
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > বিপ্লবী বাঘা যতীন / Bagha Jatin- Revolutionary (1879-1915)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100236 বার পড়া হয়েছে
বিপ্লবী বাঘা যতীন / Bagha Jatin- Revolutionary (1879-1915)

বিপ্লবী বাঘা যতীনের (Bagha Jatin) হলদিঘাট বুড়ি বালামের তীরের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম রচনা করেছিলেন -
“বাঙালির রণ দেখে যা তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট।”
নবভারতের হলদি ঘাট বুড়ি বালামের তীরে যে সংগ্রামের কথা কবি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন. তার সেনাপতি ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (Jatindranath Mukherjee), যিনি বাঘা যতীন নামেই সমধিক পরিচিত। বাঘা যতীন এবং তাঁর অনুসারীরা মারণাস্ত্র হাতে উল্লেখিত জীবনমরণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯১৫ সালে। তাঁরা ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে একসঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জাতির ইতিহাসে সেই কাহিনী স্বর্ণক্ষরে লেখা আছে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন-Bagha Jatin) বাংলার বারভূঁইয়াদের অন্যতম যশোরের রাজা মহারাজ প্রতাপাদিত্যের বংশধর ছিলেন।
বাঘা যতীনের জন্ম হয় (Bagha Jatin) ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মামা বাড়ী কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার রিসখালী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম উমেষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম শরৎশশী দেবী। ঝিনাইদহ জেলায় পৈত্রিক বাড়িতে তাঁর ছেলেবেলা কাটে। ৫ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। মা এবং বড় বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়াগ্রামে চলে যান।
অল্পবয়সেই পিতৃহারা হয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। বিধাব মা শিশু যতীন্দ্রনাথ ও জ্যেষ্ঠ কন্যা বিনোদবালাকে নিয়ে কুষ্টিয়ায় কয়া গ্রামে পিতার বাড়িতে যেয়ে ওঠেন। তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল মাতা শরৎশশী। পরোপকার বৃত্তি, দুঃশাসন ও অন্যায় প্রতিরোধ করার শিক্ষা যতীন্দ্রনাথ মায়ের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন।
বাঘা যতীনের (Bagha Jatin) মা ছিলেন বাঘিনী। গ্রামের পাশেই গভীর নদী। তিনি বালক যতীন্দ্রনাথকে স্নান করাতে যেয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নিজেই সাঁতরে গিয়ে নিয়ে আসতেন। এভাবে সাঁতার শিখে যতীন্দ্রনাথ একদিন বর্ষার ভরা নদী সাঁতরে পার হবার সাহস ও শক্তি অর্জন করেছিলেন। বাঘিনী মায়ের শিক্ষাতেই গড়ে উঠেছিলেন দেশপ্রেমিক যতীন্দ্রনাথ, বিপ্লবী বাঘা যতীন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যতীন্দ্রনাথের শক্তি সাহস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও মন ছিল স্নেহ, মায়া-মমতায় ভরা। কারো উপকার করতে পারলে নিজেকে তিনি ধন্য মনে করতেন। তাঁর পরোপকারের বহু ঘটনা আজো কিংবদন্তীর মতো হয়ে আছে।
বাঘাযতীন নামকরণ:
যতীন্দ্রনাথের ‘বাঘা যতীন’ নামটি কে দিয়েছিলেন তা জানা যায় না। কিন্তু নামকরণের ইতিহাসের সঙ্গে নামটিও অমরত্ব লাভ করেছে।
একবার কয়াগ্রামে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। সেই সময় গ্রামে বাঘের খুব উৎপাত ছিল। একদিন গ্রামবাসীরা বাঘের আস্তানায়
হানা দিল। গ্রামবাসী বাঘটি মারার জন্য চেষ্টা করছিল। তাদের সাথে বন্দুক হাতে আছেন যতীন্দ্রনাথের এক জ্ঞাতি ভাই। খবর শুনে যতীনও ভিড়ে গেলেন বাঘ শিকারীদের দলে। এজনের হাতে শুধু বন্দুক। আর যার যার হাতে লাঠি, বল্লম আর দা। যতীনের হাতে এসবের কিছুই নেই। তাঁর হাতে শুধু পেন্সিল কাঠার ছুরি। ওটা নিয়েই যতীন বাঘ শিকারীর দলে শামিল হলেন।
হঠাৎ বাঘ দেখা গেল। তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলো। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সেই গুলি। বাঘটা গেল ক্ষেপে। ক্রুদ্ধ বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়লো যতীন্দ্রনাথের উপর। কিন্তু যতীন ঘাবড়ে যাবার ছেলে নন। তিনি তাঁর হাতের পেন্সিল কাটার ছুরি দিয়েই বাঘের সাথে লড়াই করে যেতে লাগলেন। বাঘকে ক্ষত-বিক্ষত করতে করতে নিজেও ক্ষত-বিক্ষত হলেন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। ছুরির ঘা মেরেই একসময় বাঘকে পরাস্থ করলেন। শেষ করে দিলেন তার জীবনলীলা। এই দুঃসাহসিক অভিযানের পর থেকে তিনি বাঘা যতীন নামে অভিহিত হলেন।
এরপরেও আরেকবার তাঁকে বাঘিনীর মুখে পড়তে হয়েছিল। সেবার গুলি করে বাঘিনী মেরে তার তিনটি শাবককে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
কয়া গ্রামের এক প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হলেও বাঘা যতীনের সত্যিকার শিক্ষাজীবন শুরম্ন হয় কৃষ্ণগ্রামের মামার বাড়িতে এসে। এখানেই তিনি স্কুলের শিক্ষাজীবন শুরম্ন করেছিলেন। পড়াশোনার চেয়ে নানান খেলা, শরীরচর্চা প্রভৃতিতেই ছিল তাঁর বেশী উৎসাহ। স্থানীয় স্কুলে পড়ার সময় একদিন একটি পাগলা ঘোড়াকে কব্জা করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
যতীন্দ্রনাথের বড় মামা বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণনগরে ওকালতি করতেন। তিনি কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতেই থাকতেন। ১৮৯৮ সালে যতীন্দ্রনাথ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে কোলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু কলেজের তাঁর বেশীদূর অগ্রসর হলো না। তিনি পড়া ছেড়ে দিয়ে স্টেনোগ্রাফি শিক্ষা করতে লাগলেন। পরে বাংলা সরকারের সেক্রেটারী হুইলার সাহেবের স্টেনোগ্রাফার হন। এইভাবে শুরু হলো তাঁর কর্মজীবন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে যতীন্দ্রনাথ:
কিশোর বয়স থেকেই যতীন্দ্রনাথের মনে পরাধীনতার গ্লানি, দাসত্বের অপমান গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি বুঝতে পারলেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো পরাধীনতা। কি করে দেশ স্বাধীন করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার পথ করা যায়। এই চিন্তা যতীন্দ্রনাথকে সংগ্রামের পথ, বিপ্লবের পথের সন্ধান দেখিয়েছিল।
১৯০৫ সালে দেশব্যাপী শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিলেন যতীন্দ্রনাথ নিজে। তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করলেন। এইভাবে স্বাধীনতার বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। এই সময় থেকে যতীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট জীবন হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রামের ইতিহাস। কলকাতায় অবস্থানকালে একসময় সহকর্মীদের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় কলকাতা সার্কুলার রোডের ঘাঁটি, ইস্ট ক্লাব ছেড়ে সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের মেস বাড়িতে চলে যান। এখান থেকেই তিনি বিদ্যাভূষণের সাথে একত্রে রাজনৈতিক কার্য চালিয়ে যেতে থাকেন। যোগেন্দ্রনাথ, বিদ্যাভূষণ, ম্যাটসিনি এবং গ্যারিবল্ডির জীবনী বাংলায় অনুবাদ করেন। এ বাড়িতেই স্বামী বিবেকানন্দ যাতায়াত করতেন। যতীন্দ্রনাথকে অরবিন্দ ঘোষ খুবই শ্রদ্ধা করতেন। যতীন্দ্রনাথ ও বারীন্দ্রনাথ ঘোষের অনুরোধেই অরবিন্দ ১৯০৩ সালে কলকাতা আসেন। যোগেন্দ্রনাথের এই বাড়িতেই যতীন্দ্রনাথের সাথে শ্রী অরবিন্দ অবস্থান করতেন। যোগেন্দ্রনাথের পুত্র শচীন্দ্রনাথ যতীন্দ্রনাথকে অরবিন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যতীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রভান্ডার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ছিলেন কার্তিক দত্ত, পবিত্র দত্ত, ইন্দ্রনাথ নন্দী, নিখিলেশ্বর রায় মৌলিকসহ আরো অনেকে।
