
Home মাগুরা জেলা / Magura District > মুসলিম শাসনামলে মাগুরা / Muslim rule at Magura
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100179 বার পড়া হয়েছে
মুসলিম শাসনামলে মাগুরা / Muslim rule at Magura
মুসলিম শাসনামলে মাগুরা
Muslim rule at Magura
Muslim rule at Magura
বাংলাদেশে মুসলিম শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই এখানে ইসলামের শান্তির বাণী পৌঁছেছিল। আধুনিক গবেষণায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয় যে, মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সাঃ) জীবদ্দশায় ৬১৭ খৃস্টাব্দে সাহাবী আবুওয়াক্কাস মালিক (রাঃ) এর নেতৃত্বে কায়েস ইবনে ছায়রদী, তামীম আনছারী, উরওয়াহ ইবনে আছাছা, আবু কায়েস ইবনে হারিসা (রাঃ) সহ একটি দল এবং তাঁর ওফাতের পর সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উতবান, আসেম ইবনে আমর তামীমি, সাহল ইবনে আবদী, সুহায়েল ইবনে আদী, হাকিম ইবনে আবিল আস সাকাফী (রাঃ) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রামে আসেন। এমনকি পরবর্তীতে দুইজন তাবেয়ী মুহাম্মদ মামুন ও মুহাম্মদ মোহায়মেন এর একটি দলসহ এরূপ পাঁচটি দল বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করেন। ১২০১ খৃস্টাব্দে (মতান্তরে ১২০৪খৃঃ) ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়া বিজয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম শাসনের পত্তন করে বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। বাংলাদেশে ১২০১ খৃস্টাব্দ থেকে ১৭৬৫ খ্রীঃ অর্থাৎ মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়া বিজয় থেকে বক্সারের যুদ্ধ পর্যন্ত মুসলিম শাসনামল হিসেবে গণ্য করা হয়।
মাগুরা অঞ্চলে কোন শুভ লগ্নে কে বা কারা ইসলামের দাওয়াত নিয়ে আসেন তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায়না। তবে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ভারতবর্ষ তথা বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার ন্যায় মাগুরাতেও সুফী-সাধক-আউলিয়া-দরবেশদের মাধ্যমেই সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচার শুরু হয়। শ্রীপুরের পাল বংশীয় বৌদ্ধ বিরাট রাজা মুসলিম বিজেতা গজনীর গিয়াস উদ্দিন কর্তৃক পরাজিত হন বলে কেউ কেউ মনে করে থাকেন। ৭৫৬ খৃস্টাব্দ থেকে ১১২৪ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত পাল রাজারা বাংলাদেশে রাজত্ব করেন। ১২০১ খৃস্টাব্দে সর্বপ্রথম ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলা বিজয় করেন। এর পূর্বে কোন মুসলিম বিজেতা বাংলাদেশের কোন এলাকা বিজয় করেন বলে জানা যায় না। মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নদীয়া অধিকার করলেও পার্শ্ববর্তী জেলা হিসেবে যশোর তথা মাগুরা অঞ্চল বিজয় করেন বলে মনে হয় না। তবে তিনি এতদ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারক দল প্রেরণ করেন। মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজীর পরে ইলিয়াস শাহী বংশ (১২০১ খ্রীঃ-১৩৪২ খ্রীঃ) পর্যন্তু খলজী, মামলুক ও বলবনী বংশের মোট সতের জন শাসক বাংলাদেশ শাসন করেন। পাল আমলের কিছু ঐতিহাসিক তথ্যাদি পাওয়া গেলেও উপরিউক্ত সময়ে মাগুরা অঞ্চলে কে বা কারা শাসনকার্য পরিচালনা করেন তা জানা যায় না।
