
Home যোদ্ধা-বিদ্রোহী / Fighters-Rebel > কমরেড অমল সেন / Comrade Amal Sen (1912 - 2003)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100024 বার পড়া হয়েছে
কমরেড অমল সেন / Comrade Amal Sen (1912 - 2003)
কমরেড অমল সেন
Comrade Amal Sen
Home District: Narail

প্রখ্যাত বাম রাজনীতিবিদ কমরেড অমল সেন ১৯১২ সালে নড়াইল জেলার আফরনা গ্রামে এক জমিদার-জোতদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম জিতেন্দ্রনাথ সেন।
রাজনৈতিক জীবন:
কমরেড অমল সেন তাঁর কৈশোর জীবনেই তিনি বিপ্লবের দীক্ষা গ্রহণ করেন। যখন তিনি মাত্র নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখনই বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে বিপ্লবী ‘অনুশীলন’ গ্রুপের সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে ১৯৩৩ সালে খুলনার দৌলতপুর কলেজে রসায়ন শাস্ত্রে অনার্স পড়াকালীন সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সক্রিয়ভাবে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তদানিন্তন খুলনা-যশোরকে নিয়ে গড়ে ওঠা জেলা কমিটি ১৯৩৩ সালের শেষভাগে নড়াইলের এগারখান অঞ্চলে তাঁকে কৃষক আন্দোলন গড়ার দায়িত্ব অর্পণ করে। তিনি বাকড়ি গ্রামের গরীব কৃষক রসিক ঘোষের বাড়িতে ওঠেন। ঐ অঞ্চলেই ছিল তাঁদের পারিবারিক জমিদারী। জমিদারের সন্তান হয়েও নিপীড়িত নির্যাতিত কৃষকদের সংগঠিত করে জমিদারী শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন। তাঁর এ কর্মকান্ড পার্টি নেতাদের নজর কাড়ে, এক বছরের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৩৪ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সভ্যপদ অর্জন করেন। ঐ সময় এঘারোখানসহ নড়াইলের বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষক আন্দোলন গড়ার গুরুদায়িত্ব তাঁর উপর অর্পন করা হয়। ‘হাটখোলা আন্দোলনে’ সক্রিয়ভাবে তিনি কৃষকের পাশে দাঁড়ান। এর পাশাপাশি মৎসজীবিদের সংগঠিত করে ‘মৎসজীবি সমিতি’ গঠন করেন।
তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৩৭ সালে তাঁকে ‘যশোর-খুলনা আঞ্চলিক কমিটি’তে অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে ১৯৪২ সালে খুলনা-বরিশাল-যশোর অঞ্চলকে নিয়ে যে গেরিলা টিম গঠন করা হয় কমরেড অমল সেনকে সে টিমেরও সদস্য করা হয়। ১৯৪৬ সালে যে তেভাগা আন্দোলনের উত্তাল জোয়ার সৃষ্টি হয়, নড়াইলে সে তেভাগা আন্দোলনের প্রধান সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তিনি যশোর জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঐ সময় কমরেড রণদীভের বাম হঠকারী লাইন প্রয়োগের প্রাক্কালে তিন গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন। যদিও কমরেড রণদীভের হঠকারী লাইনের বিরোধিতা প্রথম থেকেই তিনি করে আসছিলেন, কিন্তু ইস্পাত দৃঢ় কমিউনিস্ট শৃঙ্খলা মেনে চলা কমরেড অমল সেন পার্টি লাইন কার্যকরী করার ক্ষেত্রে কখনও অদৃঢ় ছিলেন না। অবশেষে যুক্তফ্রন্ট সরকারের আমলে (আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভাকালে) তিনি মুক্তি পান। