
Home মাগুরা জেলা / Magura District > ভূষণা ও রাজা সীতারাম রায় / Bhusana and Raja Sitaram Roy
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100192 বার পড়া হয়েছে
ভূষণা ও রাজা সীতারাম রায় / Bhusana and Raja Sitaram Roy
ভূষণা ও রাজা সীতারাম রায়
Bhusana and Raja Sitaram Roy
Bhusana and Raja Sitaram Roy
মাগুরা জেলার ইতিহাস মূলত ভূষণার সঙ্গে একই সূত্রে গাঁথা। বর্তমান মাগুরা জেলার অধিকাংশ এলাকাই শতাব্দীকাল যাবৎ ভূষণা রাজার অধীনে ছিল। এমন কি মাগুরাতে থানা হবার অনেক আগে অত্র অঞ্চল ভূষণার অধীনে ছিল। যশোরের সাবেক জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জে, ওয়েস্টল্যান্ড বলেন, ১৭৮১ সালে তিনি যখন প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন ইছাখাদায়। তখনও পুলিশ চৌকি ছিল ভূষণাধীন। মাগুরায় এসময় কোন থানা বা শহর গড়ে ওঠে নাই। ভূষণা একটি প্রাচীন নগর। বর্তমান ইহা ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলাধীন। বৃহত্তর ফরিদপুর ও যশোর জেলার বেশ কিছু অংশ নিয়ে সেকালে ভূষণা রাজ্য ছিল বিস্তৃতি। মোগল, পাঠান ও হিন্দু-মুসলমান বহুবার ভূষণাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। প্রাচীন কিছু ভগ্নাবশেষ বুকে ধারণ করে আজও কালের নীরব সাক্ষী হয়ে টিকে আছে ছোট্ট একটি গ্রাম ভূষণা। কথিত আছে ধেনুকর্ণ নামক রাজার পুত্রের উপাধী ছিল বঙ্গ ভূষণ। আর তার নাম অনুসারে নামকরণ করা হয় ‘ভূষণা’।
ভূষণা ছিল মোগল আমলে সাতৈর পরগনাধীন। সম্রাট আকবরের রাজত্বের শেষের দিকে মীর্জা আজিজ কোকা ও রাজা টোডরমল বাংলাদেশে বিদ্রোহ দমনের জন্যে আসেন। এ সময় মুকুন্দরাম ভূষণা দখল করেন। এক পর্যায়ে বার ভূইয়াদের অন্যতম চাঁদরায় ও কেদার রায় ভূষণার মালিক হন এবং মোগলদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। যুদ্ধে চাঁদরায় নিহত হয়। ১৫৯৮-৯৯ খ্রীস্টাব্দে রাজা টোডরমলের সহায়তায় মুকুন্দ রায়ের পুত্র সত্যজিৎ রায় ভূষণা অধিকার করেন। সত্যজিৎ রায়ের শাসনামলে ভূষণার চরম উন্নতি সাধিত হয়। মোগলদের সঙ্গে প্রথমে আপোষ করে চললেও স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালীর স্বভাবানুসারে সত্যজিৎ রায়ের সংগে মোগলদের বিরোধ দেখা দেয়। তিনি ধুবড়ীর নিকট এক যুদ্ধে মোগলদের নিকট পরাজিত ও বন্দী হন। ১৬৩৯ খৃস্টাব্দে মোগলদের বিচারে সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। বর্তমান মাগুরা জেলার একটা বিশিষ্ট ব্যবসা কেন্দ্র নবগঙ্গা তীরের শক্রজিৎপুর তিনিই প্রতিষ্ঠিত করেন। রাজা সত্যজিৎ রায়ের নামানুসারে ‘শক্রজিৎপুর গ্রাম’। (বর্তমানে শক্রজিৎপুরকে ‘শক্রজিৎপুর’ হিসেবে লেখা হচ্ছে)। রাজা সত্যজিৎ রায়ের পরে ভূষণার শাসনকর্তা হন মোঘল সেনাপতি সংগ্রাম শাহ্। এ সময় বর্তমান মাগুরা শহর ও পার্শ্ববর্তী বেশ কিছু এলাকা ভূষণার অধীনে উপফৌজদার নাদের অলীর