
Home মাগুরা জেলা / Magura District > মৌর্য গুপ্ত পাল ও সেন আমলে মাগুরা / Magura at the period of Pal and Sen Gupta Maurya
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100089 বার পড়া হয়েছে
মৌর্য গুপ্ত পাল ও সেন আমলে মাগুরা / Magura at the period of Pal and Sen Gupta Maurya
মৌর্য গুপ্ত পাল ও সেন আমলে মাগুরা
Magura at the period of Pal and Sen Gupta Maurya
Magura at the period of Pal and Sen Gupta Maurya
চিরায়ত সুখ-সম্পদ আর প্রাচুর্যে ভরা আমাদের এই মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এ দেশের প্রতিটি নগর বন্দর জনপদ স্বকীয় ঐতিহ্যে ভাস্বর। আর সোনার বাংলার সকল লোকালয় ও জনপদই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে মধুমতী, নবগঙ্গা, কুমার ও ফটকী নদী বিধৌত একটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা মাগুরা। সুদূর অতীতেও এ অঞ্চলের ছিল সোনালি ইতিহাস। তবে সে ইতিহাস অস্পষ্ট এবং তা রয়েছে ছড়ানো ছিটানো।
বাংলাদেশ মৌর্য বংশের (খৃঃ পূঃ ৩২৪-১৮৫ খৃঃ পূঃ) শাসনাধীন ছিল। পর্যটক ইউয়ান চোয়াং এর বর্ণনা মতে বর্তমান পশ্চিম বাংলার মেদিনীপুর, চব্বিশ পরগনা ও পূর্ণিয়া জেলায় আবিস্কৃত মুদ্রা এবং মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত সম্রাট অশোকের শিলালিপি হতে নিশ্চিত প্রমাণিত হয় যে মৌর্যরা বাংলাদেশ শাসন করেন। তবে সে সময়ে বর্তমান মাগুরা অঞ্চলের নাম কি ছিল তা জানা যায় না। আর মাগুরা জেলার সীমানা, জনবসতি এসব বিষয়ের সঠিক কোন দিক নির্দেশনা পাওয়া যায় না।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর ভারতবর্ষে ভঙ্গ, কাম্ব, গ্রীক, শক, পহলব ও কুষাণ প্রভৃতি রাজবংশের আবির্ভাব ঘটলেও বাংলাদেশে তাদের কৃতিত্ব প্রতিষ্ঠার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায় না।
ভারতবর্ষে গুপ্ত বংশের উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে এক নবযুগের সূচনা হয়। সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী ব্যাপী গুপ্ত শাসনামলে বাংলাদেশ বিজিত হয়। সমূদ্র গুপ্তের পুত্র ২য় চন্দ্রগুপ্তের আমলে মাগুরা অঞ্চল এক সমৃদ্ধশালী জনপদে পরিণত হয়। মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় গুপ্ত শাসনামলের বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া যায়্ লেখক, গবেষক ও ঐতিহাসিক হোসেন উদ্দিন হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, ব্রিটিশ আমলে যশোর জেলার উত্তরাঞ্চলের মধুমতি নদীর সন্নিকটে মহম্মদপুরে একটি পুকুর খনন করতে গিয়ে কয়েকটি প্রাচীন মুদ্রা আবিস্কৃত হয়েছে। মুদ্রাগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে রাজা শশাঙ্কের, দ্বিতীয়টি কোন গুপ্ত নৃপতির এবং তৃতীয়টি সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নাই। এই মুদ্রাগুলো বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত রয়েছে। গুপ্ত শাসনামলের শেষ দিকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে কড়ির প্রচলন ছিল। মাগুরা জেলার বিভিন্ন এলাকায় পুকুর খননকালে কড়ি পাওয়া গেছে। এক টঙ্কার (টাকা) সঙ্গে ১০,৫২০ টি কড়ি বিনিময় হতো বলে জানা যায়।
গুপ্ত শাসনামলের শেষ দিকে মাগুরা জেলার মহম্মদপুরে একটি বৌদ্ধ নগরী গড়ে উঠে। এ সময়ে মাগুরা অঞ্চলে কয়েকটি নদীবন্দর স্থাপিত হয়। প্রখ্যাত চীনা পর্যটক ইউনিয়ন চোয়াং মধুমতী তীরে গড়ে উঠা এলেংখালী বন্দর হয়ে মহম্মদপুর আসেন। গবেষক ও লেখক গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনীর মতে, গুপ্ত শাসন আমলে মাগুরা জেলার মহম্মদপুর উপজেলায় অবলুপ্ত ছাতিয়ান নদীর তীরে সিন্দাইনে একটি বন্দর ছিল। তবে এ বন্দরের তখন কি নাম ছিল তা জানা যায় না। টলেমীর ইতিহাস হতে জানা যায় যে, মাগুরা জেলার লাঙ্গলবাঁধ একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। মাগুরা অন্যান্য অঞ্চলের এলাকার এ আমলের কোন পূর্নাঙ্গ তথ্য পাওয়া যায় না। তবে শালিখা এলাকাটি গভীর জঙ্গলে পরিপূর্ণ ছিল।
