
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস / Digambar Biswas and bisnucaran Biswas
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100106 বার পড়া হয়েছে
দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস / Digambar Biswas and bisnucaran Biswas
দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস
Digambar Biswas and bisnucaran Biswas
Home District: Jessore, Chowgacha
যশোর শহর থেকে ১৫ মাইল পশ্চিমে থানা শহর চৌগাছা। এক সময়কার প্রবল খরস্রোতা নদ কপোতাক্ষের পুব গা ঘেঁষে গড়ে ওঠা এই শহর। সেই কবেকার দিনে কোন মহারথিদের কোন প্রয়োজনে গড়ে উঠেছে এ জনপদ তা আজ কয়জনই বা জানে। হয়তো জানে কপোতাক্ষ। হয়তোবা জানে তার গর্ভাস্রোত অথবা পলি।
কিন্তু কে শুনবে তার কাছে সে কাহিনী। কারই বা আছে অত সময়! রত্নগর্ভা কপোতাক্ষের হয়তোবা এই-ই সন্তাপ, সে জন্ম দিয়েছে এমনি কত নগর জনপদ, সভ্যতা, কিন্তু সবই নিষ্ফল আগাছা-মাইকেল হয়েছে একজন-যে শুনতে পায় তার অন্তর আহ্বান, আর তাই ফিরে আসে মায়ের কোলে কপোতাক্ষের পাড়ে।
চৌগাছা শহরের পশ্চিমে কপোতাক্ষের ওপর দিয়ে বেইলি ব্রিজ পার হয়ে মহেশপুর রোডের মাইলখানেক জিয়েলগাড়ি থেকে ডানে নারায়ণপুর অভিমুখে, আবার ডানে ভেন্নাবেড়ে-টেঙ্গুরপুরের খোল, কপোতাক্ষের পশ্চিম তীরে এক মরা নদের ইতিকথা। দু’পাড়ের বিস্তীর্ণ বসতিহীন আবাদি জমিন আজও বহন করে চলেছে এ নদের অতীত বিস্তৃতি। হয়তোবা একদিন জাহাজ চলেছে এ পথে-নয়তোবা বজরা অথবা বিরাট পালতোলা শতটনি নৌকা অথচ আজ তালের ডোঙ্গাও দেখা যায় না সচরাচর। তবে জানাযায়, অনেক যুগ পরে হলেও গেল ’৯১ সাল থেকে চৌগাছা নারায়ণপুর পর্যন্ত এপথে চলা শুরু করেছে সৌখিন স্যালো ট্রলার। ছোট্ট সামিয়ানা টাঙিয়ে ৭-৮ জনের বাহন এটি। ভট-ভট, পট-পট শব্দ করে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মরা কপোতাক্ষের বুক চিরে চলে সে। ভাবছিলাম-ইউফ্রেটিস, তাইগ্রিস, নীল, সিন্ধু, যমুনা, গঙ্গা, পদ্মার মত কত নগর জনপদ সভ্যতারই না জন্ম দিয়েছে এ কপোতাক্ষও একদিন। কত হাসি-আনন্দ-বিক্ষোভ-বিদ্রোহ আর বিপ্লবেরই না সাক্ষী সে। অথচ আজ মরা। কঠিন ফসিল। সব হারিয়ে সরু নালা।
এভাবে লেখক বেনজিন খান দেখতে দেখতে ভাবতে ভাবতে নীরব কিছুক্ষণ। হঠাৎ পিছন থেকে কণ্ঠ ভেসে আসল। মানুষ দু’জন। একজন পেট ভরা গ্রামের আব্দুল বারিক (৬৫) অন্যজন হাজরাখানার শৈলেন্দ্রনাথ শিকদার (৭০)।
লেখক জিজ্ঞেস করলেন-
আপনারা তো এ অঞ্চলের মানুষ, বয়সও কম দিগম্বর বিশ্বাসের নাম শুনেছেন?
বারিক : ‘না তো, খুড়ো তুমি শুনেছ?’
খুড়োরও একই জবাব, ‘না তো!’
লেখক আরো এগিয়ে প্রশ্ন করলেন-কেন নীল বিদ্রোহের দুই নায়ক বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস আর দিগম্বর বিশ্বাসের নাম শোনেননি?
একই সাথে দু’জন উত্তর দিল : ‘না তো! এই প্রথম ওদের নাম শুনছি।’
লেখক বললেন-অনেক বছর আগে সেই ব্রিটিশ আমলে ইংরেজরা এঅঞ্চলে নীলের চাষ করত-কৃষকরা না চাইলে অত্যাচার করত এসব কথা শোনেননি?