প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে ছিল। নাদের আলীর নামানুসারে ‘নান্দুয়ালী’ গ্রামের নামকরণ হয় বলে জানা যায়। মাগুরা শহরের নতুন বাজারের উত্তরে নবগঙ্গার উত্তর তীরে নান্দুয়ালী গ্রাম। এ গ্রামেই উপফৌজদার নাদের আলীর বাড়ি ছিল। কালের করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করে আজও নাদের আলীর বাড়ির ধ্বংসাবশেষের কিছু অংশ ছোটখাটো ইটের টুকরা তার কথাই স্মরণ করে দিচ্ছে।
মাগুরার প্রামাণ্য ইতিহাসের নায়ক ভূষণা তথা মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায়। বাংলার যে সমস্ত খ্যাতনামা জমিদার দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তৎমধ্যে মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায় ছিলেন অন্যতম। সীতারাম উত্তর রাঢীয় কায়স্থ। বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কল্যাণগঞ্জ থানার গিধিনা গ্রামে তার পূর্বপুররুষের বসবাস ছিল। তার পিতার নাম উদয়নারায়ণ। সীতারামের পিতামহের নাম হরিশ চন্দ্র এবং প্রপিতামহের নাম রাম দাস। সীতারামের মায়ের নাম দয়াময়ী। মাতা দয়াময়ীর নাম অনুসারে মহম্মদপুরে ‘দয়াময়ী তলা’ নামে একটি গ্রাম আছে। কাটোয়ার অন্তর্গত মহিপতি গ্রামে ছিল সীতারামের মাতুলদের নিবাস। পিতা, পিতামহ ও প্রপিতামহ সকলেই ছিলেন মোগল রাজ কর্মচারী। পিতা উদয়নারায়ণ মোগল শাসনাধীনে ভূষণার রাজস্ব সংক্রান্ত উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। উদয়নারায়ণ পরবর্তীকালে একটি তালুকের মালিক হন। বর্তমান ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী উপজেলাধীন গুণবহা ইউনিয়নভূক্ত হরিহরনগরে তাঁর বাসস্থান ছিল। সীতারাম এককালের প্রমত্তা মধুমতীর অপর পাড়ে এ হরিহরনগর গ্রামেই ১৬৫৮ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। সীতারামের পিতা মোগল শাসনাধীনে ঢাকায় বদলী হন। সীতারাম ঢাকায় লেখাপড়া করেন। তিনি অস্ত্র বিদ্যায়ও পারদর্শী হয়ে উঠেন।
সীতারাম কিভাবে ভূষণার কর্তৃত্ব লাভ করেন তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কেউ কেউ দস্যু সর্দার হিসেবে এলাকা দখলের কথা বলে থাকেন। তবে উত্তরাধীকারী সূত্রে তিনি ভূষণার জমিদারী লাভ করেন বলেই মনে হয়। চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি জমিদারী শুরু করেন। ঢাকাতে সীতারামের অস্ত্র চালনার কৌশল ও দক্ষতায় বিমুগ্ধ হন মোগল গভর্নর ইব্রাহীম খান। বিদ্রোহী আফগান কাসিম খানকে দমন করার জন্য তাই সীতারামকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর কাশিম খানকে যুদ্ধে পরাজিত করে বীরত্ব প্রদর্শন করায় মোগলদের নিকট থেকে তিনি নলদী পরগণার জায়গীর প্রাপ্ত হন। আবার কারো মতে, শায়েস্তা খাঁনের আদেশে সাতৈর পরগণার বিদ্রোহী শাসক আব্দুল করিম খাঁনকে পরাজিত ও নিহত করে সুবাদারের নৈকট্য এবং নলদী পরগণার জমিদারী লাভ করেন।
