্য করার ফলে তাকে রাজ্যচুত করা হয়েছিল। ‘যশোরের ইতিহাস’ লেখক ওয়েস্টল্যাণ্ড সাহেব তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, নবাব সরফরাজ খাঁ যখন বাংলার নবাব তখন তার সমস্ত রাজ্য পত্যর্পণ করে দেন। নবাব আলীবর্দ্দীর আমলে সমগ্র বাংলাদেশে এক অশান্তির সূচনা হয়। বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের শালবন অতিক্রম করে উড়িষ্যার গীরি নদী পার হয়ে নানা পথে সহস্র সহস্র মহারাষ্ট্রীয় অশ্বারোহী ক্ষুধার্ত পতঙ্গের ন্যায় বাংলাদেশের বুকের উপর ছুটে এসেছিল। তারা লুণ্ঠনের আশায় বাংলাদেশে পদার্পন করে। এর নাম ইতিহাসে বর্গীর হাঙ্গামা। বর্গীরা ভাগীরথীর পশ্চিম তীরস্ত সমস্ত জনপদগুলি জনশূন্য করে দেয়। নবাব আলীবর্দ্দী তাদের দমন করবার জন্যে অগ্রসর হলেও তাদেরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মহাসমস্যায় পড়েছিলেন। মহারাষ্ট্র সেনা রাজধানী আক্রমণ করে জগৎশেঠের রাজভাণ্ডার পর্যন্ত লুট করেছিল। ১৭৪১ খৃষ্টাব্দে মহারাষ্ট্র দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বেরার প্রদেশে রঘুজি ভোঁসলা এবং পুনা প্রদেশে বালাজী। রঘুজীর আজ্ঞাবহ সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বাংলাদেশে প্রথম পদার্পণ করেন। তার কিছুদিন পরে বালাজী বাহুবলে দিল্লরি বাদশাহকে বশীভূত করে ১১ লক্ষ টাকা চৌথ আদায়ের ফরমান নিয়ে বিহার অঞ্চল লুণ্ঠন করতে করতে বাংলাদেশে আসেন। একদিকে বালাজী, অন্যদিকে পণ্ডিত। আলীবর্র্র্র্র্র্র্দ্দীর পক্ষে একাকী প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ভাস্কর পণ্ডিত যখন বর্দ্ধমানে লুটতরাজ করে ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করেন, তখন বর্দ্ধমানের রাজা চিত্রসেন উপায়ান্তর না দেখে পলায়ন করে নলডাঙ্গায় এসে উপস্থি হন। রঘুদেভ তাকে আশ্রয়ের জন্যে তৈলকুপী গ্রামে অস্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করে দেন। চিত্রসেন পাগড়ী বদল করে তার সংগে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। চিত্রসেন যে স্থানে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে আজও গড় কাটা ও বিলুপ্তপ্রায় শিবমন্দিরের পরিচয় চিহ্ন বিদ্যমান। রাজা চিত্রসেন এখানে গুঞ্জানাথ শিবলিঙ্গের জন্য যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, তার নাম গুজ্ঞনাথের মন্দির। মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চলেছে। এর বাইরের মাপ ২৮ ফুট x ২৮ ফুট। মন্দিরের সদর পূর্র্ব দিকে। চারদিকে বারান্দা। তার মধ্যে পূর্ব দিকের বারান্দা খোলা। সেদিকে দুটি স্তম্ভের উপর তিনটি খিলান। বারান্দার পরিধি ৫ ফুট-৬ইঞ্চি । গুঞ্জানাথের নাম অনুসারে বর্তমানে এই গ্রামটির নাম গুঞ্জানগর। ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে রাজা রঘুদেব রায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যুর পর সমস্ত জমিদারী কনিষ্ঠা ভ্রাতা কৃষ্ণদেবের হস্তে আসে। কৃষ্ণদেবের আমলে জমিদারী কিছুটা ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। তার দুই স্ত্রী ছিলেন। এক স্ত্রীর নাম রাজরাজেশ্বরী এবং অন্যজনের নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া। রাজরাজেশ্বরীর গর্ভে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাদের নাম মহেন্দ্র ও রামশঙ্কর। রাণী লক্ষ্মীপ্রিয়ার কোন সন্তানাদি ছিল না। তিনি এক দত্তক পুত্র গ্রহণ করেছিলেন। কৃষ্ণদেব ১৭৭৩ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুর পর তার জমিদারীর ৪ অংশ গোবিন্দ দেব রায়ের হস্তগত হয়। বাকি সম্পত্তি এজমালী হিসাবে থাকে। লর্ড কর্ণওয়ালিস যখন গভর্ণর, তখন তিনি জমাজমি বিষয়ক এক নতুন আইন প্রবর্তন করেন। এই আইনের নাম ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বাংলার জমিদারদিগের সহিত বাৎসরিক বা পাঁচ বৎসরের জন্য জমাজমি বিষয়ক চুক্তির জন্য প্রায়শঃ রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে কলহ হতো। এই কারণে বিলাত হতে কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ এদেশে জমা-জমি বিষয়ক কলহ দূর করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার জন্যে লর্ড কর্নওয়ালিসকে গর্ভণর জেনারেল করে পাঠান। তাদের মত ছিল এই: A moderate jumma if regularly and punctually collected unites the comsideration of their interest, with the happiness of the natives and security of the land-holders, more rationally than any imperfect collection of an exaggerated jumma to be enforced with severity and exaction. (Fifth Report, 1812 P-30; 1917, Cambry Vol. I, P-31)
কর্ণওয়ালিস বাংলায় পদার্পণ করেই এ বিষয়ে যেসব অভিজ্ঞ কর্মচারীদের মতামত জিজ্ঞাসা করেন, তাদের মধ্যে যশোরের জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট হেঙ্কেল সাহেব অন্যতম। হেঙ্কেল সাহেব যে মত দিয়েছিলেন তা হচ্ছে এই যে, জমিজমা রাইয়তের সংগে বন্দোবস্ত করা উচিৎ। তিনি বলেছিলেন, জমিদারের স্বত্ব অধিকার যায় না বটে, কিন্তু তাদেরকে রাজস্ব সংগ্রহ করার ব্যপারে সাহায্যকারী হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রজারা খাজনা জমিদারদের উচ্চ হারে দিয়ে থাকে। জমির অতিরিক্ত পাট্টা দিলে, খাজনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। লর্ড কর্ণওয়ালিস সব অভিজ্ঞদের মতামতের সমন্বয় সাধন করে ডিরেক্টরগণের আদেশ কার্যকরী করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কালে আবহাওয়া বা সায়র আদায়সমূহ বাদ দিয়ে জমিদারদের রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই আইন প্রবর্তিত হওয়ায় বাংলার অনেক ভূ-স্বামীর জমিদারী নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। গোবিন্দ দেব রায়ের সম্পত্তিরও একই দশা হয়েছিল। তার তিন আনী অংশ ১৮০০ খৃষ্টাব্দে নিলাম হয়। মহেন্দ্র দেবেরও ১৮ গণ্ডা অংশ নিলামে ওঠে। শুধুমাত্র রাম শঙ্করের ১৮ অংশ তার নিজের দখলে ছিল। কার্যতঃ তিনিই রাজা বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজা রামশঙ্করের পুত্রের নাম ছিল মোহন চাঁদ। পিতার জীবদ্দশায় তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার বিধবা পত্নী রাণী রাধামণি স্বামীর সংগে সহমরণে যান। তার দশ মাসের এক শিশু সন্তান ছিল। এই শিশু পুত্রের নাম শশীভূষণ। এই সময় সমস্ত জমিদারী কোর্ট-অভ-ওয়ার্ডসের হস্তগত হয়। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হলে জমিদারী স্বহস্তে গ্রহণ করেন। তার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি দত্তক পুত্র গ্রহণ করেছিলেন। কিছুদিন পরেই তার অকাল বিয়োগ ঘটে। এই সময় দত্তক পুত্রের বয়স ছিল খুবই কম। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে দত্তক পুত্র ইন্দ্রভূষণ জমিদারী গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি রাজা উপাধি ব্যবহার করতে পারেন নাই। তিনি রাজা উপাধি ব্যবহার করবার জন্যে মুর্শীদাবাদে গিয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে চণ্ডিচরণ দেব রায়ের রাজ সনদের প্রতিলিপি এনে ইংরেজ সরকারের নিকট বহু আবেদন নিবেদন করে রাজা উপাধি লাভ করেন। তিনিও বেশী দিন জীবিত ছিলেন না। মাত্র ৪০ বছর বয়সে ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ত্রিবেণীতে পরলোক গমন করেন। রাজা ইন্দ্রভূষণ অনেক জনহিতকর কার্য করেছিলেন। তার বারো বছর বয়স্ক দত্তক পুত্র ভূষণ জমিদারীর মালিক হন। সরকার তাকে রাজবাহাদুর খেতাব দিয়েছিলেন। যশোরাদ্য দেশে যে কয়জন রাজার পরিচয় পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রমথ ভূষণই একমাত্র ইংরেজ আমলে সনন্দধারী রাজা। রাজা প্রমথ ভূষণ দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে প্রথম নীল ব্যবসার কারবার খুলেছিলেন। তিনি নহাটা নীলকুঠি মিঃ সেলবী সাহেবের নিকট থেকে খরিদ করেন। যশোর জেলায় নলডাঙ্গা রাজপরিবারের অগাধ দান আছে। জনগণের হিতার্থে তারা অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন। রাজা প্রমথ ভূষণ পিতার নামে ইন্দ্রভূষণ বৃত্তি প্রবর্তন করেছিলেন। মায়ের নামে প্রর্বতন করেছিলেন মধুমতি বৃত্তি। তার দুটি পুত্র সন্তান ছিল। তার মধ্যে একজনের নাম কুমার পন্নভূষণ এবং অন্যজনের নাম কুমার মৃগাঙ্ক ভূষণ। দেশ বিভাগের পর রাজপরিবারের কেহ এখানে নেই। তাদের রাজপ্রাসাদ আজ ধূলায় লুণ্ঠিত। কিছুদিন পূর্বেও নলডাঙ্গা রাজাদের রাজপুরীর অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত শ্বেত পাথমে নির্মিত বেদী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। কালের নিয়মে আজ সবই ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। ভাঙা ইটের কঙ্কাল ছাড়া আজ আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না।
তথ্যসূত্র: যশোরাদ্য দেশ
লেখক: হোসেন উদ্দিন হোসেন
নবাবী পরওয়ানা পাওয়া সত্ত্বেও রাজা রামদেব নবাবের সৈন্যদলকে সাহায্য করলেন না। তিনি বরং তলে তলে আত্মরক্ষার জন্যে শক্তি সঞ্চয় করতে লাগলেন। নিজ রাজ্য রক্ষার্থে বিপুল পরিমাণে সৈন্য বৃদ্ধি করতে লাগলেন। এ ব্যাপারে অর্থ খরচ করতেও কৃপণতা করলেন না। বক্স আলী খাঁ যখন ফৌজদার হয়ে আসেন, তখন তার সহকারীরূপে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদের সুবাদারী সৈন্যের অধিনায়ক সংগ্রাম সিংহ ও জমিদারী ফৌজের কর্তা দয়ারাম রায়। দয়ারাম ছিলেন দিঘাপাতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি জমিদারী বন্দোবস্ত প্রভৃতির ব্যাপারে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁকে সাহায্য করে তার প্রিয়পাত্র হয়েছিলেন।
