
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ / Bir Shrestha Nur Mohammad Sheikh (1936-1971)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100202 বার পড়া হয়েছে
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ শেখ / Bir Shrestha Nur Mohammad Sheikh (1936-1971)
বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ
Bir Shrestha Lance Naik Nur Mohammad Sheikh
Home District: Narail
পারিবারিক
পরিচিতি:
স্বাধীনতার অমর সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ নড়াইল জেলার মহেশখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ মহেশখালী গ্রামের একজন কৃষক ছিলেন। মাতার নাম জেনাতুন নেছা। নূর মোহাম্মদ ছিলেন পিতা মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন।
ছেলে বেলাঃ
জমি জায়গা যা ছিলো তাতে নিজের হাতে চাষ করে সংসার মোটামুটি সচ্ছলই থাকতো। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হিসেবে তাঁর প্রতি আদর আহল্লাদের পরিমান একটু বেশীই ছিলো। ফলে বুদ্ধি ও মেধা থাকা সত্ত্বেও স্কুলের লেখাপড়ার দিকে বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি। অন্যদিকে গান-বাজনা, যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়লেন। খেলাধূলাতেও তাঁর আসক্তি কম ছিলো না। গ্রাম-বাংলার নিভৃত পল্লীর মাঠে-ঘাটে, পথে প্রান্তরে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। গ্রামে তাঁর পরিচয় ছিলো দুরন্ত ও সাহসী ছেলে হিসেবে। মা-বাবা তাঁর কোন কিছুতেই বাঁধা দিতেন না। এই রকম অগাধ ভালোবাসা ও অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে তিনি বড় হয়ে উঠছিলেন।
পিতা-মাতার অর্ন্তধ্যান পরবর্তী সময়ঃ
শৈশবের মধুর দিনগুলি পার হতে না হতেই এর মাঝে হঠাৎ করে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত মা-বাবা দুজনই হারিয়ে যায় চিরদিনের জন্য। নূর মোহাম্মদ এই বিয়োগ ব্যাথায় দিশেহারা হয়ে যায়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিক হয়ে নবীন কিশোর নূর মোহাম্মদ ভেবেই পেলেন না কি করবেন। আশেপাশে তাঁর কোন দরদী অভিভাবকও ছিলেন না যে তাঁকে সঠিক পথে চলার জন্য সৎ পরামর্শ দেবেন। এই অবস্থায় তিনি সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে গান-বাজনায় মেতে উঠলেন। নূর মোহাম্মদ খুব ভালো গান গাইতে পারতেন। সমবয়সী বন্ধুরাই হয়ে উঠেন তাঁর ব্যাথার বেদনার সাথী ও আনন্দের অংশীদার। তিনি যাত্রার দল ও জারী গানের দল তৈরী করতে চাইলেন। কিন্তু এসব করতে বেশ টাকা-পয়সা লাগে। আর সারা বছরের খাওয়া, পরা, ঔষধ ক্রয় ও লোক লৌকিকতার জন্য বড় ধরনের একটা খরচ তো আছেই। টাকা-পয়সার প্রয়োজন হলে তিনি জমি বিক্রি করতেন। এরকম অবস্থার ভিতর দিয়ে বেশ কয়েক বছর কেটে গেল। যাত্রা, থিয়েটার, গান-বাজনার জগতে সবাই তাঁকে চিনে ফেললো। জমি বিক্রি করার টাকা দিয়ে তিনি একটি গ্রামোফোন পর্যন্ত কিনলেন। এক সময় বিক্রি করার মত আর কোন জমি অবশিষ্ট থাকলো না। শেষ পর্যন্ত ভিটেবাড়ীটাই তাঁর সম্বল থাকলো।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
পরিণত বয়সে তিনি নিজ গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের মেয়ে তোতাল বিবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। বিয়ের পর থেকেই
নূর মোহাম্মদ শ্বশুর বাড়ীতেই অবস্থান করতে থাকেন। সংসারের দায়িত্ব ঘাড়ে পড়ার পর উপার্জন করার তাগিদে তিনি স্থানীয় আনসার বাহিনীতে যোগ দিলেন। ইতোমধ্যে তাঁর ছেলেমেয়ে হয়েছে। কিন্তু স্বল্প আয়ে সংসার চলতে চায় না। আরো বেশী উপার্জন করার প্রয়োজনে ১৯৫৯ সালের ১৪ই মার্চ ২৩ বছর বয়সে নূর মোহাম্মদ ভর্তি হলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ই.পি.আর) বাহিনীতে, যা এখন বি. ডি. আর অর্থাৎ বাংলাদেশ রাইফেলস নামে পরিচিত। চাকরি প্রাপ্তির পর তিনি স্ত্রী, পুত্র ও কন্যাদের জন্য কাপড় কিনে একটি চিঠিতে বিস্তারিত জানালেন।