সীতারাম ভূষণার কর্তৃত্ব লাভ করার পর তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকদেরকে নিয়ে বাহিনী গঠন করেন। মেনাহাতী, রূপচাঁদ ঢালী, বকতিয়ার খান, মৃতরা সিংহ, গোবর দলন প্রমুখ সীতারামের বিখ্যাত সেনাপতি। মাগুরা ও ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় আজও যার বীরত্ব গাথা লোকমুখে ফেরে- তিনি হলেন সীতারামের প্রধান সেনাপতি মেনাহাতী। মেনাহতীর প্রকৃত নাম রূপনারায়ণ বা রামরূপ ঘোষ। কেউ কেউ বলেন মৃন্ময় ঘোষ। মেনাহাতী নড়াইল জেলার অন্তর্গত রায় গ্রাম নিবাসী ঘোষ বংশের পূর্বপুরুষদের একজন। দৈর্ঘ্যে ৭ হাত, প্রকান্ড মস্তক বিশিষ্ট বিশাল দেহী ছোট খাট হস্তী সদৃশ্য বিধায় মেনাহাতী বলে তার এই খ্যাতি। তবে স্থানীয় জনশ্রুতি অনুযায়ী তিনি পিঁড়ি দিয়ে পিটিয়ে সীতারামের একটি হাতী হত্যা করেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল মেনাহাতী। গ্রাম এলাকায় আজও কেউ কেউ তাকে মেলাই হাতী বলে জানে। রূপচাঁদ ঢালী সীতারামের অপর একজন সেনাপতি ছিলেন। রূপচাঁদের বংশধরগণ মহম্মদপুর উপলেজলার খলিশাখালী গ্রামে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করেন বলে জানা যায়। রাজা সীতারামের অপর একজন সেনাপতি শিবরাম চক্রবর্তীর নামানুসারে মাগুরা শহরের অদূরে ‘শিবরামপুর’ গ্রাম অবস্থিত।
রাজা সীতারাম তাঁর এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় খ্যাতি অর্জন করেন। প্রাচীনকালে মাগুরা অঞ্চল সুন্দরবনের অংশ ছিল। বনাঞ্চলের আধিক্যের কারণে এ এলাকায় দস্যু তস্করদের উপদ্রব হতো। যদুনাথ ভট্টাচার্য তার ‘সীতারাম রায়’ গ্রন্থেরাখা, শ্যামা, রামা, মুম্ভো, বিশে, হরে, নিমে, কালা, দিনে, ভুলো, জগা ও জেদো এই ১২জন কুখ্যাত ডাকাতের উল্লেখ করেছেন। তিনি ভূষণা, হরিহর নগর, মহম্মদপুর, নলদী ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের মগ ও ফিরিঙ্গী দস্যুদের কঠোর হস্তে দমন করেন।
অধিকান্ত তিনি বাংলার উপকূল অঞ্চলেও মগ ও ফিরিঙ্গীদের উপদ্রব বন্ধের জন্য চেষ্টা করেন। উত্তর ভারতে তীর্থে যাবার নাম করে তিনি সম্রাট আত্তরঙ্গজেবের সঙ্গে দেখা করেন এবং এতদ অঞ্চলের নৈরাজ্যের কথা তাঁকে অবহিত করেন। শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে সীতারামকে সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান পূর্বক সম্রাট ১৬৮৭-৮৮ খ্রীস্টাব্দে তাকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। দিল্লী হতে ফিরে এসে তিনি সুবাদার মুর্শিদকূলী খানের সনদ ও অনুমতি বলে উপকূল অঞ্চলে দূর্গ নির্মাণ ও সৈন্য মোতায়েন করেন। ফলে এতদঞ্চলে শান্তি ফিরে এসেছিল এবং জনগণও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল। তৎকালে একজন কবি তাই লেখেন -
“ধন্য রাজা সীতারাম বাংলা বাহাদুর
যার বলেতে চুরি ডাকাতি হয়ে গেল দূর।
এখন বাঘ মানুষে একই ঘাটে সুখে জল খাবে