উত্তরে বারিক বললেন, ‘শুনিছি বাপ-দাদাদের কাছে, আমরা দেখিনি-সে কি আজগের কথা? অতো মনেও নেই-শুনিছি কৃষকরা নীল লাগাতি না চালি সাহেবরা তাদের মাথার ওপর কাদা দিয়ে নীল লাগাত।’
ভাবলেন, বিষ্ণুচরণ আর দিগম্বর বিশ্বাসরা আজ একদমই বেঁচে নেই। বেঁচে নেই আর্তনাদ, চিৎকার, লাঠির শব্দ রক্তমাখা দ্রোহ। তবে নীল এবং অত্যাচার কিংবদন্দী হয়ে এখনও লাল কেরসিনের মিটমিটে ল্যাম্পের মত জ্বলে আছে। হয়তোবা সেটিও নিভে যেতে আর কিছু মাত্র দেরি নেই। এমন সময় এখানে এসে পৌঁছলেন নারায়ণপুর গ্রামের মোঃ আবু তালেব বিশ্বাস (৬০)।
আবু তালেব লেখককে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি গো বাপু?’ লেখক বললেন কিছু না চাচা এই কপোতাক্ষ দেখতে এসেছি। কপোতাক্ষের দু’পাড়, দু’পাড়ের মানুষ আর তাদের অতীত কিছু ঘটনা জানতে এসেছি।
‘তা আপনার বাড়ি কনে হাগা?’ আবু তালেব জিজ্ঞাসা করলেন।
লেখক বললেন, এখন যশোরে চাচা, তবে আসল বাড়ি সিংহঝুলি।
‘ও, কোন পাড়ায়?’
লেখক বললেন, মিয়া বাড়ি।
‘তালি তো আমরা এক জাগারই মানুষ-মিয়াদের সাথে আমাদের আত্মীয়তা আছে। তা কি মনে করে?’ আবু তালেব আবার জিজ্ঞাসা করলেন।
লেখক প্রশ্ন করলেন দিগম্বর বিশ্বাসের নাম শুনেছেন চাচা?
উত্তরে বললেন, ‘না তো!’
বিষ্ণুচরণ বিশ্বাসের?
‘না তো!’
‘কেন উরা কিডা?’
লেখক বললেন-কেন, নীল-নীলচাষ-অত্যাচার-বিদ্রোহ-বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে, অবশেষে নীলকর সাহেবদের পরাজয়-নীল চাষের অবসান-এসব সম্পর্কে কিছুই শোনেননি?
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে শিশুর মত সরল হয়ে গেলেন আবু তালেব। অকপটে বলে চললেন,
‘আমরা মুরুক্ষো মানুষ-ও সব বুঝিনে। বাপ-চাচাদের মুখি শুনিছি কিছু কিছু তা মনেও নেই। শুনিছি সাহেবরা পানি মেপে ঘাঁটি করত। যেখেনে পাতলা পানি পেত সেখেনে ঘাঁটি করত।’
পাতলা পানি দেখে ঘাঁটি গাড়তো কেন? জানতে চাইলে বললেন,
‘জানিনে’।
আসলে নীল পচাবার জন্য পরিষ্কার পানির প্রয়োজন। এজন্য নীল কুঠিগুলি প্রায়ই মিঠা পানির নদীর তীরে অবস্থিত হত।
ওদের সম্পর্কে আর কি শুনেছেন? প্রশ্ন করলে আবু তালেব বলেন,
“তাহেরপুর (হাকিমপুর ইউনিয়নের একটি গ্রাম) কুঠির জন্নি কপোতাক্ষ’র উপর বান্দাল দিয়ে সাহেবরা পানি বুড়িগঙ্গায় (আসলে বুড়িভৈরব) নিতি চাইল কিন্তু পারিল না। বুড়িগঙ্গা নিইল না। বুড়িগঙ্গা ¯^cœ দ্যাখাইল তুই (সাহেব) যে মা’র গর্ভত্তে আইছিস সে গর্ভে কি আর ফিরে যাবি? এই বলে বান্দাল ভেঙ্গে নিয়ে পানি সুজা চলে আইল’।
তার মানে? জানতে চাইলে তিনি বললেন,
‘কপোতাক্ষত্তে জন্ম হয়েছে বুড়িগঙ্গার। বুড়িগঙ্গা কপোতাক্ষ’র শাখা-সেই জন্নি বুড়ি কপোতাক্ষ’র পানি নিইলো না।’
একথা শোনার পরে বুঝতে আর বাকি রইল না যে, নীলকর সাহেবরা কিংবদন্তী হয়ে এখনো বেঁচে আছে কিন্তু হারিয়ে গেছে আমাদের বিষ্ণুচরণ আর দিগম্বর বিশ্বাসরা।
আবু তালেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ঐসব কি আবার হবে?’