প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে ১৯৫৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর তাঁকে দিনাজপুর সেক্টরে পোস্টিং দেয়া হয়। আর এখানেই তিনি ১৯৭০ সালের ১লা জুলাই পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর বদলী হয়ে আসেন নিজের জেলা যশোর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে।
একাত্তরের প্রথম থেকেই সারা বংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে উত্তাল সমুদ্রের মত গর্জন শুরু করতে থাকে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় জেগে ওঠা মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে নগর থেকে গ্রামান্তরে। গ্রাম-বাংলার প্রতিটি মানুষ স্বাধীকারের চেতনায় জেগে ওঠে। স্বাধীনতার আন্দোলনের ও স্বদেশ প্রেমের ঢেউ সিপাহী নূর মোহাম্মদের সৈনিক মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের অর্থ তাঁর ভালো
ভাবেই জানা ছিলো। তিনিও অন্য সকলের মত স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতেন। তাই মার্চে ছুটি ভোগ করতে এসে যখন দেখলেন ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতে পাক হানাদার বাহিনী এদেশের নিরীহ জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যা করছে তখন তিনি আর স্থির থাকতে পারলেন না। শুরু হলো স্বাধীনতার যুদ্ধ। সিপাহী নূর মোহাম্মদ সচেতন বিবেকবোধের নির্ভুল নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করলেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ আট নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক জেনারেল মঞ্জুরের নির্দেশে সীমান্তে নিয়োজিত হন। দীর্ঘদিনের সামরিক অভিজ্ঞতা থাকার দরুন একটি কোম্পানীর প্রধান নিযুক্ত করে গোয়াল হাটি গ্রামের সামনে স্থায়ী দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে। সাবেক ই, পি, আর’এর বাঙ্গালী সৈন্যদের নিয়ে তাঁর কোম্পানীটি গঠিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর নূর মোহাম্মদের সাথে দুইজন সহযোদ্ধা। ছুটিপুর ঘাঁটি হতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর নজর রাখার এবং নিজস্ব প্রতিরক্ষায় নিরাপত্তার জন্যই নূর মোহাম্মদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নূর মোহাম্মদের সাথে অন্য দুইজন সহযোদ্ধা কঠোর দায়িত্ব পালনের জন্য সতর্ক প্রহরা দিয়ে চলেছেন। সীমাহীন নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে তাঁরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানী দস্যুরা একসময় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি ও অবস্থানের কথা জানতে পারে। শত্রুর উপর নজর রাখতে গিয়ে তাঁরা নিজেরা তিনজনই শত্রু র নজরে পড়ে যান। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়। সকাল সাড়ে
ন’টার দিকে পাক হানাদার বাহিনী মুক্তি বাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটির তিনদিকে অবস্থান গ্রহণ করে। নূর মোহাম্মদের বাহিনীকে গোলক ধাঁধায় ফেলার জন্য শত্রু সৈন্যরা প্রতিরক্ষা ঘাটির তিনদিকে ঘুরপথে অবস্থান নেয়। শত্রু সৈন্যরা বিপদজনক অবস্থায় টহলকে ফাঁদে ফেলার জন্য তিন দিক থেকে এগিয়ে আসে। আক্রমণ করার জন্য গুলি ছোড়া শুরু করলে নূর মোহাম্মদ বুঝতে পারেন যে, ফাঁদে পড়ে গেছেন। নূর মোহাম্মদের বুঝতে বাকী রইল না যে, জীবনের শেষ যুদ্ধের সম্মুখে তিনি উপস্থিত হয়েছেন। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা ঘাঁটিও জেনে গেছে যে, তাদের টহল আক্রান্ত। নূর মোহাম্মদ আর তাঁর দুই সহযোদ্ধাকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে প্রতি আক্রমণ করা হয়। কিন্তু নূর মোহাম্মদ ও তাঁর দুই সহযোদ্ধা তখন চতুর্দিক থেকে শত্রুবেষ্টিত।