এখন রামী শ্যামী পোঁটলা বেঁধে গঙ্গা স্নানে যাবে ॥”
রাজা সীতারাম রায় তার পৈতৃক নিবাস মধূমতী তীরবর্তী হরিহর নগর নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। এ শহরটিতে বেশ কিছু সুরম্য ইমারত ও মন্দির নির্মাণ করেন। জনগণের পানীয় জলের কষ্ট লাঘবের জন্য খনন করেন কয়েকটি দীঘি। সে আমলে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠে এই হরিহর নগর। এখনও এখানে এসবের কিছু ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
রাজা সীতারাম ১৬৯৭-৯৮ খ্রীস্টাব্দে মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করেন। মহম্মদপুরকে রাজধানীর স্থান হিসেবে নির্ধারণ করার ব্যাপারে একটি প্রবাদ আছে। আর তা হ’ল, একদিন সীতারাম ঘোড়ায় চড়ে এই পথ দিয়ে যান। পথিমধ্যে হঠাৎ তাঁর ঘোড়ার পা মৃত্তিকা গর্ভে আটকে যায়। শত চেষ্টা সত্ত্বেও ঘোড়ার পা মৃত্তিকা থেকে উঠাতে পারেন না। পরে লোকজন দিয়ে স্থানটি খনন করে ঘোড়ার পা উদ্ধার করেন। খননকালে এখানে একটি মন্দির আবিষ্কৃত হয়। আর মন্দিরে তিনি পান লক্ষীনারায়ণের মুর্তি। লক্ষীনারায়ণ সৌভাগ্যের প্রতীক। তাই স্থানটিকে শুভ মনে করে সীতারাম প্রথমত এখানে নিজের বাসভবন নির্মাণ ও পরে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। রাজধানীর নামকরণের ব্যাপারে একাধিক মত আছে। কেউ কেউ মনে করেন সূফীসাধক মুহম্মদ আলী শাহ (রঃ) এর নামানুসারে সীতারাম রায় রাজধানীর নাম মহম্মদপুর রাখেন। অবশ্য উপরিউক্ত সূফীসাধক মাহমুদ আলী শাহ (রঃ) এ নামেও অত্র এলাকায় পরিচিত ছিলেন। এ জন্য মহম্মদপুর স্থানীয় লোকের নিকট আজও ‘মাহমুদপুর’ নামে পরিচিত। কারো কারো মতে, এই সুফি সাধকের উত্তর পুরুষ হলেন আলী মাওলা। মুহম্মদপুর থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে বড়রিয়া গ্রামে আলী মাওলার দরগাহ ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হিসেবে অদ্যাবধি বিদ্যমান। আবার কেউ কেউ মনে করেন ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠ প্রচারক মহানবী হযরত মুহম্মদ (সাঃ) এর নামানুসারেই সীতারাম তাঁর মুসলমান প্রজাদের মনোরঞ্জনের জন্য রাজধানীর নাম ‘মহম্মদপুর’ রাখেন। মহাম্মদপুর সীতারামের রাজধানী হিসেবে বাংলাদেশের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ নগরীতে পরিণত হয়। এখানে এক সময় গৌড় বঙ্গের একটি টাকশাল ছিল বলে জানা যায়। এখানেই ১৭৯৫ খৃস্টাব্দে যশোর জেলা সদর করার প্রস্তব হয়। মহম্মদপুরের সমৃদ্ধি লক্ষ্য করেই যশোর জেলার ম্যাজিস্ট্রেট, কালেক্টর গভমেন্টের নিকট ১৮১৫ সালের ১৬ মার্চ গভমেন্টকে প্রাচীন মুরলীর জেলা মহম্মদপুরে স্থানান্তরিত করতে পত্র লেখেন। ১৮১৫ সালের এপ্রিল মাসে মহম্মদপুরে পুলিশ স্টেশন ও মুনসেফি চৌকি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মহম্মদপুরকে জেলা করার জল্পনা কল্পনা চলতে থাকে। এ সময় বর্তমান মাগুরার তেমন কোন