
Home ঝিনাইদহ জেলা / Jhenidah District > গাজী কালু চম্পাবতী উপাখ্যান / Fable of Gazi Kalu Campabati
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100035 বার পড়া হয়েছে
গাজী কালু চম্পাবতী উপাখ্যান / Fable of Gazi Kalu Campabati
গাজী কালু চম্পাবতী উপাখ্যান
Fable of Gazi Kalu Campabati
গাজীকালু চম্পাবতীর পরিচয় নিয়ে আছে নানা কিংবদন্তী। জনশ্রুতিতে পাওয়া যায় যে বৈরাগ নগরের শাষক দ্বরবেশ শাহ সিকান্দের পুত্র গাজী। কালু ছিলেন সিকান্দারের পোষ্য পুত্র, আর চম্পাবতি ছিলেন সাপাই নগরের সামান্ত রাজা রামচন্দ্র ওরফে মুকুট রাজার কন্যা। এক পর্যায়ে গাজীর সাথে চম্পাবতির প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মিলনের মাঝে দুর্বেধ্য প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালো সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা। কিন্তু গাজী কালুর খন্ড খন্ড যুদ্ধে রাজা মুকুট রায়কে পরাজিত করে চম্পাবতীকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজারে। আজও গাজী কালু চম্পাবতীর মাজারে হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ মানত করে। শ্রীরাম রাজার বীর দিঘির দক্ষিণ পার্শে তিনটি পাশাপাশি কবরের অবস্থান। মাঝখানের বড় কবরটি গাজীর, পশ্চিম দিকের কবরটি কালুর এবং পূর্বের ছোট করবটি চম্পাবতির বলে পরিচিত। মাজার সংলগ্ন দক্ষিণ পশ্চিমে একটি প্রাচীন বটগাছ আছে। এই বটগাছের তলদেশে একটি শুন্য স্থান দেখা যায়। এটিকে অনেকে কূপ কিংবা অন্য কোন কবর বলে মনে করে। প্রতি বৎসর এখানে মেলা বসে এবং উরস হয়। তবে স্থানীয় ও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সকলের অভিমত এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে সংরক্ষণ ও সংস্কারের একান্ত প্রয়োজন।
ইতিহাসবেত্তা হোসেন উদ্দিন হোসেন লিখেছেন- “গাজী কালু একসময় ছাপাই নগরে আসেন। ছাপাই নগর নিয়ে অনেক কথা আমরা শুনতে পাই। অন্য ছাপাই নগর থাকলেও, বারোবাজার এলাকাতে ছাপাইনগর এককালে ছিল। বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপের রাজা কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র রায় ছাপাইনগরের রাজা ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের জামাতা হন (সতীশ চন্দ্র মিত্র- যশোর-খুলনার ইতিহাস, পৃঃ- ৪৪)।
কিংবদন্তী আছে গাজী-কালু রাজার দান দক্ষিণার কথা শুনে গাজী ছাপাইনগরের মধ্যে প্রবেশ করেন। এক সময় ইসলামের জয়গান করতে করতে দরবারে উপস্থিত হন। মৌলবাদী মানসিকতায় তাড়িত হয়ে রাজা রামচন্দ্র রায় গাজী-কালুকে নগরের বাইরে বের করে দেন। দাম্ভিক রাজার দর্প চূর্ণ করতে গাজী সৃষ্টিকর্তার কাছে রাজার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানালেন। শোনা যায় দেখতে দেখতে রাজ পূরীতে আগুন লেগে যায়। অবশেষে নগরের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি রাজপ্রাসাদ থেকে রাণী অপহৃতা হন। জ্যোতিষী জানালেন সবই গাজীর কাজ। রাজা অবশেষে গাজী কালুর আস্তানার সন্ধান পেলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে রাজা তাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। পুঁথির ভাষায় আছে-
“কহেন শ্রীরাম রাজা জোড় করি কর
আগুন জ্বলিয়া পুরি হৈলা গেল ছাঁই,
কোথায় গেলেন রাণী খুঁজিয়া না পাই।”
গাজী তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেন। রাজার সম্মতিতে, গাজী তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। রাজা রামচন্দ্র রায় গাজী-কালুকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন এবং আপ্যায়নে তুষ্ট করেন। রাজার রাজ প্রাসাদ মাটির গর্ভে চলে গেছে। প্রাসাদের চারদিকের গড় আজও দেখা যায়। গড়ে জল থাকে বারোমাস। গাজীর স্মৃতিচিহ্ন গাজীর দরগাহ্ হাসিলবাগ গ্রামের দক্ষিণে ভৈরব কুলে বিদ্যমান।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ
গাজী কালু চম্পাবতীর কথা এদেশে কিংবদন্তীর আকারে বিরাজমান। দক্ষিণ বঙ্গে গাজীর কথা শোনেনি এমন কোন লোক দেখা যায় না। রামায়নের রামনফনের মত গাজী কালু চম্পাবতীর কথা একত্রে গ্রথিত। এককালে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের প্রায় সর্বত্র গাজীর প্রভাব বিরাজমান ছিল। পূর্বে পল্লীতে গাজীর গীতের আসর বসতো। গ্রামাঞ্চলের লোকজন গাজীর গান শুনে চিত্তবিনোদন করতো। বর্তমানে গাজীর গান তেমন শোনা যায় না। এককালে গাজীর গান মুসলমানদের নিকট খ্যাতি লাভ করেছিলো। পূর্বে গাজীর গীত শুনতে শুনতে দেশের লোক এমনভাবে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল যে, লোকে একই কথা বার বার ব্যক্ত করলে ‘গাজীর আলাপ’ বলে উপহাস করতো এবং কোন বিষয় সম্পর্কে অতিরিক্ত লেখা দেখলে ‘গাজীর পট’ বলে উপহাস করতো। গাজীর জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের ফলে এদেশের জনগণ তাকে আজও স্মরণ করে। এদেশের বহুস্থানে গাজীর নামে গাজীপুর, গাজীহাট, গাজীর ডাঙ্গাল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর দেউল, গাজীরঘাট, গাজীর খাল, গাজীর খুটো ইত্যাদি গাজীর নাম স্মরণ করে চলেছে। কলিকাতার পরপারে শিবপুরে এবং পশ্চিমবঙ্গের শেরপুরে গাজী কালু নামে মেলা বসে। সুন্দরবনের মৎস্যজীবী হিন্দুরা গাজীর নামে মেলা পাঠা বলি দেয়। দুর্গম নদী পথে ঝড়-তুফানের মধ্যেও দাঁড়ি-মাঝিরা নৌকা চালিয়ে আপন মনে পাল তুলে চলতে থাকে এবং শক্তিধর গাজী শাহের গুণ কীর্তন করে।
আমরা আজি পোলাপান
গাজী আছে লিখাবান
শিবে গঙ্ গা দরিয়া
পাঁচ পীর বদরবদর।
এই পাঁচ পীরের মধ্যে সিকান্দার শাহ, গাজী ও কালুর নাম সুপরিচিত। আর দু’জনের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে পাঁচ পীরের মধ্যে গিয়াসউদ্দীন ও শামসুদ্দিনের নামও শ্রুত হয়। গাজীর গীতের মধ্যেও পাঁচ পীরের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু গাজীর গীতের প্রচলিত মতের সাথে এই পাঁচ পীরের সম্পর্ক ইতিহাসে মেলে না। কথিত আছে যে, এই পাঁচ পীরের নাম গিয়াসউদ্দীন, তৎপুত্র শামসুদ্দিন, তৎপুত্র সেকেন্দার এবং সেকেন্দারের পুত্র বরখান গাজী ও কালু। প্রচলিত গাজীর গীতে পাঁচ পীরের কথা পাওয়া যায়ঃ
পোড়া রাজা গয়েসদি, তার পুত্র সেকেন্দার,
তার বেটা বরকান গাজীঃ
খোদাবন্দ মুলুকের কাজী।
কলিযুগে যার অবসর,
বাদশাই হিড়িন বঙ্গে
কেবল ভাই কালু সঙ্গে
নিজ নামে হইল ফকির।
সুবর্ণগ্রামে এই পাঁচ পীরের নামে পাঁচটি দরগা আছে। সিলেট জেলার জিন্দা বাজার মহল্লার এক গোরস্থান “পাঁচ পীরের মোকান” বলে পরিচিত। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারবর্ষের অনেক জায়গায় পাঁচ পীরের নাম শোনা যায়। এই পাঁচ পীর কথাটি বার ভূঁইয়া ও বারো আউলিয়ার মত। তবে জানা যায় যে, তুর্কি আফগান আমলে এই দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য অসংখ্য পীর আউলিয়ার আগমন ঘটেছিল। তাদের মধ্যে বইতে পাঁচ পীরের নামকরণ করা হয়েছে। “পাঁচ পীর” প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পৃথক সত্তা ছিল কিনা সে সম্পকেং ডক্টর আনিসুজ্জামান বলেছেন, “হিন্দু দেবদেবী ও তাদের গুণাবলীর পরিচয় মুসলিম মানসে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তারই ফলে এসব দেবদেবীর মুসলমান প্রতিরূপও গড়ে ওঠে। হিন্দু বনদূর্গার স্থলে বনবিবি, দক্ষিণ রায়ের রূপান্তর গাজী পীর ও কালু, মৎসেন্দ্র নাথের পরিবর্তে মসন্দলি এবং সত্যনারায়ণের প্রতিরূপ সত্যপীর। মুসলমান সমাজের খোয়াজ খিজির, পীর বদর, মানিক পীর ও পাঁচ পীরের উপাসনা দেখা যায়।” এগুলোর মধ্যে বনবিবি, সত্যপীর ও মানিক পীরের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক ভিত্তি আমাদের জানা নেই। তবে গাজী কালু, পীর বদর ও দক্ষিণ রায় প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক চরিত্র বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
বিলুপ্ত নগরী বারবাজারে পাঁচ পীরের প্রভাব দেখা যায়। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার লাবসা গ্রামে পাঁচ পীরের মোকাম বা দরগা আছে। বারবাজার হাইস্কুলের উত্তরে এবং রেল লাইনের পূর্বদিকে পাঁচ পীরের নামে জলাশয় আছে যা তাদের স্মৃতি স্মরণ করে চলেছে। পীর বদরের নামও বাংলাদেশে পরিচিত। বারবাজারের হাসিলবাগ গ্রামে বদরের নামে হাট আছে। চট্টগ্রাম শহরের বকশী বাজার মার্কেটের দক্ষিণে পীর বদরের মাজার আছে। তিনি বদর শাহ ও শাহ বদর নামে পরিচিত ছিলেন। শোনা যে, পীর বদর প্রায় ছয় শত বছর পূর্বে একটি প্রস্তরের উপর বসে চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন। তিনি একটি মাটির আশ্চর্য প্রদীপ জ্বালাতেন যাকে চাটি বলা হতো এবং যে স্থানে ঐ প্রদীপ জ্বলতো সেই স্থান বর্তমানে ‘বদর চাট’ নামে পরিচিত। এই ‘চাটি’ শব্দ হতে চাটিগ্রাম বা চাটগাঁও নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে কথিত আছে। গাজী পীর ও পীর বদর উভয়ই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। পীর বদর সম্পর্কে গাজীর ন্যায় বহু অলৌকিক ও অতিরঞ্জিত কথা শোনা যায়। সারা দেশে তার সম্পর্কে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত থাকলেও এ কথা সত্য যে, তিনি সর্বপ্রথমে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। ভক্তের কণ্ঠে পীর বদরের কথা শোনা যায়ঃ
আমরা আছি পোলাপান
গাজী আছে নিঘাবান
আলী নবী পাঁচ পীর
বদর বদর।
চট্টগ্রামের একটি মাজারের ফলক থেকে জানা যায় যে, পীর বদর ১৩৪০ খৃষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন। সিলেট জেলার বদরপুর রেলস্টেশনের পাশের এক পীর বদরের সমাধি আছে। পীর বদরের মাজারের উৎকীর্ণ ফলক থেকে জানা যায় যে, গাজী পীরের বহু পূর্বে পীর বদর এদেশে আগমন করেছিলেন।
ঐতিহাসিক বারবাজার অঞ্চলে গাজীর নামে গাজীল জাঙ্গল আছে। বারবাজার রেলস্টেশন থেকে এক মাইল উত্তর-পূর্বে বাদুরগাছার মৌজার মধ্যে গাজী কালুর স্মৃতি বিজড়িত ছাপাইনগর গ্রাম অবস্থিত। এই ছাপাইনগরে শ্রী রামরাজার গড়বেষ্টিত বাড়ী ছিল। যার ধ্বংসের নিদর্শন আজও দৃষ্টিগোচর হয়। গড়ের মধ্যে বর্তমানেও বার মাস জল ভর্তি থাকে। গড়ের দক্ষিণে জঙ্গল অপসারিত হয়ে একটি পাকাঘর আবিস্কৃত হয়েছে। এখানে গাজীর নামে একটি দর্গা আছে। স্থানীয় লোকশ্রুতির মাধ্যমে জানা যায় যে, গাজী তার প্রিয়তমা পত্নীকে নিয়ে মুড়লী ও বারবাজার অঞ্চলে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন। বারবাজারের নিকটবর্তী হালিসবাগ গ্রামের দক্ষিণে এবং ভৈরব নদীর তীরবর্তী স্থানে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে গাজীর দরগা আছে। এসব জায়গর লোকেরা নানারকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গাজীর নাম স্মরণ করে।
ঝিকরগাছার দুই মাইল পুর্বে এবং রেলস্টেশন হতে সামান্য পূর্বে যশোর রাস্তার পার্শ্বে লাউজানী গ্রামে (ব্রাহ্মণনগর) গাজী পীরের বিখ্যাত দরগা অবস্থিত। দরগার পাশে চম্পাবতীর পুকুর এবং দক্ষিণে খনিয়ার মাঠ (রণক্ষেত্র) অবস্থিত। বেনাপোল কাস্টমস কলোনীর মধ্যে গাজীর দরগা দেখা যায়। বাগেরহাটের নিকটবর্তী রণবিজয়পুরে গাজীর দরগা আছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গাজীর বটগাছ আছে। মুজগুন্নির পাশে এক স্থানের নাম গাজীর ঘুটো। ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক এ এফএম আব্দুল জলিল সাহেব উল্লেখ করেছেন যে, মোরেলগঞ্জ থানার সুরাতলী গ্রামে কাষ্ট নির্মিত বিরাটাকার ব্রাহ্ম ও অশ্বমূর্তির পৃষ্ঠে গাজী ও কালুর মূর্তিদ্বয় সোয়ার অবস্থায় দেখা যেতো। এই সমস্ত দর্শনে শক্তিশালী গাজীর প্রতাপ এতদঞ্চলে বিশেষভাবে অনুভূত হয়।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক ব্যক্তি সম্পর্কে এত প্রকার কিংবদন্তী প্রচলিত যে, তার সম্পর্কে সঠিক বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিভিন্ন রকম পুঁথি যেমনঃ “গাজী কালু ও চম্পাবতীর পুঁথি” “দরাফ খানের গঙ্গাক্ষেত্র” “দরাফ খা গাজী” “বরখা গাজীর কেরামতি” ও “গাজী মঙ্গল” প্রভৃতি পুঁথিতে গাজী সম্পর্কে অতিরঞ্জিত, অযৌক্তিক ও অলীক গল্পে পরিপূর্ণ। এসব পুঁথি থেকে গাজী সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এসব পুঁথি লেখকরা ঐতিহাসিক সত্যকে এমনভাবে বিকৃত করেছে যে, আসল সত্য ধামাচাপা পড়েছে। নিন্মে আমরা প্রতাপশালী পীর ও ঐতিহাসিক ব্যক্তি গাজী সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবার চেষ্টা করবো। নানা যুক্তি তর্কের মাধ্যমে যা বাস্তব সত্য তাই উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অযোগ্য, অবাস্তব ও অসত্য তথ্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এখন আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই ভাগ্যবান মহাপুরুষ সিংহ কে ? কি তার পরিচয় ? কি ছিল তার জীবন দর্শন ও প্রত্যাশা ? নিন্মে আমরা পুঁথিনির্ভর তথ্য উপস্থাপন করলাম। পরবর্তীকালে আমরা কিংবদন্তীর পুঁথির আলোকে ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটন করার চেষ্টা করবো।