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইনজারির পর তিনি পুনরায় গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে কারমুক্ত হন। মুক্তি পাওয়ার পর পরই যশোর জেলা কমিটির সদস্য হিসেবে নড়াইল অঞ্চলে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। কিন্তু বেশিদিন তাঁকে বাইরে থাকতে দেয়নি স্বৈরচার সরকার। আবারও কারারুদ্ধ করা হয় এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা জেল থেকে মুক্তি পান। কমরেড অমল সেন ছিলেন শোষক-নির্যাতকদের কাছে মূর্তিমান বিপ্লবী। তাই ১৯৭০ সালে আবারও কারান্তরালে যেতে হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখে পাক হানাদার বাহিনীর হামলার পরপরই বীরজনতা জেল ভেঙ্গে তাঁকে বের করে। ১৯৭১ সালের জুন মাসে তিনি ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ-ভারত যখন ‘শ্রেণীশত্রু খতমে’র উন্মাদনা চলছে, তখনও সেই কালস্রোতে তিনি ভেসে যাননি। গণলাইনে কাজ করার গণবিপ্লবী পতাকা তুলে ধরেন তিনি।
অমল সেনের সহকর্মী ছিলেন কমরেড হেমন্ত সরকার, কমরেড নূর জালাল, কমরেড মোদাচ্ছের মুন্সি প্রমুখ। ১৯৭১ সালে তিনি যখন জেল থেকে বের হলেন, তখন কমরেড সুখেন দস্তিদারের নেতৃত্বাধীন ই. পি. সি. পি (এম. এল)-এর সভ্য ছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত নীতি নিয়ে মতবিরোধ বাধায় তিনি দলত্যাগ করেন এবং পরে কলকাতা চলে যান। সেখানে ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক কমিটি’র সাথে যুক্ত হন।
১৯৬৬ সালে পার্টিতে এক ভাঙ্গন সৃষ্টি হয়। চীনপন্থি অর্থাৎ পিকিংপন্থি এবং রুশপন্থি অর্থাৎ মস্কোপন্থি বলে সাধারণভাবে পরিচিতি হয়েছিল দুটি অংশ। তিনি চীনাপন্থি অংশে ছিলেন।
১৯৭২ সালে বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর তিনটি পার্টি কেন্দ্রে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যে লেনিনবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠে, সে পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কমরেড অমল সেন। ১৯৮৮ সালে ৬টি পার্টি কেন্দ্রের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পদেও কমরেড অমল সেন নির্বাচিত হন। ১৯৯২ সালে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, সাম্যবাদী দল ও ওয়ার্কার্স পার্টির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা ঐক্যবদ্ধ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি হন। পরবর্তীতে ১৯৯৫ সালে পুনরায় কংগ্রেসের সভাপতি হন এবং ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে (২০০০) তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। সর্বশেষ তিনি ছিলেন বাংলাদেশ ওয়ার্কাস পার্টির সভাপতি হন (১৯৯২-২০০২)। বার্ধক্যজনিত কারণে, তাঁরই প্রস্তাবক্রমে তাঁকে রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য করা হয়নি।
সাহিত্যচর্চা:
তিনি ছিলেন একজন তাত্ত্বিক নেতা। ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি এমনকি সাহিত্যবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তাঁর ছিল অবাধ বিচরণ। তিনি সাহিত্যানুরাগীও ছিলেন। তাঁর লেখা বেশ অনেকগুলো কবিতা আছে, যা ছাপা হয়নি; কাব্যমানের দিক থেকে যা যথেষ্ট উন্নত ছিল। তবে কবিতার আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে বিষয়বস্তু। কৃষকজীবনের আলেখ্য, সুখ-দুঃখ সংগ্রাম, ছোট কৃষক কন্যার আকাঙ্খা, কৃষক বধূর মন-বাসনা, দারিদ্র তাড়িত কৃষকের সংগ্রামী মেজাজ ইত্যাদি অত্যন্ত সাবলীল ভাষা ফুটে উঠেছে এই সব কবিতায়। তাঁর কিছু তাত্ত্বিক রচনাও আছে। কমিউনিস্টজীবন পদ্ধতি কেমন হওয়া উচিত, এই রকম বিষয়বস্তু থেকে জটিল আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়েও তাঁর রচনা আছে।
