
Home মাগুরা জেলা / Magura District > মেনাহাতি / Menahati
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100226 বার পড়া হয়েছে
মেনাহাতি / Menahati
মেনাহাতি
Menahati
মাগুরা শহর থেকে পূর্ব দিকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দুরে মধুমতি নদীর পারে ১৬’শ সালের শেষের দিকে স্বাধীন রাজা সীতারাম রায় মহম্মদপুরে রাজধানী স্থাপন করেছিলেন। মহম্মদপুর উপজেলার সদর থেকে সামান্য দুরে এই রাজার রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যামান। এই রাজার প্রধান সেনাপতির নাম ছিল রামরূপ বা মেনাহাতি।
মেনাহাতির বাড়ি ছিল মহম্মদপুর উপজেলার কলাগাছি গ্রামে। লম্বায় ছিল সাত হাত। তার ভীষণ মূর্তি ও বীর বিক্রমের জন্য লোক ভয় করতো। তিনি সীতারামের আমলে মহম্মদপুরের চিন্তহরন দাশের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তিনি প্রচুর খাবার খেতে পারতেন। শ্বশুরালয়ে বিধবা শ্বাশুড়ী ছাড়া আর কেউ বেঁচে ছিলেন না। শ্বাশুড়ী গরীব হওয়ায় তার বাড়িতে তিনি বেশি আসতেন না। প্রতি বছর দোল পুজার সময় তিনি শ্বশুর বাড়িতে আসতেন। সীতারমের রাজধানীর পাশেই ছিল তার শ্বাশুড়ীর ঘর। পুজার সময়ে রাজধানীতে রাজা প্রচুর খাবারের ব্যবস্থা করতেন। এজন্যেই প্রতিবছর ঐ সময়ে মেনাহাতী শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসতো।
একবার মেনাহাতী দোল পুজার সময় রাজবাড়ির ভোজনালয়ে খেতে বসেছেন, এমন সময় রাজার একটি পাগলা হাতী ছুটে এসে তার খাবার নষ্ট করে দেয়। হাতীটির নাম ছিল মেনা। তার খাবার নষ্ট করে দেওয়ায় তিনি হাতীর উপর খুব রেগে গিয়ে লোহার ডান্ডা দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। খবর গেল রাজার কানে। তাকে রাজার সামনে হাজির করা হলো। সীতারাম তার সাহসিকতা ও শক্তির জন্য হাতীর নামে তাকে মেনাহাতী উপাধিতে ভূষিত করে তার সেনা বাহিনীর প্রধান পদে নিয়োগ করেন। মেনাহাতী যেমন সুনিপণ যোদ্ধা তেমনি সৈন্য সামন্ত তার একান্ত বাধ্য ছিলেন। এজন্য কামান দ্বারা সুরক্ষিত দুর্গ তার কাছ থেকে দখল করা সহজ ছিল না। এজন্য তার শক্তি ও সাহসিকতার কথা মুর্শিদাবাদেও গিয়ে পৌঁছেছিল।
বকস আলী খাঁ যখন ভূষণায় ফৌজদার হয়ে আসেন তখন তার সহকারী হয়ে এসেছিলেন জমিদারি ফৌজের কর্তা দয়ারাম রায়। সীতারামের সাথে দয়া রামের যুদ্ধ হয়েছিল। তবে দয়ারাম আগেই বুঝতে পেরেছিলেন মেনাহাতীকে হত্যা করতে না পারলে মহম্মদপুর রাজধানী কোন রূপেই দখল করা যাবে না। তাই তিনি গুপ্ত ঘাতকের দ্বারা মেনাহাতীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র লিপ্ত হন। মেনাহাতীকে হত্যা করা সহজ ব্যাপার ছিল না। তার হাতে একটি রক্ষা কবজ ছিল। এই কবজ তার হাতে বাঁধা থাকলে কখনই তিনি মারা যাবেন না বলে কবজ প্রদানকারী দরবেশ বলেছিলেন। আর দরবেশ তাকে আরো বলেছিলেন মেনাহাতীকে সামনের দিকে আক্রমণ করে কখনো কেউ হত্যা করতে পারবে না।
