
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > হায়দার আনোয়ার খান জুনো / Haider Anwar Khan Juno (1944)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99951 বার পড়া হয়েছে
হায়দার আনোয়ার খান জুনো / Haider Anwar Khan Juno (1944)
হায়দার আনোয়ার খান জুনো
Haider Anwar Khan Juno
Home District: Narail
Haider Anwar Khan Juno
Home District: Narail
পারিবারিক পরিচিতি:
হায়দার আনোয়ার খান জুনো একাধারে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও বীর মুক্তিযোদ্ধা, অপরদিকে সাংস্কৃতিক সংগঠক ও মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ছোট গল্প লেখক। হায়দার আনোয়ার খান জুনোর জন্ম কোলকাতায়, ১৯৪৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর। তাঁর পিতৃভূমি নড়াইলের বরাশুলা গ্রাম (বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার অন্তর্গত) আর নানাবাড়ি নড়াইল থানার অন্তর্গত মির্জাপুর গ্রাম। নানা উপমহাদেশের বিখ্যাত রাজনীতিবিদ সৈয়দ নওশের আলী। পিতা মরহুম হাতেম আলী খান ছিলেন একজন নামকরা প্রকৌশলী। হাতেম আলী খান অত্যন্ত সৎ, আদর্শবান এবং প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মাতার নাম কানিজ ফাতেমা মোহসিনা। তিনি প্রগতিশীল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতির কর্মীদের কাছে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই তার অকৃত্রিম স্নেহ, ভালবাসা পেয়ে ধন্য হয়েছেন। হায়দার আনোয়ার খান জুনোরা দুই ভাই। বড় ভাই হায়দার আকবর খান রণো এদেশের মানুষের কাছে একজন অতি পরিচিত রাজনীতিবিদ।
শিক্ষাজীবন:
হায়দার আনোয়ার খান জুনো যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল, ঢাকা সেন্ট গ্রেগরীজ হাই স্কুল নটোরডাম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন। তিনি ছিলেন খুবই মেধাবী ছাত্র। গণিত ও বিজ্ঞানে তার দখল ছিল অপরিসীম। আইএসসি পরীক্ষায় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তিনি একাদশ স্থান অধিকার করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যা বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। অনার্সেও তিনি ফাস্ট ক্লাস পেয়েছিলেন। পদার্থ বিদ্যায় এমএসসি পাশ করার পর তিনি এটামিক এনার্জি কমিশনে চাকরির সুযোগ পেয়েও তা গ্রহণ করেননি। কারণ রাজনীতিকেই তিনি সার্বক্ষনিক পেশা হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
রাজনৈতিক জীবন:
হায়দার আনোয়ার খান জুনো স্কুল জীবনেই কমিউনিস্ট শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৬২ সালে যখন সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে তিনি সেই আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন এবং কারারুদ্ধ হন। ১৯৬২ সালে যখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন পুনর্জীবিত হয়, তখন থেকেই তিনি পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেন। প্রায় সমসাময়িককালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। একই সঙ্গে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীরও ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছিলেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি কমিউনিস্ট পার্টির জন্য আনেক সাহসী ও ঝুঁকিপূর্ন কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