১৯১০ সালে আলীপুর বোমা হামলা মামলার তদনত্মকারী বিখ্যাত সিআইডি অফিসার মৌলভী শামসুল আলমকে গুলি করে হত্যা করে বীরেন্দ্র দত্ত গুপ্ত নামে এক যুবক। পরে বীরেন্দ্র ধরা পড়লে পুলিশ জানতে পারে এই হত্যাকান্ডের নেপথ্য নায়ক আসলে যতীন্দ্র। এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশ যতীন্দ্রনাথকেও গ্রেফতার করে। পুলিশ নানা প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে কোন রকম স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পেরে তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান দেওয়া হয়। যতীন্দ্রনাথ ও আরও কয়েকজন বিপ্লবীকে জড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে মামলা করেছিলেন তা ‘হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত।
হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা ১৯১০ সালে মার্চ মাসে শুরু হয়ে ১৯১১ সাল এপ্রিল মাসে শেষ হয়। এক বছর জেলে থাকার পর প্রধান বিচারপতি জেঙ্কিন্সের বিচারে অভিযুক্তগণ সকলেই নিরপরাধী সাব্যস্ত হন। হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলার সাথে জড়িত হওয়ার ফলে যতীন্দ্রনাথের নাম সরকারের বিরাগভাজন ব্যক্তিদের তালিকায় উঠে গেল। ফলে তিনি মিঃ হুইলারের অধীন চাকরিটি হারালেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি জেলা বোর্ডের কন্ট্রোলারের কাজ নেন। এই কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির সময় তিনি বুঝতে পারলেন, সরকারী গুপ্তচরেরা তাঁকে সর্বদা পর্যবেক্ষণ করছে। এতে তিনি অস্বস্তির চেয়ে বিরক্ত হলেন বেশী।
এক সময় বাঘা যতীনের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর এলাকায় যাতায়াত করতে হতো। এই সুযোগে তিনি ইংরেজ বিরোধী একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন। যশোরের নলডাঙ্গা বলরামপুরে তিনি বিপ্লবের কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করেন। বহু তরুণ তাঁর দলে যোগ দিতে থাকে। এই বিপ্লবী দল বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ নিধন অভিযান কৃতিত্বের সাথে সম্পাদন করে।
ইংরেজদের উপর ছিল তাঁর মর্মান্তিক বিতৃষ্ণা। কারণ যে কোন ইংরেজই এদেশীয়দের উপর অত্যাচার করতো। ফলে দিনে দিনে তাঁর ইংরেজদের প্রতি বিতৃষ্ণা, ঘৃণা
ও বিদ্বেষ বেড়ে যায়। একবার ফোর্ট উইলিয়ামের কাছে গোরাবাজারে অন্যায় কাজের জন্য এক গোরা সৈন্যকে বেধড়ক পিটুনি দিয়েছিলেন। আর একবার সরকারী কাজে দার্জিলিং যাবার পথে এক স্টেশনে কয়েকজন ইংরেজ সৈন্যের সাথে তাঁর খুবই মারামারি হয়েছিল। বলাবাহুল্য অসম্ভব দৈহিক শক্তির অধিকারী যতীন্দ্রনাথ গোরা সৈন্যদের চূড়ান্ত পর্যায়ে লাঞ্চিত করেছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ জাতীয় মর্যাদার প্রতি সর্বদা সচেতন ছিলেন। এসব কারণেই তিনি জাতীয় জীবনের সকল মান-অপমানকে নিজের মান-অপমান বলে গ্রহণ করতে শিখেছিলেন। সেইজন্য তাঁর সমগ্র সত্তা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করার জন্য। উত্তরকালে এই উদ্দেশ্যেই তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, সন্ধ্যা প্রভৃতি বিপ্লবী দলগুলোর সংস্পর্শে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতিতে কাজ করতে থাকেন। আলীপুর বোমা মামলায় যখন বহু বিপ্লবী অত্নরীণ ছিলেন তখন যতীন্দ্রনাথের উপরই অবশিষ্ট দলগুলোর ভার পড়েছিল।
বাংলার গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজদেরকে মাতৃভূমি ভারত থেকে উৎখাত করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান গড়ে তোলার প্রয়োজন। এই কাজের জন্য বাংলার স্বাধীন বিপ্লবী গ্রুপগুলোকে একত্রিত করা দরকার। আরো মনে হয়, অভ্যুত্থানের কাজে ইংরেজ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। এরপর থেকেই সেযুগের বাংলার বিপ্লবী চিন্তাধারা আন্তর্জাতিকমুখী করে গড়ে ওঠে। তিনি নিজেই বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে লাগলেন। এই সময় বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল্সে কাজ করতেন স্বদেশী ভাধারার এক তরুণ অবনী মুখার্জী। যতীন্দ্রনাথ এবার তাকেই কাছে টানলেন। বাংলার বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে সাহায্য করার জন্য তিনি তাকে জাপানে যেতে অনুরোধ করেন। তখন ব্যবসা ক্ষেত্রে জাপান ছিল বৃটিশ বিরোধী দেশগুলোর অন্যতম। তাই যতীন্দ্রনাথ বাস্তব বুদ্ধিবলে বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজ বিরোধী গুপ্ত আন্দোলনে হয়তো তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। যতীন্দ্রনাথের পরামর্শে অবনী মুখার্জী ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জাপান গেলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্যার্জনে তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। ফলে তাকে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়।
রক্তাক্ত বুড়ী বালামের তীর:
১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বেধে যায়। ইতোমধ্যে জার্মানীতে ভারতীয় ছাত্রদের উদ্যোগে জার্মান থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচারকার্য চালানোর জন্য “বার্লিন কমিটি” নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যতীন্দ্রনাথ আবার ১৯১৫ সালে অবনী মুখার্জীকে জাপানে রাসবিহারী বসুর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এইভাবে ক্রমাগত চেষ্টার ফলে চীনের নেতা সানইয়াং স্পেনের কাছ থেকে পাওয়া যায় ৫০টি পিস্তল, ৪৬ হাজার গুলি এবং বহু টাকা সাহায্য বাবদ পাওয়া গেল। দেশের নানা বিপ্লবী সংগঠনের মধ্যে এই অস্ত্র ও টাকা বন্টনকরে দেওয়া হয়।
বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানী করতে হলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। যতীন্দ্রনাথ সেই টাকার সুরাহা করেন স্বদেশী ডাকাতির মাধ্যমে। ইতোমধ্যে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন.রায়) ও যীতেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর যোগাযোগের ফলে জার্মান সরকার বিপ্লবীদের জন্য এক জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র এবং কিছু নগদ অর্থ পাঠিয়ে দিলেন। স্থির হয়েছিল বিদেশ থেকে আসা অস্ত্র সুন্দরবনে জাহাজ থেকে নামিয়ে একভাগ পাঠানো হবে বালেশ্বরে, একভাগ সন্দ্বীপ হাতিয়া অঞ্চলসহ বরিশাল পার্টির মাধ্যমে যাবে, অপরভাগ যাবে কোলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানপেড্রো বন্দর থেকে এস. এস. ম্যাভারিক নামে সমুদ্র জাহাজে অস্ত্র আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ‘ম্যাভারিক’ ও ‘অ্যানলুই’ জাহাজের নাম। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও ডাচেরা সাগর পাহারা দিচ্ছিল। ম্যাভারিক সম্পর্কে মিত্রশক্তি সন্দেহ করে। স্ট্যান্ডার অয়েল কোম্পানির তৈলবহনকারী জাহাজ ম্যাভারিক ধরাপড়া যখন অবধারিত তখন কাগজপত্র, অস্ত্রশস্ত্র তারা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে জাপান চলে যায়। সেখানে ডাচ লোকজনসহ জাহাজটি আটক হয়। এরপর জার্মানী আরো তিন জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। এ বিষয়ে যতীন্দ্রনাথের নির্দেশে সমস্ত যোগাযোগ করলেন রাসবিহারী বসু, ভগবান সিংহ ও অবনী মুখার্জী।