‘গাজী’ নামক পুঁথির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, বৈরাটনগরের রাজা সেকেন্দার শাহের প্রথমা রাণী অজুপা সন্দিরীর গর্ভে গিয়াসউদ্দিন (জুলহাস) ও বরখান গাজী জন্মগ্রহণ করেছিল। রাণীর পালিত পুত্রের নাম ছিল কালু। রাজা ও রাণীর প্রথম পুত্র জুলহাস শিকারে যেয়ে নিরুদ্দেশ হলে প্রাপ্তবয়স্ক গাজীকে রাজ্য গ্রহণ করতে বললেন। গাজী উত্তরে বললেন “আমি বাদশাহী চাহি না, পক্ষান্তরে ফকির হতে ইচ্ছা করি।” পিতা পুনঃ পুনঃ তাকে রাজ্য গ্রহণ করার জন্য বললেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। অবশেষে রাজার আদেশ অমান্য করার জন্য রাজরোষে পতিত হন। রাজা হিরণ্যকশিপুর মত তার উপর নানা রকম অত্যাচার করা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হলো না। রাজার আদেশে জল্লাদ তাকে হত্যাকরার জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু গাজীর একটি লোমও কাটলো না। তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হলো, কিন্তু কিছুই হলো না। গাজীকে পাথরের সাথে বেঁধে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলো। অবশেষে একটি র্সূঁচে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করে গাজীকে তুলে আনবার জন্য আদেশ করা হলো। খোদার কৃপায় সাগর শুকিয়ে গেল। খোয়াজ খিজির পাতালপুরী হতে গাজীকে সূঁচ এনে দিলেন। গাজী মহানন্দে রাজপ্রাসাদে প্রত্যার্পণ করলেন।
অবশেষে গাজী কালুর সঙ্গে গোপনে রাসিংহাসন ও সংসার জীবন ত্যাগ করে ফকিরি বেশে বাংলাদেশের সুন্দরবনে এসে উপস্থিত হলেন। তাদের অসাধারণ আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘ ও কুমীর সবই বশীভূত হলো। অবশেষে গাজী ও কালু ইসলাম প্রচার করবার জন্য ছাপাইনগরের শ্রীরাম রাজার দেশে উপস্থিত হলেন। পুঁথির ভাষায়ঃ
প্রজাগণ যত তার সব হিন্দুবান
সে দেশের মধ্যে নাহিএক মসিলমান।
অকস্মাৎ একদিন রাজবাটীতে অগ্নি লাগলো। রাণী অপহৃত হলেন এবং সেখানকার সব মুসলমান হয়ে নিস্তার পেলো। ছাপাইনগরে একটি সুবর্ণমন্ডিত মসজিদ নির্মিত হলো। অবশেষে তারা দুইভাই সেখানকার পুর ও রায় হয় দেশ ব্রাহ্মণনগরে গেলেন।
পুঁথির ভাষায়ঃ
ব্রাহ্মণনগর এইশুন বিবরণ ॥
এদেশের প্রজাগণ সকলি ব্রাহ্মণ।
অন্য জাতি দেশে রাজা নাহি দেয় ঠাঁই ॥
যবন পাইলে খাই দক্ষিণা গোসাই ॥
মুকুটরায় ছিলেন যবনদ্বেষী ব্রাহ্মণ। রাজার সাত পুত্র ও এক কন্যা ছিল। কন্যার নাম চম্পাবতী। গাজী চম্পাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে পাগলপ্রায় হলেন। কালু ঘটক হিসেবে রাজা মুকুট রায়ের দরবারে যেয়ে গাজীর সাথে চম্পাবতীর বিয়ের কথা উত্থাপন করলে কালু বন্দী হলেন। ফলে গাজীর সাথে প্রকার যুদ্ধ বাঁধলো। পুঁথির ভাষায়ঃ
সাত শত গাড়ল লয়ে
দাবার ঘাট পার হয়ে
গাজী চললেন খুনিয়া নগর
খুনিয়ানগরে যেয়ে মুকুট রাজার মেয়ে
গাজী বিয়ে করলেন কৌশল্যা সুন্দরী।
গাজী অসংখ্য ব্যাঘ্র সেনা নিয়ে নদী পার হয়ে মুকুট রায়ের রাজধানী আক্রমণ করলেন। মুকুট রায়ের বলশালী প্রধান সেনাপতি দক্ষিণ রায় কুমীর নিয়ে গাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। দক্ষিণ রায় মুগুর দ্বারা গাজীর হাতের আশা ভেঙ্গে দিলেন। অবশেষে তিনি গাজীর অদ্ভূত রণকৌশলের নিকট পাজিত হলেন। রণবিজয়ী গাজী দক্ষিণ রায়ের কান কেটে, বারো হাত লম্বা টিকি কেটে বেঁধে রাখলেন। এই সংবাদ শ্রবণ করে রাজা মুকুট রায় স্বয়ং কয়েক হাজার সৈন্য এবং তোপ তীর নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। যুদ্ধ চলতে লাগলো। রাজা মুকুটি রায় প্রত্যহ রাত্রিতে “মৃত্যুঞ্জীব কূপ” হতে জল ছিটিয়ে সৈন্য, হাতি ও ঘোড়া বাঁচিয়ে দিতেন। গাজী এই সমস্ত রহস্য জানতে পেরে সেই কূপে গোমাংশ ও রক্ত নিক্ষেপ করলেন। গাজীর ব্যাঘ্র সেন্য ও পরীদল মুকুট রায়ের সৈন্যদের মেরে ফেলেছিল। রাজা ও সভাসদগণ কলেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। রাণী এতে আপত্তি করলেন না। পুঁথির ভাষায়ঃ
বড় আহ্লাদের মোর কন্য চম্পাবতী
সাতপুত্র মধ্যে সেই আদরের অতি।
তার প্রতি দয়া তুমি সদয় রাখিবা
অনিষ্ট করিলে কোন মার্জনা করিবা।
গাজী চম্পাবতীকে নিয়ে বিদায় হলেন। বাঘ ও পরীগণ রাজাকে সালাম জানিয়ে বিদায় লইলো। গাজী চম্পাবতীর রূপে মুগ্ধ হলেন। পুঁথিতে তার অপরূপ রূপের কথা বর্ণিত আছেঃ
জ্বলিতেছে রূপ যেন লক্ষ কোটি শশী
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেনিয়া
মুর্ছিত হইয়া গাজী পড়িল ঢলিয়া।
কিছুদিন পরে পথিমধ্যে গাজী দেখলেন, এক নদীর কূলে তিন শথ যোগী সাধনায় নিযুক্ত আছেন। সঙ্গীকে ডেকে তিনি যোগীদিগের অভিষ্ট কমলে কামিনী দর্শন করালেন। যোগীরা মুসলমান ধর্মের ন্যায় ধর্ম নাই দেখে ঝুটি কেটে মুসলমান হয়ে গেল। পরে পাতালপুরী হতে জুলহাসকে নিয়ে গাজী কালু ও চম্পাবতী সাগর পার হয়ে বৈরাটনগরে পৌঁছিলেন। মলিন রাজপুরী আবার হর্ষ কোলাহলে মুখরিত হলো। এই কাহিনীই পুঁথির মূল কথা।
এখন আমরা বিবেচনা করে সামনের দিকে অগ্রসর হবো যে, কাল্পনিক পুঁথির মধ্যে কতটুকু ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে। সর্বপ্রথমে আমাদের জানা দরকার বৈরাটনগর কোথায় অবস্থিত? পুঁথিতে বিরাটনগর, সোনাপুর ও ছাপাইনগর নাম পাওয়া যায়। সর্বপ্রথমে তার জন্মস্থান বৈরাটনগরের পরিচয় পাওয়া যায়।
গাজীর প্রকৃত পরিচয় ও বৈরাটনগরের পরিচয় অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রায়ই। বহু অনুসন্ধারে পর জানা যায় যে, বারবাজারের নিকটবর্তী বেলাট গ্রাম বৈরাটনগর থেকে অপভ্রংশের মাধ্যমে এসেছে। তুর্ক আফগান আমলে এখানে শহর এবং মুসলমান সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। বৈরাট বা বিরাটনগর বেলাট গ্রামে হওয়া স্বাভাবিক। এরূপ ধারণা করার পিছনে যুক্তি হচ্ছে ব্রাহ্মণনগর বৈরাটনগরের কাছেই অবস্থিত। গাজী ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তবে সেকেন্দার শাহের পুত্র তা ঐতিহাসিক সত্যের বিপরীত। সেকেন্দর শাহের বরখান গাজী বা বড় খাঁ গাজী নামে কোন নামে কোন সন্তান ছিল না। সেকেন্দার শাহ ১৩৫৯ খৃষ্টাব্দে থেকে ১৩৯২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন। তার আটরোজন পুত্র সন্তান ছিল। তার পুত্র গিয়াসউদ্দীন পিতার উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেকেন্দার শাহের প্রায় একশত বছর পরে মুকুট রায় ও গাজীর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তাই সিকান্দার শাহ ও গাজীর সাথে পিতাপুত্রের সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, দক্ষিণ রায়ের সাথে যে গাজীর যুদ্ধ হয়েছিল তার নাম বরখান গাজী। বনবিবি ও গাজীর গীতের মধ্যেও বরখান গাজীর নাম দেখতে পাওয়া যায়। ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে আছেঃ
বড় খা গাজীর সাথে মহাযুদ্ধ খনিয়াতে দোস্তালী হইল তারপর গরীবুল্লা।
জঙ্গনামা পুঁথিতে বড় খাঁ নাম পাওয়া যায় যেমনঃ
বাপ নাম শাহ ছুন্দি আল্লার ফকির
অধীন ফকির বলে কিতাবের বাত
সম্ভবতঃ বরখান গাজী শব্দটি অপভ্রংশের মাধ্যমে বড় খাঁ গাজীতে পরিণত হয়েছে। ১৬৮৬-৮৭ খৃষ্টাব্দে চব্বিশ পরগণা জেলার কবি কৃষ্ণরাম দাস ‘রায়মঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। এই কাব্যে অসংখ্য কাহিনী দ্বারা ভরপুর থাকলেও এর মাঝে অনেক ঐতিহাসিক সত্যতা নিহিত আছে।
এখন আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমাদের আলোচিত গাজী শাহের নাম বরখান গাজী। সম্ভবতঃ তিনি সেকেন্দার নামীয় কোন বর্ণাঢ্য ব্যক্তির পুত্র ছিলেন। তার পিতা সম্ভতঃ তুর্ক আফগান আমলে সামন্তরাজ বা অধীনস্থ শাসনকর্তা ছিলেন।
গাজীর বংশ পরিচয়ের মত বাল্য জীবনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট। কথিত আছে যে, বাল্যকালে তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। অল্পদিনের মধ্যে তিনি পবিত্র কোরান শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন। তিনি আরবী, ফার্সী, গণিত ও ধর্মশাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বাল্যকাল হতে তিনি ধর্মকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। তার গুণ উত্তরোত্তর প্রস্ফুটিত হতে লাগলো। তিনি শাহ জালালউদ্দিন তাব্রিজীর নিকট আধ্যাত্মিক জগত সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তবে এ কথা সত্য যে, জালালউদ্দিন তাব্রিজী তার বাল্যশিক্ষক ছিলেন না। কেননা, জালালউদ্দিন তাব্রিজী দ্বাদশ শতাব্দীর পরেই এদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য আগমন করেছিলেন। বরখান গাজীর আবির্ভাব ঘটেছিল এর প্রায় তিন শত বছর পরে। গাজী পীর বহু চিন্তার পর ধনীর দুলাল হয়েও ইসলাম প্রচারের জন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন। গাজীগীতে উক্ত আছেঃ
গাজী বলে কালু ভাই
ছাড় দলের বাদশাই
চল মোরা ফকির হয়ে যাই।
অবশেষে গাজী এক গভীর নিশিথে কালুকে সাথে নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। সহোদর ভ্রাতা গাজী ও কালু উভয়ে যোগী সাজলেন। পরিশেষে তরুণ দুই সন্ন্যাসী সুন্দবনের গভীর অরণ্যে কঠোর সাধনায় লিপ্ত হন। সাধনার পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
গাজীর প্রকৃত নাম গাজী নয়, গাজী তার উপাধি। যার অর্থ ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী বীর। যিনি বিধর্মীর সাথে ধর্মযুদ্ধ করে জয়লাভ করেন তিনি ‘গাজী’ নামে সম্মানিত হন। হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর সময় হতে বহুলোক এদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য আগমন করেছিলেন এবং বহু গাজী এদেশে প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিল। গাজীদের আস্তানা ও দরগা এখনও সযত্নে সংরক্ষিত আছে।
অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, রাজা মুকুট রায়ের সাথে যে গাজীর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তার নাম গোরাই গাজী। কিন্তু পীর গোরাই চাঁদ বা গোরাই গাজী আমাদের আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি ভিন্ন। গোরাই গাজীর ইতিবৃত্তে দেখা যায় যে, সেখানে মুকুট রায়ের সাথে যুদ্ধের কথা উল্লেখ নেই। গোরাই গাজীর প্রকৃত নাম সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী। তিনি দেউলিয়ার রাজা চন্দ্রকেতুকে বশীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন। চব্বিশ পরগণা জেলার গেজেটিয়ার হতে জানা যায় যে, হাতিয়াগড়ে গোরাই গাজীর সাথে রাজা মহিদানন্দের পুত্র আফয়ানন্দ ও বকানন্দের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে বকানন্দ নিহত হন এবং গোরাই গাজী ভীষণভাবে আহত হন। বালারুর নিকটবর্তী হড়োয়ায় এসে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১২৩০-১২৩৭) গোরাগাজীর সমাধির উপর মসজিদ নির্মাণ করে দেন। তিনি মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য ৫ শত একর জমি নিষ্কর দিয়েছিলেন। বসিরহাট অঞ্চলে গোরাই গাজী সর্বজন পরিচিত পীর। হাড়োয়ায় প্রতিবছর তার নামে মেলা বসে। তার নামে কলিকাতায় গোরাচাঁদ রোড আছে। এখনও ফকিরের কণ্ঠে শোনা যায়, “পীর গোরা চাঁদ মুশকিল আসান”। প্রতিবছর ১২ই ফাল্গুণ তার মাজারে ওরস উদযাপিত হয়। হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান, নরনারী এই ওরসে যোগদান করে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, ‘পীর গোরাচাঁদ আসলে হিন্দুর ঠাকুর ছিলেন। পরে সম্পূর্ণ মুসলমান হয়ে গেছেন।’ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাও বর্ণনা দিয়েছেন, ‘এই পীরের শেষ খাদিম ও পীরের মুতাওয়াল্লী শায়খ দ্বারা মালিক হাড়োয়ার নিকটবর্তী পেয়ারা গ্রামে বাস করতেন।’ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তারই উত্তরসূরী। যাই হোক, আমরা এ সম্পর্কে আর বেশী দূর অগ্রসর হতে চাই না। মোদ্দাকথা হলো পীর গোরাচাঁদ ও বরখান গাজী দু’জনই ভিন্ন ব্যক্তি।
