
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > মেজর অবঃ আসাদুজ্জামান / Major (Rtd.) Asaduzzaman (1948)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99935 বার পড়া হয়েছে
মেজর অবঃ আসাদুজ্জামান / Major (Rtd.) Asaduzzaman (1948)
মেজর অবঃ আসাদুজ্জামান
Major (Rtd.) Asaduzzaman
Home District: Jessore
Major (Rtd.) Asaduzzaman
Home District: Jessore
পারি

বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর অবঃ আসাদুজ্জামান ১৯৪৮ সালের ১৫ মে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম আব্দুর রউফ ছিলেন একজন সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও সুপন্ডিত শিক্ষক। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর গুলিতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মা মরহুমা আছিয়া খাতুন একজন গৃহিণী ছিলেন। সাত ভাই ও পাঁচ বোনের মধ্যে মেজর আসাদের স্থান পঞ্চম। বড় ভাই গোলাম মাজেদ যশোরের দৈনিক রানার পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন।
মেজর আসাদের ১৯৮০ সালে যশোরের বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী পুটে সদ্দারের বড় মেয়ের সাথে পারিবারিক জীবন শুরু করেন। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক।
শিক্ষাজীবন:
১৯৬৫ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি যশোর এম. এম. কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন এবং ১৯৬৭ সালে চুয়াডাঙ্গা কলেজ থেকে বি. এ পাশ করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেবার জন্য চেষ্টা অব্যাহত থাকে। ১৯৭০ সালের নভেম্বর সেনাবাহিনীতে কমিশন র্যাংকে নির্বাচিত হন। ফলে মাস্টার্স পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ :
মেজর আসাদ তখন পাকিস্তান আর্মির কমিশন র্যংকের জন্যে চুড়ান্ত পরীক্ষায় নির্বাচিত হয়ে দিন গুনছেন পশ্চিম পাকিস্তানে যাবেন ট্রেনিং এর জন্যে, কিন্তু যে জন্যে এ আয়োজন তাহা হাতের মুঠোর ভেতর চলে আসায় আর পাকিস্তান যাওয়া হলো না। সিদ্ধান্ত নিলেন মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে দেশ স্বাধীন করবেন। পাকিস্তানে না যাবার জন্যে সেজ ভাই এ্যাডভোকেট কামরুজ্জামানের বাসায় অবস্থানকালে বার বার চিঠি আসে। শেষ পর্যন্ত পাক আর্মির ভয়ে তাঁকে ভাই এর বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে হয়।
মেজর আসাদ শেষ পর্যন্ত পাক আর্মিতে যোগ না দিয়ে যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। ৪ঠা এপ্রিল ঢাকা থেকে যশোর এসে সরাসরি ৮ নং সেক্টরে যোগ দেন। মেজর ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তখন যশোর সেক্টরে অর্গানাইজ করা আরম্ভ হয়েছে। সামান্য ট্রেনিং নিয়ে মোটামুটি অপারেশনে যোগ দিতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে ছোট খাট অপারেশনে সফলতা পান। এতে করে তাঁর মনোবল উঁচু হয়ে উঠলো। এরপর চলে গেলেন ভারতের বশিরহাটে। সেখানে ইটইন্ডিয়া নামক এক বিশাল আম বাগানে ক্যাম্প তৈরী করলেন। তাদের সাথে ছিল এক কোম্পানী ইপিআর ও এক কোম্পানী এফ. এফ (ফ্রিডম ফাইটার)। বাংলাদেশের দুইশত গজ ভিতরে তাদের ডিফেন্স ছিল। দেশের ভিতর অপারেশন চালাতে অত্র ডিফেন্স অত্যান্ত জরুরী বিধায় এটা ধরে রাখার দরকার ছিল। মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তানী পাঞ্জার রেজিমেন্ট তাদের ডিফেন্সের উপর রাত ৩.৩০ মি: প্রচন্ড আক্রমণ আরম্ভ করলেন। প্রথমে তারা হকচকিয়ে পড়লেও কিছু সময় পরে শত্রুকে দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিতে আরম্ভ করলেন। মোট ১৫ ঘন্টার যুদ্ধে তাদের পক্ষের দুইজন ই. পি. আর শহীদ হন এবং ১০ জন ছাত্র / ই. পি. আর আহত হন। শত্রু পক্ষের প্রায় ৪০ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী ১ জন পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন, ১ জন হাবিলদার ও ১ জন সিপাহীর লাশ এনেছিলেন ক্যাম্পে। যুদ্ধের ইতিহাসে এটাকে ভোমরা-খোজাডাঙ্গা যুদ্ধ নামে খ্যাত।