এবার ঠিক করা হয় অস্ত্রবোঝাই জাহাজ তিনটির একখানা বালেশ্বর এবং অপর দুইটি গোয়া ও রায়মঙ্গলের কাছে ভিড়বে। বালেশ্বরে যে জাহাজ এসেছিল তাতে ছিল ২০০ পিস্তল, প্রচুর কার্তুজ, হাতবোমা, বিস্ফোরক ও দুই লাখ টাকা। অন্য দুটি জাহাজেও ছিল অনুরূপ পরিমাণ অস্ত্র শস্ত্র। প্রথম জাহাজটি ১৯১৫ সালের ১৭ই নভেম্বর আন্দামানের কাছে এলে বৃটিশ রণতরী সেখানে হানা দেয়। সেখানে এক টুকরো কাগজ পায়। তাতে ‘কপ্তিপদার’ নাম লেখা ছিল। পরে তারা জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়।
প্রথম জাহাজে হানা দেয়ার সূত্র ধরে বালেশ্বরের সশস্ত্র পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ কিলবী, ডেনহাম, বার্ড, টেগার্ড, নীলগীরি রাজ্যে সশস্ত্র পুলিশ ও ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশসহ রাতারাতি কপ্তিপদার ডাকবাংলোয় গিয়ে পৌঁছে। কপ্তিপদায় অস্ত্র পাবার আশায় বাঘা যতীন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পূর্বেই চলে গিয়েছিলেন জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে, এসেছেন ঠিকাদার পরিচয় দিয়ে। তাঁরা সেখানে একটি আশ্রমও খুলেছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, নিরেন্দ্রনাশ ও জ্যোতিষচন্দ্র এই চারজন বালেশ্বরে জার্মান জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। যতীনকে ওখানকার জনগণ সাধু মনে করতো। তিনি গেরুয়া পরে থাকতেন। ইংরেজ সাহেবরা সৈন্যবাহিনীসহ হাতীতে চেপে ওখানে গিয়েছিল। হাতীর পিঠের ঘন্টা শুনে স্থানীয় লোকজন ‘দাদাদের’ খবর দিয়েছিল। বালেশ্বরের পুলিশ নিমাই, শৈলেশ্বর বোস, নারায়ণ ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করেছিল এবং সৈন্যবাহিনী নিয়ে বালেশ্বরের ম্যাজিস্ট্রেট কিলবী, ডেনহাম, বার্ড ও টেগার্ড অগ্রসর হচ্ছিল। ওদিকে বাঘা যতীন এম.এন রায়কে বাটাভিয়ায় পঠিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। কথা ছিল ওই সময় মালবাহী অস্ত্রসহ জাহাজ সুন্দরবনের পথে এসে যাবে। কিন্তু পথে বিপদ হওয়ায় ওদিক থেকে সে পরিকল্পনা ব্যার্থ হয় যা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে অন্য দুটো জাহাজ পথ ঘুরে মেক্সিকো উপসাগরের দিকে চলে যায়। বিপ্লবীরা সেখানে তারা অস্ত্রগুলো স্থানীয় জলদস্যুদের কাছে বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে আসে। যে ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এই মহৎ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল তার নাম কুমুদনাথ মুখার্জী। এই লোকটিই বিপ্লবীদের সমস্ত পরিকল্পনার কথা ইংরেজদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল।
এদিকে বাঘা যতীন তাঁর দল নিয়ে বালেশ্বরের তীরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং কপ্তিপদায় টেগার্টের ঘেরের মধ্যে পড়ে যায়। সাহেবদের দেখে যতীনের দল মহাবিপদ আঁচ করতে পেরে দলের সবাইকে সাবধান করে দেয়। সেখানে ছিল মনোরঞ্জন সেন ও চিত্তপ্রিয় চৌধুরী। নরেন দাস গুপ্ত ও যতীন ছিল আরো বার মাইল দূরে আরেকটি আড্ডায় তালডিহিতে। কপ্তিপদায় যিনি তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তার নাম মনীন্দ্র চৌধুরী। তার বাড়ি বিপ্লবীদের আস্তানার অল্পদূরে ছিল। বিপ্লবীরা থাকতেন একটি মুদিখানার দোকান ও আশ্রম কেন্দ্রে। যতীনদা পরতেন গেরুয়া। গ্রামবাসীদের বিপদ-আপদে সর্বপ্রকার সাহায্য করতেন। প্রকৃতিক উপায়ে বা হোমিওপ্যাথিক মতে রোগীদের সেবা ও চিকিৎসা করতেন। টিংচার আয়োডিন, কুইনাইন ব্যবহার করতেন। খুব অসহায় লোক হলে নিজেদের কাছে এনে চিকিৎসা করাতেন। নিরক্ষরদের পড়াতেন। গ্রামে আগুন লাগলে নিভানোর ব্যবস্থা করতেন। ঘটনার দিন একটি শয্যাগত রোগী তাঁদের আশ্রমে ছিল। যাবার সময় তাকে বলে গিয়েছিলেন, কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে যেন বলে বাবুরা পশুর পায়ের দাগ অনুসরণ করে জঙ্গলে শিকারের জন্য গেছেন।
বিপ্লবীরা সাহেবদের আগমন দেখে দূর থেকে বিপদ আঁচ করে মনীনদ্র চৌধুরীকে সাবধান করে দিয়ে সকাল বেলায় তালডিহির দিকে যাত্রা করলেন। যতীন ইচ্ছা করলে একা পালাতে পারতেন। কিন্তু নরেশ ও যতীশকে ফেলে তা হয় না। যতীন কাপুরুষ ছিলেন না। মনি বাবু যতীনকে মেঘাশনি পাহাড়ের নিকটে চলে যেতে বলেছিলেন।
৭ই সেপ্টেম্বর সকাল হতেই ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের মহকুমা হাকিম অক্ষয় কুমার চট্টোপাধ্যায়কে ডেনহাম ডেকে পাঠায়। ডেনহাম ছিল ভারত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী বড়কর্তা। ডেনহামের সাথে বিহারের গোয়েন্দা বিভাগের ডি.আই.জি Royland ছিল। একজন স্থানীয় লোককে পাঠানো হয়েছিল বিদেশী বাবুরা আশ্রমে আছে কিনা জানতে। সে এসে বললো, সব ফাঁকা। তার কথা বিশ্বাস না করে তাদের নিজেদের লোক গেল। দেখল সব ফাঁকা। মনিবাবুকে ডেকে পাঠানো হলো। তিনি বললেন, এরা জঙ্গলের ঠিকাদারির কাজ করতে এসেছিল। এছাড়া তার সাথে তাদের আর কোন সম্পর্ক নেই। এ সময় তারা কোথায় তা সে জানে না। বোর সাহেব সদলে আশ্রমে গেল। ইংরেজ সরকার গ্রামে গ্রামে প্রচার করে দিয়েছিল জার্মান ডাকাত এসেছে, স্বদেশী ডাকাত এসেছে, ধরিয়ে দিতে পারলে লোকপিছু দুইশো টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। গ্রামের লোক স্বদেশী ডাকাত বোঝে না। জার্মান বোমার ভয়ে তারা ভীত। তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে গেল। ডাকাত ধরার জন্য টাকা পাওয়ার লোভে।
আট তারিখে বিপ্লবীরা বিনা বাঁধায় বালেশ্বর স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে গেল। দেখলেন একটা ট্রেন অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি টিকিট কিনে নিলেন। গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। কিন্তু অত লম্বা ট্রেনের অনুপাতে যাত্রী সংখ্যা ছিল নগণ্য। ঠিক সন্দেহ করলেন এই ট্রেনে তাদের ধরার জন্য পুলিশের লোক সাদা পোশাকে আগেই ভর্তি হয়ে আছে। পাঁচজনই গাড়ি থেকে নেমে এলেন। টিকিট ছিঁড়ে ফেললেন। আবার ফিরে চললেন শহর থেকে গ্রামের মেঠো পথে গ্রামের দিকে। হরিপুর গ্রামে এসে পড়লেন। তারপর বুড়িবালাম নদীর তীরে গোবিন্দপুর পৌঁছালেন। ভাদ্রমাসের ভরা নদী পারের জন্য কোন নৌকা পাওয়া গেল না। একটি কাঠ বোঝাই নৌকার মাঝিকে অনুরোধ করায় সে এদের পার করে দেয়। তাদের জঙ্গলের দিকে যেতে দেখে লোকের মনে সন্দেহ হয়। দফাদারকে খবর দেয় যে, ডাকতদল জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। চারিদিকে রব উঠল, জার্মান ডাকাত দল এসেছে। দামুদ্রা গ্রামে তারা এসে পৌঁছালো। লোকজন তাদের ঘিরে পিছনে পিছনে আসতে থাকে। বিপ্লবীরা তাদের ফিরে যেতে বললেও তারা সে কথায় কান দেয়নি।
৯ই সেপ্টেম্বর পুস্কারের লোভে গ্রামের বৃদ্ধ রাজমহান্তি ও সুদানিগিরি সানে যেয়ে তাদের পথ আগলায়। মনোরঞ্জন গুলি করতে বাধ্য হয়। রাজমহান্তির মারা যায় আর সুদানি আহত হয়। লোকেরা পালায়। কিন্তু দূর থেকে অনুসরণ করতে থাকে। দফাদার বলেশ্বরে খবর দিতে যায়। হাজার হাজার টাকার লোভে গ্রামের লোকেরা দল বেঁধে এসে তাদের ছেঁকে ধরলো। তাদের সরে যেতে ও চলে যেতে বলা হলো কিন্তু তারা লোভে পড়ে এদের কথা শুনলো না। মিষ্টি কথায়, অনুনয়-বিনয়, শুভেচ্ছা, সাবধান বাণী, দৃঢ়স্বরে সাবধান করা সবকিছু বিফল হলো। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে যতীন্দ্রনাথকে জাপটে ধরলো। নিমিষের মধ্যে যতীন্দ্রনাথের ধাক্কায় সে চিৎ হয়ে ধরাশায়ী হলো। অন্যরা এগিয়ে এসে বাকীদের ধরার জন্য চেঁচামেচি করতে লাগলো। সাহস করে কেউ আর কাছে এগুলো না। অতঃপর শেষবারের মতো সতর্ক বাণীতে সরে যাওয়া ব্যর্থ হলে মনোরঞ্জন গুলি ছোঁড়ে। গুলিতে একজন নিহত ও বহু লোক আহত হয়।