প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে শত্রুদের আক্রমণ করেও পেট্রোলটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই রকম অবস্থায় ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ চেষ্টা করছিলেন তাঁর পেট্রোলটিকে পিছু হটিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে ফিরে যেতে। টহল দলের প্রধান অস্ত্র হালকা মেশিন গানটি ছিল নূর মোহাম্মদের দুই সহযোদ্ধার অন্যতম সিপাহী নান্নু মিয়ার হাতে। সেই সময় এই অস্ত্রটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। টহল দলকে পিছু হটিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে যোগ দেবার জন্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে পিছন ফিরতে থাকে ওরা তিনজন। এ সময় ঘটলো অঘটন। একটি বুলেটের আঘাতে নান্নু মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। মারাত্মক
আহত অবস্থায় নান্নু মিয়া এল, এম, জি চালাতে পারছিলেন না। এক সময় হাত থেকে এল, এম, জি গড়িয়ে পড়লো। সেই সময় নূর মোহাম্মদ নিজের হাতে মেশিন গান তুলে নিলেন। মাতৃভূমি রক্ষার কঠিন দায়িত্বের কথা তাঁর স্মরণ হলো। দলীয় অধিনায়ক হিসেবে তিনি নিজের জীবনটি বাঁচাতে পারতেন। সৈনিক জীবনের মহান ব্রতকে তিনি নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে সৈনিকদের রক্ষা করতে চাইলেন। আহত সিপাহী নান্নু মিয়াকে তিনি ফেলে গেলেন না। এক হাতে এলএমজি নিয়ে তিনি কাঁধে আহত সিপাহী নান্নু মিয়াকে তুলে নিলেন। সেই সাথে মেশিন গান থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ ছুড়তে থাকলেন। কিভাবে সঙ্গীদের নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরা যায় এই চিন্তায় তিনি একই সঙ্গে যুদ্ধের এবং আত্মরক্ষার কৌশল পাল্টে ফেললেন। এ সময় নিরাপদ ঘাঁটিতে পৌঁছানোই ছিল তাদের লক্ষ্য। নান্নু মিয়াকে কাঁধে রেখেই তিনি ঘন ঘন অবস্থান পাল্টে পাল্টে যুদ্ধ করে চলেছেন, যাতে শত্রু যেন বুঝতে
না পারে কোন দিক থেকে কতজন মুক্তিযোদ্ধা তাদের সাথে লড়াই করছে। শত্রুদের গোলক ধাঁধাঁয় ফেলার জন্য ডাইনে বায়ে গুলি চালাতে চালাতে পিছু হটছেন। বিরামহীনভাবে গুলি চালাতে চালাতে অতি দ্রুত তাঁরা নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে ছুটতে থাকলেন। এমন সময় হঠাৎ ২ ইঞ্চি মর্টারের একটি গোলা এসে পড়লো তাঁর ঠিক ডান পাশে। গোলার আঘাতে তাঁর ডান হাঁটু ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ডানকাঁধেও তিনি আঘাত পেলেন। জীবনের শেষ পরিণতির কথা তিনি বুঝতে পারলেন। তবে দেশমাতৃকার জন্য অধিনায়কের কথা ভুলতে পারলেন না। মরণের পূর্বে টহল বাহিনীকে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে পৌঁছে দেয়ার শেষ চেষ্টাটুকু তিনি করতে চাইলেন।
ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের কাঁধে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটছে। মারাত্মক আহত অবস্থায় তিনি সৈনিক জীবনের ব্রতের কথা স্মরণ রেখেছেন। লাইট মেশিনগান হাতে তিনি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সহযোগী সিপাহী মোস্তফার দিকে এলএমজিটা বাড়ি
য়ে দিয়ে তাঁদেরকে পশ্চাদাপসরণ করার আদেশ করলেন। ‘শিগগীর নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নাও। তাড়াতাড়ি যাও প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে। আমি ততক্ষণে শত্রুদেরকে প্রতিরোধ করি। আহত অধিনায়ককে রেখে মোস্তফা কিছুতেই যেতে রাজী হলেন না। কিন্তু নূর মোহাম্মদের নির্মম আদেশের কাছে তিনি হার মানলেন। ‘নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নাও, এই নাও এলএমজি। তোমার এসএলআরটা আমাকে দাও। এটা তোমার উপরওয়ালার হুকুম। তুমি সিপাহী, তোমার ল্যান্স নায়েকের হুকুম না মানলে তোমার কোর্টমার্শাল হবে। আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো, যেভাবে জখম হয়েছি তাতে আমি আর বাঁচবো না। যেভাবে রক্তপাত হচ্ছে, তাতে এখনই আমার সারা শরীর ঝিমঝিম করছে, চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। আমাকেসহ নিতে গেলে তোমরা দু’জনও মারা পড়বে। তিনজন মারা যাবার চেয়ে দু’জন বেঁচে থাকা ভালো নয় কি ? নান্নু মিয়ার জখম গুরুতর নয়, ও বেঁচে যাবে। কিন্তু আমি যে বাঁচবো না। সে তো তুমি বুঝতে পারছো। আমার কথা শোন। আর দেরী করো না। জানো না, যুদ্ধক্ষেত্রে এক মুহুর্ত নষ্ট করার অর্থ কি ? দেখছো না, কিভাবে শত্রুর গোলাগুলি ছুটে আসছে ? ওরা এগিয়ে আসছে ? যাও তাড়াতাড়ি যাও। দেরী করে সকলের সর্বনাশ করো না মোস্তফা। এখনই রওনা হও।