পরিচিতি ছিল না। জেলা ম্যাজিট্রেট জে. ওয়েস্টল্যান্ড এর ভাষায়, “অতীতের নথি পত্রে আমি কোথাও মাগুরার উজ্জ্বলতার চিহ্ন দেখতে পাইনি। খ্যাতির জন্য নয়, ডাকাতির মতো অপরাধ দমনের ব্যবস্থা নিতে মহাকুমা স্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নদীর সঙ্গম স্থল মাগুরা ছিল অপরাধের জন্য উপযুক্ত স্থান। ঐ মাগুরাতে তখন থানা ছিলনা। মহাকুমা স্থাপনকালে প্রথমে পুলিশ ফাঁড়ি এবং পরে থানা করা হয়”। যাইহোক, মহম্মদপুর আর জেলা শহরের মর্যদা লাভ করতে পারল না। মহম্মদপুরে ১৮৩২ খ্রীঃ (বাংলা-১২৩৯) এক অদ্ভুত ‘জ্বর’ রোগের প্রাদুর্ভাব মহামারীর আকার ধারণ করে। এই অদ্ভুত রোগকে কেউ ‘গাঙ্গেয় জ্বর’ কেউবা ‘ম্যালেরিয়া’ কেউবা ‘নিউমোনিয়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। বর্ণনা মতে, মনে হয় ইহা ছিল সমপ্রতি চীন, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান প্রভৃতি দেশের সার্স রোগের ন্যায় এক অস্বাভাবিক ভয়ংকর রোগ। সাত বছর স্থায়ী এই মহামারীর প্রকোপে রাস্তা নির্মাণে কর্মরত ১৫০জন কয়েদী, ৩৬০জন স্বর্ণকার ও অসংখ্যা মহম্মদপুরবাসী প্রাণ হারায়। এই রোগ যশোর, নদীয়া, বর্ধমান এবং হুগলী অঞ্চলেও দেখা দেয়। ১৮৩৬ সালে মহম্মদপুর ধ্বংসস্তুপের পরিণত হয়। ১৮৪৫ সালে মাগুরা মহকুমা হয় এবং মহম্মদপুর ধ্বংসের পর ১৮৫৩ খ্রীঃ মহম্মদপুরের মুনসেফি চৌকি মাগুরায় স্থানান্তরিত হয়।
স্যার যদুনাথ সরকার রাজা সীতারাম রায়কে রাজা প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে তুলনা করেন। রাজা সীতারামের জমিদারী পাবনা জেলার দক্ষিণভাগ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত এবং নদীয়া জেলার পূর্বপ্রান্ত থেকে বরিশাল জেলার মধ্যভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তার বাৎসরিক রাজস্ব আয় ছিল ৭৮লক্ষ টাকা। বিস্তৃীর্ণ এলাকার জমিদার রাজা সীতারাম স্বল্প কালের মধ্যে প্রবল প্রতাপশালী হয়ে উঠেন এবং বাংলার শাসকদের স্বাধীনতা প্রিয়তার বৈশিষ্ট্য তার মধ্যে জাগ্রত হয়ে উঠে। তিনি বাংলার সুবাদারকে দেয় রাজস্ব বন্ধ করে দেন। সুবাদার ইব্রাহিম খানের দুর্বল শাসন ব্যবস্থা, মুর্শিদকুলী খান এবং আজিমুশ্শানের মধ্যকার বিরোধ তাঁর স্বাধীনতা লাভের ইচ্ছাকে আরও উজ্জ্বীবিত করে। সীতারামের সমৃদ্ধি এবং প্রাধান্য অন্যান্য জমিদারদের মনে হিংসার উদ্রেগ করে। জমিদারগণ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় এবং সীতারামের বিরূদ্ধে মোগল ফৌজদারের কান ভারী করতে থাকে। এতদশ্রবণে মুর্শিদকুলী খান সীতারামকে বন্দী করার জন্য ভূষণার ফৌজদার সৈয়দ আবু তোরাপকে প্রেরণ করেন। বারাসিয়া নদীর তীরে এক খন্ড যুদ্ধে ১৬৯৯খ্রীঃ ফৌজদার সৈয়দ আবু তোরাপ সীতারাম কর্তৃক নিহত হন। ‘তোরাপের মাজার’ বলে কথিত ভূষণা সেনানিবাসের মাঝে আজও তার কবর নীরব সাক্ষী হয়ে আছে। ফৌজদার আবু তোরাপকে হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য নবাব মুর্শিদকুলি খান ভূষণার নবনিযুক্ত ফৌজদার বক্স আলী খানকে নির্দেশ দেন। মোগল প্রভুভক্ত নিকটবর্তী জমিদার এবং দিঘাপতিয়ার জমিদার দয়ারামকে অনুরূপ নির্দেশ প্রদান করা হয়। সংগ্রাম শাহ্, সিংহরাম ও দয়ারাম প্রমুখের সহযোগিতায় ফৌজদার বক্সআলী খান সীতারামের ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করেন। মধুমতী তীরে প্রচন্ড লড়াই শুরু হলো। যুদ্ধে প্রথমদিকে সীতারামের জয় হলেও শেষ পর্যন্তু তিনি সম্মুখসমরে টিকে থাকতে পারলেন না। অতপর রাতের অন্ধকারে তিনি তার সৈন্যদের নিয়ে ভূষণা থেকে রাজধানী মহম্মদপুরের দিকে অগ্রসর হন। মোগল সৈন্যরাও তার পশ্চাদ অনুসরণ করে।
মহম্মদপুরের দুর্ভেদ্য দূর্গে অবস্থান করে রাজা সীতারাম রায় স্বীয় স্বাধীনতা রক্ষায় ব্রতী হন। প্রধান সেনাপতি মেনাহাতী বীরবিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। মোগল পক্ষের যুদ্ধ জয় অসম্ভব হয়ে পড়ে। কুটিলতার আশ্রয় নেন মোগল বাহিনীর সমর্থক স্বার্থান্বেষী মহল। এ যেন পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্র আর বিশ্বাসঘাতকতার পূর্ব মহড়া। বিশ্বাসঘাতক কর্মচারী মুনিরামের পরামর্শে, কুচক্রী জমিদার দয়ারামের সহযোগিতায় প্রধান সেনাপতি মেনাহাতীকে অতর্কিতভাবে দোলমঞ্চের নিকট আক্রমণ করে আহত অবস্থায় বন্দী করা হয়। ৭ দিন পর্যন্ত তাদের হাতে নিদারুন নির্যাতনের পর তার মৃত্যু হয়। শত্রু সৈন্যরা তার মস্তক ছেদন করে নবাব মুর্শিদকুলী খানের নিকট মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। বিশালকার এই মস্তক দেখে বিস্ময় প্রকাশ করে এতবড় বীরকে হত্যার জন্য নিজের সৈন্যদেরকে তিরস্কার করেন। মুর্শিদাবাদ থেকে মস্তকটি ফেরত এলে যথারীতি সৎকার করে সমাহিত করা হয়। বাজারের উত্তর-পূর্ব কোণে ইট নির্মিত মেনাহাতীর সমাধিসৌধের চিহ্ন এখন আর নেই। বর্তমান মোঃ আলিমুজ্জামান সাহেবের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে রাস্তার নীচে এখন এটি চাপা পড়ে গেছে। প্রধান সেনাপতি মেনাহাতীর মৃত্যুর পরও সীতারাম প্রাণপণে মোগল বাহিনীর সঙ্গে লড়াই অব্যাহত রাখেন। সীতারাম শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হয়ে মুর্শিদাবাদে প্রেরিত হন। কথিত আছে যে তাকে লোহার খাঁচায় বন্দী করে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়। কুচক্রী দয়ারাম তাকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যান। দিঘাপতিয়ায় যাবারকালে পথিমধ্যে নাটোর রাজবাড়ীর কারাগারে বন্দী রাখা হয়। রাজা সীতারামকে যে কক্ষে বন্দী রাখা হয় তা আজও বিদ্যমান। মুর্শিদাবাদে কয়েকমাস বন্দী অবস্থায় থাকার পর নবাব তাকে মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেন।