সুলতান মুগিস উদ্দিন তুঘরল খান সর্বপ্রথম যশোর অঞ্চলে স্বীয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরে বাংলাদেশে স্বাধীন সুলতানী আমল শুরু হয়। এ সময়ে স্বাধীন সুলতানী বংশ, ইলিয়াসশাহী ও হুসাইন শাহী বংশের ২৫জন শাসক ১৩৩৮ খ্রীঃ থেকে ১৫৩৮ খ্রীঃ পর্যন্তু দুইশত বছর বাংলাদেশ কৃতিত্বের সঙ্গে শাসন করেন। পূর্ববঙ্গের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের সময়ে আগত বিখ্যাত পর্যটক মরক্কোর আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে বতুতার বর্ণনা হতে তৎকালীন বঙ্গের প্রাচুর্য ও সম্মৃদ্ধির কথা জানা যায়। বাংলার অন্যান্য এলাকার ন্যায় মাগুরা অঞ্চলও এসময় সমৃদ্ধশালী ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে সুলতান শামছুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্ বঙ্গ জয় করে যশোর অঞ্চলে তার শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ইলিয়াস শাহী বংশের শাসক নাসির উদ্দীন আবুল মোজাফ্ফর মাহমুদের (১৪৪২ খ্রীঃ ১৪৫৯ খ্রীঃ) রাজত্বকালে যশোর খুলনার বিস্তীর্ণ অঞ্চল বিজিত হয়। এসময় বিখ্যাত আউলিয়া হজরত খান জাহান আলী (রঃ) যশোর-খুলনা-বাগেরহাট এলাকা জয় করেন। তিনি একদিকে যেমন ছিলেন কামেল পুরুষ তেমনি ছিলেন মহৎপ্রাণ শাসক। ১৪৫৯ খৃঃ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বার আউলিয়া বলে কথিত তার শিষ্যগণ এতদ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। বিশেষ করে তিনি বাংলাদেশে এসে যশোরের বারবাজারে প্রথম খানকা স্থাপন করেন। আর বারবাজার মাগুরার সন্নিকটে অবস্থিত হওয়ায় ধারণা করা হয় মাগুরা অঞ্চলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে বার আউলিয়াদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
এ সময় মাগুরার অদূরে ইছাখাদা অঞ্চলে হজরত শাহ মোকাররম আলী (রঃ) ইসলাম প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর সম্পর্কে অনেক অলৌকিক কাহিনী এখনও লোক মুখে শোনা যায়। তাঁর নিজের ও সঙ্গীদের কয়েকটি মাজার, একটি প্রায় ভরাট হয়ে যাওয়া দীঘি ইছাখাদার এ খানকা এলাকায় রয়েছে। একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এবং ঈদগাহের কেবলা নির্দেশক প্রাচীরের স্থাপত্য শৈলী দেখে মনে হয় এটা বাংলার ইলিয়াসশাহী বংশের শেষের দিকে নির্মিত। ইতিহাসের উৎস ও প্রাচীন স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন হিসেবে ঈদগাহের কেবলা নির্দেশক প্রাচীর ও মসজিদের ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। ধারণা করা যায় যে, হজরত শাহ্ মোকাররম আলী (রঃ) বার আউলিয়াদেরই অন্যতম ছিলেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ইছাখাদা তথা মাগুরা অঞ্চলে ইসলাম প্রচারিত হয় এবং বিশেষ করে নবগঙ্গা তীরের ইছাখাদা একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ও জনপদে পরিণত হয়। মোগল আমলে এখানে একটি সেনা ছাউনি ছিল। আর মাগুরায় থানা-মহকুমা প্রতিষ্ঠার অনেক পূর্বেই ইছাখাদায় ভূষণার অধীন পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। হজরত শাহ মোকাররম আলী (রঃ) এর জনৈক সঙ্গী ইউসুফ শাহের নামানুসারে এলাকার নাম ইছাখাদা হয়।