সিপাহী মোস্তফা অধিনায়কের কথাকে শিরোধার্য মনে করে আহত নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নিলেন। হাতে এলএমজিটা নিয়ে বারে বারে স্থান পরিবর্তনের মাধ্যমে গুলি ছুড়তে লাগলেন এবং পিছনের দিকে অগ্রসর হতে লাগলেন। ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ সিপাহী মোস্তফার সেল্ফ লোডেড রাইফেলটি নিজ হাতে তুলে নিলেন। এ্যাডভ্যান্সডরত শত্রুদের উদ্দেশ্যে তিনি গুলি ছুড়তে লাগলেন, যাতে মোস্তফা নান্নুকে সঙ্গে নিয়ে মূল ঘাঁটিতে ফিরতে পারে। সিপাহী মোসত্মফা নেতার নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করতে থাকেন। মোস্তফা নান্নুকে বুকে আঁকড়ে নিয়ে মাটিতে গড়িয়ে গড়িয়ে নিরাপদে আশ্রয়ের জন্য অগ্রসর হতে থাকলেন।
নূর মোহাম্মদ আহত অবস্থায় এলএমজিটা সাথে না নিয়ে স্টেনগানটা নিলেন। তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আহত অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর শরীর অবশ হয়ে আসলেও শত্রুদের ব্যাতিব্যস্ত রাখার জন্য গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে অবিরাম গতিতে গুলি করেই চলেছেন, যাতে শত্রুরা মোস্তফা ও নান্নুর দিকে মনোযোগ দিতে না পারে। অবিরাম রক্তক্ষরণে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকলেও সৈনিক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কর্তব্যবোধ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
তথ্য সংগ্রহ:
হাবিব ইবনে মোস্তফা
তথ্য সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
অক্টোবর ২০১১

স্বাধীনতার অমর সৈনিক বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ নড়াইল জেলার মহেশখালী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ মহেশখালী গ্রামের একজন কৃষক ছিলেন। মাতার নাম জেনাতুন নেছা। নূর মোহাম্মদ ছিলেন পিতা মাতার একমাত্র সন্তান ছিলেন।
ছেলে বেলাঃ
জমি জায়গা যা ছিলো তাতে নিজের হাতে চাষ করে সংসার মোটামুটি সচ্ছলই থাকতো। পিতা-মাতার একমাত্র সন্তান হিসেবে তাঁর প্রতি আদর আহল্লাদের পরিমান একটু বেশীই ছিলো। ফলে বুদ্ধি ও মেধা থাকা সত্ত্বেও স্কুলের লেখাপড়ার দিকে বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি। অন্যদিকে গান-বাজনা, যাত্রা, থিয়েটার প্রভৃতি সাংস্কৃতিক কার্যকলাপের সাথে তিনি জড়িয়ে পড়লেন। খেলাধূলাতেও তাঁর আসক্তি কম ছিলো না। গ্রাম-বাংলার নিভৃত পল্লীর মাঠে-ঘাটে, পথে প্রান্তরে তাঁর জীবন অতিবাহিত হয়েছে। গ্রামে তাঁর পরিচয় ছিলো দুরন্ত ও সাহসী ছেলে হিসেবে। মা-বাবা তাঁর কোন কিছুতেই বাঁধা দিতেন না। এই রকম অগাধ ভালোবাসা ও অবাধ স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে তিনি বড় হয়ে উঠছিলেন।
পিতা-মাতার অর্ন্তধ্যান পরবর্তী সময়ঃ

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ:
পরিণত বয়সে তিনি নিজ গ্রামের অবস্থাসম্পন্ন কৃষকের মেয়ে তোতাল বিবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। বিয়ের পর থেকেই

প্রাথমিক সামরিক প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হলে ১৯৫৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর তাঁকে দিনাজপুর সেক্টরে পোস্টিং দেয়া হয়। আর এখানেই তিনি ১৯৭০ সালের ১লা জুলাই পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। এরপর বদলী হয়ে আসেন নিজের জেলা যশোর সেক্টর হেড কোয়ার্টারে।