ইতোমধ্যে গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়ে বালেশ্বরের আশেপাশে পুলিশ ছড়িয়ে পড়লো। বিপ্লবীদের দিন কাটছে একেবারে অর্ধাহারে, অনাহারে। এই তিন অবস্থায় খাদ্যের সন্ধানে মিলে ঘুরতে ঘুরতে জনমানবহীন বঙ্গোপসাগরের তীরে বুড়ী বালামের কাছাকাছি অগ্রসর হলেন।
কাছেই একটি খাবারের দোকান ছিল। সঙ্গীদের নিয়ে সেখানেই খেতে বসেন বাঘা যতীন। পথশ্রমে সবাই তখন ক্লানত্ম, ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির। সেই সময় পুলিশ কমিশনার অত্যাচারী টেগার্ট রবার্ট পুলিশ বাহিনী নিয়ে কাছাকাছি অঞ্চলে ছিলেন। এদিকে এরা যে বিপ্লবী এই খবর দোকানি পাচার করে দিয়েছিল স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট কয়েকজন রাইফেলধারী পুলিশ নিয়ে ছুটে যান সেই দোকানের দিকে। ওদিকে সদা সতর্ক বাঘা যতীনও তাদের বিপদ সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন। কিন্তু তারা পালাবার চেষ্টা না করে মরণপণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।
১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর এই দিন বুড়ী বালামের তীরে মরণজয়ী বিপ্লবীদের রক্তে পরিণত হয়েছিল রক্ততীর্থে। পুলিশ কমিশনার নিকটবর্তী হবার পূর্বেই একটা তপ্ত বুলেট তাঁর কানের পাশ দিয়ে ছুটে গিয়ে বিপ্লবীদের আক্রমণ সংতেক জানিয়ে দিল। গুলি ছুঁড়ছেন যতীন্দ্রনাথ। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালো। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরম্ন হলো। বিপ্লবীদের সামরিক অভিজ্ঞতার অভাব ছিল না। মাটির গর্তকে পরিখারূপে ব্যবহার করে তাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলো। বিপ্লবীদের অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণের মুখে টেগার্টের বাহিনী বেশীক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এই যুদ্ধ বালেশ্বরের যুদ্ধ বা Balasore Trend Fight নামে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।
বিপ্লবীরা এই সুযোগে সাঁতরে নদী পার হয়ে গেল। কিন্তু তারা জানতেননা এক ছদ্মবেশী ভিখারী দারোগা তাদেরকে অনুসরণ করে চলছিল। সে নদী পার হয়ে একটা গাছের উপর উঠে বিপ্লবীদের লক্ষ্য করতে লাগলো। ছদ্মবেশী এই দারোগাটির নাম চিন্তামণি সাধু। বিপ্লবীরা বিরাট উঁই ঢিবির অন্তরালে আশ্রয় নিলো। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অবস্থান জানতে পেরে সেখানে এসে উপস্থিত হলো ইংরেজ বাহিনী।
বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ কিলবি ও মিলিটারী লেফটেন্যান্ট রাদার ফোর্ড তিনশত রাইফেলধারী পুলিশ নিয়ে উঁই ঢিবির চাদিক ঘিরে ধরলো। একসঙ্গে তিনশত রাইফেল গর্জন করে উঠলো। গুলিবর্ষণ করতে করতে তারা এগিয়ে চললো। বিপ্লবীদের কাছ থেকে কোন বন্দুকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। এতে পুলিশের ধারণা হলো যে, বিপ্লবীদের হাতে কোন দূরপাল্লার অস্ত্র নেই। বিপ্লবী যতীন্দ্র যে কত বড় দক্ষ সেনাপতি ছিলেন এই যুদ্ধের বিবরণ থেকে যুদ্ধবিশারদগণও তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। যতীন্দ্রনাথ এসময় মসার পিস্তল গুলিভর্তি করে অপেক্ষা করছিলেন। এই পিস্তলের গঠন কৌশল এমন যে, বাট বাড়িয়ে নিলেই রাইফেলের মতো কাজ করে। এই অদ্ভুত অস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা প্রশস্ত ঢিবির আড়ালে বেশ নিরাপদেই রয়েছে। বিপ্লবীদের সমস্ত গুলিই ডিবির গায়ে বিদ্ধ হচ্ছে। পুলিশবাহিনী একসময় নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেল। বিপ্লবীদের কমান্ডার-ইন-চীফ যতীন্দ্রনাথের কণ্ঠ থেকে হঠাৎ বজ্রকঠিন শব্দ বেরিয়ে আসলো, আদেশ করলেন Fire- গুলি করো, শত্রুদের খতম করো। পাঁচটি মসার পিস্তল বিপুল গর্জনে গুলিবর্ষণ শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে রাদার ফোর্ডের ফৌজ হতাহত অবস্থায় মাঠের জলকাদায় গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কেহ আলোর আড়ালে আশ্রয় নিলো, কেহ মাঠে বুক মিশিয়ে গুলি চালাতে লাগলো। বিপ্লবীদের সহায় ছিল বীরত্ব, সাহস, নৈপুণ্য আর জ্বলন্ত দেশপ্রেম। ব্রিটিশের পক্ষে ছিল তিনশত রাইফেলধারী সৈন্য। সেদিনের লড়াইয়ে বিপ্লবীরা যে পরিমাণ সৈন্য সংহার করলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
হঠাৎ শত্রুপক্ষের বুলেটের আঘাতে যতীন্দ্রনাথের বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি চূর্ণ হয়ে গেল। ডান হাত দিয়েই তিনি মসার পিস্তল চালাতে লাগলেন। সহসা একটি বুলেট চিত্তপ্রিয়ের মাথায় বিদ্ধ হলো। ‘দাদা’ বলে শেষ কথা উচ্চারণ করে তিনি যতীন্দ্রনাথে কোলে ঢলে পড়লেন। চিত্তপ্রিয় চিরপ্রিয় দলনেতার কোলে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্বদেশের ইতিহাসে চির অমরত্ব অর্জন করলেন। যুদ্ধের ভিতর শোকের অবকাশ নেই। বিগতপ্রাণ সহযোদ্ধার মৃতদেহ পাশে রেখে চার বিপ্লবীকে অবস্থান ত্যাগ করতে হলো। এই অসম যুদ্ধ প্রায় তিন ঘন্টা ধরে চললো। এই সময় রাদার ফোর্ডের বাহিনী অজস্র গুলি বর্ষণ করে চলেছে। জ্যোতিষ মারাত্মকভাবে আহত হলেন। যতীন্দ্রনাথের পেটে এবং চোয়ালে একটি গুলি বিদ্ধ হলো। সঙ্গের টোটাও সব ফুরিয়ে গেল। যতীন্দ্রনাথের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি মিঃ কিলবিকে বললেন "Mr. Kilvy, see that no injustice is done to those boys under the British Raj, for whatever was done I am responsible.---The Entire responsibilities is mine. These boys are innocent; they have simply carried out my orders. Please see that no injustice is done to them under the British Raj."
যতীন্দ্রনাথ সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বলেছিলেন, আমি ও আমার লেফটেন্যান্ট চিত্তপ্রিয় গুলি করেছি, বাকী এ তিনজন লোক সম্পূর্ণ নির্দোষ। তারা আমাদের সাথে এসেছিল মাত্র। তিনি মনোরঞ্জন, নিরেন ও জ্যোতিষকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে শেষ চেষ্টা করেছিলেন। মুমূর্ষূ যতীন্দ্রনাথকে বালেশ্বর হাসপাতালে পাঠানো হলো। তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল। যতীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দখলদার সরকার আমাকে সুস্থ করিয়ে ঘটা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বাহবা নিবে তা হতে পারে না।” এ কথা বলেই নিজের ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ব্যান্ডেজ খুলে মগজের ভিতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে মগজ ঘুঁটে দেন। ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তিনি বালেশ্বরের হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যতীন্দ্রনাথের শেষ অনুরোধ রক্ষা করার মতো ঔদার্য বিদেশী রাজশক্তির ছিল না। বিশেষ আদালতের বিচারে মনোরঞ্জন ও নিরেশের ফাঁসির হুকুম হয়, জ্যোতিষের হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে যতীন্দ্রনাথের বিপ্লবী নেতৃজীবন শেষ হয়। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল বিস্ময়কর। অচিন্তনীয় ছিল তাঁর শক্তি ও বীরত্ব আর অপরিমেয় দেশপ্রেম। যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছিলেন "I have met the brevest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty."