ত্রিবেণীর উলুফ ই আজম হুমায়ুন জাফর খাঁ হারাম ইৎসীন গাজী সংক্ষেপে জাফর খাঁ গাজীর দুই পুত্র ছিল বলে জানা যায়। তার পুত্রত্রদ্বয়ের নাম হলো উগত্তয়ান খান গাজী এবং বড়খান গাজী। সম্ভবতঃ তিনি লাথনৌতির সুরতান রুকুনুদ্দীন কায়কাউসের (১২৯১-১৩০০) অধীনস্থ একজন সেনাপতি ছিলেন। বরেন্দ্র ও রায় এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য তার অবদান অপরিসীম। দিনাজপুর জেলার দেবীকোটে একটি মসজিদের অস্তিত্ব অম্লান পাওয়া যায়। মসজিদ না থাকলেও একটি শিলালিপির মাধ্যমে জানা যায় যে, হিজরী ৬৫৭ সালের ১ মুহররম মুতাবিক হয়েছিলেন। সুলতানবাসী মালিক জিওন্দ নামে উলুখই আজন হুমায়ুন জাফর খাঁ বাহরা জমিন গাজীর আদেশে এটি নির্মাণ করেন। এই শিলালিপিতে তাকে বলা হয়েছে, নাসিরুল ইসলামবা ইসলামের সহায়ক এবং শিহাবুল হক ওয়াদ্দিন বা সত্য ও ধর্মের উল্কাস্বরূপ। ত্রিবেণী বিজয়ের পর জাফর খাঁ গাজী ১৯২৮ ঈশায়ী খৃষ্টাব্দে হুগলীর পাতুয়ায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদের শিলালিপিতে জাফর খাঁ গাজীর পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে। তিনি প্রত্যেক অভিযানেই হিন্দুস্তানের বিভিন্ন নগর জয় করেন এবং তিনি তার ক্ষুরধার তরবারি ও বর্শার আঘাতে হৃদয় বিধর্মীদের পরাজিত করেন। হুগলীর ছোট্ট পাত্তুয়ায় জাফর খাঁ গাজী (রঃ) এর নির্মিত একটি সুউচ্চ মিনার আজও সগৌরবে ইসলামের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে। এমিনার টি ত্রিবেণী বিজয়ের পর সম্ভবতঃ ১৯২৮ খৃষ্টাব্দে নির্মিত। জাফর খাঁ গাজী ১৩১৩ খৃষ্টাব্দে ত্রিবেণীতে ইন্তেকাল করেন। অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জাফর খাঁ গাজীল পুত্র বড়খান গাজী ও আমাদের আলোচ্য বরখান গাজী বড়খান গাজী। ঘটিয়া বিবি মোবারক শাহ (রঃ) সুশরীফ শাহ গাজী সবাইকে একই ব্যক্তি বলে মনে করেন। কিন্তু সবাই পৃথক পৃথক ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ডক্টর এনামুল হক বলেছেন যে, আমাদের আলোচ্য গাজী শাহ সম্ভবতঃ ত্রিবেণী বিজেতা জাফর খাঁ গাজীর পুত্র এবং গৌভাদিপতি সুলতান সেকেন্দার শাহের আমলের ব্রাহ্মণ রাজা হলেন মুকুট রায়। বড় খাঁ গাজী সম্ভবতঃ দক্ষিণাঞ্চলে যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগণায় যুদ্ধাভিযান করেছেন। দরাফ খাঁ এবং ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজী অভিন্ন ব্যক্তি। তবে আমরা ডক্টর এনামু হকের সাথে একমত হতে পারলাম না কেননা ত্রিবেণী বিজেতা জাফর খাঁর বড়পুত্র খাঁ পুত্র সম্ভবতঃ চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করবার জন্য এসেছিলেন। কমপক্ষে আমাদের আলোচ্য গাজীর আবির্ভাবের একশত বছর পূর্বে। জাফর খাঁ গাজীর কিংবা তার পুত্রের সময় মুকুট রায় নামে কোন রাজার নাম পাওয়া যায় না। তাই উভয় গাজীই ভিন্ন ব্যক্তি। ত্রিবেণীতে বড় খান গাজী ওতার ছোট ভাই উগওয়ান খান গাজী (রঃ) এর মাযার তার পিতার মাযারের কাছেই বিদ্যমান রয়েছে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেন যে, ‘ইসমাইল গাজীই পরবর্তীকালে বড় খান গাজী নাম গ্রহণ করেছিলেন।’ ‘রিসালাতুস শুহাদা’ নামক ফর্সি গ্রন্থে তার জীবন লিপিবদ্ধ আছে। তাই ডঃ সেনের সাথে আমরা একমত হতে পারি না। এই ইসমাইল গাজী গৌড়ের সুলতান বরবক শাহের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি তার সময়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন। তিনি কামরূপ রাজাকে পরাজিত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। সপ্তদশ শতকের কবি সীতারাম দাস তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রশংসা করেছেন। বন্দেশী রায়ের চক্রান্তে ইসমাইল গাজীকে ১৪৭৪ খৃষ্টাব্দে শিরোচ্ছেদ করা হয়। ষড়যডন্ত্রের কথা জানতে পারলে সুলতান গভীর মর্মপীড়ায় ভোগেন। তিনি গাজীর বেগমকে সাথে নিয়ে মান্দারন (সমাহিত হয়েছিল) ও কাটদুয়ারে (দেহ সমাধিস্থ হয়েছিল) উপস্থিত হয়ে গাজীর দরগা জিয়ারত করেন। অতএব উভয় গাজীই ভিন্ন ব্যক্তি।
অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পীর সায়্যিদ মুবারক আলী গাজী ও আমাদের আলোচ্য গাজী অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরনগণা জেলার মুবারক গাজী নামে এক পীরের আস্তানা ছিল। এই পীর সায়্যিদ মুবারক আলী গাজী। (রঃ) মুবারক শাহ গাজী, মবরা গাজী, গাজী সাহেব, গাজী বাবা, বড় খাঁ গাজী, পীর বাবা গাজী ইত্যাদি নামে পরিচিত। চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে তার কথা রূপকথার মত ছড়িয়ে আছে। জানা যায় যে, তার পিতার নাম সেকেন্দার শাহ ও তার মাতার নাম বিবি কুলসুম। সম্ভবতঃ তিনি বেলে আদমপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কেউ কেউ বলেন যে, বৈরাটনগরে তারা জন্মগ্রহণ করেন। তবে বৈরাটনগর সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ আছে। তার মামার খুটিয়ারী গ্রামেই বিদ্যমান। তার মামাকে গাজী বাবার দরগা বলে অভিহিত করা হয়। তিনি একজন কীর্তিমান ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন। তার কথা এমনভাবে কিংবদন্তীর আকারে ছড়িয়ে আছে যে, সত্যটি আবিস্কার করা কষ্টসাধ্য। তিনি ধর্মযুদ্ধে জয়লাভ করে ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। জানা যায় তার সম্পর্কে বহু হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। মোবরা গাজী সম্পর্কে আব্দুল কাদের সাহেবের অভিমত হল, "His kindness to Hindu Zamindars shows the generosity of his nature. He was always unimposing and lived a very simple life. His frgiveness to the arogant enemies oroved this tolerate spirit and his refusal of any memoral in the humanity of his character. He was a true saint and fully desernes shown to his memory."
অপর একজন মোবারক গাজীর কথা সুন্দরবনাঞ্চলে শোনা যায়। কথিত আছে যে, তিনি বাঘের পিঠে আরোহণ করে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি যোদ্ধা ও দরবেশ ছিলেন। ধর্ম প্রচারকল্পে তিনি বহু যুদ্ধ করেছেন এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তার মাজার চব্বিশ পরগণা জেলার বাশড়া গ্রামে বিদ্যমান। ‘বালান্তর পীর হযরত গোরাচাঁদ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ঘুটিয়ারী শরিফের শাহ মুবারক গাজী (রঃ) একজন কামিল পীর ছিলেন। এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, হযরত গোরাচাঁদ (রঃ) ও সায়্যিদ মুবারক গাজী (রঃ) উভয়েই সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, শাহ মুবারক গাজী (রঃ) ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের কন্যা চম্পাবতীকে বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে দুঃখী গাজী ও মেহের গাজী নামে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলো। আমাধোরণা, ঘুটিয়ারী শরীফের শাহ মোবারক গাজী ও বাঁশড়া শরীফের শাহ মোবারক গাজী একই ব্যক্তি ছিলেন। সময় বিবেচনা করে আমাদে আরোচ্য গাজীর সাথে মোবারক গাজীর কোন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না।
কিংবদন্তীর মহানায়ক হযরত বরখান গাজীর সাথে বেশ কয়েকজন গাজীর সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের আলোচ্য গাজীর সাথে অন্য কোন গাজীর সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। তাই তার জীবন, কর্ম ও সাধনা আমাদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্নই থেকে গেছে। আমাদের আলোচ্য গাজীকে দয়ার গাজী বলা হয়ে থাকে এবং তিনি আমাদের কাছে বরখান গাজী, বড় খাঁ গাজী সাহেব নামে পরিচিত। এই গাজীর সাথে কালুর নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। এখন আমরা রাজা মুকুট রায় ও তার প্রধান সেনাপতি সম্পর্কে আলোচনা করবো এবং যুদ্ধের বর্ণনা উপস্থাপন করবো।
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে বেশ কয়েকজন মুকুট রায় নামীয় রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা একে একে তাদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করবো। প্রথম জমিদার মুকুট রায়ের জমিদারী ছিল যশোর জেলার উত্তরে। নলডাঙ্গার রাজবংশের প্রবল প্রতাপে সেই বয়ংশের জমিদারী বিলুপ্ত হয়। এই মুকুট রায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম ছিল বিনোদ রায়। এই বংশ জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিল।
দ্বিতীয়তঃ ঝিনাইদহ অঞ্চলে রাজা মুকুট রায় নামে এক প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার ছিলেন। তিনিও জাতিতে ব্রাহ্মণ। তার ভ্রাতার নাম ছিল গন্ধর্ব রায় এবং তিনি গৌড়ের সুলতান কর্তৃক ‘খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। রাজা মুকুট রায়ের বহু সৈন্য সামন্ত, অশ্ব ও হস্তী ছিল। জন হিতার্থে তিনি অসংখ্য জলাশয় ও রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। জলাশয়ের মধ্যে ঢোল সমুদ্র সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। ঝিনাইদহের পূর্বে বিজয়পুরে তার রাজধানী ছিল। তার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘বড় বাথান’ নামক স্থানে তার প্রকান্ড গোশালা ছিল। জনশ্রুতি আছে যে, রাজা মুকুট রায়ের ১৬ হালকা হাতী, ২০ হালকা ঘোড়া এবং ২২০০ কোড়াদার ছিল। তিনি অধিক সংখ্যক গাভী পুষতেন বলে তাকে বৃন্দাবনের নন্দ মহারাজ বলতো। বেড়বাড়ী নামক স্থানে তার উদ্যানবাটী ছিল। রাজা মুকুট রায়ের রঘুপতি ঘোষ রায় ও গয়েসউদ্দিন নামীয় দুইজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন। গয়েশউদ্দিনের নামে গয়েশপুর গ্রাম আছে। চন্ডী সর্দার ও কেশব সর্দার নামে তার আরও প্রধান সৈন্য ছিল। যেখানে কোড়াদার সৈন্যরা বাস করতো তার নাম কোড়াদারপাড়া। কথিত আছে যে, গয়েশ কাজী নামক এক ব্যক্তি তার একটি গরু হত্যা করলে উক্ত কাজীকে তিনি নিহত করেন। সেই কথা গৌড়ের সুলতানের নিকটে পৌঁছিলে মুকুট রায়কে বেঁধে নেবার জন্য অসংখ্য সৈন্য প্রেরিত হয়। গৌড়েশ্বর সৈন্যের সাথে বাড়ীবাথানে মুতুট রায়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন।
কথিত আছে যে, কোন রাজা বন্দী হলে তার সাথে কপোত উড়ে যেতো। বন্দীকে হত্যা করা হলে কপোত দু’টি ফিরে আসতো। কপোত প্রত্যাগমন করার কথা জানতে পারলে সকলে মিলে মাত্র তার পরিবারবর্গ পরিখাতে নিমজ্জিত হয়ে প্রাণত্যাগ করলো। যেখানে তার কন্যারা মারা যান তার নাম কন্যাদহ এবং যেখানে তার দুই স্ত্রী নিমজ্জিত হন সেই জায়গা দুই সতীনে বলে খ্যাত। যেখানে রাজ দৈবজ্ঞ নিমজ্জিত হন সেই জায়গা ‘দৈবজ্ঞদহ’ নামে পরিচিত। এখনও ঐ সকল স্থান আছে কিন্তু পরিখা ও দুর্গের চিহ্ন বিলুপ্ত হয়েছে। এই মকিটি রায়ের সাথে গাজীর যুদ্ধের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
মুকুট রায়ের বাড়ী ব্রাহ্মণনগর। যশোর জেলার ঝিকরগাছার দুই মাইল পূর্বে অবস্থিত লাউজানি গ্রামের পূর্বের নাম ব্রহ্মণনগর। পূর্বে ব্রাহ্মণনগরের পশ্চিম ভাগে কপোতাক্ষ এবং দক্ষিণ সীমা দিয়ে কপোতাক্ষ নদ প্রবাহিত হতো এবং উত্তর-পূর্ব দিকে বিল ছিল। এর মধ্যে পরিখাবেষ্টিত দুর্গে রাজমুকুট রায় বাস করতেন। তিনি গুড়গাভূক্ত ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ ছিলেন।