ঐ সব মানে?
‘মানে নীল চাষ কি আবার হবে?’
বললাম না,
আবু তালেব চলে গেলেন হাটে।
লেখক নারায়ণপুর গ্রামে। নারায়ণপুরে ঢুকতেই আবহাওয়া ভিন্ন। পুরনো, চুন-সুরকি দিয়ে গাঁথা বাড়ি-ঘর। দোকান-পাট। ঈদগা। প্রাচীন বাহারাম উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের ধ্বংসাবশেষ। মাধ্যমিক স্কুল। প্রবীণ তেতুলগাছ। গাছতলায় চরাট। চায়ের দোকানে মানুষের ভিড়। সব মিলিয়ে বোঝাই যাচ্ছে বহুদিনের ঐতিহ্য আছে এ গ্রামের। আর এই নারায়ণপুর ও বড়খানপুর গ্রাম থেকেই প্রথম নীল বিদ্রোহ শুরু হয়। ১৮৬০ অব্দে বনগাঁর জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের সাক্ষ্য অনুযায়ী কাঠগড়া কানসরণের অন্তর্গত ইলিশমারি কুঠির পার্শ্ববর্তী নারায়ণপুর, বড়খানপুর প্রভৃতি গ্রামেই প্রথম নীল চাষকে কেন্দ্র করে গোলমাল আরম্ভ হয়। নীল বুনবে না বলে রায়তেরা (চাষীরা) আপত্তি করেন এবং বাগ্দা থানার লোকের ওপর আক্রমণ করেন।
বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসকে খুঁজছেন এই জন্য যে, এই বিশ্বাসদ্বয়ই সেই বিদ্রোহের জনক। এই মহান বীর স্বাধীনচেতা নায়কদ্বয়ের ভূমিকা সম্পর্কে প্রয়াত অধ্যাপক সতীশচন্দ্র মিত্র তাঁর বিখ্যাত ‘যশোর-খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-“যশোহরের অন্তর্গত চৌগাছা গ্রামে বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস বাস করিতেন। তাঁহারা পূর্ব্বে নীলকুঠির দেওয়ান ছিলেন। কিন্তু কুঠিয়ালদিগের অত্যাচার দেখিয়া তাঁহাদের হৃদয় কাঁদিয়া উঠিল; তাঁহারা কার্য্যে ইস্তাফা দিয়া প্রজার পক্ষে দণ্ডায়মান হইলেন, গ্রামে গ্রামে ঘুরিয়া প্রকৃত অবস্থা বুঝাইয়া দিয়া প্রজাদিগকে উদ্রিক্ত করিয়া তুলিলেন। বহ্নি অনেক দিন হইতে ধুমায়িত হইতেছিল, কিন্তু এই চৌগাছা হইতে উহা সর্ব্বপ্রথম জ্বলিল। ... দুই বৎসরের মধ্যে এই বহ্নি সমস্ত দেশ জ্বালাইয়া দিল। বিশ্বাস দিগের কিছু সঙ্গতি ছিল; যাহা ছিল সব এই পাছে ব্যয় করিলেন। প্রজার ‘জোট’ ভাঙ্গিবার জন্য নীলকরেরা ক্ষেপিয়া গেল; বিশ্বাসেরা বরিশাল হইতে লাঠিয়াল আনিলেন, দেশের লোককে লাঠি ধরাইলেন; বঙ্গের মানসম্ভ্রম রক্ষার উপাদানরূপে লাঠি আবার উঠিল। নীলকরের হাজার লোক আসিয়া বিষ্ণুচরণের বিদ্রোহী গ্রাম সহসা আক্রমণ করিল, কত রক্তপাত হইল, কিন্তু বিশ্বাসদিগকে ধরিতে পারিল না। তাঁহারা রাত্রির অন্ধকারে গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে ঘুরিতেন, গ্রামের পর গ্রাম জাগাইতে লাগিলেন। রায়তেরা কোন নীল বুনিলেন না, দেড় বৎসর মধ্যে কাঠগড়া কারবার বন্ধ হইয়া গেল, আর খুলিল না। নিঃস্ব প্রজার নামে নালিশ হইলে উহারা দুই জনে তাঁহার জরিমানা বা দাদনের টাকা এবং মোকদ্দমার খরচা দিতেন, কেহ জেলে গেলে তাঁহার পরিবার পালন করিতেন। এইরূপে তাঁহারা সর্বশান্ত হইলেন। হিসাব করিয়া দেখিলেন, তাঁহার সর্ব্বসব ১৭ হাজার টাকা। টাকা সামান্য বটে, কিন্তু টাকার অনুপাতে অনুষ্ঠিত কাজের মূল্য অনেক বেশী।”
