
Home মাগুরা জেলা / Magura District > সীতারাম রায়ের কৃর্তী / The activities of Sitaram Roy
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100102 বার পড়া হয়েছে
সীতারাম রায়ের কৃর্তী / The activities of Sitaram Roy
সীতারাম রায়ের কৃর্তী
The glorious activities of Sitaram Roy
The glorious activities of Sitaram Roy
মহম্মদপুর দুর্গ:
স্বাধীনচেতা রাজা সীতারাম এক দুভের্দ্য দূর্গ নির্মাণ করেন। বর্গাকৃতি ছিল দূর্গটি। প্রত্যেক বাহু ছিল প্রায় দু’ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রবেশ পথটি ছিল দক্ষিণ-পূর্ব কোণে। দুর্ভেদ্য এ দূর্গের প্রবেশ পথ বাদে এর চারদিকে ছিল মাটির তৈরী প্রাচীর। প্রাচীরের বাইরে ছিল প্রায় নদীর মত প্রশস্থ পরিখা। প্রাচীরের বাইরের অংশ গড় নামে পরিচিত। আর এজন্যেই স্থানীয় মানুষ এখনও মহম্মদপুর বাজারকে ‘গড়ের হাট’ বলে থাকে। বর্তমান আমিনুর রহমান ডিগ্রি কলেজের দক্ষিণ দিকের গড়ের একটি অংশের পরিমাণ ১৬.৩৬ একর। গড়ের উত্তর পার্শ্বের পরিখা এখনও বিদ্যমান। দূর্গের দক্ষিণ-পূর্ব দিকেই সীতারামের বিখ্যাত রামসাগর। সীতারামের ‘কালে খাঁ’ ও ‘ঝুমঝুম খাঁ’ নামে দুটি কামান ছিল। দূর্গের ধ্বংসাবশেষের কিছু কিছু অংশ আজও চোখে পড়ে।
রাজপ্রাসাদ ও অন্যান্য ইমারত:
দূর্গের উত্তর-পশ্চিম কোনে রাজা সীতারাম তৈরি করেন একটি বিরাট সুন্দর অট্টালিকা। রাজপ্রাসাদের আশেপাশেই ছিল প্রমোদগৃহ, তোষাখানা, গোলাঘর, নওবত খানা, কারাগার, মালখানা, দশভূজার মন্দির, লক্ষীনারায়ণের মন্দির, শিব মন্দির, দোল মঞ্চ ও কৃষ্ণ মন্দির প্রভৃতি ইমারত। নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার দীঘলিয়া গ্রামেও তিনি একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন।
সীতারামের মন্দির:
সীতারামের দূর্গের অভ্যন্তরে ও রাজপ্রাসাদের চারদিকে অনেকগুলি মন্দির ছিল। ১৬৯৯খ্রীঃ - ১৭০০খ্রীঃ লক্ষীনারায়ণের পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে তিনি দশভূজা মন্দির নির্মাণ করেন। এখনও এখানে পূজা হয়ে থাকে। মোগল ও হিন্দু স্থাপত্যের অপূর্ব সমন্বয়ে নির্মিত হয় সীতারামের দোলমঞ্চ। হোলী উৎসবের সময় এ মন্দিরটিতে রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ স্থাপন করা হতো। ভগ্নপ্রায় এ মন্দিরটি বাংলাদেশ প্রত্নত্বত্ত বিভাগ কর্তৃক পূর্বাকৃতিতে পুননির্মাণ করা হয়েছে। কানাই নগর গ্রামের কৃষ্ণ সাগর দীঘির পাড়ে সীতারাম একটি পঞ্চরত্ন মন্দির নির্মাণ করেন। মন্দিরের গর্ভগৃহ ও চূড়ায় পাঁচটি রত্ন ছিল বলে এ মন্দিরের নাম পঞ্চরত্ন মন্দির হয়েছিল। বর্তমানে এর কোন অস্তিত্ব নেই। বাংলার স্বীয় নির্মাণশৈলী অনুসারে নির্মিত জোড়বাংলা মন্দিরটি ছিল সীতারামের গুরুত্বপূর্ণ ইমারত। দশভূজা মন্দিরের কিছু পূর্বদিকে শ্রীকৃষ্ণের জোড়বাংলা মন্দিরটি ছিল। দুটি দোচালা ঘরের পাকা ছাদের সংযোজনে সৃষ্ট ছিল এ মন্দিরের পাকা ছাদ। এর ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান। শিব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ এখনও চোখে পড়ে। ঘোষ পাড়ায় হরেকৃষ্ণ রায়ের একটি মন্দির তিনি নির্মাণ করেন। গোপালপুরের শিব মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের কিছু কিছু নিদর্শন এখনও দৃষ্ট হয়। রাজা সীতারামের প্রধান সেনাপতি মেনাহাতীর কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামশংকর কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল রায়গ্রাম জোড়বাংলা মন্দির। মুহম্মদপুর থেকে প্রায় ৪৬ মাইল দক্ষিণে নবগঙ্গা নদীর তীরে রায়গ্রাম নামক স্থানে সীতারামের জোড়বাংলা মন্দিরের অনুকরণে এটি নির্মিত হয়েছিল। দুটি জোড়বাংলা মন্দিরই এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