গুপ্ত শাসনামালের শেষের দিকে বাংলাদেশের দক্ষিণ এলাকায় ধর্মাদিত্য, গোপচন্দ্র ও সমাচারদের এবং গৌড় এলাকায় স্থানুদত্ত রাজা ছিলেন ! হযরত মুহম্মদ (সঃ) যখন মদিনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন ঠিক তখন গৌড় তথা বাংলাদেশের স্বাধীন নরপতি ছিলেন রাজা শশাঙ্ক। অনেকের মতে রাজা শশাঙ্ক গুপ্ত বংশশোদ্ভূত ছিলেন। বাংলার এই কীর্তিমান শাসকের রাজত্বকালে মাগুরা জনপদের অবস্থা সম্পর্কে তেমন কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না।
রাজা শশাঙ্কের মৃত্যুর পর বাংলাদেশে সীমাহীন অরাজকতা ও কলহ বিবাদ দেখা যায়। এই চরম দুরবস্থা ইতিহাসে ‘মাৎস্য ন্যায়’ (৬৩৭-৭৫৬ খ্রীঃ) নামে পরিচিত। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্র তৎকালীন যশোর খুলনা অঞ্চলের ভীষণ অরাজকতার বর্ণনা দিয়েছেন। এ সময় মাগুরা অঞ্চলেও চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
‘মাৎস্য ন্যায়’ এর মহাসংকট থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে দেশের প্রধান নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ গোপাল নামক এক ব্যক্তিকে ৭৫০ খৃষ্টাব্দে রাজা নির্বাচিত করেন। পাল বংশের শাসকগণ সুদীর্ঘ চারশত বছর ধরে বাংলাদেশ শাসন করেন। পাল বংশের প্রতিষ্ঠাতা গোপালের আমলেই মাগুরা অঞ্চল বিজিত হয়। রাজা গোপাল মাগুরা অঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশে অরাজকতা দূর করে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
বাগদাদের প্রখ্যাত আব্বাসীয় খলিফা হারুণ-অর-রশিদের সামসাময়িক বাংলার রাজা ধর্মপাল (৭৭০ খ্রীঃ ৮১০ খ্রীঃ) ছিলেন পাল বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক। তার রাজধানী ছিল পাটলীপুত্র। তাঁর আমলেই সর্বপ্রথম মাগুরা অঞ্চলের নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। নবম শতাব্দীতে মাগুরার জেলার শ্রীপুর এলাকা পাল রাজাদের অন্যতম নগর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। শ্রীপুর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত ছিল। ধর্মপালের রাজত্বকালেই শ্রীপুর পাল রাজাদের কোন অধস্তন বিরাট রাজার রাজধানী ছিল। কথিত আছে যে, বিরাট রাজার স্ত্রীর নাম ছিল ‘শ্রী’। ‘শ্রী’ নাম থেকেই শ্রীপুরের নামকরণ হয়েছে বলে শোনা যায়। অবশ্য শ্রীপুর নামকরণ সম্পর্কে আরও একটি মত পাওয়া যায়। কেউ কেউ মনে করেন মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম এ অঞ্চলে (শ্রীপুর অঞ্চলে) প্রশাসনিক তদারকির জন্য একটি কাচারী বাড়ি স্থাপন করেছিলেন। কুমার নদের উত্তর তীরে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই স্থানটির সঙ্গে তার প্রিততমা স্ত্রী ‘শ্রী’ কে চিরঞ্জীব করে রাখার মানসে নামকরণ করেন ‘শ্রীপুর’। শ্রীপুরের অদূরে রাজাপুর গ্রামে ছিল বিরাট রাজার রাজমহল। কালের গর্ভে বিরাট রাজার কীর্তিসমূহ বিনষ্ট হয়ে গেছে। তবে নাট্যশালা, কয়েদ খানা ও ধনাগারের চিহ্ন আজও পরিদৃষ্ট হয়। ঐতিহাসিক হোসেন উদ্দীন হোসেন বলেন, রাজার অনেক হস্তী ছিল, সৈন্য ছিল’ যেখানে হস্তীর আস্তানা ছিল, সে গ্রামের নাম ‘পিলখানা’। কথিত আছে, বিরাট রাজার অসংখ্য গাভী ছিল। তিনি দুধ ভক্তি করতেন। রাণী ছিলেন তাম্বুল ভক্ত। গোয়ালপাড়া গ্রামে থাকতো রাজার অসংখ্য দুগ্ধবতী গাভী। সেই জন্যে এর নাম হয় গোয়াল পাড়া। রাণীর তাম্বুলের ক্ষেত ছিল বিরাট এলাকাবাপী। সারা বছর এই ক্ষেতে প্রচুর পরিমাণে তাম্বুল হতো। তাম্বুল সংরক্ষণের জন্য এক শ্রেণীর লোক রাজার অধীনে ছিল। তাদেরকে বলা হতো বারুই। এই বারুইদের জন্য রাজা একটি স্থান নির্দিষ্ট করে দেন বসবাসের জন্য, সে স্থানাটিকে বলা হয় বারুইপাড়া। বারইপাড়া আজ একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম। বিরাট রাজার স্মৃতি বহন করে গ্রাম দুইটি প্রাচীন দিনের কথা স্মরণ করে দেয়।