তাঁর লাশ কোথায় কি করা হলো জানা গেল না। মানুষের মুখে মুখে অমর হয়ে গেলেন স্বদেশী আন্দোলনের মহান সৈনিক বিপ্লবী বাঘা যতীন আর তাঁর বিপ্লবী সাথী। কবির কবিতায় বিধৃত হলো কাহিনী।
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালামের তীর
নবভারতের হলদিঘাট।”
নবভারতের হলদি ঘাট বুড়ি বালামের তীরে যে সংগ্রামের কথা কবি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন. তার সেনাপতি ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (Jatindranath Mukherjee), যিনি বাঘা যতীন নামেই সমধিক পরিচিত। বাঘা যতীন এবং তাঁর অনুসারীরা মারণাস্ত্র হাতে উল্লেখিত জীবনমরণ সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯১৫ সালে। তাঁরা ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে একসঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। জাতির ইতিহাসে সেই কাহিনী স্বর্ণক্ষরে লেখা আছে।

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের বীর বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন-Bagha Jatin) বাংলার বারভূঁইয়াদের অন্যতম যশোরের রাজা মহারাজ প্রতাপাদিত্যের বংশধর ছিলেন।
বাঘা যতীনের জন্ম হয় (Bagha Jatin) ১৮৭৯ সালের ৭ ডিসেম্বর মামা বাড়ী কুষ্টিয়া জেলার কয়া গ্রামে। তাঁর পৈত্রিক নিবাস বাংলাদেশের যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার রিসখালী গ্রামে। তাঁর পিতার নাম উমেষ চন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম শরৎশশী দেবী। ঝিনাইদহ জেলায় পৈত্রিক বাড়িতে তাঁর ছেলেবেলা কাটে। ৫ বছর বয়সে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। মা এবং বড় বোন বিনোদবালার সাথে তিনি মাতামহের বাড়ি কয়াগ্রামে চলে যান।
অল্পবয়সেই পিতৃহারা হয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। বিধাব মা শিশু যতীন্দ্রনাথ ও জ্যেষ্ঠ কন্যা বিনোদবালাকে নিয়ে কুষ্টিয়ায় কয়া গ্রামে পিতার বাড়িতে যেয়ে ওঠেন। তাঁর জীবনকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল মাতা শরৎশশী। পরোপকার বৃত্তি, দুঃশাসন ও অন্যায় প্রতিরোধ করার শিক্ষা যতীন্দ্রনাথ মায়ের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন।
বাঘা যতীনের (Bagha Jatin) মা ছিলেন বাঘিনী। গ্রামের পাশেই গভীর নদী। তিনি বালক যতীন্দ্রনাথকে স্নান করাতে যেয়ে দূরে ছুঁড়ে ফেলে নিজেই সাঁতরে গিয়ে নিয়ে আসতেন। এভাবে সাঁতার শিখে যতীন্দ্রনাথ একদিন বর্ষার ভরা নদী সাঁতরে পার হবার সাহস ও শক্তি অর্জন করেছিলেন। বাঘিনী মায়ের শিক্ষাতেই গড়ে উঠেছিলেন দেশপ্রেমিক যতীন্দ্রনাথ, বিপ্লবী বাঘা যতীন।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যতীন্দ্রনাথের শক্তি সাহস উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও মন ছিল স্নেহ, মায়া-মমতায় ভরা। কারো উপকার করতে পারলে নিজেকে তিনি ধন্য মনে করতেন। তাঁর পরোপকারের বহু ঘটনা আজো কিংবদন্তীর মতো হয়ে আছে।
বাঘাযতীন নামকরণ:
যতীন্দ্রনাথের ‘বাঘা যতীন’ নামটি কে দিয়েছিলেন তা জানা যায় না। কিন্তু নামকরণের ইতিহাসের সঙ্গে নামটিও অমরত্ব লাভ করেছে।
একবার কয়াগ্রামে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। সেই সময় গ্রামে বাঘের খুব উৎপাত ছিল। একদিন গ্রামবাসীরা বাঘের আস্তানায়

হঠাৎ বাঘ দেখা গেল। তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলো। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সেই গুলি। বাঘটা গেল ক্ষেপে। ক্রুদ্ধ বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়লো যতীন্দ্রনাথের উপর। কিন্তু যতীন ঘাবড়ে যাবার ছেলে নন। তিনি তাঁর হাতের পেন্সিল কাটার ছুরি দিয়েই বাঘের সাথে লড়াই করে যেতে লাগলেন। বাঘকে ক্ষত-বিক্ষত করতে করতে নিজেও ক্ষত-বিক্ষত হলেন। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। ছুরির ঘা মেরেই একসময় বাঘকে পরাস্থ করলেন। শেষ করে দিলেন তার জীবনলীলা। এই দুঃসাহসিক অভিযানের পর থেকে তিনি বাঘা যতীন নামে অভিহিত হলেন।
এরপরেও আরেকবার তাঁকে বাঘিনীর মুখে পড়তে হয়েছিল। সেবার গুলি করে বাঘিনী মেরে তার তিনটি শাবককে বাড়ি নিয়ে গিয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন:
কয়া গ্রামের এক প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হলেও বাঘা যতীনের সত্যিকার শিক্ষাজীবন শুরম্ন হয় কৃষ্ণগ্রামের মামার বাড়িতে এসে। এখানেই তিনি স্কুলের শিক্ষাজীবন শুরম্ন করেছিলেন। পড়াশোনার চেয়ে নানান খেলা, শরীরচর্চা প্রভৃতিতেই ছিল তাঁর বেশী উৎসাহ। স্থানীয় স্কুলে পড়ার সময় একদিন একটি পাগলা ঘোড়াকে কব্জা করে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
যতীন্দ্রনাথের বড় মামা বসন্ত কুমার চট্টোপাধ্যায় কৃষ্ণনগরে ওকালতি করতেন। তিনি কৃষ্ণনগরে মামার বাড়িতেই থাকতেন। ১৮৯৮ সালে যতীন্দ্রনাথ প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করে কোলকাতা সেন্ট্রাল কলেজে ভর্তি হলেন। কিন্তু কলেজের তাঁর বেশীদূর অগ্রসর হলো না। তিনি পড়া ছেড়ে দিয়ে স্টেনোগ্রাফি শিক্ষা করতে লাগলেন। পরে বাংলা সরকারের সেক্রেটারী হুইলার সাহেবের স্টেনোগ্রাফার হন। এইভাবে শুরু হলো তাঁর কর্মজীবন।
স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে যতীন্দ্রনাথ:
কিশোর বয়স থেকেই যতীন্দ্রনাথের মনে পরাধীনতার গ্লানি, দাসত্বের অপমান গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি বুঝতে পারলেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো পরাধীনতা। কি করে দেশ স্বাধীন করে মানুষের মতো মানুষ হয়ে বাঁচার পথ করা যায়। এই চিন্তা যতীন্দ্রনাথকে সংগ্রামের পথ, বিপ্লবের পথের সন্ধান দেখিয়েছিল।

১৯০৫ সালে দেশব্যাপী শুরু হয় বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিলেন যতীন্দ্রনাথ নিজে। তিনি অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করলেন। এইভাবে স্বাধীনতার বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপিত হলো। এই সময় থেকে যতীন্দ্রনাথের অবশিষ্ট জীবন হলো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক আপোষহীন সংগ্রামের ইতিহাস। কলকাতায় অবস্থানকালে একসময় সহকর্মীদের সাথে মতবিরোধ হওয়ায় কলকাতা সার্কুলার রোডের ঘাঁটি, ইস্ট ক্লাব ছেড়ে সীতারাম ঘোষ স্ট্রীটের মেস বাড়িতে চলে যান। এখান থেকেই তিনি বিদ্যাভূষণের সাথে একত্রে রাজনৈতিক কার্য চালিয়ে যেতে থাকেন। যোগেন্দ্রনাথ, বিদ্যাভূষণ, ম্যাটসিনি এবং গ্যারিবল্ডির জীবনী বাংলায় অনুবাদ করেন। এ বাড়িতেই স্বামী বিবেকানন্দ যাতায়াত করতেন। যতীন্দ্রনাথকে অরবিন্দ ঘোষ খুবই শ্রদ্ধা করতেন। যতীন্দ্রনাথ ও বারীন্দ্রনাথ ঘোষের অনুরোধেই অরবিন্দ ১৯০৩ সালে কলকাতা আসেন। যোগেন্দ্রনাথের এই বাড়িতেই যতীন্দ্রনাথের সাথে শ্রী অরবিন্দ অবস্থান করতেন। যোগেন্দ্রনাথের পুত্র শচীন্দ্রনাথ যতীন্দ্রনাথকে অরবিন্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। যতীন্দ্রনাথ ‘ছাত্রভান্ডার’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এর মধ্যে ছিলেন কার্তিক দত্ত, পবিত্র দত্ত, ইন্দ্রনাথ নন্দী, নিখিলেশ্বর রায় মৌলিকসহ আরো অনেকে।