একাত্তরের প্রথম থেকেই সারা বংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে উত্তাল সমুদ্রের মত গর্জন শুরু করতে থাকে। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ডাক দিলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় জেগে ওঠা মুক্তিকামী মানুষের আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে নগর থেকে গ্রামান্তরে। গ্রাম-বাংলার প্রতিটি মানুষ স্বাধীকারের চেতনায় জেগে ওঠে। স্বাধীনতার আন্দোলনের ও স্বদেশ প্রেমের ঢেউ সিপাহী নূর মোহাম্মদের সৈনিক মনকেও নাড়া দিয়ে যায়। স্বাধীনতা, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের অর্থ তাঁর ভালো

স্বাধীনতা যুদ্ধে ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ আট নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক জেনারেল মঞ্জুরের নির্দেশে সীমান্তে নিয়োজিত হন। দীর্ঘদিনের সামরিক অভিজ্ঞতা থাকার দরুন একটি কোম্পানীর প্রধান নিযুক্ত করে গোয়াল হাটি গ্রামের সামনে স্থায়ী দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে। সাবেক ই, পি, আর’এর বাঙ্গালী সৈন্যদের নিয়ে তাঁর কোম্পানীটি গঠিত হয়েছিল।
১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর নূর মোহাম্মদের সাথে দুইজন সহযোদ্ধা। ছুটিপুর ঘাঁটি হতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর নজর রাখার এবং নিজস্ব প্রতিরক্ষায় নিরাপত্তার জন্যই নূর মোহাম্মদকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। নূর মোহাম্মদের সাথে অন্য দুইজন সহযোদ্ধা কঠোর দায়িত্ব পালনের জন্য সতর্ক প্রহরা দিয়ে চলেছেন। সীমাহীন নিস্তব্ধতার মধ্য দিয়ে তাঁরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকলেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, পাকিস্তানী দস্যুরা একসময় মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি ও অবস্থানের কথা জানতে পারে। শত্রুর উপর নজর রাখতে গিয়ে তাঁরা নিজেরা তিনজনই শত্রু র নজরে পড়ে যান। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে পাকিস্তানী সৈন্যরা আক্রমণ করার জন্য তৈরি হয়। সকাল সাড়ে

প্রতিরক্ষা ঘাঁটি থেকে শত্রুদের আক্রমণ করেও পেট্রোলটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না। এই রকম অবস্থায় ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ চেষ্টা করছিলেন তাঁর পেট্রোলটিকে পিছু হটিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে ফিরে যেতে। টহল দলের প্রধান অস্ত্র হালকা মেশিন গানটি ছিল নূর মোহাম্মদের দুই সহযোদ্ধার অন্যতম সিপাহী নান্নু মিয়ার হাতে। সেই সময় এই অস্ত্রটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। টহল দলকে পিছু হটিয়ে প্রতিরক্ষা ঘাঁটিতে যোগ দেবার জন্য গুলি ছুড়তে ছুড়তে পিছন ফিরতে থাকে ওরা তিনজন। এ সময় ঘটলো অঘটন। একটি বুলেটের আঘাতে নান্নু মিয়া মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। মারাত্মক


ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদের কাঁধে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে প্রচুর রক্তক্ষরণ ঘটছে। মারাত্মক আহত অবস্থায় তিনি সৈনিক জীবনের ব্রতের কথা স্মরণ রেখেছেন। লাইট মেশিনগান হাতে তিনি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছেন। সহযোগী সিপাহী মোস্তফার দিকে এলএমজিটা বাড়ি


নূর মোহাম্মদ আহত অবস্থায় এলএমজিটা সাথে না নিয়ে স্টেনগানটা নিলেন। তিনি জীবনের শেষ মুহূর্তটি পর্যন্ত অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আহত অবস্থায় অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে তাঁর শরীর অবশ হয়ে আসলেও শত্রুদের ব্যাতিব্যস্ত রাখার জন্য গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে অবিরাম গতিতে গুলি করেই চলেছেন, যাতে শত্রুরা মোস্তফা ও নান্নুর দিকে মনোযোগ দিতে না পারে। অবিরাম রক্তক্ষরণে শরীর নিস্তেজ হয়ে আসতে থাকলেও সৈনিক জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কর্তব্যবোধ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি।
তথ্য সংগ্রহ:
হাবিব ইবনে মোস্তফা
তথ্য সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
অক্টোবর ২০১১