মাগুরার শ্রীপুর উপজেলা এলাকায় ৪ জন গাজীর আগমন ঘটে। বর্তমান দ্বারিয়াপুর ইউনিয়নে তাঁরা তাঁদের কর্মকেন্দ্র স্থাপন করেন। এ চৌগাজী (৪জন গাজী) থেকেই পরবর্তীতে দ্বারিয়াপুরের পাশে ‘চৌগাছী গ্রামের’ নামকরণ হয়েছে বলে মনে করা হয়। অবশ্য চৌগাছী গ্রামের নামকরণ সম্পর্কে ভিন্ন আর একটি মত পাওয়া যায়। কথিত আছে যে, অত্র এলাকার ৪ জন পালোয়ান সপ্তদশ শতাব্দির প্রথম দিকে বর্গীদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করেন। তারা ৪ জন গাজী হিসেবে এলাকায় পরিচিতি লাভ করেন। তাই স্থানীয় রাজা বিক্রমবর্শী তাঁদের স্মরণে এলাকার নাম রাখেন ‘চৌগাজী’। আর এই চৌগাজী থেকে আজকের ‘চৌগাছী’ নাম এসেছে। গাজী ছানাউল্লা ওরফে রণগাজী দ্বারিয়াপুরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন এবং ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষগণ আরব থেকে এখানে আসেন বলে শোনা যায়। তাঁর উত্তর পুরুষ শাহ্ সুফী তোয়াজউদ্দীন আহম্মেদ সাহেবও রাজবাড়ীর দক্ষিণাঞ্চল ও মাগুরার শ্রীপুর অঞ্চলে ইসলামের খেদমতে ব্রতী হন।
শ্রীপুর উপজেলার নোহাটা গ্রামের গরীব শাহ্ দেওয়ান সম্পর্কে অনেক অলৌকিক কাহিনী প্রচলিত আছে। অনেকের মতে যশোরের গরীব শাহ (রঃ) এবং নোহাটার গরীব শাহ দেওয়ান একই ব্যক্তি। সুলতানী আমলের শেষের দিকে তিনি এতদ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেন বলে ধারণা করা হয়। এছাড়া মাগুরার ভায়নার পীর খন্দকার আব্দুল হামিদ সাহেবের পূর্বপুরুষগণও ইরাক থেকে সুলতানী আমলে বাংলায় আসেন এবং তৃতীয় ঊর্ধ্বতন পূরুষ খন্দকার জসীমউদ্দীন ওরফে আহম্মদ আলী মাগুরার পারলা গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এই পরিবারের অনেকেই মাগুরায় ইসলাম প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।
দিল্লীর সৈয়দ বংশের সুলতান সৈয়দ আলাউদ্দীন আজম শাহের (১৪৪২খ্রীঃ-১৪৪৫খ্রীঃ) রাজত্বকালে ঢাকার মীরপুরের হজরত শাহআলী বোগদাদী (রঃ) ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাগদাদ থেকে দিল্লী আসেন এবং সম্রাট তনায়াকে বিবাহ করেন। সম্রাট তনায়ার মৃত্যুর পর তিনি দিল্লী ত্যাগ করে ফরিদপুরের গেরদায় বসবাস শুরু করেন। এ সময় ইলিয়াস শাহী (২য় পর্যায়) বংশের শাসকবৃন্দ প্রবল প্রতাপের সঙ্গে বাংলা শাসন করেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে হজরত শাহ আলী বোগদাদী (রঃ) এর উত্তর পুরুষ হজরত শাহ হাফিজ (রঃ) গেরদা থেকে মাগুরার আলোকদিয়া গ্রামে নতুন বসতি স্থাপন করেন। হজরত শাহ হাফিজ (রঃ) এর বংশধরেরা কয়েক পুরুষ ধরেই আলোকদিয়া তথা মাগুরা অঞ্চলেই ইসলাম প্রচারের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। এ বংশেই মাগুরার কৃতী সন্তান শিক্ষাবিদ ও কবি সৈয়দ আলী আহসান, সৈয়দ আলী আশরাফ, ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, অধ্যাপক সৈয়দ আলী নকী প্রমুখ জন্মগ্রহণ করেন।
হজরত শাহ হাফিজ (রঃ) উত্তর পুরুষদের একজন হজরত জাফর ছাদেক (রঃ) (পীরসাহেব, আলোকদিয়া) মহম্মদপুর উপজেলার জোকা গ্রামের বিখ্যাত সৈয়দ বা মিয়া বংশে বিবাহ করেন। জোকার মিয়া বাড়ির ভবন ও প্রাচীরের ধ্বংসাবশেষে ব্যবহৃত ছোট আকারের ইট ও অন্যান্য নির্মাণ উপকরণ দেখে মনে হয় তাঁদের এখানে আগমনও সুলতানী আমলের শেষে অথবা মোগল আমলের প্রথম দিকে। তবে এ গ্রামে সর্বপ্রথম কে আসেন তা বলা মুশকিল। শোনা যায় শাহ্ সূফী সাদ উদ্দীন সর্বপ্রথম এখানে বসবাস শুরু করেন। গেরদা, বনমালিদিয়া, আলোকদিয়া প্রভৃতি স্থানের ঐতিহ্যবাহী সৈয়দ বংশের সঙ্গে জোকার মিয়াদের বংশীয় ঐক্যসূত্র রয়েছে। জোকার এ মিয়া বংশে একাধিক ওলীয়ে কামেল জন্মগ্রহণ করেন বলে শোনা যায়। পাশাপাশি বাঁধানো