মহাকালের অমোঘ বিধানানুসারে শ্রীপুরের বিরাট রাজারও পতন হয়। কিন্তু কিভাবে কখন কার নিকট বিরাট রাজার পতন ঘটে তা সঠিকভাবে বলা কঠিন। ‘মাগুরা সন্দর্থ প্রণেতা মনোরঞ্জন বিশ্বাস’ গজনী বংশীয় সুলতান গিয়াস উদ্দীন কর্তৃক বিরাট রাজার পতন ঘটে’ কথা উল্লেখ করেছেন। উল্লেখিত তথ্যটি সঠিক বলে মনে হয় না। কারণ গজনী বংশে (সুলতান মাহমুদের বংশ) গিয়াস উদ্দীন নামে কোন সুলতানের উল্লেখ পাওয়া যায় না। তাছাড়া সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমণের পরে যারা উপমহাদেশে এসেছেন তাদের নাম খসরু শাহ্ ও খসরু মালিক। তারা ছিলেন গজনী বংশের অত্যন্ত দুর্বল শাসক এবং তাদের রাজত্ব পাঞ্জাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয়ত গজনীর অপর বংশের নাম ঘোরী বংশ। গাজনীর এই ঘোরী বংশের প্রথম শাসক গিয়াস উদ্দীন মুহম্মদ এবং ৩য় শাসক গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ। তারা কখনও ভারত বিজয় করতে আসেননি। উক্ত বংশের মুহম্মদ ঘোরী ভারত বিজয় করেছিলেন। সুতরাং গজনীর কোন শাসকের নিকট বিরাট রাজা পরাজিত হয়েছিলেন বলে মনে হয় না। যা হোক, মাজুদয়ার রণাঙ্গণে পরাজিত হয়ে বিরাট রাজা আত্মহত্যা করেন বলে শোনা যায়। কালের সাক্ষী হিসেবে ‘মুজদিয়া’ গ্রাম মাজুদিয়া যুদ্ধের স্মৃতি বহন করছে।
পাল বংশের ধ্বংসস্তুপের উপর বাংলাদেশে সেন বংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণাত্যের কর্ণাটক হতে আগত সমপ্ত সেনের পুত্র হেমন্ত সেন ছিলেন সেন বংশের প্রথম রাজা। বল্লাল সেনের রাজত্বকালে যশোর অঞ্চল সেন সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। এ বংশের শাসনকর্তা লক্ষণ সেনের নিকট হতেই মুসলিম বীর ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলা জয় করেন। লক্ষণ সেনের আমলের প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন মাগুরার পার্শ্ববতী জেলা নড়াইলের শেখহাটি গ্রামে আজও বিদ্যমান। শেখহাটি ছিল বাগড়ীর প্রাদেশিক রাজধানী। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে রাজা লক্ষণ সেন নদীয়ার নবদ্বীপ থেকে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির অতর্কিত আক্রমণে দিশেহারা হয়ে শেখহাটিতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। মাগুরা সেন বংশের শসনাধীনে ছিল। সেন আমলে মাগুরা অঞ্চলের তেমন কোন উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্যসূত্র আজও আবিস্কৃত হয়নি।
পরিশেষে বলতে হয়, সুপ্রাচীন কালের রাজা বা তাদের উত্তরসূরী আজও আর মাগুরা অঞ্চলে কেউ নেই। কিন্তু বিভিন্ন রাজবংশের রাজন্যবর্গের র্কীতি কাহিনী আজও রূপকথার রূপ নিয়ে মাগুরার গ্রাম-গঞ্জ পথে প্রান্তরে ফিরছে। আসলে সঠিক গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে মাগুরা অঞ্চলের প্রামাণ্য ইতিহাস আজও রচিত হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে এতদঞ্চলের ইতিহাস রচনায় গবেষক ও সূধীজনমহল এগিয়ে আসবেন এই আমাদের প্রত্যাশা।
তথ্য সূত্র:
১. হোসেন উদ্দীন হোসেন, যশোরাদ্য দেশ, যশোর জেলার ইতিহাস, ২ মুদ্রণ, ১৯৯০ পৃঃ ২৮।
২. Notes on three ancient coins found at Muhammadpur in the Jessore District J.A.S.B. 1852 VOL * * JP.401;
৩। গোলাম মোস্তফা সিন্দাইনী, সিন্দাইনের ইতিহাস, দৈনিক গণদেশ খুলনা, এপ্রিল, ১৯৮৬।
তথ্য সংগ্রহেঃ
আবু বাসার আখন্দ
জেলা প্রতিনিধি
মাছরাঙ্গা টেলিভিশন / ভোরের কাগজ