প্রয়াত ইতিহাসবিদ সুপ্রকাশ রায় তাঁর ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-‘নীল বিদ্রোহের দুই জন বিখ্যাত নায়ক-বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস ছিলেন যশোহরের চৌগাছা গ্রামের অধিবাসী। তাঁহাদের উভয়েই পূর্বে নীল কুঠির দেওয়ান ছিলেন। উভয়েই ধনী হইলেও মূলত ছিলেন কৃষক। তাই কৃষকদের উপর কুঠিয়ালগণের অমানুষিক উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করিয়া তাঁহাদের হৃদয় কাঁদিয়া উঠে। নীল চাষীদের মধ্যে বিদ্রোহের আগুন ধূমায়িত হইয়া উঠিতে দেখিয়া তাঁহারা নীল কুঠির দেওয়ানী কার্য ত্যাগ করেন এবং বিদ্রোহ সংগঠিত করিবার উদ্দেশে একান্তভাবে আত্মনিয়োগ করেন।
সুপ্রকাশ রায় মহাশয় শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘বঙ্গিম-জীবনি’ থেকে উদ্ধৃত করে বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাস সন্বন্ধে লিখেছেন, “কত ওয়াট টিলর (১৩৮১ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের দাস বিদ্রোহের প্রধান নায়ক এবং নিজেও ছিলেন একজন ভূমিদাস), হ্যামডেন (পিম হ্যামডেন ছিলেন ১৬৪২-৪৮ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবের অন্যতম নায়ক এবং বিপ্লবের প্রধান নায়ক ওলিভার ক্রমওয়েলের সহকর্মী), ওয়াশিংটন (মার্কিন জাতির পিতা এবং ১৭৮৯-১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন) নিরন্তর বাংলায় জন্মগ্রহণ করিতেছেন-ক্ষুদ্র বনফুলের মত মনুষ্য নয়নান্তরালে ফুটিয়া ঝটিকাঘাতে ছিন্নভিন্ন হইতেছে, আমরা তাহা দেখিয়াও দেখি না-আমরা তাহার চিত্র তুলিয়া রাখি না; কেননা আমরা ইতিহাস লিখিতে জানি না-সবে চিত্র আঁকিতে শিখিতেছি। ... বাঙালী মার খাইয়া অবশেষে মারিবার জন্য বুক বাঁধিয়া দাঁড়াইল। একখানি ক্ষুদ্র গ্রামের দুইজন সামান্য প্রজা (চৌগাছা গ্রামের বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর এই দুই স্বার্থত্যাগী মহাপুরুষ বাংলার নিঃস্ব সহায়শূন্য প্রজাদের একপ্রাণে বাঁধিল-সিপাহী বিদ্রোহের সদ্য নির্বাপিত আগুনের ভষ্মরাশি লইয়া গ্রামে গ্রামে ছড়াইতে লাগিল। পরিণামে, তাঁর ধনসম্পদ নিঃশেষিত হয়ে যায় এবং একজন নিঃস্ব দরিদ্র হিসেবে তিনি (দিগম্বর) মৃত্যুবরণ করেন। অবশেষে সরকারীভাবে ১৮৬৮ সালে নীল চুক্তি আইন রদ করা হয় এবং এ বিদ্রোহের সফল পরিণতি ঘটে।
এরপরে যে বক্তব্য প্রশ্ন হয়ে আসে তা হলো এ দেশে তো কম কৃষক বিদ্রোহ হয়নি-কম রক্তে মাটি এত উর্বর হয়নি-আর সব বিদ্রোহেই ছিল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নেতৃত্ব এবং কোন যুদ্ধই নিছক গোলমাল নয় এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই মনুষ্য সমাজ ঋণী হয়ে যায় এভাবেই সভ্যতার উৎকর্ষ সাধিত হয়; তাহলে বাংলার এত ব্যাপকতর কৃষক বিদ্রোহের মধ্যে নীল বিদ্রোহকে কেন নতুন করে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে?