দুটি কবর এখনও বিদ্যমান। ইসলাম প্রচারের ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান অনস্বীকর্য। আসলে ‘জোকা’ এতদাঞ্চলে ‘মৌলবী জোকা’ নামেই সমধিক পরিচিত। গ্রামের নামকরণের মাঝদিয়েই ধর্মীয় চেতনাবোধ ও অত্র এলাকায় তাঁদের প্রাধান্যের পরিচয় মেলে। ‘মৌলবী’ আরবি শব্দ যার অর্থ হ’ল মুসলমান পন্ডিত, অধ্যাপক। আর ‘জোকা’ ফারসি শব্দ যার অর্থ ‘মালিক’। অর্থ করলে দাড়ায় ‘মৌলভীরা মালিক’ অর্থাৎ ‘মৌলবীরাই এ গ্রামের মালিক’। পরবর্তীকালে জোকার মিয়ারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন এলাকার জমিদারী লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরে উড়িষ্যার কটক অঞ্চলে তাঁদের জমিদারীর পরিবর্তে সাবেক পশ্চিম পাকিসত্মানের সিন্ধু প্রদেশের থাট্টা জেলায় জমিদারী প্রদান করা হয়। মহম্মদপুর উপজেলা তথা মাগুরা জেলার বিভিন্ন এলাকার বয়োবৃদ্ধদের কাছে মৌলবী জোকার মিয়াদের (সৈয়দ) পরিচিতি এখনও রয়েছে। উল্লেখ্য যে, এ জোকা গ্রামেই মাগুরার বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মোঃ আছাদুজ্জমান এম.পি এবং কবি গোলাম হোসেন জন্মগ্রহণ করেন।
রুকুন উদ্দীন বরবক শাহ (১৪৫৯খ্রীঃ-১৪৭৪খ্রীঃ) ইলিয়াসশাহী বংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুলতান ছিলেন। উদারচেতা রুকুনউদ্দীন বরবক শাহ শিল্প সাহিত্য ও জ্ঞানবিজ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তাঁর সুশাসনে খুলনা-যশোর-মাগুরা অঞ্চল সমৃদ্ধশালী ছিল।
হুসাইন শাহী বংশের (১৪৯৩খ্রীঃ-১৫৩৮খ্রীঃ) আবির্ভাবের ফলে বাংলার ইতিহাসের নবযুগের সূচনা হয়। এবংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সঙ্গে যশোর জেলা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হোসেন উদ্দীন হোসেন বলেন, “তার কৈশরের স্মৃতি বহন করছে বেনাপোলের কাগজ পুকুরিয়া গ্রাম। তিনি সেখানে এক ব্রাহ্মণের গৃহে আশ্রয় লাভ করেন।” মাগুরা অঞ্চল তাঁর শাসনাধীনে ছিল। শ্রীপুর উপজেলার হানু নদীর অববাহিকায় সাঁচিলাপুর ও কচুয়ার মাঝখানে শ্রীপুর ইউনিয়নভূক্ত ‘হোসেনপুর গ্রাম’ আজও আলাউদ্দীন হোসেন শাহের স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। আলাউদ্দীন হোসেন শাহের নামানুসারে এ গ্রামের নামকরণ করা হয় ‘হোসেনপুর’। হোসেন শাহী বংশের জনৈক উত্তরপুরুষ এখানে বসবাস করতেন বলে শোনা যায়। এ আমলের কীর্তিরাজীর ভগ্নাবশেষ ছোট ছোট ইটের টুকরা আজও এ গ্রামে বিদ্যমান। তাছাড়া আলাউদ্দীন হোসেন শাহের সভাসদ সনাতনের নামানুসারে ‘সুনাতন্দী গ্রাম’ আজও তার স্মৃতি বহন করে চলেছে। এ বংশের সুলতান নসরত শাহ গৌড় থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে মাগুরার পার্শ্ববর্তী উপজেলা শৈলকূপাতে (ঝিনাইদহ) একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। যা এখনও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তিনি প্রখ্যাত সুফী সাধক মাওলানা মোহাম্মদ আরব শাহ্ (রঃ) কে এতদঅঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রেরণ করেন। নসরত শাহ্ মধুমতীর অপর পাড়ে সাতৈর এ (ফরিদপুর) একটি মসজিদ নির্মাণ করেন যা আজও বিদ্যমান। সম্রাট বাবর ১৫২৯ খ্রীঃ গোগরার যুদ্ধে নসরত শাহের সমর্থন পুষ্ট আফগান বাহিনীকে পরাজিত করেন। সুলতান নসরত শাহ্ সম্রাট বাবরের সঙ্গে সন্ধি করে স্বীয় স্বাধীনতা অক্ষুন্ন রাখেন। মাগুরা-ঝিনাইদহের বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে গঠিত এককালের বিখ্যাত পরগণা ‘মাহমুদ শাহী’ এ বংশের সর্বশেষ সুলতান গিয়াস উদ্দীন মাহমুদ শাহের নামানুসারে নামকরণ করা হয়।