অবশ্য সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শোনা যায়। কারো মতে তিনি বিষপানে আত্মহত্যা করেন। জে. ওয়েস্টল্যান্ড সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কে বলেন, বন্দী অবস্থায় তাকে ঢাকায় নবাবের কাছে নেওয়া হয়। বন্দীশালায় নবাব তাঁর প্রতি এক নজর তাকান। তাকে অল্প সময় সেখানে অবস্থান করানো হয়। নবাবের একজন অফিসার এসে তাকে বলে, জীবনের আশা নেই। অবশ্যই তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য রাজা সীতারাম রায় সবসময় বিষযুক্ত আংটি হাতে রাখতেন। অবশেষে তিনি সেই বিষ পান করে আত্মহত্যা করেন। যদুনাথ ভট্টাচার্যের মতে, “কোন শাল বিক্রেতাদিগের সাথে যুদ্ধ করিয়া গঙ্গাতীরে মৃত্যুর কথাই সীতারামের গুরম্নকুল পঞ্জিকায় লিখিত আছে। সীতারামকে কেহ নিহত করেন নাই অথবা তিনি আত্মহত্যা করেন নাই”। সীতারামের মৃত্যু সম্পর্কেও মহম্মদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচলিত কিংবদন্তী হল, অত্যাচারী রাজা সীতারাম প্রতিশোধের আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রামসাগরে নৌকায় স্বহস্তে কুড়াল মেরে সপরিবারে জ্বলে ডুবে আত্মহুতি দেন। আবার অনেকের মতে, মোগলদের নিকট থেকে রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করতে ব্যর্থ রাজা সীতারাম পরিবার পরিজন নিয়ে একখানি মজবুত কাষ্ঠ নির্মিত নৌকায় উঠেন এবং রামসাগরের মধ্যে নিয়ে যান। তার পর নৌকার মধ্যখানে কুঠারাঘাত করেন। ফলে নৌকার মধ্যে হু হু করে পানি উঠে এবং ফলস্বরূপ নৌকা ডুবে যায়। আর এর সঙ্গে রামসাগরের অতল তলে হারিয়ে যায় রাজা সীতারাম ও তার পরিবার পরিজন। সত্যিই স্বাধীনচেতা, পরোপকারী মহম্মদপুরের এই রাজার মৃত্যু আজও রহস্যাবৃত রয়ে গেছে। এমনকি তাঁর মৃত্যু সন তারিখ নিয়েও মতভেদ আছে। তাঁর মৃত্যুর সন ১৭১৪খ্রীঃ, ১৭১৮খ্রীঃ, ১৭২২খ্রীঃ, ১৭২৪ খ্রীঃ বলে বিভিন্ন বর্ণনায় পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। সুষ্ঠু গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চয়ই সঠিক তথ্য পাওয়া যাবে।
সীতারামের উত্তরপূরুষ সম্পর্কে কোন উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তার ৩টি, মতান্তরে ৫ জন স্ত্রী ছিল বলে জানা যায়। তার প্রথমা স্ত্রীর নাম কমলা। তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। তার অন্য একজন স্ত্রীর নাম ‘শ্রী’। এ ‘শ্রী’ থেকেই ‘শ্রীপুর’ (উপজেলা) নামকরণ হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। মহম্মদপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দুরে বালিদিয়া ইউনিয়নভূক্ত ‘শ্রীপুর’ নামে একটি গ্রামও রয়েছে। মাগুরা জেলায় আরও একাধিক ‘শ্রীপুর’ নামের গ্রামের অস্তিত্ব বিদ্যমান। অনেকের মতে, সীতারামের স্ত্রী ‘শ্রী’-র নামানুসারেই এই গ্রামগুলির নামকরণ করা হয়েছে। শোনা যায় সীতারামের ভ্রাতা লক্ষীনারায়ণ ও তাঁর উত্তর পুরুষগণ হরিহরনগরে দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাস করেন। যাহোক সীতারামের পতনের পর তার রাজ্য নাটোরের জমিদার রামজীবন রায় ও চাঁচড়ার জমিদার মনোহর রায় এবং নলডাঙ্গার জমিদারের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয়।