এ প্রশ্নের উত্তরে ব্লায়ার বি. কিং (অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, আরবানা, শ্যাম্পেন, যুক্তরাষ্ট্র) তার ‘নীল বিদ্রোহ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘... কারণ এই বিদ্রোহ সমকালীন কলকাতা সমাজের কল্পনাকে নাড়া দিয়েছে। নীল চাষীদের দুঃখ-কষ্ট কলকাতার মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উঠতি রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্য একটি আদর্শ সুযোগ এনে দেয়। কলকাতার বাবু শ্রেণী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে নারাজ, কারণ তারা সবাই নানা সুবিধার জন্য সরকারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ইউরোপীয় প্রাইভেট স্বার্থগোষ্ঠির সমালোচনা করতে বাধা নেই। অতএব ধনী জমিদার থেকে শুরু করে শিক্ষক, সাংবাদিক সবাই ইউরোপীয় নীলকরদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করার প্রয়াস পায়।’ এমনকি ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করেই। নীলকর বিরোধী আন্দোলনে দেশী জমিদারদের অত্যাচার চাপা পড়ে যায়। অতএব সাময়িককালের জন্য জমিদার বিরোধী মনোভাব দূরীভূত হয়। কিন্তু অচিরেই কৃষকদের আন্দোলন জমিদারদের বিরুদ্ধে ধাবিত হয়। কৃষক-বিক্ষোভ সহিংসতায় রূপ নেয় ১৮৭০ এর দশকে। উল্লেখ্য, হিন্দু পেন্ট্রিয়ট পত্রিকা ছিল নীল বিদ্রোহের সময় কৃষকের পক্ষে। এর মফস্বল সংবাদদাতা শিশির কুমার ঘোষ (ঝিকরগাছার পলুয়া মাগুরার বর্তমানে অমৃতবাজার নামে চিহ্নিত অধিবাসী ছিলেন; তাঁর অন্য নাম ছিল নম্মাথলাল ঘোষ) রায়তের দুর্দশার ওপর তখন অনেক মর্মস্পর্শী খবর পরিবেশন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি নিজে এখন (তখন) ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার মালিক ও সম্পাদক। সত্তর দশকের কৃষক বিক্ষোভে কৃষকের বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন, অর্থাৎ নীল বিদ্রোহের প্রতি কলকাতার বাবু শ্রেণী যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে, তা ছিল অনেকাংশে নেতিবাচক। ইউরোপীয় শাসনের বিরুদ্ধে পরোক্ষ প্রতিবাদ জানানোর সুযোগ আসে নীল বিদ্রোহের মাধ্যমে। ইউরোপীয় সাহিত্য পাঠলব্ধ আদর্শবাদ নিয়ে তারা উৎপীড়িত রায়তের পক্ষ অবলম্বন করে। দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ নাটক ছিল সে আদর্শবাদেরই বহিঃপ্রকাশ।
সেদিন যে আদর্শ উদয়ের পথে উঁকি দিয়েছিল, সে আদর্শ ছিল সুপ্ত জাতীয়তাবাদেরই আদর্শ। বাঙালী জাতীয়তাবাদের বীজ উপ্ত করে নীল বিদ্রোহ। নীল বিদ্রোহের সময় বিরাজিত সকল শ্রেণীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলন আসলে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিবিধ উপাদানের সংমিশ্রণে গঠিত এবং এই সংমিশ্রণ থেকে কোন উপাদানকে আলাদা করে দেখা খুবই কঠিন। অধ্যাপক রমেশচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়, ‘... পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধী যে রূপ অসহযোগ আন্দোলন করেন বাংলার নীল চাষীদের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ (Passive Resistance) তাহার পূর্বাভাস বলা যাইতে পারে।