১৯১০ সালে আলীপুর বোমা হামলা মামলার তদনত্মকারী বিখ্যাত সিআইডি অফিসার মৌলভী শামসুল আলমকে গুলি করে হত্যা করে বীরেন্দ্র দত্ত গুপ্ত নামে এক যুবক। পরে বীরেন্দ্র ধরা পড়লে পুলিশ জানতে পারে এই হত্যাকান্ডের নেপথ্য নায়ক আসলে যতীন্দ্র। এই হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে আরও কয়েকজনের সঙ্গে পুলিশ যতীন্দ্রনাথকেও গ্রেফতার করে। পুলিশ নানা প্রলোভন ও ভয় দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে কোন রকম স্বীকারোক্তি আদায় করতে না পেরে তাঁকে আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে চালান দেওয়া হয়। যতীন্দ্রনাথ ও আরও কয়েকজন বিপ্লবীকে জড়িয়ে তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ যে মামলা করেছিলেন তা ‘হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে অভিহিত।
হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলা ১৯১০ সালে মার্চ মাসে শুরু হয়ে ১৯১১ সাল এপ্রিল মাসে শেষ হয়। এক বছর জেলে থাকার পর প্রধান বিচারপতি জেঙ্কিন্সের বিচারে অভিযুক্তগণ সকলেই নিরপরাধী সাব্যস্ত হন। হাওড়া ষড়যন্ত্র মামলার সাথে জড়িত হওয়ার ফলে যতীন্দ্রনাথের নাম সরকারের বিরাগভাজন ব্যক্তিদের তালিকায় উঠে গেল। ফলে তিনি মিঃ হুইলারের অধীন চাকরিটি হারালেন। জেল থেকে বেরিয়ে তিনি জেলা বোর্ডের কন্ট্রোলারের কাজ নেন। এই কাজের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরির সময় তিনি বুঝতে পারলেন, সরকারী গুপ্তচরেরা তাঁকে সর্বদা পর্যবেক্ষণ করছে। এতে তিনি অস্বস্তির চেয়ে বিরক্ত হলেন বেশী।
এক সময় বাঘা যতীনের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে যশোর, নদীয়া, ফরিদপুর এলাকায় যাতায়াত করতে হতো। এই সুযোগে তিনি ইংরেজ বিরোধী একটি বিপ্লবী দল গঠন করেন। যশোরের নলডাঙ্গা বলরামপুরে তিনি বিপ্লবের কেন্দ্র স্থাপন করেন। তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদার করেন। বহু তরুণ তাঁর দলে যোগ দিতে থাকে। এই বিপ্লবী দল বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ নিধন অভিযান কৃতিত্বের সাথে সম্পাদন করে।
ইংরেজদের উপর ছিল তাঁর মর্মান্তিক বিতৃষ্ণা। কারণ যে কোন ইংরেজই এদেশীয়দের উপর অত্যাচার করতো। ফলে দিনে দিনে তাঁর ইংরেজদের প্রতি বিতৃষ্ণা, ঘৃণা

যতীন্দ্রনাথ জাতীয় মর্যাদার প্রতি সর্বদা সচেতন ছিলেন। এসব কারণেই তিনি জাতীয় জীবনের সকল মান-অপমানকে নিজের মান-অপমান বলে গ্রহণ করতে শিখেছিলেন। সেইজন্য তাঁর সমগ্র সত্তা ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল দেশের স্বাধীনতা অর্জন করে হৃত সম্মান পুনরুদ্ধার করার জন্য। উত্তরকালে এই উদ্দেশ্যেই তিনি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর, সন্ধ্যা প্রভৃতি বিপ্লবী দলগুলোর সংস্পর্শে বিভিন্ন গুপ্ত সমিতিতে কাজ করতে থাকেন। আলীপুর বোমা মামলায় যখন বহু বিপ্লবী অত্নরীণ ছিলেন তখন যতীন্দ্রনাথের উপরই অবশিষ্ট দলগুলোর ভার পড়েছিল।
বাংলার গুপ্ত সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে যতীন্দ্রনাথই প্রথম উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজদেরকে মাতৃভূমি ভারত থেকে উৎখাত করতে হলে তাদের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী ও বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান গড়ে তোলার প্রয়োজন। এই কাজের জন্য বাংলার স্বাধীন বিপ্লবী গ্রুপগুলোকে একত্রিত করা দরকার। আরো মনে হয়, অভ্যুত্থানের কাজে ইংরেজ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের চেষ্টা করে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করা যায়। এরপর থেকেই সেযুগের বাংলার বিপ্লবী চিন্তাধারা আন্তর্জাতিকমুখী করে গড়ে ওঠে। তিনি নিজেই বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালাতে লাগলেন। এই সময় বঙ্গলক্ষ্মী কটন মিল্সে কাজ করতেন স্বদেশী ভাধারার এক তরুণ অবনী মুখার্জী। যতীন্দ্রনাথ এবার তাকেই কাছে টানলেন। বাংলার বিপ্লবী প্রচেষ্টাকে সাহায্য করার জন্য তিনি তাকে জাপানে যেতে অনুরোধ করেন। তখন ব্যবসা ক্ষেত্রে জাপান ছিল বৃটিশ বিরোধী দেশগুলোর অন্যতম। তাই যতীন্দ্রনাথ বাস্তব বুদ্ধিবলে বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজ বিরোধী গুপ্ত আন্দোলনে হয়তো তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাওয়া যেতে পারে। যতীন্দ্রনাথের পরামর্শে অবনী মুখার্জী ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে জাপান গেলেন। কিন্তু তিনি লক্ষ্যার্জনে তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। ফলে তাকে নিরাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়।
রক্তাক্ত বুড়ী বালামের তীর:
১৯১৪ সালে শুরু হলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। জার্মানীর সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ বেধে যায়। ইতোমধ্যে জার্মানীতে ভারতীয় ছাত্রদের উদ্যোগে জার্মান থেকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচারকার্য চালানোর জন্য “বার্লিন কমিটি” নামে একটি সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। এদের সঙ্গে যোগাযোগ করে যতীন্দ্রনাথ আবার ১৯১৫ সালে অবনী মুখার্জীকে জাপানে রাসবিহারী বসুর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। এইভাবে ক্রমাগত চেষ্টার ফলে চীনের নেতা সানইয়াং স্পেনের কাছ থেকে পাওয়া যায় ৫০টি পিস্তল, ৪৬ হাজার গুলি এবং বহু টাকা সাহায্য বাবদ পাওয়া গেল। দেশের নানা বিপ্লবী সংগঠনের মধ্যে এই অস্ত্র ও টাকা বন্টনকরে দেওয়া হয়।
বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানী করতে হলে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। যতীন্দ্রনাথ সেই টাকার সুরাহা করেন স্বদেশী ডাকাতির মাধ্যমে। ইতোমধ্যে বিপ্লবী নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য ওরফে মানবেন্দ্রনাথ রায় (এম.এন.রায়) ও যীতেন্দ্রনাথ লাহিড়ীর যোগাযোগের ফলে জার্মান সরকার বিপ্লবীদের জন্য এক জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র এবং কিছু নগদ অর্থ পাঠিয়ে দিলেন। স্থির হয়েছিল বিদেশ থেকে আসা অস্ত্র সুন্দরবনে জাহাজ থেকে নামিয়ে একভাগ পাঠানো হবে বালেশ্বরে, একভাগ সন্দ্বীপ হাতিয়া অঞ্চলসহ বরিশাল পার্টির মাধ্যমে যাবে, অপরভাগ যাবে কোলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার স্যানপেড্রো বন্দর থেকে এস. এস. ম্যাভারিক নামে সমুদ্র জাহাজে অস্ত্র আনার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ‘ম্যাভারিক’ ও ‘অ্যানলুই’ জাহাজের নাম। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও ডাচেরা সাগর পাহারা দিচ্ছিল। ম্যাভারিক সম্পর্কে মিত্রশক্তি সন্দেহ করে। স্ট্যান্ডার অয়েল কোম্পানির তৈলবহনকারী জাহাজ ম্যাভারিক ধরাপড়া যখন অবধারিত তখন কাগজপত্র, অস্ত্রশস্ত্র তারা সমুদ্রে ফেলে দিয়ে জাপান চলে যায়। সেখানে ডাচ লোকজনসহ জাহাজটি আটক হয়। এরপর জার্মানী আরো তিন জাহাজ অস্ত্রশস্ত্র ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করে। এ বিষয়ে যতীন্দ্রনাথের নির্দেশে সমস্ত যোগাযোগ করলেন রাসবিহারী বসু, ভগবান সিংহ ও অবনী মুখার্জী।