মহম্মপুরের গৌরব রাজা সীতারাম রায় আজ আর নেই, কিন্তু তাঁর অসংখ্যা কীর্তিকালের করাল গ্রাসকে উপেক্ষা করে তার কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। তিনি নির্মাণ করেন মুহম্মদপুর দূর্গ, একাধিক প্রাসাদ, অসংখ্যা মন্দির ও দীঘি।
সীতারামের পতন পরবর্তী সময়:
সীতারামের পতনের পর তার রাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কয়েকজন জমিদারের উত্থান ঘটে। তারা ‘রাজা’ উপাধি নিয়ে স্ব স্ব এলাকায় প্রতাপের সঙ্গে রাজত্ব করতে থাকেন। ঠিক এমনই একজন হলেন ‘রাজা শচিপতি’। কারো মতে আঠারখাদা গ্রামে আবার কেউ কেউ মনে করেন নিজনান্দুয়ালী গ্রামে তার বাড়ি ছিল। রাজা সীতারামের সমর্থক হওয়ার কারণে নবাব মুর্শিদকুলী খাঁনের নির্দেশে নলডাঙ্গার জমিদার কর্তৃক তার পতন ঘটে। সীতারামত্তোর আর একজন রাজা ছিলেন যার নাম দেবল রাজা। মাগুরা সদর উপজেলার ঘোড়ানাছ গ্রামে তার বাড়ি ছিল বলে শোনা যায়। কথিত আছে যে, তিনি পরশ পাথর পেয়েছিলেন। এছাড়া শালিখা এলাকায় রাজা বীরেন্দ্র চন্দ্র সিংহ, কালিকান্ত রায় এবং শ্রীপুর এলাকায় রাজা রামচন্দ্র নামক জমিদারের কথা শোনা যায়। শ্রীপুর উপজেলা আমলসার ইউনিয়নের রাজাপুর গ্রামের রাজা ছিলেন বিক্রম বর্শী। তাঁর বাড়ির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। উপরে উল্লেখিত রাজাদের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় না।
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, সীতারামের পতন হতে ১৭৬৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্তু এবং বক্সারের যুদ্ধে নবাব মীর কাসিমের ভাগ্য বিপর্যয় পর্যন্ত মাগুরা তথা বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত একদিকে বাংলার শাসকদের দুর্বলতা অন্যদিকে বিদেশী শক্তির ইংরেজদের ক্ষমতা বৃদ্ধিরই ইতিহাস। এ সময়ে মাগুরার বিভিন্ন এলাকায় অনেক ছোট বড় রাজা উপাধিধারী ভূস্বামীদের উত্থান ঘটে। তারা আজও মাগুরার হাটে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, গ্রামে-গঞ্জে কিংবদন্তী হিসেবে বেঁচে আছেন। থাকবেন বেঁচে হয়তো আরও কিছুকাল এমনি করে। তারপর মহাকালের আবর্তে চিরদিনের মত হারিয়ে যাবেন। অতীতে স্থানীয় ইতিহাস সংগ্রহের উদ্যোগ নিলে আজ আর এমনটি হত না। তবুও এখনও সময় আছে-এগুলোকে রক্ষা করার। আসুন, সুষ্ঠু ও সঠিক গবেষণার মাধ্যমে কিংবদন্তীর তমসালোক থেকে এ সমন্ত রাজাদেরকে ইতিহাসের আলোকে উদ্ভাসিত করি ! রচনা করি মাগুরা জেলার ইতিহাস।
তথ্য সংগ্রহে:
আবু বাসার আখন্দ
সহ-সভাপতি, যশোর.ইনফো
/
জেলা প্রতিনিধি:
মাছরাঙ্গা টেলিভিশন
ভোরের কাগজ
দি এডিটর (অনলাইন নিউজ পেপার)
সকালের খবর
সর্বশেষ আপডেট:
আগস্ট ২০১২