এ বক্তব্যের সত্যতা মেলে তৎকালীন সময়ের নীলকর হার্সেল এর কথা থেকে। বিদ্রোহের গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে তিনি কলকাতার এক এজেন্টকে লিখেন : “আমার বিশ্বাস, এমনতরো ঐক্য সংহতি বাংলার কৃষক-সমাজ ইতিপূর্বে কখনো প্রদর্শন করেনি। বাঙালীর অনৈক্য সম্পর্কে বাঙালীদের মধ্যে অনেক প্রবাদ-প্রবচন প্রচলিত আছে। আমি নিজের কানে এদের বহুবার বলতে শুনেছি যে বাঙালীদের মধ্যে ঐক্যের বড় অভাব, কিন্তু এখন কোন ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে এক গ্রামের রায়তরা মামলা রুজু করলে বা কোন দাঙ্গা শুরু করলে অন্য গ্রামের লোকেরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের প্রতি সংহতি ঘোষণা করে এবং সংগ্রাম তহবিলে চাঁদা দেয়।”
হার্সেল কৃষক ঐক্য সম্পর্কে আরো রিপোর্ট দেন যে, নীলকর কোন রায়তের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা রুজু করলে তার পক্ষে সকল কৃষক সাক্ষ্য প্রদান করে এবং তারা শুধু তার অনুকূলে সাক্ষ্যই দেয় না, তার মামলার খরচ বহন করতে পর্যন্ত এগিয়ে আসে। কোন প্রজার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষী পাওয়া অসম্ভব। ... নীলখেদাও আন্দোলনে কৃষকরা সামাজিক প্রতিষ্ঠানাদিকেও কাজে লাগায় এবং নীলকরদের দেশী গোমস্তা, পাইক-পেয়াদাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করে তাদের প্রভুপ ত্যাগ করে জনসাধারণের কাতারে এসে দাঁড়াতে বাধ্য করত। নীলকরদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের সামাজিক বিধি-নিষেধ প্রয়োগ করা হয়। যেমন, নাপিত তাদের চুল কাটবে না, ঘটক তাদের বিয়ের ঘটকালি করবে না, তাদের সামাজিক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ করা হবে না। এমনকি তাদের সঙ্গে ধুমপান পর্যন্ত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। তাদের সঙ্গে কেনাকাটা, বাণিজ্যিক লেনদেন সবই ছিল নিষিদ্ধ। এই সামাজিক অবরোধে হিন্দু-মুসলমান ছিল সম্পূর্ণ একতাবদ্ধ।
নীল বিদ্রোহ আরো যে কারণে গুরুত্বপূর্ণ তা জানা যায় প্রয়াত নরহরি কবিরাজের ভাষায়। তিনি তার "স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙলা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন-১৮৫৯-৬০ সালেই নীল কৃষকরা যে প্রথম নীলকরদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তা নয়। এর পূর্বেও মাঝে মাঝেই নীলকর ও নীল চাষীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধত।
তবে ১৮৫৯-৬০ সালে নীলচাষীদের প্রতিরোধ যেমন ব্যাপক ও চরম আকার ধারণ করেছিল ঠিক তেমনটি এর পূর্বে কখনও হয়নি। এই বিদ্রোহের নেতা ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাষীরা নিজেরাই। (যদিও) নদীয়ার চৌগাছায় বিদ্রোহের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন বিশ্বাস ভ্রাতৃদ্বয়-বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাস। (আসলে) হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সমস্ত নীলচাষীই এই বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিল। (যেমন) মালদহে নীলচাষীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ফারাজী নেতা রফিক মণ্ডল।