সীতারামের সাথে নবাবী ফৌজের সংঘর্ষকালে পাশ্ববর্তী সকল জমিদারেরা সাহায্যের জন্যে এগিয়ে এলেন, শুধু এলেন না রামদেব রায়। তিনি নীরবে নবাবী সৈন্য ও সীতারামের সৈন্যের যুুদ্ধের অবস্থা লক্ষ্য করেছিলেন। অবশেষে সীতারামের পরাজয় হলে রামদেব ভীত ও নিজেই আসন্ন বিপদের কথা উপলব্ধি করলেন। কার্যেও তাই হলো। রাজধানী মুর্শিদাবাদে তলব পড়লো রামদেব রায়ের। রামদেব নবাবের তলবে সাড়া দিলেন না। বাধ্য হয়ে নবাব তাকে ধরে নিয়ে যাবা জন্যে বহু সৈন্য প্রেরণ করলেন। মুর্শীদাবাদের পুতিগন্ধময় বৈকুণ্ঠে শাস্তির ভয়ে পালিয়ে গেল রামদেব রায়। নবাবের সৈন্যরা তাকে ধরতে না পারায় রাজ্যমধ্যে যথেষ্ট উৎপাত করা আরম্ভ করলো। রামদেব এই ভাবে পালিয়ে থাকা নিরাপদ মনে করলেন না। অবশেষে তিনি নিজেই হাজির হলেন মুর্শিদাবাদে। শাস্তি পাবার ভয়ে স্বেচ্ছায় সমস্ত জমিদারী ত্যাগ করলেন। পরে নবাবের অনুগ্রহে তিনি আবার মাসুদশাহী পরগনার নতুন বন্দোবস্ত পেলেন। এই ঘটনা ঘটেছিল ১৭২২ খৃষ্টাব্দে। নবাব তাকে আশ্বাস দিলেন যে, তার বকেয়া রাজস্ব কিস্তিতে কিস্তিতে পরিশোধ করে দিতে হবে। কথিত আছে, রাজা রামদেবের পুনঃ জমিদারী প্রাপ্তির মূলে ছিলেন তার নবাব দরবারে নিযুক্ত আম মোক্তার কৃষ্ণচন্দ্র দাস। মাগুরা মহকুমার অন্তর্গত নান্দুয়ালী গ্রামে তার বাড়ি ছিল। রামদেব রায় পরবর্তীকালে কৃষ্ণচন্দ্রকে যথেষ্ট ভূমি দান করেছিলেন। ১৭২৭ খৃষ্টাব্দে রামদেবের মৃত্যু হলে তার পুত্র রঘুদেব রায় রাজ্যের কার্যভার গ্রহণ করেছিলেন। সুজাউদ্দীন যখন বাংলার নবাব, তখন একটি সরকারী পরওয়ানা অমান্য করার ফলে তাকে রাজ্যচুত করা হয়েছিল। ‘যশোরের ইতিহাস’ লেখক ওয়েস্টল্যাণ্ড সাহেব তার গ্রন্থে লিখেছেন যে, নবাব সরফরাজ খাঁ যখন বাংলার নবাব তখন তার সমস্ত রাজ্য পত্যর্পণ করে দেন। নবাব আলীবর্দ্দীর আমলে সমগ্র বাংলাদেশে এক অশান্তির সূচনা হয়। বীরভূম ও বিষ্ণুপুরের শালবন অতিক্রম করে উড়িষ্যার গীরি নদী পার হয়ে নানা পথে সহস্র সহস্র মহারাষ্ট্রীয় অশ্বারোহী ক্ষুধার্ত পতঙ্গের ন্যায় বাংলাদেশের বুকের উপর ছুটে এসেছিল। তারা লুণ্ঠনের আশায় বাংলাদেশে পদার্পন করে। এর নাম ইতিহাসে বর্গীর হাঙ্গামা। বর্গীরা ভাগীরথীর পশ্চিম তীরস্ত সমস্ত জনপদগুলি জনশূন্য করে দেয়। নবাব আলীবর্দ্দী তাদের দমন করবার জন্যে অগ্রসর হলেও তাদেরকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে মহাসমস্যায় পড়েছিলেন। মহারাষ্ট্র সেনা রাজধানী আক্রমণ করে জগৎশেঠের রাজভাণ্ডার পর্যন্ত লুট করেছিল। ১৭৪১ খৃষ্টাব্দে মহারাষ্ট্র দল দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বেরার প্রদেশে রঘুজি ভোঁসলা এবং পুনা প্রদেশে বালাজী। রঘুজীর আজ্ঞাবহ সেনাপতি ভাস্কর পণ্ডিত বাংলাদেশে প্রথম পদার্পণ করেন। তার কিছুদিন পরে বালাজী বাহুবলে দিল্লরি বাদশাহকে বশীভূত করে ১১ লক্ষ টাকা চৌথ আদায়ের ফরমান নিয়ে বিহার অঞ্চল লুণ্ঠন করতে করতে বাংলাদেশে আসেন। একদিকে বালাজী, অন্যদিকে পণ্ডিত। আলীবর্র্র্র্র্র্র্দ্দীর পক্ষে একাকী প্রতিরোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ভাস্কর পণ্ডিত যখন বর্দ্ধমানে লুটতরাজ করে ভীষণ অত্যাচার আরম্ভ করেন, তখন বর্দ্ধমানের রাজা চিত্রসেন উপায়ান্তর না দেখে পলায়ন করে নলডাঙ্গায় এসে উপস্থি হন। রঘুদেভ তাকে আশ্রয়ের