এবার ঠিক করা হয় অস্ত্রবোঝাই জাহাজ তিনটির একখানা বালেশ্বর এবং অপর দুইটি গোয়া ও রায়মঙ্গলের কাছে ভিড়বে। বালেশ্বরে যে জাহাজ এসেছিল তাতে ছিল ২০০ পিস্তল, প্রচুর কার্তুজ, হাতবোমা, বিস্ফোরক ও দুই লাখ টাকা। অন্য দুটি জাহাজেও ছিল অনুরূপ পরিমাণ অস্ত্র শস্ত্র। প্রথম জাহাজটি ১৯১৫ সালের ১৭ই নভেম্বর আন্দামানের কাছে এলে বৃটিশ রণতরী সেখানে হানা দেয়। সেখানে এক টুকরো কাগজ পায়। তাতে ‘কপ্তিপদার’ নাম লেখা ছিল। পরে তারা জাহাজটিকে ডুবিয়ে দেয়।
প্রথম জাহাজে হানা দেয়ার সূত্র ধরে বালেশ্বরের সশস্ত্র পুলিশসহ ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ কিলবী, ডেনহাম, বার্ড, টেগার্ড, নীলগীরি রাজ্যে সশস্ত্র পুলিশ ও ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের সশস্ত্র পুলিশসহ রাতারাতি কপ্তিপদার ডাকবাংলোয় গিয়ে পৌঁছে। কপ্তিপদায় অস্ত্র পাবার আশায় বাঘা যতীন তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পূর্বেই চলে গিয়েছিলেন জঙ্গলে কাঠ সংগ্রহ করতে, এসেছেন ঠিকাদার পরিচয় দিয়ে। তাঁরা সেখানে একটি আশ্রমও খুলেছিলেন।
যতীন্দ্রনাথ চিত্তপ্রিয়, মনোরঞ্জন, নিরেন্দ্রনাশ ও জ্যোতিষচন্দ্র এই চারজন বালেশ্বরে জার্মান জাহাজের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। যতীনকে ওখানকার জনগণ সাধু মনে করতো। তিনি গেরুয়া পরে থাকতেন। ইংরেজ সাহেবরা সৈন্যবাহিনীসহ হাতীতে চেপে ওখানে গিয়েছিল। হাতীর পিঠের ঘন্টা শুনে স্থানীয় লোকজন ‘দাদাদের’ খবর দিয়েছিল। বালেশ্বরের পুলিশ নিমাই, শৈলেশ্বর বোস, নারায়ণ ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতার করেছিল এবং সৈন্যবাহিনী নিয়ে বালেশ্বরের ম্যাজিস্ট্রেট কিলবী, ডেনহাম, বার্ড ও টেগার্ড অগ্রসর হচ্ছিল। ওদিকে বাঘা যতীন এম.এন রায়কে বাটাভিয়ায় পঠিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের জন্য। কথা ছিল ওই সময় মালবাহী অস্ত্রসহ জাহাজ সুন্দরবনের পথে এসে যাবে। কিন্তু পথে বিপদ হওয়ায় ওদিক থেকে সে পরিকল্পনা ব্যার্থ হয় যা তাদের পক্ষে জানা সম্ভব ছিল না। বিপদের সম্ভাবনা আঁচ করতে পেরে অন্য দুটো জাহাজ পথ ঘুরে মেক্সিকো উপসাগরের দিকে চলে যায়। বিপ্লবীরা সেখানে তারা অস্ত্রগুলো স্থানীয় জলদস্যুদের কাছে বিক্রি করে স্বদেশে ফিরে আসে। যে ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতার ফলে এই মহৎ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল তার নাম কুমুদনাথ মুখার্জী। এই লোকটিই বিপ্লবীদের সমস্ত পরিকল্পনার কথা ইংরেজদের কাছে ফাঁস করে দিয়েছিল।
এদিকে বাঘা যতীন তাঁর দল নিয়ে বালেশ্বরের তীরে অপেক্ষা করতে থাকেন এবং কপ্তিপদায় টেগার্টের ঘেরের মধ্যে পড়ে যায়। সাহেবদের দেখে যতীনের দল মহাবিপদ আঁচ করতে পেরে দলের সবাইকে সাবধান করে দেয়। সেখানে ছিল মনোরঞ্জন সেন ও চিত্তপ্রিয় চৌধুরী। নরেন দাস গুপ্ত ও যতীন ছিল আরো বার মাইল দূরে আরেকটি আড্ডায় তালডিহিতে। কপ্তিপদায় যিনি তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তার নাম মনীন্দ্র চৌধুরী। তার বাড়ি বিপ্লবীদের আস্তানার অল্পদূরে ছিল। বিপ্লবীরা থাকতেন একটি মুদিখানার দোকান ও আশ্রম কেন্দ্রে। যতীনদা পরতেন গেরুয়া। গ্রামবাসীদের বিপদ-আপদে সর্বপ্রকার সাহায্য করতেন। প্রকৃতিক উপায়ে বা হোমিওপ্যাথিক মতে রোগীদের সেবা ও চিকিৎসা করতেন। টিংচার আয়োডিন, কুইনাইন ব্যবহার করতেন। খুব অসহায় লোক হলে নিজেদের কাছে এনে চিকিৎসা করাতেন। নিরক্ষরদের পড়াতেন। গ্রামে আগুন লাগলে নিভানোর ব্যবস্থা করতেন। ঘটনার দিন একটি শয্যাগত রোগী তাঁদের আশ্রমে ছিল। যাবার সময় তাকে বলে গিয়েছিলেন, কেউ জিজ্ঞাসা করলে সে যেন বলে বাবুরা পশুর পায়ের দাগ অনুসরণ করে জঙ্গলে শিকারের জন্য গেছেন।
বিপ্লবীরা সাহেবদের আগমন দেখে দূর থেকে বিপদ আঁচ করে মনীনদ্র চৌধুরীকে সাবধান করে দিয়ে সকাল বেলায় তালডিহির দিকে যাত্রা করলেন। যতীন ইচ্ছা করলে একা পালাতে পারতেন। কিন্তু নরেশ ও যতীশকে ফেলে তা হয় না। যতীন কাপুরুষ ছিলেন না। মনি বাবু যতীনকে মেঘাশনি পাহাড়ের নিকটে চলে যেতে বলেছিলেন।
৭ই সেপ্টেম্বর সকাল হতেই ময়ূরভঞ্জ রাজ্যের মহকুমা হাকিম অক্ষয় কুমার চট্টোপাধ্যায়কে ডেনহাম ডেকে পাঠায়। ডেনহাম ছিল ভারত সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের সহকারী বড়কর্তা। ডেনহামের সাথে বিহারের গোয়েন্দা বিভাগের ডি.আই.জি Royland ছিল। একজন স্থানীয় লোককে পাঠানো হয়েছিল বিদেশী বাবুরা আশ্রমে আছে কিনা জানতে। সে এসে বললো, সব ফাঁকা। তার কথা বিশ্বাস না করে তাদের নিজেদের লোক গেল। দেখল সব ফাঁকা। মনিবাবুকে ডেকে পাঠানো হলো। তিনি বললেন, এরা জঙ্গলের ঠিকাদারির কাজ করতে এসেছিল। এছাড়া তার সাথে তাদের আর কোন সম্পর্ক নেই। এ সময় তারা কোথায় তা সে জানে না। বোর সাহেব সদলে আশ্রমে গেল। ইংরেজ সরকার গ্রামে গ্রামে প্রচার করে দিয়েছিল জার্মান ডাকাত এসেছে, স্বদেশী ডাকাত এসেছে, ধরিয়ে দিতে পারলে লোকপিছু দুইশো টাকা পুরস্কার দেয়া হবে। গ্রামের লোক স্বদেশী ডাকাত বোঝে না। জার্মান বোমার ভয়ে তারা ভীত। তাদের মধ্যে চাঞ্চল্য পড়ে গেল। ডাকাত ধরার জন্য টাকা পাওয়ার লোভে।
আট তারিখে বিপ্লবীরা বিনা বাঁধায় বালেশ্বর স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে গেল। দেখলেন একটা ট্রেন অপেক্ষা করছে। তাড়াতাড়ি টিকিট কিনে নিলেন। গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। কিন্তু অত লম্বা ট্রেনের অনুপাতে যাত্রী সংখ্যা ছিল নগণ্য। ঠিক সন্দেহ করলেন এই ট্রেনে তাদের ধরার জন্য পুলিশের লোক সাদা পোশাকে আগেই ভর্তি হয়ে আছে। পাঁচজনই গাড়ি থেকে নেমে এলেন। টিকিট ছিঁড়ে ফেললেন। আবার ফিরে চললেন শহর থেকে গ্রামের মেঠো পথে গ্রামের দিকে। হরিপুর গ্রামে এসে পড়লেন। তারপর বুড়িবালাম নদীর তীরে গোবিন্দপুর পৌঁছালেন। ভাদ্রমাসের ভরা নদী পারের জন্য কোন নৌকা পাওয়া গেল না। একটি কাঠ বোঝাই নৌকার মাঝিকে অনুরোধ করায় সে এদের পার করে দেয়। তাদের জঙ্গলের দিকে যেতে দেখে লোকের মনে সন্দেহ হয়। দফাদারকে খবর দেয় যে, ডাকতদল জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। চারিদিকে রব উঠল, জার্মান ডাকাত দল এসেছে। দামুদ্রা গ্রামে তারা এসে পৌঁছালো। লোকজন তাদের ঘিরে পিছনে পিছনে আসতে থাকে। বিপ্লবীরা তাদের ফিরে যেতে বললেও তারা সে কথায় কান দেয়নি।
৯ই সেপ্টেম্বর পুস্কারের লোভে গ্রামের বৃদ্ধ রাজমহান্তি ও সুদানিগিরি সানে যেয়ে তাদের পথ আগলায়। মনোরঞ্জন গুলি করতে বাধ্য হয়। রাজমহান্তির মারা যায় আর সুদানি আহত হয়। লোকেরা পালায়। কিন্তু দূর থেকে অনুসরণ করতে থাকে। দফাদার বলেশ্বরে খবর দিতে যায়। হাজার হাজার টাকার লোভে গ্রামের লোকেরা দল বেঁধে এসে তাদের ছেঁকে ধরলো। তাদের সরে যেতে ও চলে যেতে বলা হলো কিন্তু তারা লোভে পড়ে এদের কথা শুনলো না। মিষ্টি কথায়, অনুনয়-বিনয়, শুভেচ্ছা, সাবধান বাণী, দৃঢ়স্বরে সাবধান করা সবকিছু বিফল হলো। তাদের মধ্যে একজন এগিয়ে এসে যতীন্দ্রনাথকে জাপটে ধরলো। নিমিষের মধ্যে যতীন্দ্রনাথের ধাক্কায় সে চিৎ হয়ে ধরাশায়ী হলো। অন্যরা এগিয়ে এসে বাকীদের ধরার জন্য চেঁচামেচি করতে লাগলো। সাহস করে কেউ আর কাছে এগুলো না। অতঃপর শেষবারের মতো সতর্ক বাণীতে সরে যাওয়া ব্যর্থ হলে মনোরঞ্জন গুলি ছোঁড়ে। গুলিতে একজন নিহত ও বহু লোক আহত হয়।
ইতোমধ্যে গুপ্তচর মারফত সংবাদ পেয়ে বালেশ্বরের আশেপাশে পুলিশ ছড়িয়ে পড়লো। বিপ্লবীদের দিন কাটছে একেবারে অর্ধাহারে, অনাহারে। এই তিন অবস্থায় খাদ্যের সন্ধানে মিলে ঘুরতে ঘুরতে জনমানবহীন বঙ্গোপসাগরের তীরে বুড়ী বালামের কাছাকাছি অগ্রসর হলেন।