এই বিদ্রোহ নীলকরদের অত্যাচার সম্পর্কে জনগণকে এতই সচেতন করে তুলল যে বিদেশীদের একাংশের ইচ্ছা না থাকলেও জাগ্রত জনমতের চাপে নীলচাষের ব্যবস্থাটিকে নিন্দা করা ছাড়া আর তাদের উপায় রইল না। এমনকি বাধ্য হয়েই ‘... সারজন পিটার গ্র্যান্ট মহাশয় বঙ্গেশ্বর রূপে এ দেশের শাসনভার হস্তে লয়েন। এবং অবশেষে ‘... ইন্ডিগো কমিশন’ নামে নীলকরকৃত অত্যাচরের সত্যাসত্য নির্ধারণের নিমিত্ত এক কমিশন নিযুক্ত করেন। ... এবং প্রকাশ্যভাবে নীলকর ব্যাপারের তদন্ত আরম্ভ করেন। তিন মাসব্যাপী কমিশন সর্বসম্মত ১৩৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন। তন্মধ্যে ১৫ জন গভর্নমেন্ট কর্মচারী, ২১ জন নীলকর, ৮ জন মিশনারি, ১৩ জন জমিদার এবং ৭৭ জন রায়ত বা প্রজা। এ সময় ‘মিস্টার টাওয়ার (E.W.L Tower) নামক একজন ম্যাজিস্ট্রেট সরকারি নীল তদন্ত কমিশনে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় বলেছিলেন : “আমি স্বচক্ষে দেখিয়াছি কয়েকজন রায়তকে বর্শা দ্বারা বিদ্ধ করা হইয়াছে। অন্য কয়েকজনকে গুলি করিয়া মারা হইয়াছে। আর কয়েকজনকে প্রথমে বর্শায় বিদ্ধ করিয়া পরে গুম করা হইয়াছে।”
এদিকে যখন কমিশন প্রজাগণের সাক্ষ্য গ্রহণ করছিলেন তখন সদাশয় বঙ্গেশ্বর গ্র্যান্ট মহোদয় কার্যাকর ব্যাপদেশে নদীয়া ও যশোহর মধ্যে প্রবাহিনী “কুমার” ও “কালীগঙ্গা” দিয়া স্টিমার আরোহণে গমন করিতেছিলেন। তিনি বলেন “তখন নদী তীরে দলে দলে প্রজাগণ সমবেত হইয়া আর নীল বুনিবনা আপনি অনুমতি করুন এই কাতর প্রার্থনা উপস্থিত করে।” তিনি তাঁর রিপোর্টে উল্লেখ করেন-‘বাংলার প্রজা ক্রীতদাস নহে, পরন্ত প্রকৃতপক্ষে জমির স্বত্বাধিকারী তাহাদের পক্ষে এইরূপ ক্ষতির বিরোধী হওয়া বিস্ময়কর নহে। যাহা তিজনক তাহা করাইতে গেলে অত্যাচার অবশ্যম্ভাবী, এই অত্যাচারের আতিশয্যই নীল বপণে প্রজার আপত্তির মুখ্য কারণ।”
অবশেষে ... ‘কমিশন নীলকরগণের বিরুদ্ধে অভিযোগসমূহের অধিকাংশ স্বীকার করিতে বাধ্য হন এবং স্পষ্টভাবে নির্দেশ দান করেন যে, “নীলকরদিগের ব্যবসা-পদ্ধতি উদ্দেশ্যও পাপজনক, কার্যত ক্ষতিকারক এবং মূলত ভ্রমসঙ্কুল।”
নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে শাহরিয়ার ইকবাল তার ‘নীল বিদ্রোহ’ গ্রন্থে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকা’র ১৮৭৪ সালের ২২ মে সংখ্যায় শিশির কুমার ঘোষের উদ্ধৃতি উল্লেখ করে লিখেছেন, “নীল বিদ্রোহই সর্বপ্রথম এ দেশের লোককে রাজনৈতিক আন্দোলনে সংঘবদ্ধ হইবার প্রয়োজনীয়তা শিক্ষা দিয়াছিল।” নীল বিদ্রোহের আগেও বাংলাদেশে ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’, ‘ওয়াহাবী বিদ্রোহ’, ‘তীতুমিরের বিদ্রোহ’ ও ‘ফরাজী বিদ্রোহ’ হয়েছিল এবং বাংলার জনসাধারণকে আলোড়িত করেছিল। তবে বাংলাদেশের সকল বিদ্রোহের মধ্যে নীল বিদ্রোহ সামাজিক গুরুত্বে, ব্যাপকতর সংগঠনের দৃঢ়তায় ও পরিণতিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছিল।
নীল বিদ্রোহ বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধতার মন্ত্রে নতুনভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রামে অনুপ্রাণিত করেছিল।
নীল বিদ্রোহ প্রমাণ করল যে কৃষক সংগ্রামের নেতৃত্ব, সংগ্রামের মধ্যে থেকে গড়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এমন ব্যাপক ও বিস্তৃত বিদ্রোহকে নির্দিষ্ট কোন নেতৃত্ব দিয়ে পরিচালনা সম্ভব ছিল না। তাই বিভিন্ন স্থানে সাধারণ কৃষকের মধ্যে থেকেই প্রয়োজন মতো নেতা তৈরি হয়েছিল। কোন একজন স্থানীয় নায়ক নিহত আহত বা কারারুদ্ধ হলে শত শত কৃষক সেই শুন্যস্থান পূরণ করেছিল। মধ্যবিত্ত সমাজ যখন ইংরেজের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত, সেই সময়ে উৎপীড়িত নীলকৃষক সমাজ এককভাবে জাতীয় সংকট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিল। এই জন্য নীল বিদ্রোহকে বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় রাজনৈতিক সংগ্রাম বলা যায়। সুপ্রকাশ রায়ের মতে, নীল বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে বাংলার কৃষক পরাধীন বাংলাদেশে তথা ভারতবর্ষের কাছে এক নতুন ঐতিহাসিক আদর্শ স্থাপন করেছিল।