দয়ারাম প্রচুর অর্থের বিনিময়ে গুপ্ত ঘাতক পাঠালে ঘাতক তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে হত্যা করার জন্য চেষ্টা চালাতে লাগলো। মেনাহাতী দুর্গ দ্বারের কাছে একটি গৃহে রাতে শয়ন করতেন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে তিনি বীরের মত সশস্ত্র হয়ে নগর পরিভ্রমণ করতেন। এ সময়ে তিনি সঙ্গে কোন লোকজন নিতেন না।
একদিন ভোরবেলা মেনাহাতী গুপ্ত ঘাতকের হাতে পিছন দিক থেকে আক্রান্ত হলেন ও তার পিঠে শুল বিদ্ধ হলো। মহাবীর মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগলেন। গুপ্ত ঘাতক তাড়াতাড়ি তার হাত থেকে রক্ষা কবজ খুলে তা নিজের হাতে বেঁধে নিয়ে মেনাহাতীর মুন্ডু ছিন্ন করে ফেললো। দ্রুত গতিতে গুপ্ত ঘাতক ছিন্ন মুন্ডু নিয়ে দয়া রামের হাতে তুলে দিলো।
দয়ারাম নবাবের কাছে বাহাদুরী নিবার জন্য মেনা হাতীর ছিন্ন মুন্ড মুর্শিদাবাদে প্রেরণ করেন। নবাব সে প্রকান্ড মুন্ডু দেখে শিহরিত হয়ে উঠলেন। তিনি দয়ারামকে মুর্শিদাবাদে ডেকে আনেন। রাজ দরবারে দয়ারাম উপস্থিত হলে নবাব রাগে ফেটে পড়েন আর তাকে উদ্দেশ্য করে বলেন- দয়ারাম তোমাকে আমার হত্যা করতে ইচ্ছে করছে।
জাহাপনা, এ ছাড়াতো উপায় ছিল না। তুমি কাপুরুষ দয়ারাম। তুমি একজন যোদ্ধা হয়ে অন্য একজন যোদ্ধার প্রতি সম্মান দেখাতে পারনি। যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাকে হত্যা করলে তোমাকে বিপুল পুরস্কার দিতাম। আর যে কাজ তুমি করেছ তার জন্য তোমাকে আমি তিরস্কার করছি। তোমাকে আমি ঘৃণা করছি।
মাফ করবেন জাহাপনা, মেনাহাতীকে তো যুদ্ধের ময়দানে হত্যা করা সহজ ব্যাপার ছিল না।
তাকে বন্দি করে নিয়ে আসতে পারতে। আর এটা করতে পারলে তোমাকে আরো উচ্চাসনে আমি পদোন্নতি করে দিতাম। তোমার একাজের জন্য আমি তোমাকে বরখাস্ত না করে এক হাজার টাকা জরিমানা ঘোষণা করছি।
আপনার আদেশ মেনে নিলাম হুজুর। সত্যিই আমার ভুল হয়ে গেছে। মেনাহাতীকে এমনভাবে হত্যা করা ঠিক হয়নি। আমাকে মাফ করবেন জাহাপনা। নবাব মেনাহাতীর মুন্ডু মহম্মদপুরে ফেরত পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু এর আগেই রাজা সীতারাম মেনাহাতীর মুন্ড বিহীন দেহ সৎকার করে অস্থিখন্ডসমূহ সমাধিতলে রক্ষা করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মুর্শিদাবাদ থেকে ফেরত পাঠানো মুন্ডু সমাধি স্থানে সমাহিত করা হয়।
মহম্মদপুর বাজার থেকে উত্তর দিকে গিয়ে কাষ্ট ঘর পাড়া হতে পূর্বে যে রাস্তাটি ভূষণার দিকে গিয়েছে তারই পার্শ্বে মেনাহাতীর সমাধি স্থল ছিল। এখন সে সমাধির চিহ্ন মাত্র নেই। কিন্তু মেনাহাতীর কথা মানুষের মুখে মুখে বেঁচে আছে আজও কিংবদন্তী হয়ে। মেনাহাতীর নির্মম হত্যা কাহিনী শুনে আজও মহম্মদপুর অঞ্চলের গ্রামের মানুষেরা চোখের পানি ফেলে।
তথ্য সংগ্রহেঃ
আবু বাসার আখন্দ
জেলা প্রতিনিধি
মাছরাঙ্গা টেলিভিশন / ভোরের কাগজ
দি এডিটর (অনলাইন নিউজ পেপার)