জন্যে তৈলকুপী গ্রামে অস্থায়ী বাড়ি নির্মাণ করে দেন। চিত্রসেন পাগড়ী বদল করে তার সংগে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। চিত্রসেন যে স্থানে বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন, সেখানে আজও গড় কাটা ও বিলুপ্তপ্রায় শিবমন্দিরের পরিচয় চিহ্ন বিদ্যমান। রাজা চিত্রসেন এখানে গুঞ্জানাথ শিবলিঙ্গের জন্য যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, তার নাম গুজ্ঞনাথের মন্দির। মন্দিরটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হতে চলেছে। এর বাইরের মাপ ২৮ ফুট x ২৮ ফুট। মন্দিরের সদর পূর্র্ব দিকে। চারদিকে বারান্দা। তার মধ্যে পূর্ব দিকের বারান্দা খোলা। সেদিকে দুটি স্তম্ভের উপর তিনটি খিলান। বারান্দার পরিধি ৫ ফুট-৬ইঞ্চি । গুঞ্জানাথের নাম অনুসারে বর্তমানে এই গ্রামটির নাম গুঞ্জানগর। ১৭৪৮ খৃষ্টাব্দে রাজা রঘুদেব রায় মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার মৃত্যুর পর সমস্ত জমিদারী কনিষ্ঠা ভ্রাতা কৃষ্ণদেবের হস্তে আসে। কৃষ্ণদেবের আমলে জমিদারী কিছুটা ভাগ-বাটোয়ারা হয়ে যায়। তার দুই স্ত্রী ছিলেন। এক স্ত্রীর নাম রাজরাজেশ্বরী এবং অন্যজনের নাম লক্ষ্মীপ্রিয়া। রাজরাজেশ্বরীর গর্ভে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাদের নাম মহেন্দ্র ও রামশঙ্কর। রাণী লক্ষ্মীপ্রিয়ার কোন সন্তানাদি ছিল না। তিনি এক দত্তক পুত্র গ্রহণ করেছিলেন। কৃষ্ণদেব ১৭৭৩ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন। তার মৃত্যুর পর তার জমিদারীর ৪ অংশ গোবিন্দ দেব রায়ের হস্তগত হয়। বাকি সম্পত্তি এজমালী হিসাবে থাকে। লর্ড কর্ণওয়ালিস যখন গভর্ণর, তখন তিনি জমাজমি বিষয়ক এক নতুন আইন প্রবর্তন করেন। এই আইনের নাম ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। বাংলার জমিদারদিগের সহিত বাৎসরিক বা পাঁচ বৎসরের জন্য জমাজমি বিষয়ক চুক্তির জন্য প্রায়শঃ রাজস্ব সংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে কলহ হতো। এই কারণে বিলাত হতে কোম্পানীর ডিরেক্টরগণ এদেশে জমা-জমি বিষয়ক কলহ দূর করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার জন্যে লর্ড কর্নওয়ালিসকে গর্ভণর জেনারেল করে পাঠান। তাদের মত ছিল এই: A moderate jumma if regularly and punctually collected unites the comsideration of their interest, with the happiness of the natives and security of the land-holders, more rationally than any imperfect collection of an exaggerated jumma to be enforced with severity and exaction. (Fifth Report, 1812 P-30; 1917, Cambry Vol. I, P-31)
কর্ণওয়ালিস বাংলায় পদার্পণ করেই এ বিষয়ে যেসব অভিজ্ঞ কর্মচারীদের মতামত জিজ্ঞাসা করেন, তাদের মধ্যে যশোরের জজ ও ম্যাজিস্ট্রেট হেঙ্কেল সাহেব অন্যতম। হেঙ্কেল সাহেব যে মত দিয়েছিলেন তা হচ্ছে এই যে, জমিজমা রাইয়তের সংগে বন্দোবস্ত করা উচিৎ। তিনি বলেছিলেন, জমিদারের স্বত্ব অধিকার যায় না বটে, কিন্তু তাদেরকে রাজস্ব সংগ্রহ করার ব্যপারে সাহায্যকারী হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রজারা খাজনা জমিদারদের উচ্চ হারে দিয়ে থাকে। জমির অতিরিক্ত