পাঠান আক্রমণের পূর্ব হতেই তারা যশোরাঞ্চলে নানা স্থানে নদী তীরে বাস করতেন। তারাই এক সময়ে চেঙ্গুটিয়া পরগণার রাজা ছিলেন। স্বধর্মনিষ্ঠ মুকুট রায় প্রবল প্রতাপে শাসকার্য পরিচালনা করতেন। কেউ কেউ বলেন যে, মুকুট রায়ের জমিদারী পাবনা হতে সমুদ্র এবং ফরিদপুর হতে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুকুট রায়ের প্রধান সেনাপতির নাম দক্ষিণ রায়। তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি রাজার দক্ষিণহস্ত স্বরূপ এবং আত্মীয় ছিলেন। ব্রাহ্মণনগরের মুকুটেশ্বর শিবমন্দির থেকে শিবপূজা না করে তিনি জলগ্রহণ করতেন না। অধিবাসীদের অধিকাংশ ব্রাহ্মণ ছিল বলে নগরের নাম ব্রাহ্মণনগর হয়েছিল। মুকুট রায় মুসলমানদ্বেষী ছিলেন। তিনি কোন কারণে মুসলমানদের মুখ দর্শন করলে প্রায়শ্চিত্ত করতেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। তিনি নিজে উত্তরদিকের শাসনভার পরিচালনা করতেন। তার অধীনে বিপুল সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। তিনি দক্ষিণ দেশে বা ভাটি মুল্লুকের শাসনভার দক্ষিণ রায়ের হস্তে সমর্পণ করেছিন। এই জন্য রোকে তাকে ভাটিশ্বর এবং আঠার ভাটির রাজেশ্বর বলতো। তার শক্তিশালী নৌসেনা ও নৌবাহিনী ছিল। সুন্দরবন অঞ্চলে তার প্রতাপ ছিল অত্যধিক। তিনি বলকবান পুরুষ ছিলেন। তিনি তীর ধনুক ও অস্ত্রের সাহায্যে ব্যাঘ্র-কুমীর শিকার করতে পারতেন। তিনি মল্লযুদ্ধে ব্যাঘ্রের মুন্ডুপাত করতে পারতেন। এই জন্য তিনি ব্যাঘ্রভীতিনিবারক দেবতারূপে পূজিত হয়ে আসছেন। এই সব কারণে সুন্দরবন অঞ্চলে তার নাম সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। কৃষ্ণদাস প্রণীত ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, প্রভাকর নামক জনৈক রাজা চব্বিশ পরগণার দক্ষিণে জঙ্গল কেটে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। দক্ষিণ রায় তার পুত্র। সম্ভবতঃ মুকুট রায়ের কর্ণগোচর হলে তিনি তাকে সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনিও মুকুট রায়ের মত মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন। এই জাতি বিদ্বেষের কারণেই তাদের পতন হয়েছিল। এই স্থানে আমরা চারজর মুকুট রায়ের কথা উল্লেখ করেছি। অনেকে মনে করেন যে, ঝিনাইদহের মুকুট রায় ও ব্রাহ্মণনগরের একই ব্যক্তি। কিন্তু এই দুই জন ঐতিহাসিক ব্যক্তির ভিন্ন ব্যক্তি। ঝিনাইদহের মুকুট রায় পরিশোত্রীয় এবং ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় গুড় গোত্রীয়। ঝিনাইদহের মুকুট রায়ের চম্পাবতী নামে কোন কন্যার কথা পাওয়া যায় না। তার সাথে গাজীর কোন যুদ্ধ হয়নি এবং দক্ষিণ রায়ের সাথে তার কোন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। তিনি বন্দী হয়ে রাজধানীতে নীত হয়েছিলেন কিন্তু ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় বন্দী হবার পূর্বেই কূপে পড়ে আত্মহত্যা করেন। সুতরাং উপরোক্ত তথ্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উভয় মুকুট রায়ই পৃথক ব্যক্তি। সম্ভবতঃ ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় হোসেন শাহের মুকুট রায় মোঘল আমলের প্রথম দিকে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এইরূপ অনুমান করার পক্ষে যুক্ত আমরা অত্র অধ্যায়ের শেষের দিকে বর্ণনা করবো। উপরোক্ত আলোচ্য ৩ জন মুকুট রায়ের মধ্যে শেষোক্ত মুকুট রায়ই আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি। মুকুট রায়ের স্ত্রীর নাম লীলাবতী। তার সাত সন্তান। চম্পাবতী ও সুভদ্রা তার একমাত্র কন্যা। তার প্রধান সেনাপতির নাম দক্ষিণ রায় এবং গাজীর সাথে খনিয়াতে মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। চম্পাবতী সাত ভাইয়ের এক বোন হওয়ার জন্য সকলেরই বিশেষ আদরণীয় ছিলেন। কোন আদরের ভগ্নির প্রসঙ্গ উঠলে আমাদের দেশে ‘সাত ভাই চম্পা’র কথা বলে থাকে। ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’ এই সুর লহরী থেকে কেন্দ্র করে গাজীর সহধর্মিণী চম্পাবতী। কবি ও গায়কের নিকট তার গান অতি প্রিয়। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন রূপবতী রাজকন্যা এবং তাঁর অপরূপ খ্যাতির সৌন্দর্য ছিল। পুঁথিতে বর্ণিত আছে যে, গাজী চম্পাবতীকে পাবার জন্য পাগলপ্রায় হয়েছিলেন। তিনি কালুকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। রাজা মুকুট রায় তার দুঃসাহসিক প্রস্তাবে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন এবং তাকে কারারুদ্ধ করলেন। প্রবাদ আছে যে, গৌড়ের সুলতার হোসেন শাহ মুসলমান বিদ্বেষী রাজার বিরুদ্ধে গাজীকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। অবশ্য এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতেন। সম্ভবতঃ তিনি কালুকে মুকুট রায়ের দরবারে ইসলামের দাওয়াত কবুল করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। ইসলাম ধর্মের প্রতি অবমাননা ও কামুক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাকে ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও কামুক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সতীশ বাবু বলেছেন, “এ বিষয় মুসলমান পুঁথিতে গাজী সাহেবের কামুকতার যে বিকৃত কাহিনী আছে তাহা সম্পূর্ণ অলীক বলিয়া বোধ হয়”। যে গাজী সংসারের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে ফকির বেশ ধারণ করে বলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন তার পক্ষে চম্পাবতীর রূপের কথা শ্রবণ করে তাকে একান্ত কাছে পাবার জন্য উতলা হওয়া অলীক ও কল্পিত কাহিনী ছাড়া আমাদের কাছে আর কিছুই মনে হয় না। আমাদের আলোচ্য গাজী এই রকম মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধ করলে বীর গাজী আখ্যা পাওয়ার সৌভাগ্য তার কপালে কখনোই জুটতো না। তাই একজন ধর্মযোদ্ধা সেনানায়কের এইরূপ কুৎসিত চরিত্র কল্পনাপ্রসূত ছাড়া অন্য কিছুই নয়। গাজী কালুর পুঁথিতে আছে, গাজী কিছু ব্যাঘ্রকে মেষ করে গুপ্তভাবে নগরে প্রবেশ করেন। ব্রাহ্মণনগর সংলগ্ন খনিয়ার রণক্ষেত্রে গাজীর সাথে মুকুট রায়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। দক্ষিণ রায় মুকট রায়ের সেনাপতিরূপে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। পুঁথিতে গাজীর ব্যাঘ্র সৈন্য ও দক্ষিণ রায়ের কুমীর সৈন্যের কথা উল্লেখিত আছে। এই কথার কোন তাৎপর্য নেই। গাজী সম্ভবঃ পাঠন সৈন্য ২৪ পরগণার জেলার হিজলী, হাতিয়ার, সেনারপুর, বর্ধমান ও হুগলী অঞ্চল থেকে সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন। এই জন্য পুঁথিতে ব্যাঘ্র সৈন্যের কথা বলা হয়েছে। তবে আমাদের কাছে সর্বাপেক্ষা সত্য বলে মনে হয় যে, গাজীর শক্তিশালী পদাতিক সৈন্যের সাথে দক্ষিণ রায়ের নৌবাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। খনিয়ার ময়দানে গাজীর সৈন্যের সাথে দক্ষিণ রায়ের সৈন্যদের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ গাজীকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এমন কোন সত্য আমাদের হাতে নেই। যাই হোক, কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলেছিল। দক্ষিণ রায়ের সৈন্যগণ বীরবিক্রম যুদ্ধ করেও মুসলমানদের নিকট পরাজিত হলেন। গাজীর সৈন্যগণ সদলবলে যুদ্ধে জয়লাভ করে রাজপুরীর মধ্যে প্রবেশ করলে মুকুট রায় আত্মসমর্পণ করেন। পরাজয়ের গ্লানি হতে নিষ্কৃতি পাবার জন্য মুকুট রায়ের পরিবারবর্গের অনেকে কূপে পড়ে আত্মহত্যা করেন। মুকট রায়ের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র কামদেব পরে ইসলাম গ্রহণ করে ‘পীর ঠাকুরবর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য দেশব্যাপী বেড়াতেন। তার সম্পর্কেও অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। জানা যায় যে, তিনি ইসলাম প্রচার করে নানা দেশে ঘুরে অবশেষে গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে চারঘাটে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি চারঘাটে মুসলমান ফকিরের মত বসবাস করতেন। জানা যায় যে, মুসলমান হওয়ার পর তার ক্রমে ধর্মের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায় এবং হিন্দুদিগকে মুসলমান করতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রায় ১০০ বছরকাল জীবিত ছিলেন। সুন্দরবনের বাঘ নামে পরিচিত প্রতাপাদিত্যের উত্থান পতন এবং তার মৃত্যুর পর পীর ঠাকুরবর দেহ ত্যাগ করেন। সে সময় হবে শুঁড়ি নামক একজন প্রসিদ্ধ সমৃদ্ধিসম্পন্ন বণিক চারঘাটে বাস করতেন। তিনি তাকে মুসলমান দর্শে দীক্ষা দিবার জন্য বহু চেষ্টাকরেছিলেন। হবেশুঁড়ি ধর্মান্তর অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয় মনে করতেন। সেই জন্য এই অঞ্চলে একটা কথা শোনা যায়, ‘মরলো তবুও হবেশুঁড়ি ঠাকুরবর বলল না’। অর্থাৎ ঠাকুরবরের বশ্যতা স্বীকার করলো না। যাই হোক, এ সম্পর্কে আমরা আলোচনার শেষ পর্যায়ে আরো আলোচনা করবো।
যুদ্ধে সেনাপতি পরাজিত হবার পর গাজীর সাথে সখা সূত্রে আবদ্ধ হন। মুকুট রায় এরপর দেশত্যাগ করেন। কেউ কেউ বলেন যে, তিনি কূপে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই যুদ্ধের পর কিংবদন্তীর মহাবীর সেনানায়ক ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হন। এটাই যুদ্ধের মূলকথা।
এখন আমরা ঐতিহাসিক ব্রাহ্মণনগর সম্পর্কে আলোচনা করবো। বিখ্যাত ‘কালীবাবুর রাস্তা’ ঐতিহাসিক ব্রহ্মণনগর তথা লাউজানির মধ্য দিয়ে কলিকাতায় গিয়েছে। রেল লাইনের উত্তরদিকে লাউজানি গেটের পূর্বে বিখ্যাত ‘গাজীর দরগাহ’ অবস্থিত। বহু পুর্বে এখানে প্রতিবছর মেলা বসতো। দরগার পূর্বদিকে ‘চম্পাবতী’ নামীয় পুকুর আছে। এর একটু পূর্বে ‘বাঘামরীর পুকুর অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে যে, গাজী এখানে ব্যাঘ্র বেঁধে রাখতেন। দরগা সংলগ্ন ‘মৃত্যুঞ্জীব কূপ’ এখনও লোকে দেখিয়ে থাকে। পরবর্তীকালে এই কূপের সন্ধান করা হয়েছে কিন্তু পাওয়া যায়নি। কথিত আছে যে, কূপের জল ছিটিয়ে দিলে মৃত ব্যক্তি বেঁচে উঠতো। দরগার দক্ষিণ দিকে খনিয়ার/কুনিয়ার রণক্ষেত্র এই ময়দানেই দক্ষিণ রায়ের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তিন-চার বর্গমাইল ব্যাপী মুকুট রায়ের রাজধানী ও শহর বিস্তৃত ছিল। লাউজানী গ্রামের লোক তথা স্থানীয় লোক গ্রামকে ব্রাহ্মণনগর বলেই জানে। বর্তমানে আমরা ব্রাহ্মণনগরের রাজধানীর কোন চিহ্ন দেখতে পাই না। কেউ কেউ বলেন যে, বর্তমান মাদ্রাসার স্থানেই ছিল রাজধানী। এর অদূরে গড় ও টিলা পরিলক্ষিত হয়। দরগার পশ্চিমে লাউজানীর ক্ষুদ্র বাজারের পাশে অবস্থিত রাজবাড়ীর সীমানার মধ্য দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। এর দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে মুকুট খনিত দীর্ঘ দিঘী আছে। দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে মুকুট রায়ের রাজবাড়ীর ধ্বংবাশেষ আজও দেখা যায়। দিঘীর দক্ষিণ পাশে পাকা ঘাট ছিল। সে চিহ্ন এখন আর দেখা যায় না। রাজবাড়ীর দক্ষিণ দিকে অন্দর মহলে একটি পুকুর ছিল।
রাজা মুকুট রায়ের পতনের পর তার জমিদারি চাঁচড়া ও নলডাঙ্গা রাজাদের মধ্যে বন্টন হয়ে যায়। নলডাঙ্গার অংশ ছিল চারি আনা এবং চাঁচড়ার ছিল বার আনা। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার বহু দরিদ্র কৃষক পরিবার রাজবাড়ীর আশেপাশে পরিত্যক্ত ভিটায় বসবাস করছে। এই হচ্ছে ব্রাহ্মণনগরের কথা। গাজীর সাথে মুকুট রায়ের যুদ্ধ শেষে চম্পাবতী মুসলমান শিবিরে নীত হলে গাজীর সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। শেষ পর্যন্ত গাজী ভক্তগণের অনুরোধে চম্পাবতীকে বিবাহ করেছিলেন। এই দাম্পত্য জীবনের ইতিহাস অজ্ঞাত। মুসলমানী পুঁথিতে আছে যে, গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করার কিছুদিন পর তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, গাজীর সাথে চম্পাবতীর বিবাহ হয়নি। ইসলামদ্বেষী রাজা মুকুট রায়কে শাসন করার জন্যই এ ব্যবস্থা করেছিলেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলাম প্রচার। তাই গাজী কামুক পুরুষ ছিলেন এ কথা আমাদের অবিশ্বাস্য। অন্যান্য গাজী গানের চরিত্র আলোচনা করলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, গাজী সাহেব নরপিশাচদের মত ইন্দ্রিয়সেবী ছিলেন না। যাই হোক, আমরা মোদ্দা কথায় এসে বলতে চাই যে, ফকির গাজীর সংসার বিরাগী হওয়ার জন্য চম্পাবতীর সাথে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এই মহান গাজীর কবর সিলেট জেলায় এবং চম্পাবতীর কবর খুলনা জেলার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। উভয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করলে সমাধি একই জায়গায় থাকতো। শেষ জীবনে রাজনন্দিনী চম্পাবতী ধর্ম সাধনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তার সঞ্চিত সব সম্পত্তি পরসেবায় দান করে দিয়েছিলেন। এই জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে তাকে মা বলে ডাকতো, মায়ের মত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতো। এই মহিলার নাম হওেয়ছিল ‘মা চম্পা বিবি’। তার মৃত্যুর পর ভক্তগণ স্মৃতি রক্ষার জন্য তার সমাধির উপর একটি সুন্দর ও বৃহৎ এক গম্বুজ বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেন। তিনি মুসলমানের পত্নী ছিলেন বলে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। ‘মা চম্পা’র দরগা আজও স্মৃতি রক্ষা করে চলছে। খুলনা জেলার পশ্চিম সীমান্তে এবং সাতক্ষীরা শহরের তিন মাইল উত্তরে লাবসা গ্রামে তার দরগা অবস্থিত। বারাসতের নিকট ঘোলা গ্রামে ‘মা চম্পা’র একটি প্রসিদ্ধ আস্তানা আছে। কালের করাল গ্রাসে তার সমাধি সৌধ মৃত্তিকা খনন করে তা বের করা হয়। দরগার উপরে একটি চম্পক ফুলের গাছ। দুইটি বটগাছ, একটি নিম গাছ ও অন্যান্য বৃক্ষলতা স্থানটিতে জঙ্গলের ন্যায় করে রেখেছে। এই দরগা সংস্কার করা প্রয়োজন। পূর্বে এখানে মেলা বসতো। লোকে মেলায় মুরগী ও ছাগল মানত করতো। দরগায় হিন্দুগণ শনি ও মঙ্গলবার পূজা করতো। বর্তমানে আলেমগণের ফতোয়ার কারণে এই আচার বন্ধ রয়েছে। গাজী কালুর ন্যায় চম্পাবতীর জীবন কাহিনী সম্পর্কে ইতিহাস একেবারে অজ্ঞ। খুলনা গেজেটিয়ার প্রণেতা মিঃ ওমালী সাহেব প্রবাদের উপর ভিত্তি করে বলেছেন, চম্পা বাগদাদ নগরীর খলিফা বংশের অবিবাহিত কন্যা। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি মহানগরী বাগদাদ হতে সুদূর বঙ্গদেশে আগমন করেছিলেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে চম্পা একদিন নৌখালী নদীর মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে যাবার সময় লাবসা গ্রামে তার নৌকাডুবি হয়। তিনি ও তার সঙ্গীরা এই দুর্ঘটনা হতে রক্ষা পান এবং তখন হতে নদীতীরে লাবসা গ্রামে আস্তানা স্থাপন করেন। সেখানে তার শিষ্যগণতদীয় সমাধির উপর এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। স্বয়ং ওমালী সাহেব এই গল্পকে অবিশ্বাস করেন তিনি উল্লেখ করেন যে, চম্পাবতী হিন্দু রাজকন্যা ছিলেন। তবে তিনি ঐতিহাসিক সূত্র পরিবেশন করতে পারেননি। এখন আমরা গাজীর ইতিহাসের উপর যবনিকা পতন ত্বরান্বিত করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হবো। জানা যায় যে, গাজী ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য যশোরাঞ্চ হতে আসামের দিকে অগ্রসর হন। কথিত আছে যে, সিলেট জেলার গাজীপুরে তার শেষ জীবন অতিবাহিত হয়। এবং রেসখানে তার নামে দরগা দেখতে পাওয়া যায়। এখানে বিশেগাঁও তথা গাজীপুর গ্রামে তার সমাধি ও আস্তানা অক্ষতরূপে বিদ্যমান থেকে গাজীর শৌর্যবীর্য ও ইসলাম প্রচারের কাহিনী সগৌরবে মাথা উঁচু করে ঘোষণা করছে। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত সৈয়দ আব্দুল আফগর কর্তৃক লিখিত তরপের ইতিহাসে আছে, “মা গাজী বিলগ্রামের অন্তবর্তী গাজীপুরে তার দরগা আছে। সৈয়দ নাসিরউদ্দিন মা গাজীর সহায়তায় ত্রিপুরার রাজাকে পরাজিত করে তরফ দখল করেন।” স্টেপেলটন সাহেব বৈশগাঁও গ্রামের গাজীর সমাধির কথা উল্লেখ করেছেন।
এখন আমরা দক্ষিণ রায় ও গাজীর কথায় শেষ পরিচয় লিপিবদ্ধ করবো। দক্ষিণ রায় ও বনবিবির আধিপত্য সর্বত্র বিরাজমান। নৌকার মাঝিরা বনের মধ্যে প্রবশ করে তাদের নাম স্মরণ করে। কিন্তু এই বনদেবতা বনবিবি কে ? ইতিহাস শত চেষ্টা করেও তা নির্ণয় করতে পারেনি। সুন্দরবনাঞ্চলে সর্বত্র বনবিবির আজগুবি গল্পের কথা শোনা যায়। প্রবাদ আছে যে, বনবিবিকে গহীণ অরন্যে এক বৃক্ষ হতে অপর বৃক্ষে যাতায়াত করতে দেখা যায়। বনের সব হিংস্র জীবজন্তু তার অনুগত। সাধারণ লোকে এই কাহিনী বিশ্বাস করে।
‘বনবিবির জহুরনামা’ নাম মুসলমানী কেতাবে ‘বনবিবি’র কাহিনী বর্ণিত আছে। পুঁথিতে আছে যে, মক্কাবাসী নির্বাসিত হন। সেই সময় তিনি সন্তান সম্ভবা ছিলেন। বনের মধ্যে শাহ জঙ্গুলী ও বনবিবি নামে দুই জমজ পুত্র-কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায় যে, বনবিবি’র বাল্যকাল রোমাঞ্চকর কাহিনীর সাথে জড়িত ছিল। পুঁথিতে আছেঃ
বনের হরিণ সব খোদার মেহের ॥
হামেশা পালন করে বনবিবি তরে ॥
বেহেশতের হুর এসে কোলে কাখে নিয়া
তুষিয়া মায়ের মত ফেরে বেড়াইয়া ॥
ভাটিশ্বর দক্ষিণ রায়ের কবল হতে দুঃখী ও দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্য আলাহর আদেশে বনবিবি ও তার ভ্রাতা সুন্দরবনে থেকে যায়। দক্ষিণ রায় সম্পর্কে বনবিবির পুঁথিতে আছেঃ
“এখানে দক্ষিণ রায় ভাটির ঈশ্বর
নানা শিষ্য কৈল সেই বনের ভিতর।”
অল্পদিনের মধ্যে শিবদাহ, চাঁদখালি, রায়মঙ্গল ও আন্ধারমানিক প্রভৃতি স্থান তাদের অধীনতা স্বীকার করে। দক্ষিণ রায় এই অধীনতা সহ্য করতে পারলেন না। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি বনবিবির বিরুদ্ধে সমরায়োজন করলেন। পুরুষ হয়ে তিনি নারীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি মাতা নারায়ণীকে বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রেরণ করলেন। যুদ্ধে নারয়ণী পরাজিত হয়ে বনবিবির সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হলেন। এই সন্ধি অনেকদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। পুঁথিতে আছে যে, বরিজহাটিতে ধোনাই মোনাই নামে দুই ভাই বাস করতো। একদিন তারা সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গেল। তাদের সাথে এক দুখিনী মায়ের এক পুত্র দুঃখেও গিয়েছিল। তারা গড়খালি নদীতে পৌঁছালে দক্ষিণ রায় নরবলি দাবী করলেন এবং দুঃখকে বেছে নিলেন। ধোনাই ও মোনাই অসহায় অবস্থায় দুঃখকে রেখে গেল। দুঃখের মা বনবিবির সাহায্য প্রার্থনা করলেন।
কহে মা বনবিবি কোথা রইলে এই সময়,
জলদি করে এসে দেখ তোমার দুঃখে মারা যায়।
কড়াল দিয়াছো মগো যদি না পালিবে,
ভাটি মধ্যে তোমার কলঙ্ক রয়ে যাবে।
দুখী মায়ের করুণ ক্রন্দনে তিনি সাড়া দিলেন। তিনি দুর্বল দুঃখের পক্ষ নিলেন এবং দক্ষিণ রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করলেন। এইভাবে বনবিবির কৃপায় দুঃখ রক্ষা পায়। বনবিবি এইভাবে অনাথিনী মায়ের অন্ধত্ব এবং বধিরত্ব ঘুচালেন। দুঃখে বহু ধন-সম্পত্তির মালিক হলো এবং ধোনাইয়ের কন্যা চম্পার সাথে বিবাহ হয়েছিল। সেই থেকে বনবিবি, বনদেবতা বা মানস সুন্দরী দেবী। পুঁথিতে আছে, আমাদের আলোচ্য বরখান গাজী (রঃ) বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। এই কথাইা পুঁথির মূলকথা। গাজীর সাথে সম্পর্কিত কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত সত্য স্বীকার করা হয়েছে কিন্তু বনবিরি কাহিনী নিছক কল্পিত। এই কল্পিত কাহিনী মক্কাবাসীর জীবনের কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে। এতে ইতিহাস নেই। আছে শুধু রোমাঞ্চকর কল্পিত কাহিনী। বনবিবির নাম সুন্দর বনাঞ্চলে খুবই পরিচিত। উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতো পারি যে, সেকেন্দার শাহের সাথে বরখান গাজীর পিতা-পুত্র সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। আবার সেকেন্দোর শাহের রাজত্বকালে তার আবির্ভাব হলেও তাকুরবরে ইতহাসের সাথে মেলে না। পূর্বে বলা হয়েছে যে, ঠাকুরবর প্রায় ১০০ বছর জীবিত ছিলেন। জানা যায় যে, সুন্দরবনের বাঘ মহারাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে রাজধানীতে কাভালোর হত্যাকালে অর্থাৎ ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে বৃক্ষ ফকির জীবিত ছিলেন। রাজা মুকুট রায়ের মৃত্যুর তারিখ আনুমানিক ১৫১৫ খৃষ্টাব্দের দিকে হবে। তাহলে আনুমানিক ১৫/২০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৫০০ খৃষ্টাব্দে বরখান গাজীর সুন্দবন অঞ্চলে আবির্ভাব ঘটছিল। তাই গাজীর আবির্ভাব সেকেন্দার শাহের সময় হয়নি। কেননা সেকেন্দার শাহের রাজত্বকালে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশে একদল গাজীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের মধ্যে বরখান গাজী অন্যতম ছিলেন।
তথ্য সূত্র:
অজ্ঞাত
সর্বশেষ আপডেট :
২০.০৮.১১
ইতিহাসবেত্তা হোসেন উদ্দিন হোসেন লিখেছেন- “গাজী কালু একসময় ছাপাই নগরে আসেন। ছাপাই নগর নিয়ে অনেক কথা আমরা শুনতে পাই। অন্য ছাপাই নগর থাকলেও, বারোবাজার এলাকাতে ছাপাইনগর এককালে ছিল। বাকলা বা চন্দ্রদ্বীপের রাজা কন্দর্পনারায়ণের পুত্র রামচন্দ্র রায় ছাপাইনগরের রাজা ছিলেন। তিনি পরবর্তীতে রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের জামাতা হন (সতীশ চন্দ্র মিত্র- যশোর-খুলনার ইতিহাস, পৃঃ- ৪৪)।
কিংবদন্তী আছে গাজী-কালু রাজার দান দক্ষিণার কথা শুনে গাজী ছাপাইনগরের মধ্যে প্রবেশ করেন। এক সময় ইসলামের জয়গান করতে করতে দরবারে উপস্থিত হন। মৌলবাদী মানসিকতায় তাড়িত হয়ে রাজা রামচন্দ্র রায় গাজী-কালুকে নগরের বাইরে বের করে দেন। দাম্ভিক রাজার দর্প চূর্ণ করতে গাজী সৃষ্টিকর্তার কাছে রাজার বিরুদ্ধে ফরিয়াদ জানালেন। শোনা যায় দেখতে দেখতে রাজ পূরীতে আগুন লেগে যায়। অবশেষে নগরের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি রাজপ্রাসাদ থেকে রাণী অপহৃতা হন। জ্যোতিষী জানালেন সবই গাজীর কাজ। রাজা অবশেষে গাজী কালুর আস্তানার সন্ধান পেলেন। সেখানে উপস্থিত হয়ে রাজা তাদের কাছে ক্ষমা চাইলেন। পুঁথির ভাষায় আছে-
“কহেন শ্রীরাম রাজা জোড় করি কর
আগুন জ্বলিয়া পুরি হৈলা গেল ছাঁই,
কোথায় গেলেন রাণী খুঁজিয়া না পাই।”
গাজী তাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের প্রস্তাব দেন। রাজার সম্মতিতে, গাজী তাঁকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। রাজা রামচন্দ্র রায় গাজী-কালুকে রাজধানীতে নিয়ে আসেন এবং আপ্যায়নে তুষ্ট করেন। রাজার রাজ প্রাসাদ মাটির গর্ভে চলে গেছে। প্রাসাদের চারদিকের গড় আজও দেখা যায়। গড়ে জল থাকে বারোমাস। গাজীর স্মৃতিচিহ্ন গাজীর দরগাহ্ হাসিলবাগ গ্রামের দক্ষিণে ভৈরব কুলে বিদ্যমান।
বিস্তারিত বিশ্লেষণ
গাজী কালু চম্পাবতীর কথা এদেশে কিংবদন্তীর আকারে বিরাজমান। দক্ষিণ বঙ্গে গাজীর কথা শোনেনি এমন কোন লোক দেখা যায় না। রামায়নের রামনফনের মত গাজী কালু চম্পাবতীর কথা একত্রে গ্রথিত। এককালে পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গের প্রায় সর্বত্র গাজীর প্রভাব বিরাজমান ছিল। পূর্বে পল্লীতে গাজীর গীতের আসর বসতো। গ্রামাঞ্চলের লোকজন গাজীর গান শুনে চিত্তবিনোদন করতো। বর্তমানে গাজীর গান তেমন শোনা যায় না। এককালে গাজীর গান মুসলমানদের নিকট খ্যাতি লাভ করেছিলো। পূর্বে গাজীর গীত শুনতে শুনতে দেশের লোক এমনভাবে বিরক্ত হয়ে উঠেছিল যে, লোকে একই কথা বার বার ব্যক্ত করলে ‘গাজীর আলাপ’ বলে উপহাস করতো এবং কোন বিষয় সম্পর্কে অতিরিক্ত লেখা দেখলে ‘গাজীর পট’ বলে উপহাস করতো। গাজীর জনপ্রিয়তা ও প্রভাবের ফলে এদেশের জনগণ তাকে আজও স্মরণ করে। এদেশের বহুস্থানে গাজীর নামে গাজীপুর, গাজীহাট, গাজীর ডাঙ্গাল, গাজীডাঙ্গা, গাজীর দেউল, গাজীরঘাট, গাজীর খাল, গাজীর খুটো ইত্যাদি গাজীর নাম স্মরণ করে চলেছে। কলিকাতার পরপারে শিবপুরে এবং পশ্চিমবঙ্গের শেরপুরে গাজী কালু নামে মেলা বসে। সুন্দরবনের মৎস্যজীবী হিন্দুরা গাজীর নামে মেলা পাঠা বলি দেয়। দুর্গম নদী পথে ঝড়-তুফানের মধ্যেও দাঁড়ি-মাঝিরা নৌকা চালিয়ে আপন মনে পাল তুলে চলতে থাকে এবং শক্তিধর গাজী শাহের গুণ কীর্তন করে।
আমরা আজি পোলাপান
গাজী আছে লিখাবান
শিবে গঙ্ গা দরিয়া
পাঁচ পীর বদরবদর।
এই পাঁচ পীরের মধ্যে সিকান্দার শাহ, গাজী ও কালুর নাম সুপরিচিত। আর দু’জনের সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না। তবে পাঁচ পীরের মধ্যে গিয়াসউদ্দীন ও শামসুদ্দিনের নামও শ্রুত হয়। গাজীর গীতের মধ্যেও পাঁচ পীরের নাম পাওয়া যায়। কিন্তু গাজীর গীতের প্রচলিত মতের সাথে এই পাঁচ পীরের সম্পর্ক ইতিহাসে মেলে না। কথিত আছে যে, এই পাঁচ পীরের নাম গিয়াসউদ্দীন, তৎপুত্র শামসুদ্দিন, তৎপুত্র সেকেন্দার এবং সেকেন্দারের পুত্র বরখান গাজী ও কালু। প্রচলিত গাজীর গীতে পাঁচ পীরের কথা পাওয়া যায়ঃ
পোড়া রাজা গয়েসদি, তার পুত্র সেকেন্দার,
তার বেটা বরকান গাজীঃ
খোদাবন্দ মুলুকের কাজী।
কলিযুগে যার অবসর,
বাদশাই হিড়িন বঙ্গে
কেবল ভাই কালু সঙ্গে
নিজ নামে হইল ফকির।
সুবর্ণগ্রামে এই পাঁচ পীরের নামে পাঁচটি দরগা আছে। সিলেট জেলার জিন্দা বাজার মহল্লার এক গোরস্থান “পাঁচ পীরের মোকান” বলে পরিচিত। শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারবর্ষের অনেক জায়গায় পাঁচ পীরের নাম শোনা যায়। এই পাঁচ পীর কথাটি বার ভূঁইয়া ও বারো আউলিয়ার মত। তবে জানা যায় যে, তুর্কি আফগান আমলে এই দেশে ইসলাম প্রচারের জন্য অসংখ্য পীর আউলিয়ার আগমন ঘটেছিল। তাদের মধ্যে বইতে পাঁচ পীরের নামকরণ করা হয়েছে। “পাঁচ পীর” প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন পৃথক সত্তা ছিল কিনা সে সম্পকেং ডক্টর আনিসুজ্জামান বলেছেন, “হিন্দু দেবদেবী ও তাদের গুণাবলীর পরিচয় মুসলিম মানসে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে তারই ফলে এসব দেবদেবীর মুসলমান প্রতিরূপও গড়ে ওঠে। হিন্দু বনদূর্গার স্থলে বনবিবি, দক্ষিণ রায়ের রূপান্তর গাজী পীর ও কালু, মৎসেন্দ্র নাথের পরিবর্তে মসন্দলি এবং সত্যনারায়ণের প্রতিরূপ সত্যপীর। মুসলমান সমাজের খোয়াজ খিজির, পীর বদর, মানিক পীর ও পাঁচ পীরের উপাসনা দেখা যায়।” এগুলোর মধ্যে বনবিবি, সত্যপীর ও মানিক পীরের অস্তিত্বের ঐতিহাসিক ভিত্তি আমাদের জানা নেই। তবে গাজী কালু, পীর বদর ও দক্ষিণ রায় প্রত্যেকেই ঐতিহাসিক চরিত্র বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