আর সে কারণেই নীল বিদ্রোহ স্বাধীনচেতা বাঙালীর অস্তিত্বের অহংকার। বাঙালীকে বাঙালী জাতি হয়ে গড়ে ওঠবার প্রয়োজনে তার সম্পূর্ণ বিকাশের পূর্ব পর্যন্ত এ অহমবোধ তাকে স্বযতনে লালন করতে হবে। যতক্ষণ সে ইতিহাসের এই আড়াই হাত (গ্রাম বাংলার লোককথা-তালগাছের আড়াই হাত) অতিক্রম না করতে পারছে-আর যাই হোক, মানুষ সমাজে মানুষ সৃষ্ট শোষণের হিমালয় উচ্ছেদের পবিত্র যুদ্ধে সে কখনো শরিক হতে পারবে না। সম্ভবত সে কারণেও আজ কেবলমাত্র অতীত আঁকড়ে পড়ে থাকার জন্য নয় বরং এক অনাগত সুন্দর আগামীর বিনির্মাণে ভূমিকা রাখতে বড় বেশি প্রয়োজন অনেক অনেকবার পেছন ফিরে দেখা। বোধহয় সে কারণেই আমাদের যেতে হবে চৌগাছায়। জানতে হবে বিশ্বাস ভ্রাতৃদ্বয়কে। সতীশচন্দ্র মিত্র মহাশয়ের ভাষায় : “শুধু চৌগাছার বিশ্বাসেরা নহেন, দেশ মধ্যে এমন অনেক লোকের আবির্ভাব হইয়াছিল। এই বিদ্রোহ স্থানিক বা সাময়িক নহে, যেখানে যতকাল ধরিয়া বিদ্রোহের কারণ বর্তমান ছিল, সেখানে ততকাল ধরিয়া গোলমাল চলিয়াছিল। উহার নিমিত্তে যে কত গ্রাম্যবীর ও নেতার উদয় হইয়াছিল, ইতিহাসের পৃষ্ঠায় তাঁহাদের নাম নাই। কিন্তু তাঁহাদের মধ্যে অনেকে অবস্থানুসারে যে বীরত্ব, স্বার্থত্যাগ ও মহাপ্রাণতার পরিচয় দিয়াছিলেন, তাহার কাহিনী শুনিবার ও শুনাইবার জিনিস। যাহারা তাহার চাক্ষুষ বিবরণ দিতে পারিতেন, আজ ৬৪ বৎসর (সতীশচন্দ্র মিত্রের সময় ৬৪ বৎসর কিন্তু বর্তমান থেকে ১৩৮ বৎসর) পরে তাঁহাদের অধিকাংশ কাল-কবলিত। এখনও গল্পগুজবে যাহা আছে, শীঘ্রই তাহা লুপ্ত হইবে। প্রাচীন যশোহরের মানচিত্রে কত শত গ্রামে নীলকুঠির চিত্র আছে, এখনও উহার অনেক ভগ্নস্তুপ ইমারতের গায়ে বা রাস্তার খোয়ায় আত্মগোপন করে নাই। ঐ সকল কুঠির তিরোভাবের সঙ্গে কিছু ঐতিহাসিকতা বিজড়িত আছে। হয়ত উহাদের পার্শ্ববর্তী ক্ষেত্র সকল একদিন যোদ্ধার রক্তে রঞ্জিত হইয়াছিল। কিন্তু কে আজ সেই যুদ্ধক্ষেত্রের তালিকা নির্ণয় করিবে? লড়াই তো অনেক হইয়াছিল, আজ কয়জনে তাহার খবর রাখে।”
বোধহয় সে কারণেই আমরা রক্ত ব্যয় করেছি ঢের কিন্তু অর্জিত মূল্য শেষ পর্যন্ত ধারণ করতে পারিনি। বোধহয় সে কারণেই আজও আমরা জাতি হয়ে উঠতে পারিনি; স্বাধীন তো সুন্দার-বোধহয় মনে রাখা দরকার কেবল মাত্র ঢাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভাস্কর্যের হাট বসালে আত্মমর্যাদাবান জাতি বিনির্মাণ হবে না বরং ভাস্কর্যকে নিয়ে যেতে হবে সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে-রক্তমাখা জমিনে। এ কাহিনীকে নিয়ে যেতে হবে-পৌঁছে দিতে হবে প্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি পরিবারে। আর নারায়ণপুর গ্রামের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আব্দুস সাত্তারের কাছে যে বলে, ‘বলা গাড়ি নীল কুঠিতি পাঞ্জাবিরা নীল চাষ করত’। আর ঐ গ্রামের আব্দুল মাবুদ বিশ্বাস (৫০) ও দুদু (৫০)-র কাছে যারা দেশের গড় আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে অথচ জীবনে নাম শোনেনি বিষ্ণুচরণ ও দিগম্বর বিশ্বাসের। হয়তোবা তাহলেই ঋণ শোধ হবে, আর আমরা পৌঁছবো ভবিষ্যতে।
তথ্য সূত্র : প্রকাশিত গদ্য
লেখক : বেনজিন খান
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)