সীতারামের দীঘি:
রাজা সীতারাম পরোপকারী ও প্রজারঞ্জক শাসক ছিলেন। প্রজাদের পানীয় জলের অভাব দূর করতে তিনি খনন করেন অনেক দীঘি। কথিত আছে যে, প্রতিদিন তিনি নতুন দীঘির জলে স্নান করতেন। আর তাই তার অধীনে ২২ (বাইশ) হাজার বেলদার সৈন্য ছিল। যুদ্ধ না থাকলে এরা সে সময় জলাশয় খনন করতো। সীতারামের সবচেয়ে বড় দীঘিটি হলো রামসাগর দীঘি। এ দীঘিটি ২৩.৩৯ একর জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। শুধু জল ভাগের আয়তন ২৪০০ফুট দৈর্ঘ ও ৯০০ ফুট প্রস্থ। সীতারামের নাম অনুসারে এই দীঘিটির নাম রামসাগর। এখন আর এই দীঘিটি নেই। প্রমত্তা মধুমতি এটিকে গ্রাস করে নিয়েছে। এটা এখন পরিণত হয়েছে বিশাল বাওড়ে। শ্বেতসাগরসহ অনেকগুলি দীঘি ঠিক এমনি করে বিলিন হয়ে গেছে। দুধসাগর দীঘিটিও ভরাট হয়ে গেছে, তবে এর অবায়ব এখনও বিদ্যমান। সাগর দীঘিটির দৈর্ঘ্য প্রায় ১৫০০ ফুট ও প্রস্থ প্রায় ৬০০ফুট। ১০০ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৩০০ফুট প্রস্থ কৃষ্ণসাগর দীঘিটি কানাইনগর গ্রামে অবস্থিত। এটি এখনও বিদ্যমান। রামসাগরের অদূরে একটু পশ্চিমে অবস্থিত ছিল সুখসাগর। ৩৭৫ ফুট বিশিষ্ট বর্গাকার দীঘিটির এর মাঝখানে ছিল একটি দ্বীপ। এটা ছিল সীতারামের গ্রীষ্ম নিবাস।
এখানে ছিল একটি সুরম্য ইমারত। এটা মূলত প্রমোদ গৃহ। এখানে সীতারাম মাঝেমধ্যে আমোদ-প্রমোদে সময় কাটাতেন। আজ আর এর কোন অস্তিত্ব নেই। বর্তমান আমিনুর রহমান কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে সুখ সাগর এখন ধানী জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে। চলার পথে শুধু বয়োবৃদ্ধ পথিকই সুখসাগরের বর্তমান দৈন্যদশা দেখে অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে হা হুতাস করে থাকেন। মহম্মদপুর ছাড়া মাগুরা ও ফরিদপুর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও রাজা সীতারামের খননকৃত অনেক পুকুর আজও বিদ্যমান। মাগুরা সদর উপজেলার সত্যবানপুর এবং শালিখা উপজেলার মধুখালী গ্রামে সীতারামের দু’টি পুকুর এখনও রয়েছে। সীতারামের পৈত্রিক নিবাস হরিহর নগরে তিনি ‘ধনডাঙ্গার দোহা’ নামে একটি জলাশয় খনন করেন। এটাই তার প্রথম খননকৃত জলাশয়।
সীতারাম সম্পর্কে কিছু কথা:
সীতারামের পরে নাটোরের রাজা রামচন্দ্র মুহম্মদপুরের কর্তৃত্ব লাভ করেন। তিনি নির্মাণ করেন একটি রাজপ্রাসাদ এবং খনন করেন একটি দীঘি। রাজপ্রাসাদ এখন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হতে চলেছে। এখনও এটি সংরক্ষণ করা সম্ভব। দীঘিটি কালের সাক্ষী হিসেবে আজও টিকে আছে। বার ভূইয়াদের অন্যতম বীর, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের স্বাধীনচেতা জমিদার রাজা সীতারামের ভগ্নপ্রায় কীর্তিরাজী সংরক্ষিত ও পুননির্মিত হলে মুহম্মদপুর আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র রূপে গড়ে উঠতে পারে।