কাছেই একটি খাবারের দোকান ছিল। সঙ্গীদের নিয়ে সেখানেই খেতে বসেন বাঘা যতীন। পথশ্রমে সবাই তখন ক্লানত্ম, ক্ষুধার জ্বালায় অস্থির। সেই সময় পুলিশ কমিশনার অত্যাচারী টেগার্ট রবার্ট পুলিশ বাহিনী নিয়ে কাছাকাছি অঞ্চলে ছিলেন। এদিকে এরা যে বিপ্লবী এই খবর দোকানি পাচার করে দিয়েছিল স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্পে। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট কয়েকজন রাইফেলধারী পুলিশ নিয়ে ছুটে যান সেই দোকানের দিকে। ওদিকে সদা সতর্ক বাঘা যতীনও তাদের বিপদ সম্পর্কে আঁচ করতে পারেন। কিন্তু তারা পালাবার চেষ্টা না করে মরণপণ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।
১৯১৫ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর এই দিন বুড়ী বালামের তীরে মরণজয়ী বিপ্লবীদের রক্তে পরিণত হয়েছিল রক্ততীর্থে। পুলিশ কমিশনার নিকটবর্তী হবার পূর্বেই একটা তপ্ত বুলেট তাঁর কানের পাশ দিয়ে ছুটে গিয়ে বিপ্লবীদের আক্রমণ সংতেক জানিয়ে দিল। গুলি ছুঁড়ছেন যতীন্দ্রনাথ। পুলিশও পাল্টা গুলি চালালো। উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় শুরম্ন হলো। বিপ্লবীদের সামরিক অভিজ্ঞতার অভাব ছিল না। মাটির গর্তকে পরিখারূপে ব্যবহার করে তাঁরা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলো। বিপ্লবীদের অবিশ্রান্ত গুলি বর্ষণের মুখে টেগার্টের বাহিনী বেশীক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তারা পিছু হটতে বাধ্য হলো। এই যুদ্ধ বালেশ্বরের যুদ্ধ বা Balasore Trend Fight নামে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে আছে।
বিপ্লবীরা এই সুযোগে সাঁতরে নদী পার হয়ে গেল। কিন্তু তারা জানতেননা এক ছদ্মবেশী ভিখারী দারোগা তাদেরকে অনুসরণ করে চলছিল। সে নদী পার হয়ে একটা গাছের উপর উঠে বিপ্লবীদের লক্ষ্য করতে লাগলো। ছদ্মবেশী এই দারোগাটির নাম চিন্তামণি সাধু। বিপ্লবীরা বিরাট উঁই ঢিবির অন্তরালে আশ্রয় নিলো। ইতোমধ্যে বিপ্লবীদের অবস্থান জানতে পেরে সেখানে এসে উপস্থিত হলো ইংরেজ বাহিনী।
বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ কিলবি ও মিলিটারী লেফটেন্যান্ট রাদার ফোর্ড তিনশত রাইফেলধারী পুলিশ নিয়ে উঁই ঢিবির চাদিক ঘিরে ধরলো। একসঙ্গে তিনশত রাইফেল গর্জন করে উঠলো। গুলিবর্ষণ করতে করতে তারা এগিয়ে চললো। বিপ্লবীদের কাছ থেকে কোন বন্দুকের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো না। এতে পুলিশের ধারণা হলো যে, বিপ্লবীদের হাতে কোন দূরপাল্লার অস্ত্র নেই। বিপ্লবী যতীন্দ্র যে কত বড় দক্ষ সেনাপতি ছিলেন এই যুদ্ধের বিবরণ থেকে যুদ্ধবিশারদগণও তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করেছেন। যতীন্দ্রনাথ এসময় মসার পিস্তল গুলিভর্তি করে অপেক্ষা করছিলেন। এই পিস্তলের গঠন কৌশল এমন যে, বাট বাড়িয়ে নিলেই রাইফেলের মতো কাজ করে। এই অদ্ভুত অস্ত্র হাতে বিপ্লবীরা প্রশস্ত ঢিবির আড়ালে বেশ নিরাপদেই রয়েছে। বিপ্লবীদের সমস্ত গুলিই ডিবির গায়ে বিদ্ধ হচ্ছে। পুলিশবাহিনী একসময় নাগালের মধ্যে পৌঁছে গেল। বিপ্লবীদের কমান্ডার-ইন-চীফ যতীন্দ্রনাথের কণ্ঠ থেকে হঠাৎ বজ্রকঠিন শব্দ বেরিয়ে আসলো, আদেশ করলেন Fire- গুলি করো, শত্রুদের খতম করো। পাঁচটি মসার পিস্তল বিপুল গর্জনে গুলিবর্ষণ শুরু করলো। সঙ্গে সঙ্গে রাদার ফোর্ডের ফৌজ হতাহত অবস্থায় মাঠের জলকাদায় গড়াগড়ি যেতে লাগলো। কেহ আলোর আড়ালে আশ্রয় নিলো, কেহ মাঠে বুক মিশিয়ে গুলি চালাতে লাগলো। বিপ্লবীদের সহায় ছিল বীরত্ব, সাহস, নৈপুণ্য আর জ্বলন্ত দেশপ্রেম। ব্রিটিশের পক্ষে ছিল তিনশত রাইফেলধারী সৈন্য। সেদিনের লড়াইয়ে বিপ্লবীরা যে পরিমাণ সৈন্য সংহার করলেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
হঠাৎ শত্রুপক্ষের বুলেটের আঘাতে যতীন্দ্রনাথের বাঁ হাতের বুড়ো আঙ্গুলটি চূর্ণ হয়ে গেল। ডান হাত দিয়েই তিনি মসার পিস্তল চালাতে লাগলেন। সহসা একটি বুলেট চিত্তপ্রিয়ের মাথায় বিদ্ধ হলো। ‘দাদা’ বলে শেষ কথা উচ্চারণ করে তিনি যতীন্দ্রনাথে কোলে ঢলে পড়লেন। চিত্তপ্রিয় চিরপ্রিয় দলনেতার কোলে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে স্বদেশের ইতিহাসে চির অমরত্ব অর্জন করলেন। যুদ্ধের ভিতর শোকের অবকাশ নেই। বিগতপ্রাণ সহযোদ্ধার মৃতদেহ পাশে রেখে চার বিপ্লবীকে অবস্থান ত্যাগ করতে হলো। এই অসম যুদ্ধ প্রায় তিন ঘন্টা ধরে চললো। এই সময় রাদার ফোর্ডের বাহিনী অজস্র গুলি বর্ষণ করে চলেছে। জ্যোতিষ মারাত্মকভাবে আহত হলেন। যতীন্দ্রনাথের পেটে এবং চোয়ালে একটি গুলি বিদ্ধ হলো। সঙ্গের টোটাও সব ফুরিয়ে গেল। যতীন্দ্রনাথের শরীর থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। তিনি মিঃ কিলবিকে বললেন "Mr. Kilvy, see that no injustice is done to those boys under the British Raj, for whatever was done I am responsible.---The Entire responsibilities is mine. These boys are innocent; they have simply carried out my orders. Please see that no injustice is done to them under the British Raj."
যতীন্দ্রনাথ সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বলেছিলেন, আমি ও আমার লেফটেন্যান্ট চিত্তপ্রিয় গুলি করেছি, বাকী এ তিনজন লোক সম্পূর্ণ নির্দোষ। তারা আমাদের সাথে এসেছিল মাত্র। তিনি মনোরঞ্জন, নিরেন ও জ্যোতিষকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে শেষ চেষ্টা করেছিলেন। মুমূর্ষূ যতীন্দ্রনাথকে বালেশ্বর হাসপাতালে পাঠানো হলো। তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছিল। যতীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দখলদার সরকার আমাকে সুস্থ করিয়ে ঘটা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বাহবা নিবে তা হতে পারে না।” এ কথা বলেই নিজের ডান হাতের আঙ্গুল দিয়ে ব্যান্ডেজ খুলে মগজের ভিতর আঙ্গুল ঢুকিয়ে মগজ ঘুঁটে দেন। ১৯১৫ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর তিনি বালেশ্বরের হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
যতীন্দ্রনাথের শেষ অনুরোধ রক্ষা করার মতো ঔদার্য বিদেশী রাজশক্তির ছিল না। বিশেষ আদালতের বিচারে মনোরঞ্জন ও নিরেশের ফাঁসির হুকুম হয়, জ্যোতিষের হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে যতীন্দ্রনাথের বিপ্লবী নেতৃজীবন শেষ হয়। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল বিস্ময়কর। অচিন্তনীয় ছিল তাঁর শক্তি ও বীরত্ব আর অপরিমেয় দেশপ্রেম। যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেছিলেন "I have met the brevest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty."
তাঁর লাশ কোথায় কি করা হলো জানা গেল না। মানুষের মুখে মুখে অমর হয়ে গেলেন স্বদেশী আন্দোলনের মহান সৈনিক বিপ্লবী বাঘা যতীন আর তাঁর বিপ্লবী সাথী। কবির কবিতায় বিধৃত হলো কাহিনী।
“বৃটিশের সাথে যুদ্ধ করেছে
তোমরা পঞ্চবীর
বুবের রক্তে রাঙায়ে দিয়েছে
বুড়ী বালামের তীর।
তোমরা পঞ্চবীর
বুবের রক্তে রাঙায়ে দিয়েছে
বুড়ী বালামের তীর।
তথ্য সংগ্রহ:
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বেশষ আপেডট:
সেপ্টেম্বর ২০১১
More Information