বিলুপ্ত নগরী বারবাজারে পাঁচ পীরের প্রভাব দেখা যায়। খুলনা বিভাগের সাতক্ষীরা জেলার লাবসা গ্রামে পাঁচ পীরের মোকাম বা দরগা আছে। বারবাজার হাইস্কুলের উত্তরে এবং রেল লাইনের পূর্বদিকে পাঁচ পীরের নামে জলাশয় আছে যা তাদের স্মৃতি স্মরণ করে চলেছে। পীর বদরের নামও বাংলাদেশে পরিচিত। বারবাজারের হাসিলবাগ গ্রামে বদরের নামে হাট আছে। চট্টগ্রাম শহরের বকশী বাজার মার্কেটের দক্ষিণে পীর বদরের মাজার আছে। তিনি বদর শাহ ও শাহ বদর নামে পরিচিত ছিলেন। শোনা যে, পীর বদর প্রায় ছয় শত বছর পূর্বে একটি প্রস্তরের উপর বসে চট্টগ্রামে আগমন করেছিলেন। তিনি একটি মাটির আশ্চর্য প্রদীপ জ্বালাতেন যাকে চাটি বলা হতো এবং যে স্থানে ঐ প্রদীপ জ্বলতো সেই স্থান বর্তমানে ‘বদর চাট’ নামে পরিচিত। এই ‘চাটি’ শব্দ হতে চাটিগ্রাম বা চাটগাঁও নামের উৎপত্তি হয়েছে বলে কথিত আছে। গাজী পীর ও পীর বদর উভয়ই ঐতিহাসিক ব্যক্তি। পীর বদর সম্পর্কে গাজীর ন্যায় বহু অলৌকিক ও অতিরঞ্জিত কথা শোনা যায়। সারা দেশে তার সম্পর্কে নানা কিংবদন্তী প্রচলিত থাকলেও এ কথা সত্য যে, তিনি সর্বপ্রথমে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার করেছিলেন। ভক্তের কণ্ঠে পীর বদরের কথা শোনা যায়ঃ
আমরা আছি পোলাপান
গাজী আছে নিঘাবান
আলী নবী পাঁচ পীর
বদর বদর।
চট্টগ্রামের একটি মাজারের ফলক থেকে জানা যায় যে, পীর বদর ১৩৪০ খৃষ্টাব্দে জীবিত ছিলেন। সিলেট জেলার বদরপুর রেলস্টেশনের পাশের এক পীর বদরের সমাধি আছে। পীর বদরের মাজারের উৎকীর্ণ ফলক থেকে জানা যায় যে, গাজী পীরের বহু পূর্বে পীর বদর এদেশে আগমন করেছিলেন।
ঐতিহাসিক বারবাজার অঞ্চলে গাজীর নামে গাজীল জাঙ্গল আছে। বারবাজার রেলস্টেশন থেকে এক মাইল উত্তর-পূর্বে বাদুরগাছার মৌজার মধ্যে গাজী কালুর স্মৃতি বিজড়িত ছাপাইনগর গ্রাম অবস্থিত। এই ছাপাইনগরে শ্রী রামরাজার গড়বেষ্টিত বাড়ী ছিল। যার ধ্বংসের নিদর্শন আজও দৃষ্টিগোচর হয়। গড়ের মধ্যে বর্তমানেও বার মাস জল ভর্তি থাকে। গড়ের দক্ষিণে জঙ্গল অপসারিত হয়ে একটি পাকাঘর আবিস্কৃত হয়েছে। এখানে গাজীর নামে একটি দর্গা আছে। স্থানীয় লোকশ্রুতির মাধ্যমে জানা যায় যে, গাজী তার প্রিয়তমা পত্নীকে নিয়ে মুড়লী ও বারবাজার অঞ্চলে কিছুকাল বসবাস করেছিলেন। বারবাজারের নিকটবর্তী হালিসবাগ গ্রামের দক্ষিণে এবং ভৈরব নদীর তীরবর্তী স্থানে একটি অশ্বত্থ বৃক্ষের নীচে গাজীর দরগা আছে। এসব জায়গর লোকেরা নানারকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গাজীর নাম স্মরণ করে।
ঝিকরগাছার দুই মাইল পুর্বে এবং রেলস্টেশন হতে সামান্য পূর্বে যশোর রাস্তার পার্শ্বে লাউজানী গ্রামে (ব্রাহ্মণনগর) গাজী পীরের বিখ্যাত দরগা অবস্থিত। দরগার পাশে চম্পাবতীর পুকুর এবং দক্ষিণে খনিয়ার মাঠ (রণক্ষেত্র) অবস্থিত। বেনাপোল কাস্টমস কলোনীর মধ্যে গাজীর দরগা দেখা যায়। বাগেরহাটের নিকটবর্তী রণবিজয়পুরে গাজীর দরগা আছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় গাজীর বটগাছ আছে। মুজগুন্নির পাশে এক স্থানের নাম গাজীর ঘুটো। ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ গ্রন্থের লেখক এ এফএম আব্দুল জলিল সাহেব উল্লেখ করেছেন যে, মোরেলগঞ্জ থানার সুরাতলী গ্রামে কাষ্ট নির্মিত বিরাটাকার ব্রাহ্ম ও অশ্বমূর্তির পৃষ্ঠে গাজী ও কালুর মূর্তিদ্বয় সোয়ার অবস্থায় দেখা যেতো। এই সমস্ত দর্শনে শক্তিশালী গাজীর প্রতাপ এতদঞ্চলে বিশেষভাবে অনুভূত হয়।
কিন্তু এই ঐতিহাসিক ব্যক্তি সম্পর্কে এত প্রকার কিংবদন্তী প্রচলিত যে, তার সম্পর্কে সঠিক বিশেষ কিছু জানা যায় না। বিভিন্ন রকম পুঁথি যেমনঃ “গাজী কালু ও চম্পাবতীর পুঁথি” “দরাফ খানের গঙ্গাক্ষেত্র” “দরাফ খা গাজী” “বরখা গাজীর কেরামতি” ও “গাজী মঙ্গল” প্রভৃতি পুঁথিতে গাজী সম্পর্কে অতিরঞ্জিত, অযৌক্তিক ও অলীক গল্পে পরিপূর্ণ। এসব পুঁথি থেকে গাজী সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া সত্যিই দুষ্কর। এসব পুঁথি লেখকরা ঐতিহাসিক সত্যকে এমনভাবে বিকৃত করেছে যে, আসল সত্য ধামাচাপা পড়েছে। নিন্মে আমরা প্রতাপশালী পীর ও ঐতিহাসিক ব্যক্তি গাজী সম্পর্কে সঠিক তথ্য উপস্থাপন করবার চেষ্টা করবো। নানা যুক্তি তর্কের মাধ্যমে যা বাস্তব সত্য তাই উদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে এবং অযোগ্য, অবাস্তব ও অসত্য তথ্যকে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এখন আমাদের বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে এই ভাগ্যবান মহাপুরুষ সিংহ কে ? কি তার পরিচয় ? কি ছিল তার জীবন দর্শন ও প্রত্যাশা ? নিন্মে আমরা পুঁথিনির্ভর তথ্য উপস্থাপন করলাম। পরবর্তীকালে আমরা কিংবদন্তীর পুঁথির আলোকে ঐতিহাসিক সত্য উদঘাটন করার চেষ্টা করবো।
‘গাজী’ নামক পুঁথির মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, বৈরাটনগরের রাজা সেকেন্দার শাহের প্রথমা রাণী অজুপা সন্দিরীর গর্ভে গিয়াসউদ্দিন (জুলহাস) ও বরখান গাজী জন্মগ্রহণ করেছিল। রাণীর পালিত পুত্রের নাম ছিল কালু। রাজা ও রাণীর প্রথম পুত্র জুলহাস শিকারে যেয়ে নিরুদ্দেশ হলে প্রাপ্তবয়স্ক গাজীকে রাজ্য গ্রহণ করতে বললেন। গাজী উত্তরে বললেন “আমি বাদশাহী চাহি না, পক্ষান্তরে ফকির হতে ইচ্ছা করি।” পিতা পুনঃ পুনঃ তাকে রাজ্য গ্রহণ করার জন্য বললেন। কিন্তু তিনি রাজি হলেন না। অবশেষে রাজার আদেশ অমান্য করার জন্য রাজরোষে পতিত হন। রাজা হিরণ্যকশিপুর মত তার উপর নানা রকম অত্যাচার করা হলো। কিন্তু কিছুতেই কিছু ফল হলো না। রাজার আদেশে জল্লাদ তাকে হত্যাকরার জন্য নিয়ে গেল। কিন্তু গাজীর একটি লোমও কাটলো না। তাকে জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করা হলো, কিন্তু কিছুই হলো না। গাজীকে পাথরের সাথে বেঁধে সমুদ্রে নিক্ষেপ করা হলো। অবশেষে একটি র্সূঁচে বিশেষ চিহ্ন দিয়ে সমুদ্রগর্ভে নিক্ষেপ করে গাজীকে তুলে আনবার জন্য আদেশ করা হলো। খোদার কৃপায় সাগর শুকিয়ে গেল। খোয়াজ খিজির পাতালপুরী হতে গাজীকে সূঁচ এনে দিলেন। গাজী মহানন্দে রাজপ্রাসাদে প্রত্যার্পণ করলেন।
অবশেষে গাজী কালুর সঙ্গে গোপনে রাসিংহাসন ও সংসার জীবন ত্যাগ করে ফকিরি বেশে বাংলাদেশের সুন্দরবনে এসে উপস্থিত হলেন। তাদের অসাধারণ আধ্যাত্মিক প্রভাবে বাঘ ও কুমীর সবই বশীভূত হলো। অবশেষে গাজী ও কালু ইসলাম প্রচার করবার জন্য ছাপাইনগরের শ্রীরাম রাজার দেশে উপস্থিত হলেন। পুঁথির ভাষায়ঃ
প্রজাগণ যত তার সব হিন্দুবান
সে দেশের মধ্যে নাহিএক মসিলমান।
অকস্মাৎ একদিন রাজবাটীতে অগ্নি লাগলো। রাণী অপহৃত হলেন এবং সেখানকার সব মুসলমান হয়ে নিস্তার পেলো। ছাপাইনগরে একটি সুবর্ণমন্ডিত মসজিদ নির্মিত হলো। অবশেষে তারা দুইভাই সেখানকার পুর ও রায় হয় দেশ ব্রাহ্মণনগরে গেলেন।
পুঁথির ভাষায়ঃ
ব্রাহ্মণনগর এইশুন বিবরণ ॥
এদেশের প্রজাগণ সকলি ব্রাহ্মণ।
অন্য জাতি দেশে রাজা নাহি দেয় ঠাঁই ॥
যবন পাইলে খাই দক্ষিণা গোসাই ॥
মুকুটরায় ছিলেন যবনদ্বেষী ব্রাহ্মণ। রাজার সাত পুত্র ও এক কন্যা ছিল। কন্যার নাম চম্পাবতী। গাজী চম্পাবতীর রূপে মুগ্ধ হয়ে পাগলপ্রায় হলেন। কালু ঘটক হিসেবে রাজা মুকুট রায়ের দরবারে যেয়ে গাজীর সাথে চম্পাবতীর বিয়ের কথা উত্থাপন করলে কালু বন্দী হলেন। ফলে গাজীর সাথে প্রকার যুদ্ধ বাঁধলো। পুঁথির ভাষায়ঃ
সাত শত গাড়ল লয়ে
দাবার ঘাট পার হয়ে
গাজী চললেন খুনিয়া নগর
খুনিয়ানগরে যেয়ে মুকুট রাজার মেয়ে
গাজী বিয়ে করলেন কৌশল্যা সুন্দরী।
গাজী অসংখ্য ব্যাঘ্র সেনা নিয়ে নদী পার হয়ে মুকুট রায়ের রাজধানী আক্রমণ করলেন। মুকুট রায়ের বলশালী প্রধান সেনাপতি দক্ষিণ রায় কুমীর নিয়ে গাজীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন। দক্ষিণ রায় মুগুর দ্বারা গাজীর হাতের আশা ভেঙ্গে দিলেন। অবশেষে তিনি গাজীর অদ্ভূত রণকৌশলের নিকট পাজিত হলেন। রণবিজয়ী গাজী দক্ষিণ রায়ের কান কেটে, বারো হাত লম্বা টিকি কেটে বেঁধে রাখলেন। এই সংবাদ শ্রবণ করে রাজা মুকুট রায় স্বয়ং কয়েক হাজার সৈন্য এবং তোপ তীর নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হলেন। যুদ্ধ চলতে লাগলো। রাজা মুকুটি রায় প্রত্যহ রাত্রিতে “মৃত্যুঞ্জীব কূপ” হতে জল ছিটিয়ে সৈন্য, হাতি ও ঘোড়া বাঁচিয়ে দিতেন। গাজী এই সমস্ত রহস্য জানতে পেরে সেই কূপে গোমাংশ ও রক্ত নিক্ষেপ করলেন। গাজীর ব্যাঘ্র সেন্য ও পরীদল মুকুট রায়ের সৈন্যদের মেরে ফেলেছিল। রাজা ও সভাসদগণ কলেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণ করলেন। রাণী এতে আপত্তি করলেন না। পুঁথির ভাষায়ঃ
বড় আহ্লাদের মোর কন্য চম্পাবতী
সাতপুত্র মধ্যে সেই আদরের অতি।
তার প্রতি দয়া তুমি সদয় রাখিবা
অনিষ্ট করিলে কোন মার্জনা করিবা।
গাজী চম্পাবতীকে নিয়ে বিদায় হলেন। বাঘ ও পরীগণ রাজাকে সালাম জানিয়ে বিদায় লইলো। গাজী চম্পাবতীর রূপে মুগ্ধ হলেন। পুঁথিতে তার অপরূপ রূপের কথা বর্ণিত আছেঃ
জ্বলিতেছে রূপ যেন লক্ষ কোটি শশী
হঠাৎ চম্পার রূপ নয়নে হেনিয়া
মুর্ছিত হইয়া গাজী পড়িল ঢলিয়া।
কিছুদিন পরে পথিমধ্যে গাজী দেখলেন, এক নদীর কূলে তিন শথ যোগী সাধনায় নিযুক্ত আছেন। সঙ্গীকে ডেকে তিনি যোগীদিগের অভিষ্ট কমলে কামিনী দর্শন করালেন। যোগীরা মুসলমান ধর্মের ন্যায় ধর্ম নাই দেখে ঝুটি কেটে মুসলমান হয়ে গেল। পরে পাতালপুরী হতে জুলহাসকে নিয়ে গাজী কালু ও চম্পাবতী সাগর পার হয়ে বৈরাটনগরে পৌঁছিলেন। মলিন রাজপুরী আবার হর্ষ কোলাহলে মুখরিত হলো। এই কাহিনীই পুঁথির মূল কথা।
এখন আমরা বিবেচনা করে সামনের দিকে অগ্রসর হবো যে, কাল্পনিক পুঁথির মধ্যে কতটুকু ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে। সর্বপ্রথমে আমাদের জানা দরকার বৈরাটনগর কোথায় অবস্থিত? পুঁথিতে বিরাটনগর, সোনাপুর ও ছাপাইনগর নাম পাওয়া যায়। সর্বপ্রথমে তার জন্মস্থান বৈরাটনগরের পরিচয় পাওয়া যায়।
গাজীর প্রকৃত পরিচয় ও বৈরাটনগরের পরিচয় অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রায়ই। বহু অনুসন্ধারে পর জানা যায় যে, বারবাজারের নিকটবর্তী বেলাট গ্রাম বৈরাটনগর থেকে অপভ্রংশের মাধ্যমে এসেছে। তুর্ক আফগান আমলে এখানে শহর এবং মুসলমান সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। বৈরাট বা বিরাটনগর বেলাট গ্রামে হওয়া স্বাভাবিক। এরূপ ধারণা করার পিছনে যুক্তি হচ্ছে ব্রাহ্মণনগর বৈরাটনগরের কাছেই অবস্থিত। গাজী ঐতিহাসিক ব্যক্তি। তবে সেকেন্দার শাহের পুত্র তা ঐতিহাসিক সত্যের বিপরীত। সেকেন্দর শাহের বরখান গাজী বা বড় খাঁ গাজী নামে কোন নামে কোন সন্তান ছিল না। সেকেন্দার শাহ ১৩৫৯ খৃষ্টাব্দে থেকে ১৩৯২ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ শাসন করেছিলেন। তার আটরোজন পুত্র সন্তান ছিল। তার পুত্র গিয়াসউদ্দীন পিতার উত্তরাধিকার প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সেকেন্দার শাহের প্রায় একশত বছর পরে মুকুট রায় ও গাজীর সাথে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তাই সিকান্দার শাহ ও গাজীর সাথে পিতাপুত্রের সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, দক্ষিণ রায়ের সাথে যে গাজীর যুদ্ধ হয়েছিল তার নাম বরখান গাজী। বনবিবি ও গাজীর গীতের মধ্যেও বরখান গাজীর নাম দেখতে পাওয়া যায়। ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যে আছেঃ
বড় খা গাজীর সাথে মহাযুদ্ধ খনিয়াতে দোস্তালী হইল তারপর গরীবুল্লা।
জঙ্গনামা পুঁথিতে বড় খাঁ নাম পাওয়া যায় যেমনঃ
বাপ নাম শাহ ছুন্দি আল্লার ফকির
অধীন ফকির বলে কিতাবের বাত
সম্ভবতঃ বরখান গাজী শব্দটি অপভ্রংশের মাধ্যমে বড় খাঁ গাজীতে পরিণত হয়েছে। ১৬৮৬-৮৭ খৃষ্টাব্দে চব্বিশ পরগণা জেলার কবি কৃষ্ণরাম দাস ‘রায়মঙ্গল’ কাব্য রচনা করেছিলেন। এই কাব্যে অসংখ্য কাহিনী দ্বারা ভরপুর থাকলেও এর মাঝে অনেক ঐতিহাসিক সত্যতা নিহিত আছে।
এখন আমরা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, আমাদের আলোচিত গাজী শাহের নাম বরখান গাজী। সম্ভবতঃ তিনি সেকেন্দার নামীয় কোন বর্ণাঢ্য ব্যক্তির পুত্র ছিলেন। তার পিতা সম্ভতঃ তুর্ক আফগান আমলে সামন্তরাজ বা অধীনস্থ শাসনকর্তা ছিলেন।
গাজীর বংশ পরিচয়ের মত বাল্য জীবনও আমাদের কাছে অস্পষ্ট। কথিত আছে যে, বাল্যকালে তার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল। অল্পদিনের মধ্যে তিনি পবিত্র কোরান শিক্ষায় শিক্ষিত হলেন। তিনি আরবী, ফার্সী, গণিত ও ধর্মশাস্ত্রে অসাধারণ পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন। বাল্যকাল হতে তিনি ধর্মকার্যে আত্মনিয়োগ করেন। তার গুণ উত্তরোত্তর প্রস্ফুটিত হতে লাগলো। তিনি শাহ জালালউদ্দিন তাব্রিজীর নিকট আধ্যাত্মিক জগত সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। তবে এ কথা সত্য যে, জালালউদ্দিন তাব্রিজী তার বাল্যশিক্ষক ছিলেন না। কেননা, জালালউদ্দিন তাব্রিজী দ্বাদশ শতাব্দীর পরেই এদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য আগমন করেছিলেন। বরখান গাজীর আবির্ভাব ঘটেছিল এর প্রায় তিন শত বছর পরে। গাজী পীর বহু চিন্তার পর ধনীর দুলাল হয়েও ইসলাম প্রচারের জন্য গৃহত্যাগ করেছিলেন। গাজীগীতে উক্ত আছেঃ