একজন প্রকৃত জননেতা:
সম্পত্তির সামান্যতমও লোভ ছিল না তাঁর। পারিবারিক সূত্রে তিনি যে সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন তা তিনি স্পর্শও করেননি। নড়াইলে তাঁদের যে বিরাট দোতালা বাড়ী ও জায়গা জমি ছিল তার প্রায় সবই অন্যরা ভোগ করছে। এ নিয়ে তাঁর কোন চিন্তাভা

কমরেড অমল সেনের প্রবল আকাঙ্খা ছিল এদেশেই তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। সেজন্য তিনি কিছুতেই কলকাতায় বা অন্য কোথাও অস্ত্রপাচার বা বড় ধরনের চিকিৎসার জন্য যেতে রাজী হতেন না। কারণ যদি বিদেশে মৃত্যু হয়, এই ছিল তাঁর ভয়। কমরেড অমল সেন ছিলেন আন্তর্জাতিকতাবাদী, কিন্তু নিজ দেশের প্রতি ভালবাসা ছিল প্রবল। আর দেশ বলতে বুঝতেন দেশের ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যারা গরিব ও শ্রমজীবি।
তিনি নড়াইলের বাকড়ী গ্রামে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যেখানে অগ্রাধিকার থাকবে শোষিত শ্রেণীর ছেলে-মেয়েদের। জমিদার শাসিত অঞ্চলে কৃষকদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখবে, এটা সমস্ত প্রভুরা মোটেও ভাল চোখে দেখতো না। গরিব সন্তানদের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা সেসময় শ্রেণীসংগ্রামেরই অংশ ছিল। তাঁর প্রতিষ্ঠা করা সেই স্কুল এখন হাইস্কুলের পরিণত হয়েছে।
কমরেড অমল সেন তাঁর ধনী পরিবার ছেড়ে চলে গেলেন বাকড়ী গ্রামে একেবারে গরিব কৃষক কমরেড রসিক ঘোষের বাড়ী। কমরেড রসিক ঘোষের পরিবারই হয়ে উঠেছিল তাঁর পরম আত্মীয় এবং স্থায়ী ঠিকানা।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিশিষ্ট বাম চিনত্মাবিদ কমরেড হায়দার আকবর খাঁন রণো বলেছেন, ‘আমি নিজেও কমরেড অমল সেনের সঙ্গে কমরেড রসিক ঘোষের বাড়ীতে গেছি এবং থেকেছি। দেখেছি নড়াইলের এগারখান অঞ্চলের গরিব ভূমিহীন শ্রমজীবিদের বাড়ীতে থাকতেই তিনি তৃপ্তি ও আরাম বোধ করতেন। ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে গরিব মানুষগুলো অমল সেনকে তাদেরই একজন মনে করতো”।
কমরেড অমল সেন একটা কথা তিনি প্রায়ই বলতেন, “শ্রমজীবি জনগণের কাছে পুরোপুরি আত্মসর্পণ করতে হবে।
পরলোক গমন:
২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারী ৯০ বছর বয়সে ঢাকার কমিউনিটি হাসপাতালে বৃহস্পতিবার বেলা ২.২৫টা তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর পরই তাঁর মরদেহ লালপতাকায় ঢেকে দেয় হয়। ঐদিন বৈকাল ৫টায় লালপাতাকা শোভিত মরদেহ বার্ডেম হাসপাতাল ‘মর্চুয়ারীতে’ রাখা হয়। ১৮ জানুয়ারী শনিবার বিকাল ৩টায় ৩১/এফ, তোপখানা রোডস্থ ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে চত্ত্বরের মঞ্চে কমরেড অমল সেনের মরদেহ রাখা হয়। এখানে পার্টি ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক-কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-যুব-নারী-সাংস্কৃতিক সংগঠনের হাজার হাজার নেতাকর্মী এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। ১৯ জানুয়ারী পার্টির প্রবীণ তাত্ত্বিক নেতা কমরেড হায়দার আকবর খাঁন রণো’র নেতৃত্বে দলীয় নেতাকর্মীরা মরদেহ নিয়ে নড়াইল যান এবং এগারোখানের বাকরি গ্রামে যথাযোগ্য মর্যাদায় কমরেড অমল সেনকে সমাহিত করা হয়।
তথ্য সংগ্রহ :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
মার্চ ২০১২