ছাত্রজীবনে তাঁর প্রধান রাজনৈতিক কাজের ক্ষেত্র ছিল সংগঠন ও ছাত্র আন্দোলন। ১৯৬৩ সালে তিনি যখন কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র তখনি তিনি তদানিন্তন সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন অবিভক্ত পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬- সালে তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক ও সহসভাপতি পদে নির্বাচিত হন। ১৯৭০ সালে তিনি বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সাভাপতি ছিলেন। ১৯৬৬ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি দ্বিধাবিভক্ত হলে তিনি তথাকথিত চীনপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের “পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি” গঠিত হলে, তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে ১৯৭২ সালে তিনি সেই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নাম পরিবর্তন করে ওয়ার্কাস পার্টি নামকরণ করা হয়। তিনি ওয়াকার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৪ সালে কমরেড জুনো ইউনাইডেট পিপলস পার্টি (ইউপিপির) সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ’ ৭১:
৭১ সালের ফেব্রুয়ারী-মার্চের দিকে যখন রাজনৈতিক সংকট তীব্র হয়ে উঠেছিল তখন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত নেয়। কমরেড হায়দার আনোয়ার খান জুনোর উপর দায়িত্ব পড়েছিল সারাদেশ থেকে বাছাই করা কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া। হায়দার আনোয়ার খান জুনোর কিছুটা সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল (ইউ ও টি সি’র মাধ্যমে)। তিনি অস্ত্র সংগ্রহ ও কর্মী প্রশিক্ষণের কাজে হাত দেন। মেধাবী ছাত্র হায়দার আনোয়ার খান জুনো বিজ্ঞানের বই ঘেটে বোম তৈরীর ফর্মূলা আবিস্কার করেন এবং টঙ্গীর কারখানায় বোমা তৈরীর কাজ শুরু হয়। টঙ্গীর শ্রমিকদের সঙ্গেও তার গভীর সম্পর্ক ছিল এবং নানাভাবে শ্রমিক আন্দোলনকে সহযোগিতা করতেন।
৭১ এর মার্চ মাসেই ২৫ তারিখের আগে জুনোর নেতৃত্বে পরীক্ষামূলকভাবে পাক সেনাবাহিনীর গাড়ীর ওপর বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল। হয়দার আনোয়ার খান জুনোর নেতৃত্বে ঢাকা শহরে একগুচ্ছ সাহসী তরুনকে সম্ভব্য যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে তৈরী করা হয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যুদ্ধ শুরু হলে হায়দার আনোয়ার খান জুনো ঢাকার নিকটস্থ শিবপুরে অবস্থান করেন এবং সেখানেই তিনি পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। শিবপুরে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অসংখ্য ছোট বড় যুদ্ধ হয়েছে। অধিকাংশ যুদ্ধে হায়দার আনোয়ার খান জুনো কখনও সৈনিক, কখনও কমান্ডারের ভুমিকা পালন করেছেন। সাহস, রণকৌশল ও বিচক্ষনতার জন্য তার যথেষ্ট নামও ছিল। কোন কোন যুদ্ধে তাঁর ভুমিকা এখনও ঐ অঞ্চলে কিংবদন্তী হয়ে আছে। এ অঞ্চলে তিনি রাজনৈতিক সংগঠনের ভূমিকাও একই সঙ্গে পালন করেছিলেন, যে কারণে তিনি শিবপুরের আবাল বৃদ্ধ বণিতার কাছেও সমভাবে জনপ্রিয় ছিলেন। হায়দার আনোয়ার খান জুনো শিবপুরের যুদ্ধের উপর একটি বই লিখেছেন যা প্রামান্য দলিল হিসাবে বর্তমানে রয়েছে।
সাংস্কৃতিক সংগঠন ও অন্যান্য ভূমিকা:
হায়দার আনোয়ার খান জুনো রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি প্রগতিশীল গণমুখী সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারেও আগ্রহী। এ ছাড়াও তিনি বাংলাদেশ কিউবা সংহতি কমিটির সাধারণ সম্পাদক। সমাজতান্ত্রিক কিউবার সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য অনুষ্ঠিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (যেমন ভিয়েতনমে রাজধানী হ্যানয়, কলিকাতা ও চেন্নাই) যোগদান করেছেন। চেন্নাই সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতা ছিলেন।
হায়দার আনোয়ার খান জুনো গণ-সংস্কৃতি ফ্রন্ট- এর সভাপতি, সমাজতন্ত্র ও মেহনতি মানুষের শোষণমুক্তির সংগ্রামে সংস্কৃতির হাতিয়ারকে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সে ব্যাপারে তিনি তৎপর রয়েছেন। নতুন নতুন গণসংগীত রচনা, গণশিল্পীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং তরুণ ও নতুন প্রতিভাবান শিল্পীদের মার্কসবাদী মতাদর্শে শিক্ষিত করার জন্য তিনি নানা ধরনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ব্যাপারে একটা বড় রকমের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছেন।
তথ্য সংগ্রহ :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
জানুয়ারী ২০১২