গাজী বলে কালু ভাই
ছাড় দলের বাদশাই
চল মোরা ফকির হয়ে যাই।
অবশেষে গাজী এক গভীর নিশিথে কালুকে সাথে নিয়ে গৃহত্যাগ করলেন। সহোদর ভ্রাতা গাজী ও কালু উভয়ে যোগী সাজলেন। পরিশেষে তরুণ দুই সন্ন্যাসী সুন্দবনের গভীর অরণ্যে কঠোর সাধনায় লিপ্ত হন। সাধনার পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্ম প্রচারে মনোনিবেশ করেন।
গাজীর প্রকৃত নাম গাজী নয়, গাজী তার উপাধি। যার অর্থ ধর্মযুদ্ধে বিজয়ী বীর। যিনি বিধর্মীর সাথে ধর্মযুদ্ধ করে জয়লাভ করেন তিনি ‘গাজী’ নামে সম্মানিত হন। হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর সময় হতে বহুলোক এদেশে ইসলাম প্রচার করার জন্য আগমন করেছিলেন এবং বহু গাজী এদেশে প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিল। গাজীদের আস্তানা ও দরগা এখনও সযত্নে সংরক্ষিত আছে।
অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, রাজা মুকুট রায়ের সাথে যে গাজীর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল তার নাম গোরাই গাজী। কিন্তু পীর গোরাই চাঁদ বা গোরাই গাজী আমাদের আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি ভিন্ন। গোরাই গাজীর ইতিবৃত্তে দেখা যায় যে, সেখানে মুকুট রায়ের সাথে যুদ্ধের কথা উল্লেখ নেই। গোরাই গাজীর প্রকৃত নাম সৈয়দ আব্বাস আলী মক্কী। তিনি দেউলিয়ার রাজা চন্দ্রকেতুকে বশীভূত করার চেষ্টা করেছিলেন। চব্বিশ পরগণা জেলার গেজেটিয়ার হতে জানা যায় যে, হাতিয়াগড়ে গোরাই গাজীর সাথে রাজা মহিদানন্দের পুত্র আফয়ানন্দ ও বকানন্দের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে বকানন্দ নিহত হন এবং গোরাই গাজী ভীষণভাবে আহত হন। বালারুর নিকটবর্তী হড়োয়ায় এসে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন। গৌড়ের সুলতান হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১২৩০-১২৩৭) গোরাগাজীর সমাধির উপর মসজিদ নির্মাণ করে দেন। তিনি মসজিদের ব্যয় নির্বাহের জন্য ৫ শত একর জমি নিষ্কর দিয়েছিলেন। বসিরহাট অঞ্চলে গোরাই গাজী সর্বজন পরিচিত পীর। হাড়োয়ায় প্রতিবছর তার নামে মেলা বসে। তার নামে কলিকাতায় গোরাচাঁদ রোড আছে। এখনও ফকিরের কণ্ঠে শোনা যায়, “পীর গোরা চাঁদ মুশকিল আসান”। প্রতিবছর ১২ই ফাল্গুণ তার মাজারে ওরস উদযাপিত হয়। হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান, নরনারী এই ওরসে যোগদান করে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেছেন, ‘পীর গোরাচাঁদ আসলে হিন্দুর ঠাকুর ছিলেন। পরে সম্পূর্ণ মুসলমান হয়ে গেছেন।’ ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাও বর্ণনা দিয়েছেন, ‘এই পীরের শেষ খাদিম ও পীরের মুতাওয়াল্লী শায়খ দ্বারা মালিক হাড়োয়ার নিকটবর্তী পেয়ারা গ্রামে বাস করতেন।’ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তারই উত্তরসূরী। যাই হোক, আমরা এ সম্পর্কে আর বেশী দূর অগ্রসর হতে চাই না। মোদ্দাকথা হলো পীর গোরাচাঁদ ও বরখান গাজী দু’জনই ভিন্ন ব্যক্তি।
ত্রিবেণীর উলুফ ই আজম হুমায়ুন জাফর খাঁ হারাম ইৎসীন গাজী সংক্ষেপে জাফর খাঁ গাজীর দুই পুত্র ছিল বলে জানা যায়। তার পুত্রত্রদ্বয়ের নাম হলো উগত্তয়ান খান গাজী এবং বড়খান গাজী। সম্ভবতঃ তিনি লাথনৌতির সুরতান রুকুনুদ্দীন কায়কাউসের (১২৯১-১৩০০) অধীনস্থ একজন সেনাপতি ছিলেন। বরেন্দ্র ও রায় এলাকায় ইসলাম প্রচারের জন্য তার অবদান অপরিসীম। দিনাজপুর জেলার দেবীকোটে একটি মসজিদের অস্তিত্ব অম্লান পাওয়া যায়। মসজিদ না থাকলেও একটি শিলালিপির মাধ্যমে জানা যায় যে, হিজরী ৬৫৭ সালের ১ মুহররম মুতাবিক হয়েছিলেন। সুলতানবাসী মালিক জিওন্দ নামে উলুখই আজন হুমায়ুন জাফর খাঁ বাহরা জমিন গাজীর আদেশে এটি নির্মাণ করেন। এই শিলালিপিতে তাকে বলা হয়েছে, নাসিরুল ইসলামবা ইসলামের সহায়ক এবং শিহাবুল হক ওয়াদ্দিন বা সত্য ও ধর্মের উল্কাস্বরূপ। ত্রিবেণী বিজয়ের পর জাফর খাঁ গাজী ১৯২৮ ঈশায়ী খৃষ্টাব্দে হুগলীর পাতুয়ায় একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এই মসজিদের শিলালিপিতে জাফর খাঁ গাজীর পরিচয় লিপিবদ্ধ আছে। তিনি প্রত্যেক অভিযানেই হিন্দুস্তানের বিভিন্ন নগর জয় করেন এবং তিনি তার ক্ষুরধার তরবারি ও বর্শার আঘাতে হৃদয় বিধর্মীদের পরাজিত করেন। হুগলীর ছোট্ট পাত্তুয়ায় জাফর খাঁ গাজী (রঃ) এর নির্মিত একটি সুউচ্চ মিনার আজও সগৌরবে ইসলামের বিজয়বার্তা ঘোষণা করছে। এমিনার টি ত্রিবেণী বিজয়ের পর সম্ভবতঃ ১৯২৮ খৃষ্টাব্দে নির্মিত। জাফর খাঁ গাজী ১৩১৩ খৃষ্টাব্দে ত্রিবেণীতে ইন্তেকাল করেন। অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, জাফর খাঁ গাজীল পুত্র বড়খান গাজী ও আমাদের আলোচ্য বরখান গাজী বড়খান গাজী। ঘটিয়া বিবি মোবারক শাহ (রঃ) সুশরীফ শাহ গাজী সবাইকে একই ব্যক্তি বলে মনে করেন। কিন্তু সবাই পৃথক পৃথক ঐতিহাসিক ব্যক্তি। ডক্টর এনামুল হক বলেছেন যে, আমাদের আলোচ্য গাজী শাহ সম্ভবতঃ ত্রিবেণী বিজেতা জাফর খাঁ গাজীর পুত্র এবং গৌভাদিপতি সুলতান সেকেন্দার শাহের আমলের ব্রাহ্মণ রাজা হলেন মুকুট রায়। বড় খাঁ গাজী সম্ভবতঃ দক্ষিণাঞ্চলে যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগণায় যুদ্ধাভিযান করেছেন। দরাফ খাঁ এবং ত্রিবেণীর জাফর খাঁ গাজী অভিন্ন ব্যক্তি। তবে আমরা ডক্টর এনামু হকের সাথে একমত হতে পারলাম না কেননা ত্রিবেণী বিজেতা জাফর খাঁর বড়পুত্র খাঁ পুত্র সম্ভবতঃ চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করবার জন্য এসেছিলেন। কমপক্ষে আমাদের আলোচ্য গাজীর আবির্ভাবের একশত বছর পূর্বে। জাফর খাঁ গাজীর কিংবা তার পুত্রের সময় মুকুট রায় নামে কোন রাজার নাম পাওয়া যায় না। তাই উভয় গাজীই ভিন্ন ব্যক্তি। ত্রিবেণীতে বড় খান গাজী ওতার ছোট ভাই উগওয়ান খান গাজী (রঃ) এর মাযার তার পিতার মাযারের কাছেই বিদ্যমান রয়েছে। ডক্টর সুকুমার সেন বলেন যে, ‘ইসমাইল গাজীই পরবর্তীকালে বড় খান গাজী নাম গ্রহণ করেছিলেন।’ ‘রিসালাতুস শুহাদা’ নামক ফর্সি গ্রন্থে তার জীবন লিপিবদ্ধ আছে। তাই ডঃ সেনের সাথে আমরা একমত হতে পারি না। এই ইসমাইল গাজী গৌড়ের সুলতান বরবক শাহের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি তার সময়ে উড়িষ্যা আক্রমণ করেছিলেন। তিনি কামরূপ রাজাকে পরাজিত করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। সপ্তদশ শতকের কবি সীতারাম দাস তার আধ্যাত্মিক শক্তির প্রশংসা করেছেন। বন্দেশী রায়ের চক্রান্তে ইসমাইল গাজীকে ১৪৭৪ খৃষ্টাব্দে শিরোচ্ছেদ করা হয়। ষড়যডন্ত্রের কথা জানতে পারলে সুলতান গভীর মর্মপীড়ায় ভোগেন। তিনি গাজীর বেগমকে সাথে নিয়ে মান্দারন (সমাহিত হয়েছিল) ও কাটদুয়ারে (দেহ সমাধিস্থ হয়েছিল) উপস্থিত হয়ে গাজীর দরগা জিয়ারত করেন। অতএব উভয় গাজীই ভিন্ন ব্যক্তি।
অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, পীর সায়্যিদ মুবারক আলী গাজী ও আমাদের আলোচ্য গাজী অভিন্ন ব্যক্তি। কিন্তু ভিন্ন ব্যক্তি হিসেবে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে।
পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরনগণা জেলার মুবারক গাজী নামে এক পীরের আস্তানা ছিল। এই পীর সায়্যিদ মুবারক আলী গাজী। (রঃ) মুবারক শাহ গাজী, মবরা গাজী, গাজী সাহেব, গাজী বাবা, বড় খাঁ গাজী, পীর বাবা গাজী ইত্যাদি নামে পরিচিত। চব্বিশ পরগণা অঞ্চলে তার কথা রূপকথার মত ছড়িয়ে আছে। জানা যায় যে, তার পিতার নাম সেকেন্দার শাহ ও তার মাতার নাম বিবি কুলসুম। সম্ভবতঃ তিনি বেলে আদমপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কেউ কেউ বলেন যে, বৈরাটনগরে তারা জন্মগ্রহণ করেন। তবে বৈরাটনগর সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ আছে। তার মামার খুটিয়ারী গ্রামেই বিদ্যমান। তার মামাকে গাজী বাবার দরগা বলে অভিহিত করা হয়। তিনি একজন কীর্তিমান ঐতিহাসিক ব্যক্তি ছিলেন। তার কথা এমনভাবে কিংবদন্তীর আকারে ছড়িয়ে আছে যে, সত্যটি আবিস্কার করা কষ্টসাধ্য। তিনি ধর্মযুদ্ধে জয়লাভ করে ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। জানা যায় তার সম্পর্কে বহু হিন্দু, বৌদ্ধ, ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। মোবরা গাজী সম্পর্কে আব্দুল কাদের সাহেবের অভিমত হল, "His kindness to Hindu Zamindars shows the generosity of his nature. He was always unimposing and lived a very simple life. His frgiveness to the arogant enemies oroved this tolerate spirit and his refusal of any memoral in the humanity of his character. He was a true saint and fully desernes shown to his memory."
অপর একজন মোবারক গাজীর কথা সুন্দরবনাঞ্চলে শোনা যায়। কথিত আছে যে, তিনি বাঘের পিঠে আরোহণ করে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন। তিনি যোদ্ধা ও দরবেশ ছিলেন। ধর্ম প্রচারকল্পে তিনি বহু যুদ্ধ করেছেন এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হন। তার মাজার চব্বিশ পরগণা জেলার বাশড়া গ্রামে বিদ্যমান। ‘বালান্তর পীর হযরত গোরাচাঁদ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, ঘুটিয়ারী শরিফের শাহ মুবারক গাজী (রঃ) একজন কামিল পীর ছিলেন। এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি যে, হযরত গোরাচাঁদ (রঃ) ও সায়্যিদ মুবারক গাজী (রঃ) উভয়েই সমসাময়িক ব্যক্তি ছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, শাহ মুবারক গাজী (রঃ) ব্রাহ্মণনগরের রাজা মুকুট রায়ের কন্যা চম্পাবতীকে বিয়ে করেন। এই স্ত্রীর গর্ভে দুঃখী গাজী ও মেহের গাজী নামে সন্তান জন্মগ্রহণ করেছিলো। আমাধোরণা, ঘুটিয়ারী শরীফের শাহ মোবারক গাজী ও বাঁশড়া শরীফের শাহ মোবারক গাজী একই ব্যক্তি ছিলেন। সময় বিবেচনা করে আমাদে আরোচ্য গাজীর সাথে মোবারক গাজীর কোন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না।
কিংবদন্তীর মহানায়ক হযরত বরখান গাজীর সাথে বেশ কয়েকজন গাজীর সম্পর্ক স্থাপন করার চেষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের আলোচ্য গাজীর সাথে অন্য কোন গাজীর সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। তাই তার জীবন, কর্ম ও সাধনা আমাদের কাছে অন্ধকারাচ্ছন্নই থেকে গেছে। আমাদের আলোচ্য গাজীকে দয়ার গাজী বলা হয়ে থাকে এবং তিনি আমাদের কাছে বরখান গাজী, বড় খাঁ গাজী সাহেব নামে পরিচিত। এই গাজীর সাথে কালুর নাম অঙ্গাঙ্গিভাবে মিশে আছে। এখন আমরা রাজা মুকুট রায় ও তার প্রধান সেনাপতি সম্পর্কে আলোচনা করবো এবং যুদ্ধের বর্ণনা উপস্থাপন করবো।
বৃহত্তর যশোর অঞ্চলে বেশ কয়েকজন মুকুট রায় নামীয় রাজার পরিচয় পাওয়া যায়। আমরা একে একে তাদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করবো। প্রথম জমিদার মুকুট রায়ের জমিদারী ছিল যশোর জেলার উত্তরে। নলডাঙ্গার রাজবংশের প্রবল প্রতাপে সেই বয়ংশের জমিদারী বিলুপ্ত হয়। এই মুকুট রায়ের কনিষ্ঠ ভ্রাতার নাম ছিল বিনোদ রায়। এই বংশ জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিল।
দ্বিতীয়তঃ ঝিনাইদহ অঞ্চলে রাজা মুকুট রায় নামে এক প্রবল প্রতাপান্বিত জমিদার ছিলেন। তিনিও জাতিতে ব্রাহ্মণ। তার ভ্রাতার নাম ছিল গন্ধর্ব রায় এবং তিনি গৌড়ের সুলতান কর্তৃক ‘খাঁ’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। রাজা মুকুট রায়ের বহু সৈন্য সামন্ত, অশ্ব ও হস্তী ছিল। জন হিতার্থে তিনি অসংখ্য জলাশয় ও রাস্তা নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। জলাশয়ের মধ্যে ঢোল সমুদ্র সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। ঝিনাইদহের পূর্বে বিজয়পুরে তার রাজধানী ছিল। তার দক্ষিণ-পশ্চিমে ‘বড় বাথান’ নামক স্থানে তার প্রকান্ড গোশালা ছিল। জনশ্রুতি আছে যে, রাজা মুকুট রায়ের ১৬ হালকা হাতী, ২০ হালকা ঘোড়া এবং ২২০০ কোড়াদার ছিল। তিনি অধিক সংখ্যক গাভী পুষতেন বলে তাকে বৃন্দাবনের নন্দ মহারাজ বলতো। বেড়বাড়ী নামক স্থানে তার উদ্যানবাটী ছিল। রাজা মুকুট রায়ের রঘুপতি ঘোষ রায় ও গয়েসউদ্দিন নামীয় দুইজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন। গয়েশউদ্দিনের নামে গয়েশপুর গ্রাম আছে। চন্ডী সর্দার ও কেশব সর্দার নামে তার আরও প্রধান সৈন্য ছিল। যেখানে কোড়াদার সৈন্যরা বাস করতো তার নাম কোড়াদারপাড়া। কথিত আছে যে, গয়েশ কাজী নামক এক ব্যক্তি তার একটি গরু হত্যা করলে উক্ত কাজীকে তিনি নিহত করেন। সেই কথা গৌড়ের সুলতানের নিকটে পৌঁছিলে মুকুট রায়কে বেঁধে নেবার জন্য অসংখ্য সৈন্য প্রেরিত হয়। গৌড়েশ্বর সৈন্যের সাথে বাড়ীবাথানে মুতুট রায়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যুদ্ধে তিনি পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন।