হুসাইন শাহী বংশের শেষ সুলতান মাহমুদ শাহকে পরাজিত করে শেরখান (শেরশাহ্) বাংলা দখল করেন। শেরশাহ্ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বংশ ১৫৩৯ খ্রীঃ - ১৫৬৪ খ্রীঃ পর্যন্ত বাংলা শাসন করেন। মাগুরা জনপদ শূরী বংশের শাসনাধীনে ছিল। মহান শাসক শেরশাহ্ তাঁর অসামান্য শাসন প্রতিভা ও সৃজনশীল কর্মকান্ডের জন্যে অমর হয়ে আছেন। দুরদর্শী শেরশাহ্ উপমহাদেশকে একইসূত্রে গ্রথিত করার মানসে ‘গ্রান্ডট্রাংক রোড’ বা ‘সড়ক-ই-আজম’ নির্মাণ করেন যা মাগুরা সদর, শালিখা এবং ইতিহাস খ্যাত মহম্মদপুর উপজেলার উপর দিয়ে সোনারগাঁও এর দিকে গিয়েছে।
শুরী বংশের অবসানে বাংলায় কররাণী বংশের শাসন (১৫৬৪ খ্রীঃ - ১৫৭৬ খ্রীঃ) প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বংশে ৪ জন শাসক ছিলেন। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম কর্তৃক ‘মানুষ কবিতায়’ উল্লেখিত ‘কালা পাহাড়’ এ বংশের শাসক সুলায়মান কররাণীর সেনাপতি ছিলেন। বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এ বংশের শাসক দাউদ কররাণী আপ্রাণ চেষ্টা করেন। খুলনা-যশোর-মাগুরা অঞ্চল তাঁর শাসনাধীনে ছিল। তিনি ১৫৭৬ খৃষ্টাব্দের ১০ জুলাই রাজমহলের যুদ্ধে মোগল সম্রাটের সেনাপতি খান-ই-জাহানের নিকট পরাজিত ও নিহত হন। আর “দাউদ কররাণীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বঙ্গের স্বাধীন সত্ত্বা বিলুপ্ত হয়।”
দাউদ কররানীর পরাজয়ের পর বাংলাদেশ মোগল সাম্রাজ্যভূক্ত হয়। এ দেশের পরবর্তী ইতিহাস মূলত স্বাধীনতাকামী বাংলার বার ভূঁইয়াদের সঙ্গে মোগলদের সুদীর্ঘ কালব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। এই বার ভূঁইয়াদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে যশোর তথা মাগুরা অঞ্চলও পিছিয়ে ছিল না। মোগলদের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে যারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেন তৎমধ্যে যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য অন্যতম। রাজা প্রতাপাদিত্য ছিলেন দাউদ কররানীর সহপাঠী ও ক্রীড়াসঙ্গী, প্রধান অমাত্য শ্রীহরির পুত্র। মোগল ফৌজদার ইনায়েত খান রাজা প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত ও বন্দী করেন। কথিত আছে যে, রাজা প্রতাপাদিত্য ১৬১১ খ্রীঃ আত্নহত্যা করেন। রাজা প্রতাপাদিত্যের এক জ্ঞাতি সারদা পাল চৌধুরী নামে এক বিখ্যাত জমিদার মাগুরার শ্রীপুরে বাস করেন। জমিদারের নামানুসারে অত্র এলাকা ‘পালের শ্রীপুর’ নামে খ্যাতি লাভ করে। জানা যায় মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পুত্র উদয়াদিত্যের সঙ্গে সারদা পাল চৌধুরীর কন্যা বিভাপাল চৌধুরীর বিয়ে হয়। এই সূত্রে মহারাজা প্রতাপাদিত্য শ্রীপুরে আসেন। আরও জনশ্রুতিতে প্রকাশ বিভাপাল চৌধুরীকে কেন্দ্র করে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “বৌঠাকুরানীর হাট” উপন্যাস রচনা করেন। শ্রীপুর বালিকা বিদ্যালয়ের পূর্ব-উত্তরে এবং শ্রীপুর-সাঁচিলাপুর রাস্তার পূর্ব পার্শ্বে এখনও তাঁদের ভবনের ভগ্নাবশেষ এবং সিংহ দরজাটি অক্ষত অবস্থায় আছে।
তথ্য সংগ্রহেঃ
আবু বাসার আখন্দ
সহ-সভাপতি, যশোর.ইনফো
/
জেলা প্রতিনিধি:
মাছরাঙ্গা টেলিভিশন
ভোরের কাগজ
দি এডিটর (অনলাইন নিউজ পেপার)
সকালের খবর।