দ্বিতীয় আক্রমণ পরিচালিত হয় বৈকারী বিওপিতে। এখানে ও পাক-পক্ষে বেশ হতাহত হয়েছিল, কিন্তু বিওপি দখল করতে পারেনি কারণ তাদের আক্রমণে ভূল পরিকল্পনা ছিল। জুন মাস পর্যন্ত এমন কোন রাত ছিল না যে রাতে তাঁরা অপারেশনে যান নাই। জুলাই থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত ভারতের মেঘালয় রাজ্যের মূর্তি নামক স্থানে তাদের ৬২ জন ক্যাডেটকে ট্রেনিং দিয়ে কমিশন দেওয়া হয়। তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সালাম গ্রহণ করেন।
১২ অক্টোবর হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ১১ নং সেক্টরের মানকের চর ও পুরাখাসিয়া সাব-সেক্টরের কামান্ডার হিসাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন যথাক্রমে-কর্ণকোরা মার্কেট, নক্সী, কামালপুর, ভাইডাঙ্গা এবং শেরপুর ও গাইবান্ধায়।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পাক-আর্মির কনভয়ের উপর এ্যামবুশ করেন। এই জায়গাটা ছিল বক্সিগঞ্জ ও কামালপুরের মাঝামাঝি জায়গায়। ভারতের দুই কোম্পানী সৈন্য এবং মেজর আসাদের ১ কোম্পানী সৈন্য ছিল। এখানে পাকিস্তানের এক প্লাটুন সৈন্য সম্পূর্ণ খতম হয়েছিল এবং বহু আস্ত্র শস্ত্র দখল করেছিলেন। এর পর মেজর আসাদকে পুরা খাসিয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় নভেম্বরের ১৬ তারিখে এবং ওখান থেকে নক্সি বি ওপিতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। পাক-আর্মির বেশ ক্ষয়ক্ষতি সাধন করে ফিরে আসেন। পাক-ভারত যুদ্ধ আরম্ভ হলে আবার ও তাঁকে মানকের চরে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানে হয়। ১২ ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনীর হাত থেকে গাইবান্ধা মুক্ত করেন ।
পুরা খাসিয়ার দায়িত্বে থাকাকালীন ফরওয়ার্ড পজিশনে বেশ কয়েকবার পাক-আর্মি তাদের ক্যাম্পের উপর আক্রমণ পরিচালনা করে। প্রতিবারেই দুই/একজন নিহত হলেই পাক-বাহিনী পশ্চাদবরণ করে।
রৌমারী থানা সর্বদায় মুক্ত ছিল। এখানে পাক-আর্মি কয়েক বার দখলের চেষ্টা করে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পাক-আর্মি হতাহতদের ফেলে পালিয়ে যায়। রৌমারী তাদের মানকেবচর এর ফবোয়ার্ড হেড কোয়াটার ও ট্রেনিং ক্যাম্প হিসাবে ব্যহত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের মূল অংশ্যই এখানে থাকতো এবং মাঝে মধ্যে গাইবান্দায় আক্রমণ পরিচালনা করতো।
মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে চাওয়া পাওয়া :
মেজর আসাদের সেই রক্ত ঝরা দিনগুলির কথা মনে হলেই মনে পড়ে আলমগীর, বাদশা, সেলিম, হাবিব এবং আরো অনেকের কথা যাদের নাম তাঁর স্মৃতিপট থেকে হারিয়ে গেছে। যারা জীবন দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতার লালসূর্যকে আহবান করতে চেয়েছিল। চেয়েছিল আগামী প্রজন্মকে শোষন দুঃশাসন ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি দিতে। যে লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য সাধনের জন্য এ সমস্ত বীর সন্তানেরা রক্ত দিয়ে গেল, জীবনকে উৎস্বর্গ করে গেল। কিন্তু তাঁরা কি পেয়েছে? তাদের স্বপ্ন কি বাস্তবায়িত করতে পেরেছে কি আগামী প্রজন্মের জন্যে সামাজিক রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করতে? আজ ও শোষনের নির্যাতনের নিপীড়নের ও বঞ্চনার কাহিনী শুনতে শুনতে অতিষ্ট হতে হয়। আজও মানুষ অত্যাচারীর বুটের তলায় পিষ্ট হচ্ছে। আজও এক মুঠো অন্ন যোগাতে পেটের সন্তান বিক্রী করে দিতে হয়। সম্ভ্রম বিক্রি করে উদর পুর্তি করতে হয়।
পেশাগত জীবন :
যুদ্ধের পর ১১তম সেক্টরের মুক্তিবাহিনী নিয়ে ময়মানসিংহে শানকি পাড়া ক্যাম্প স্থাপন করেন। ওখান থেকে মার্চ মাসে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে আসেন। গাজীপুরে ১৬তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দাঁড় করান। এটা সম্পন্ন হবার পর কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ১৩ তম ইস্টবেঙ্গলে পোস্টিং দেওয়া হয় এবং ওখানে প্রায় ৩ বৎসর অতিবাহিত করেন।
বর্তমান অবস্থান :
বর্তমানে ঠিকাদারী ব্যবসায় জড়িত। সাথে সাথে বাংলাদেশ বেসরকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি নামে একটি অরাজনৈতিক সংগঠন দাঁড় করান। ১৯৯০ সালে আন্দোলন ও সংগ্রাম করে বহু দাবি আদায় করেন। এক সময় দৈনিক ইনকিলাবে একজন কলামিস্ট হিসাবে রাজনৈতিক কলাম লিখতেন। বর্তমানে কিছুটা অবসর জীবনযাপন করছেন।
তথ্য সূত্র :
সাক্ষাৎকার
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট :
১২.১১.২০১১