চাষাবাদের সময় মাটির নীচে সীতারামের রাজত্বকালের স্মৃতিবাহী বেশকিছু জিনিসপত্র সম্প্রতি আবিস্কৃত হয়েছে। পাথরের দুটি থালা ও একটি বাটি মহম্মদপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার অফিসে সংরক্ষিত আছে। মহম্মদপুর থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (O.C) অফিসেও অনুরূপ জিনিসপত্র আছে বলে জানা গেছে। রাজা সীতারামের একটি সংস্কৃত শিলালিপি বরেন্দ্র জাদুঘর, রাজশাহীতে সংরক্ষিত আছে।
সীতারাম সম্পর্কে মাগুরা-মহম্মদপুর-ফরিদপুরে প্রচলিত আছে অজস্র প্রবাদ ও কিংবদন্তী। আর এই কিংবদন্তীর মাঝেই সীতারামের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া ভার। সীতারামের কর্মকান্ড ও প্রচলিত কিংবদন্তী আপাত বিরোধী। কিংবদন্তীর রাজা সীতারাম একজন লোভী ডাকাত, অত্যাচারী, উৎপীড়ক, ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও নিষ্ঠুর রাজা ছাড়া আর কিছুই নন। প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী সীতারাম প্রথম জীবনে দস্যুবৃত্তির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নিষ্ঠুর সীতারাম ছোট ছোট বালক-বালিকাকে মাতৃকোল থেকে কেড়ে নিয়ে জলে ফেলে মৃত্যু দৃশ্য দেখে সুখানুভব করতেন। কখনও বা অন্তসত্ত্বা মহিলাদের গর্ভ বিদারণ পূর্বক গর্ভস্থ সন্তান দর্শন করে আনন্দ অনুভব করতেন। লম্পট ও ইন্দিয়াসক্ত সীতারাম সর্বদা প্রমোদ বালা পরিবেষ্টিত থাকতেন। প্রচলিত আরও প্রবাদ ‘দাতার মধ্যে খেলারাম, বদমায়েসে সীতারাম’। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা হলো, নিজে অত্যাচারী হওয়ার কারণে উত্তরপুরুষদের উপর প্রতিশোধের আশঙ্কা করেন। আর যাতে কেউ প্রতিশোধ না নিতে পারে সে লক্ষ্যে নিজে সপরিবারে নৌকায় রামসাগরে গমন করেন। আর রামসাগরের মধ্যখানে পৌঁছালে নিজ হস্তে নৌকায় কুঠার মেরে জলে ডুবে সপরিবারে আত্মহুতি দেন।
কিংবদন্তীর সীতারামের সঙ্গে তার কর্মকান্ডের মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। সীতারামকে আসলে আমরা পাই অসংখ্য মন্দির প্রতিষ্ঠকারী একজন ধার্মিক, হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতি স্থাপনকারী, অসংখ্য দীঘি খননকারী একজন প্রজারঞ্জক সুশাসক, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকারী, সর্বোপরি স্বাধীনচেতা বাঙ্গালী হিসেবে। মোগলদের সঙ্গে একটু আপোস করলেই তাঁর মৃত্যুদন্ড হতো না। কিন্তু স্বাধীনচেতা সীতারাম মোগলদের নিকট মাথা নত করেন নাই। এখন জিজ্ঞাস্য এটাই যে, প্রবাদ বা কিংবদন্তীতে সীতারাম খারাপভাবে চিত্রায়িত হলেন কেন? বস্তুত দেশের জমিদার, ব্রাহ্মণ সমাজের প্রবল বিরোধীতা, উকিল মুনিরামের তীব্র শত্রুতা, দয়ারামের গোপন চক্রান্ত, সর্বোপরি স্বর্থান্বেষী কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্র প্রভৃতি সীতারামের চরিত্র ও মহত্ত্বকে কলুষিত করেছে। সীতারামের কোন উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থ নেই। লেখক বা ঐতিহাসিক যারাই বা সীতারাম সম্পর্কে কিছু লিখেছেন, তারাও প্রচলিত প্রবাদ-প্রবচন- কিংবদন্তীকে উপেক্ষা করতে পারেন নাই। কিংবদন্তীর তমসালোক থেকে সীতারামের আসল চেহারা উন্মোচনের জন্য আজ প্রয়োজন গবেষণার।
তথ্য সংগ্রহেঃ
আবু বাসার আখন্দ
সহ-সভাপতি, যশোর.ইনফো
/
জেলা প্রতিনিধিঃ
মাছরাঙ্গা টেলিভিশন
ভোরের কাগজ
দি এডিটর (অনলাইন নিউজ পেপার)
সকালের খবর