
Home মাগুরা জেলা / Magura District > গুপ্ত শাসনামলের মাগুরার ইতিহাস / The history of Magura at Gupta period
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99990 বার পড়া হয়েছে
গুপ্ত শাসনামলের মাগুরার ইতিহাস / The history of Magura at Gupta period
গুপ্ত শাসনামলের মাগুরার ইতিহাস
The history of Magura at Gupta period
The history of Magura at Gupta period
বাংলাদেশে গুপ্ত শাসনামলের সময় ধরা হয় ৩২০ খ্রীস্টাব্দ থেকে ৬৩৭ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত। গুপ্ত শাসকদের রাজত্বকাল ছিল ৩১৮ বছর। মোট শাসক ছিলেন ২২ জন। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নৃপতি ও শাসক ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত, সমুদ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ও শশাঙ্ক।
গুপ্ত শাসন আমলে মাগুরা গুপ্ত রাজাদের অধীনে আসে। সমুদ্রগুপ্তের শাসন আমলে সমগ্র বাংলাদেশ তার অধীনে এসেছিল। হোসেন উদ্দিন হোসেন বলেছেন, ‘‘বৃটিশ আমলে যশোর জেলার উত্তরাঞ্চলের মধুমতি নদীর সন্নিকটে মহম্মদপুরে একটি পুকুর খনন করতে গিয়ে কয়েকটি মুদ্রা আবিস্কার হয়েছে। মুদ্রাগুলো গুপ্ত রাজ বংশের চন্দ্রগুপ্ত, কুমার গুপ্ত ও সুন্ধগুপ্তের প্রচলিত মুদ্রার ন্যায়”। রাজা রাজেন্দ্র লাল মিত্র বলেছেন-,‘এই মুদ্রাগুলির মধ্যে একটি হচ্ছে রাজা শশাঙ্কের, দ্বিতীয়টির কোন গুপ্ত নৃপতির এবং তৃতীয়টি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নাই। এই মুদ্রাগুলো বর্তমানে কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত আছে।” যত দূর জানা যায় এই মুদ্রাগুলো পাওয়া যায় ১৮৫২ সালে। মুদ্রাগুলো তৎকালীন যশোরের ম্যাজিস্ট্রেট F.L.BEAUFORT এর হাতে পড়ে ছিল। তিনি এগুলো এশিয়াটিক সোসাইটিকে উপহার হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।
চন্দ্রগুপ্ত; গুপ্ত সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। দু’বছর রাজত্বের পর তার পুত্র সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেন। তিনি বহু রাজ্য দখল করেছিলেন। সমতট ছিল তার মধ্যে একটি। মাগুরা জেলা ছিল সমতটের মধ্যে। সমুদ্র গুপ্তের পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত; বিক্রমাদিত্য ছিল তার উপাধি। তিনি সমতট রাজ্য জয় করেছিলেন। কুমার গুপ্ত ও সুন্ধ গুপ্তসহ আরো কয়েকজন এ রাজ্যে রাজত্ব করেছিলেন। এক সময় শশাঙ্ক কর্ণসুবর্ণে রাজধানী স্থাপন করেন। তখন তিনি পূর্বদেশ দখল করে নিয়েছিলেন। ফলে সমতটও তার অধীন হয়ে পড়ে। তার রাজত্বকালে সমতটের নানা স্থানে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, “এই যুগে সমতট ও কলিঙ্গের মত কতস্থান হইতে কত লোক সমুদ্র হতে বালি, লম্বক ও সুমাত্রা প্রভৃতি দ্বীপে গিয়া শৈবমত প্রচার এবং বহু সংখ্যক শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। এই নব ঔপনিবেশিক বাঙালীর শক্তি বৃদ্ধি করিয়াছিল। শিবের লিঙ্গ মূর্তি