পাট্টা দিলে, খাজনা বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। লর্ড কর্ণওয়ালিস সব অভিজ্ঞদের মতামতের সমন্বয় সাধন করে ডিরেক্টরগণের আদেশ কার্যকরী করেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কালে আবহাওয়া বা সায়র আদায়সমূহ বাদ দিয়ে জমিদারদের রাজস্ব নির্ধারণ করা হয়েছিল। এই আইন প্রবর্তিত হওয়ায় বাংলার অনেক ভূ-স্বামীর জমিদারী নিলামে বিক্রি হয়ে যায়। গোবিন্দ দেব রায়ের সম্পত্তিরও একই দশা হয়েছিল। তার তিন আনী অংশ ১৮০০ খৃষ্টাব্দে নিলাম হয়। মহেন্দ্র দেবেরও ১৮ গণ্ডা অংশ নিলামে ওঠে। শুধুমাত্র রাম শঙ্করের ১৮ অংশ তার নিজের দখলে ছিল। কার্যতঃ তিনিই রাজা বলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। রাজা রামশঙ্করের পুত্রের নাম ছিল মোহন চাঁদ। পিতার জীবদ্দশায় তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। তার বিধবা পত্নী রাণী রাধামণি স্বামীর সংগে সহমরণে যান। তার দশ মাসের এক শিশু সন্তান ছিল। এই শিশু পুত্রের নাম শশীভূষণ। এই সময় সমস্ত জমিদারী কোর্ট-অভ-ওয়ার্ডসের হস্তগত হয়। ১৮৩০ খৃষ্টাব্দে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হলে জমিদারী স্বহস্তে গ্রহণ করেন। তার কোন পুত্র সন্তান না থাকায় তিনি দত্তক পুত্র গ্রহণ করেছিলেন। কিছুদিন পরেই তার অকাল বিয়োগ ঘটে। এই সময় দত্তক পুত্রের বয়স ছিল খুবই কম। ১৮৫৩ খৃষ্টাব্দে দত্তক পুত্র ইন্দ্রভূষণ জমিদারী গ্রহণ করেন। প্রথমে তিনি রাজা উপাধি ব্যবহার করতে পারেন নাই। তিনি রাজা উপাধি ব্যবহার করবার জন্যে মুর্শীদাবাদে গিয়ে অনেক ত্যাগ স্বীকার করে চণ্ডিচরণ দেব রায়ের রাজ সনদের প্রতিলিপি এনে ইংরেজ সরকারের নিকট বহু আবেদন নিবেদন করে রাজা উপাধি লাভ করেন। তিনিও বেশী দিন জীবিত ছিলেন না। মাত্র ৪০ বছর বয়সে ১৮৭০ খৃষ্টাব্দে ত্রিবেণীতে পরলোক গমন করেন। রাজা ইন্দ্রভূষণ অনেক জনহিতকর কার্য করেছিলেন। তার বারো বছর বয়স্ক দত্তক পুত্র ভূষণ জমিদারীর মালিক হন। সরকার তাকে রাজবাহাদুর খেতাব দিয়েছিলেন। যশোরাদ্য দেশে যে কয়জন রাজার পরিচয় পাওয়া যায়, তার মধ্যে প্রমথ ভূষণই একমাত্র ইংরেজ আমলে সনন্দধারী রাজা। রাজা প্রমথ ভূষণ দেশীয় রাজন্যবর্গের মধ্যে প্রথম নীল ব্যবসার কারবার খুলেছিলেন। তিনি নহাটা নীলকুঠি মিঃ সেলবী সাহেবের নিকট থেকে খরিদ করেন। যশোর জেলায় নলডাঙ্গা রাজপরিবারের অগাধ দান আছে। জনগণের হিতার্থে তারা অনেক অর্থ ব্যয় করেছেন। রাজা প্রমথ ভূষণ পিতার নামে ইন্দ্রভূষণ বৃত্তি প্রবর্তন করেছিলেন। মায়ের নামে প্রর্বতন করেছিলেন মধুমতি বৃত্তি। তার দুটি পুত্র সন্তান ছিল। তার মধ্যে একজনের নাম কুমার পন্নভূষণ এবং অন্যজনের নাম কুমার মৃগাঙ্ক ভূষণ। দেশ বিভাগের পর রাজপরিবারের কেহ এখানে নেই। তাদের রাজপ্রাসাদ আজ ধূলায় লুণ্ঠিত। কিছুদিন পূর্বেও নলডাঙ্গা রাজাদের রাজপুরীর অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত শ্বেত পাথমে নির্মিত বেদী সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। কালের নিয়মে আজ সবই ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। ভাঙা ইটের কঙ্কাল ছাড়া আজ আর কিছুই দৃষ্টিগোচর হয় না।
তথ্যসূত্র: যশোরাদ্য দেশ
লেখক: হোসেন উদ্দিন হোসেন