সব জাতীয় লোকে স্পর্শ করিতে ও পূর্জা করিতে পারে। শিবপূজা সকলের কর্তব্য, এতে অধিকারী ও অনাধিকারীর ভেদ নাই, দীক্ষিত না হইলেও বালক বালিকায় ও ইচ্ছামত জলে, ফুলে বিলবকলে শিব পূর্জা করিতে পারে-এই উদার পদ্ধতি হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয় করিয়া দিয়া ছিলেন। ক্রমেক্রমে এ অঞ্চলের লোক এত শৈব মতবলম্বী হইয়াছিল যে সকলে শিব পূজা করিত। শিব কথা কহিত, শিব গীত গাইত এবং শিবের তর্থকথা এমনভাবে সকল বর্ণে প্রবেশ লাভ করেছিল যে, ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ এদেশের একটি প্রবাদ বাক্য হইয়া রহিয়াছে। মাগুরা জেলায় আজও এই প্রবাদটি প্রচলিত আছে।
প্রাচীন বুড়ন দ্বীপ এক সময় গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধীন ছিল। তখন বুড়ন দ্বীপের প্রশাসনিক নাম ছিল ‘খাড়ি মন্ডল’। যশোরের কসবা মুড়লীতে প্রাপ্ত চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্তে মুদ্রা প্রমাণ করে যে, খাড়ি অঞ্চলে গুপ্ত সভ্যতা বিস্তার লাভ করে। গুপ্ত আমলে ভূক্তির শাসন কর্তা ছিল উপরিকা। খাড়ি অঞ্চলের শাসনকর্তা ছিল মন্ডালিকা। মন্ডল কতগুলি গ্রামের সমষ্টি। মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় মন্ডলগাতী নামে একটি গ্রাম রয়েছে। এতেই বুঝা যায় যে, মাগুরা অঞ্চলে এক সময় খাড়ি অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
গুপ্ত শাসনামলের শেষভাগে টাকার পরিবর্তে কড়ির প্রচলন হয়েছিল। কড়ি দিয়ে বেচাকেনা হত। ব্যবসায়ীরা এই কড়ি মাটির পাত্রে রাখত। চোর ডাকাতের ভয়ে অনেক সময় মাটিতে পুতে রাখত। বিভিন্ন কারণে হয়ত এই কড়ি আর মাটি থেকে তুলা সম্ভব হত না। ফলে তা মাটির নিচে থেকে যায়। মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর বা কুপ খননকালে মাটির নিচে মাটির পাত্রে রক্ষিত কড়ি পাওয়া গেছে। এই কড়িগুলো অনেক অনেক বছরের পুরানো বলে ধারণা করা যায়। আব্দুল করিম বলেছেন, “ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য রৌপ্য মুদ্রা ব্যবহার হইত, এই মুদ্রাগুলিকে তংকা (বা টাকা) বলা হইত এবং ওজন ছিল তিন ক্যান্ডারীন (চীনা আউন্সের আট শতাংশ)। তংকার পরিধি ছিল দেড় ইঞ্চি এবং ইহার দুই পিঠেই লেখা থাকত। নির্দিষ্ট ওজন অনুসারে জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণ করা হইত। কেনা বেচার সময় কড়ি ব্যবহার হতো, এক তংকার সঙ্গে ১০,৫২০টি কড়ি বিনিময় হইত।
গুপ্ত শাসন আমলে গ্রাম্য শাসন কর্তার নাম ছিল গ্রামিক। কোন কোন গ্রামে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য একটি করে অধিকরণ ও পুস্তপালের দপ্তর থাকত। এই গ্রাম্য অধিকরণের সদস্য ছিলেন মহত্তর, গ্রামিক কুটুম্ব প্রভৃতিরা। মহত্তর শব্দের অর্থ গ্রামের মুখ্য ব্যক্তি। এই মহত্তর শব্দ থেকেই মাতব্বর শব্দ এসেছে। মাগুরা জেলার প্রতিটি গ্রামে এখনো মাতব্বর আছে। তাদের মাধ্যমে গ্রাম্য বিভিন্ন সালিশ আজও পরিচালিত হয়।
গুপ্ত শাসনামলে মগধের নালান্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুখ্যাতি সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল। শীল ভদ্র এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ ছিলেন। তার শিষ্য ছিলেন চীনা পর্যাটক ইউয়ান চোয়াং। তিনি পাঁচ বছর যাবত বৌদ্ধ শাস্ত্র শিক্ষা লাভ করে ‘মহাবান দব’ উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি ৬২৯ থেকে ৬৪৫ সাল পর্যন্ত সমতটের অধিকাংশ এলাকা ভ্রমণ করেছিলেন। বৃহত্তর যশোর জেলার ৩০টি বৌদ্ধ সংঘরাম ছিল। যশোরের মুরলীতে একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল। মাগুরা জেলার মহম্মদপুরে বৌদ্ধদের বসতি ছিল। এটি বৌদ্ধ নগরীও গড়ে উঠেছিল। নদীর করাল গ্রাসে এই নগরী হারিয়ে যায়। গুপ্তশাসন আমলের শেষভাগে ইউয়ান চোয়াং মহম্মদপুর এসেছিলেন। তখন মহম্মদপুর নাম কি ছিল তা- জানা যায় না। তবে গুপ্ত শাসন আমলে এলেংখালি নামে একটি বন্দর ছিল। মহম্মদপুরের পাশে এলেংখালি নামে মধুমতি নদীর খেয়াঘাট আছে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, ইয়াং চোয়াং এলেংখালি বন্দর হয়ে মহম্মদপুরের বদ্ধ নগরীতে এসেছিলেন।
গুপ্ত শাসন আমলে মাগুরা অঞ্চলে অনেক কায়স্থ ও ব্রাহ্মণ বসতি স্থাপন করেছিলেন। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। এই সময়ে মাগুরা অঞ্চলে কয়েকটি নদী বন্দর স্থাপিত হয়েছিল। এসব বন্দরের সাথে বিদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক গড়ে ওঠেছিল। টলেমির ইতিহাসে প্রমাণ করে মাগুরা জেলার লাঙ্গলাবান্দ বন্দর ছিল। শালিখা অঞ্চলে গভীর জঙ্গল ছিল। এই জঙ্গলে হিংস্র জীব-জন্তু ছিল। গুপ্ত শাসন আমলে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় অবলুপ্ত ছাতিয়ান নদীর তীরে সিন্দাইনে একটি বন্দর ছিল। তবে এ বন্দরের তখন কি নাম ছিল জানা যায়না। গুপ্ত শাসনামলে আজকের মাগুরা জেলা বেশ সমৃদ্ধশালী ছিল।
তথ্যসূত্রঃ
১। হোসেন উদ্দিন হোসেন, যশোরাজ্য দেশ, ঢাকা, ১৯৭৪, পৃঃ ৮।
২। Notes on three ancient coins found at Muhammadpur in the Jessore District J.A.S.B 1852 VOL xxi P.401
৩। সতীশচন্দ্র মিত্র, যশোর খুলনার ইতিহাস, রূপান্তর, ২০০১ পৃ-১২১
৪। গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, মাগুরার ইতিহাস (প্রবন্ধ), দৈনিক জন্মভূমি, খুলনা, ১৮ মে ১৯৮৮ সাল।
৫। গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, প্রাগুক্ত-৪ নং
৬। আব্দুল করিম
৭। অজায় রায়, বাংলা ও বাঙালি
৮। গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, মহম্মদপুর উপজেলার গ্রামের নামে ইতিকথা, দৈনিক বঙ্গবাসী, খুলনা ১৮ ফেব্রুয়ারি-২০০১।
৯। গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, প্রাগুপ্ত-৪ নং
১০। গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, সিন্দাইনের ইতিহাস, দৈনিক গণদেশ খুলনা, এপ্রিল, ১৯৮৬।
তথ্য সংগ্রহেঃ
আবু বাসার আখন্দ
জেলা প্রতিনিধি
মাছরাঙা টেলিভিশন / ভোরের কাগজ