কথিত আছে যে, কোন রাজা বন্দী হলে তার সাথে কপোত উড়ে যেতো। বন্দীকে হত্যা করা হলে কপোত দু’টি ফিরে আসতো। কপোত প্রত্যাগমন করার কথা জানতে পারলে সকলে মিলে মাত্র তার পরিবারবর্গ পরিখাতে নিমজ্জিত হয়ে প্রাণত্যাগ করলো। যেখানে তার কন্যারা মারা যান তার নাম কন্যাদহ এবং যেখানে তার দুই স্ত্রী নিমজ্জিত হন সেই জায়গা দুই সতীনে বলে খ্যাত। যেখানে রাজ দৈবজ্ঞ নিমজ্জিত হন সেই জায়গা ‘দৈবজ্ঞদহ’ নামে পরিচিত। এখনও ঐ সকল স্থান আছে কিন্তু পরিখা ও দুর্গের চিহ্ন বিলুপ্ত হয়েছে। এই মকিটি রায়ের সাথে গাজীর যুদ্ধের কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না।
মুকুট রায়ের বাড়ী ব্রাহ্মণনগর। যশোর জেলার ঝিকরগাছার দুই মাইল পূর্বে অবস্থিত লাউজানি গ্রামের পূর্বের নাম ব্রহ্মণনগর। পূর্বে ব্রাহ্মণনগরের পশ্চিম ভাগে কপোতাক্ষ এবং দক্ষিণ সীমা দিয়ে কপোতাক্ষ নদ প্রবাহিত হতো এবং উত্তর-পূর্ব দিকে বিল ছিল। এর মধ্যে পরিখাবেষ্টিত দুর্গে রাজমুকুট রায় বাস করতেন। তিনি গুড়গাভূক্ত ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণ ছিলেন।
পাঠান আক্রমণের পূর্ব হতেই তারা যশোরাঞ্চলে নানা স্থানে নদী তীরে বাস করতেন। তারাই এক সময়ে চেঙ্গুটিয়া পরগণার রাজা ছিলেন। স্বধর্মনিষ্ঠ মুকুট রায় প্রবল প্রতাপে শাসকার্য পরিচালনা করতেন। কেউ কেউ বলেন যে, মুকুট রায়ের জমিদারী পাবনা হতে সমুদ্র এবং ফরিদপুর হতে বর্ধমান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুকুট রায়ের প্রধান সেনাপতির নাম দক্ষিণ রায়। তিনি জাতিতে ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি রাজার দক্ষিণহস্ত স্বরূপ এবং আত্মীয় ছিলেন। ব্রাহ্মণনগরের মুকুটেশ্বর শিবমন্দির থেকে শিবপূজা না করে তিনি জলগ্রহণ করতেন না। অধিবাসীদের অধিকাংশ ব্রাহ্মণ ছিল বলে নগরের নাম ব্রাহ্মণনগর হয়েছিল। মুকুট রায় মুসলমানদ্বেষী ছিলেন। তিনি কোন কারণে মুসলমানদের মুখ দর্শন করলে প্রায়শ্চিত্ত করতেন। শাসনকার্যের সুবিধার জন্য তিনি রাজ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। তিনি নিজে উত্তরদিকের শাসনভার পরিচালনা করতেন। তার অধীনে বিপুল সংখ্যক পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্য ছিল। তিনি দক্ষিণ দেশে বা ভাটি মুল্লুকের শাসনভার দক্ষিণ রায়ের হস্তে সমর্পণ করেছিন। এই জন্য রোকে তাকে ভাটিশ্বর এবং আঠার ভাটির রাজেশ্বর বলতো। তার শক্তিশালী নৌসেনা ও নৌবাহিনী ছিল। সুন্দরবন অঞ্চলে তার প্রতাপ ছিল অত্যধিক। তিনি বলকবান পুরুষ ছিলেন। তিনি তীর ধনুক ও অস্ত্রের সাহায্যে ব্যাঘ্র-কুমীর শিকার করতে পারতেন। তিনি মল্লযুদ্ধে ব্যাঘ্রের মুন্ডুপাত করতে পারতেন। এই জন্য তিনি ব্যাঘ্রভীতিনিবারক দেবতারূপে পূজিত হয়ে আসছেন। এই সব কারণে সুন্দরবন অঞ্চলে তার নাম সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। কৃষ্ণদাস প্রণীত ‘রায়মঙ্গল’ কাব্যের মাধ্যমে জানা যায় যে, প্রভাকর নামক জনৈক রাজা চব্বিশ পরগণার দক্ষিণে জঙ্গল কেটে একটি রাজ্য স্থাপন করেন। দক্ষিণ রায় তার পুত্র। সম্ভবতঃ মুকুট রায়ের কর্ণগোচর হলে তিনি তাকে সেনাপতির পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। তিনিও মুকুট রায়ের মত মুসলমান বিদ্বেষী ছিলেন। এই জাতি বিদ্বেষের কারণেই তাদের পতন হয়েছিল। এই স্থানে আমরা চারজর মুকুট রায়ের কথা উল্লেখ করেছি। অনেকে মনে করেন যে, ঝিনাইদহের মুকুট রায় ও ব্রাহ্মণনগরের একই ব্যক্তি। কিন্তু এই দুই জন ঐতিহাসিক ব্যক্তির ভিন্ন ব্যক্তি। ঝিনাইদহের মুকুট রায় পরিশোত্রীয় এবং ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় গুড় গোত্রীয়। ঝিনাইদহের মুকুট রায়ের চম্পাবতী নামে কোন কন্যার কথা পাওয়া যায় না। তার সাথে গাজীর কোন যুদ্ধ হয়নি এবং দক্ষিণ রায়ের সাথে তার কোন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। তিনি বন্দী হয়ে রাজধানীতে নীত হয়েছিলেন কিন্তু ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় বন্দী হবার পূর্বেই কূপে পড়ে আত্মহত্যা করেন। সুতরাং উপরোক্ত তথ্য দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, উভয় মুকুট রায়ই পৃথক ব্যক্তি। সম্ভবতঃ ব্রাহ্মণনগরের মুকুট রায় হোসেন শাহের মুকুট রায় মোঘল আমলের প্রথম দিকে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এইরূপ অনুমান করার পক্ষে যুক্ত আমরা অত্র অধ্যায়ের শেষের দিকে বর্ণনা করবো। উপরোক্ত আলোচ্য ৩ জন মুকুট রায়ের মধ্যে শেষোক্ত মুকুট রায়ই আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি। মুকুট রায়ের স্ত্রীর নাম লীলাবতী। তার সাত সন্তান। চম্পাবতী ও সুভদ্রা তার একমাত্র কন্যা। তার প্রধান সেনাপতির নাম দক্ষিণ রায় এবং গাজীর সাথে খনিয়াতে মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। চম্পাবতী সাত ভাইয়ের এক বোন হওয়ার জন্য সকলেরই বিশেষ আদরণীয় ছিলেন। কোন আদরের ভগ্নির প্রসঙ্গ উঠলে আমাদের দেশে ‘সাত ভাই চম্পা’র কথা বলে থাকে। ‘সাত ভাই চম্পা জাগো রে’ এই সুর লহরী থেকে কেন্দ্র করে গাজীর সহধর্মিণী চম্পাবতী। কবি ও গায়কের নিকট তার গান অতি প্রিয়। সত্যিকার অর্থে তিনি ছিলেন রূপবতী রাজকন্যা এবং তাঁর অপরূপ খ্যাতির সৌন্দর্য ছিল। পুঁথিতে বর্ণিত আছে যে, গাজী চম্পাবতীকে পাবার জন্য পাগলপ্রায় হয়েছিলেন। তিনি কালুকে বিবাহের প্রস্তাব দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে প্রেরণ করেছিলেন। রাজা মুকুট রায় তার দুঃসাহসিক প্রস্তাবে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হলেন এবং তাকে কারারুদ্ধ করলেন। প্রবাদ আছে যে, গৌড়ের সুলতার হোসেন শাহ মুসলমান বিদ্বেষী রাজার বিরুদ্ধে গাজীকে সৈন্য দিয়ে সহায়তা করেছিলেন। অবশ্য এ বিষয়ে সঠিক তথ্য জানতেন। সম্ভবতঃ তিনি কালুকে মুকুট রায়ের দরবারে ইসলামের দাওয়াত কবুল করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। ইসলাম ধর্মের প্রতি অবমাননা ও কামুক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে এবং তাকে ইন্দ্রিয়পরায়ণ ও কামুক হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ সম্পর্কে সতীশ বাবু বলেছেন, “এ বিষয় মুসলমান পুঁথিতে গাজী সাহেবের কামুকতার যে বিকৃত কাহিনী আছে তাহা সম্পূর্ণ অলীক বলিয়া বোধ হয়”। যে গাজী সংসারের সুখ-শান্তি ত্যাগ করে ফকির বেশ ধারণ করে বলে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন তার পক্ষে চম্পাবতীর রূপের কথা শ্রবণ করে তাকে একান্ত কাছে পাবার জন্য উতলা হওয়া অলীক ও কল্পিত কাহিনী ছাড়া আমাদের কাছে আর কিছুই মনে হয় না। আমাদের আলোচ্য গাজী এই রকম মানসিকতা নিয়ে যুদ্ধ করলে বীর গাজী আখ্যা পাওয়ার সৌভাগ্য তার কপালে কখনোই জুটতো না। তাই একজন ধর্মযোদ্ধা সেনানায়কের এইরূপ কুৎসিত চরিত্র কল্পনাপ্রসূত ছাড়া অন্য কিছুই নয়। গাজী কালুর পুঁথিতে আছে, গাজী কিছু ব্যাঘ্রকে মেষ করে গুপ্তভাবে নগরে প্রবেশ করেন। ব্রাহ্মণনগর সংলগ্ন খনিয়ার রণক্ষেত্রে গাজীর সাথে মুকুট রায়ের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। দক্ষিণ রায় মুকট রায়ের সেনাপতিরূপে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিলেন। পুঁথিতে গাজীর ব্যাঘ্র সৈন্য ও দক্ষিণ রায়ের কুমীর সৈন্যের কথা উল্লেখিত আছে। এই কথার কোন তাৎপর্য নেই। গাজী সম্ভবঃ পাঠন সৈন্য ২৪ পরগণার জেলার হিজলী, হাতিয়ার, সেনারপুর, বর্ধমান ও হুগলী অঞ্চল থেকে সৈন্য সংগ্রহ করেছিলেন। এই জন্য পুঁথিতে ব্যাঘ্র সৈন্যের কথা বলা হয়েছে। তবে আমাদের কাছে সর্বাপেক্ষা সত্য বলে মনে হয় যে, গাজীর শক্তিশালী পদাতিক সৈন্যের সাথে দক্ষিণ রায়ের নৌবাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। খনিয়ার ময়দানে গাজীর সৈন্যের সাথে দক্ষিণ রায়ের সৈন্যদের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। আলাউদ্দিন হোসেন শাহ গাজীকে সৈন্য দিয়ে সাহায্য করেছিলেন এমন কোন সত্য আমাদের হাতে নেই। যাই হোক, কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ চলেছিল। দক্ষিণ রায়ের সৈন্যগণ বীরবিক্রম যুদ্ধ করেও মুসলমানদের নিকট পরাজিত হলেন। গাজীর সৈন্যগণ সদলবলে যুদ্ধে জয়লাভ করে রাজপুরীর মধ্যে প্রবেশ করলে মুকুট রায় আত্মসমর্পণ করেন। পরাজয়ের গ্লানি হতে নিষ্কৃতি পাবার জন্য মুকুট রায়ের পরিবারবর্গের অনেকে কূপে পড়ে আত্মহত্যা করেন। মুকট রায়ের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র কামদেব পরে ইসলাম গ্রহণ করে ‘পীর ঠাকুরবর নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তনি ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য দেশব্যাপী বেড়াতেন। তার সম্পর্কেও অনেক কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। জানা যায় যে, তিনি ইসলাম প্রচার করে নানা দেশে ঘুরে অবশেষে গোবরডাঙ্গার দক্ষিণে চারঘাটে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তিনি চারঘাটে মুসলমান ফকিরের মত বসবাস করতেন। জানা যায় যে, মুসলমান হওয়ার পর তার ক্রমে ধর্মের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পায় এবং হিন্দুদিগকে মুসলমান করতে চেষ্টা করেন। তিনি প্রায় ১০০ বছরকাল জীবিত ছিলেন। সুন্দরবনের বাঘ নামে পরিচিত প্রতাপাদিত্যের উত্থান পতন এবং তার মৃত্যুর পর পীর ঠাকুরবর দেহ ত্যাগ করেন। সে সময় হবে শুঁড়ি নামক একজন প্রসিদ্ধ সমৃদ্ধিসম্পন্ন বণিক চারঘাটে বাস করতেন। তিনি তাকে মুসলমান দর্শে দীক্ষা দিবার জন্য বহু চেষ্টাকরেছিলেন। হবেশুঁড়ি ধর্মান্তর অপেক্ষা মৃত্যু শ্রেয় মনে করতেন। সেই জন্য এই অঞ্চলে একটা কথা শোনা যায়, ‘মরলো তবুও হবেশুঁড়ি ঠাকুরবর বলল না’। অর্থাৎ ঠাকুরবরের বশ্যতা স্বীকার করলো না। যাই হোক, এ সম্পর্কে আমরা আলোচনার শেষ পর্যায়ে আরো আলোচনা করবো।
যুদ্ধে সেনাপতি পরাজিত হবার পর গাজীর সাথে সখা সূত্রে আবদ্ধ হন। মুকুট রায় এরপর দেশত্যাগ করেন। কেউ কেউ বলেন যে, তিনি কূপে পড়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। এই যুদ্ধের পর কিংবদন্তীর মহাবীর সেনানায়ক ‘গাজী’ উপাধিতে ভূষিত হন। এটাই যুদ্ধের মূলকথা।
এখন আমরা ঐতিহাসিক ব্রাহ্মণনগর সম্পর্কে আলোচনা করবো। বিখ্যাত ‘কালীবাবুর রাস্তা’ ঐতিহাসিক ব্রহ্মণনগর তথা লাউজানির মধ্য দিয়ে কলিকাতায় গিয়েছে। রেল লাইনের উত্তরদিকে লাউজানি গেটের পূর্বে বিখ্যাত ‘গাজীর দরগাহ’ অবস্থিত। বহু পুর্বে এখানে প্রতিবছর মেলা বসতো। দরগার পূর্বদিকে ‘চম্পাবতী’ নামীয় পুকুর আছে। এর একটু পূর্বে ‘বাঘামরীর পুকুর অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে যে, গাজী এখানে ব্যাঘ্র বেঁধে রাখতেন। দরগা সংলগ্ন ‘মৃত্যুঞ্জীব কূপ’ এখনও লোকে দেখিয়ে থাকে। পরবর্তীকালে এই কূপের সন্ধান করা হয়েছে কিন্তু পাওয়া যায়নি। কথিত আছে যে, কূপের জল ছিটিয়ে দিলে মৃত ব্যক্তি বেঁচে উঠতো। দরগার দক্ষিণ দিকে খনিয়ার/কুনিয়ার রণক্ষেত্র এই ময়দানেই দক্ষিণ রায়ের মহাযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। তিন-চার বর্গমাইল ব্যাপী মুকুট রায়ের রাজধানী ও শহর বিস্তৃত ছিল। লাউজানী গ্রামের লোক তথা স্থানীয় লোক গ্রামকে ব্রাহ্মণনগর বলেই জানে। বর্তমানে আমরা ব্রাহ্মণনগরের রাজধানীর কোন চিহ্ন দেখতে পাই না। কেউ কেউ বলেন যে, বর্তমান মাদ্রাসার স্থানেই ছিল রাজধানী। এর অদূরে গড় ও টিলা পরিলক্ষিত হয়। দরগার পশ্চিমে লাউজানীর ক্ষুদ্র বাজারের পাশে অবস্থিত রাজবাড়ীর সীমানার মধ্য দিয়ে রেল লাইন চলে গেছে। এর দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে মুকুট খনিত দীর্ঘ দিঘী আছে। দিঘীর দক্ষিণ পাড়ে মুকুট রায়ের রাজবাড়ীর ধ্বংবাশেষ আজও দেখা যায়। দিঘীর দক্ষিণ পাশে পাকা ঘাট ছিল। সে চিহ্ন এখন আর দেখা যায় না। রাজবাড়ীর দক্ষিণ দিকে অন্দর মহলে একটি পুকুর ছিল।
রাজা মুকুট রায়ের পতনের পর তার জমিদারি চাঁচড়া ও নলডাঙ্গা রাজাদের মধ্যে বন্টন হয়ে যায়। নলডাঙ্গার অংশ ছিল চারি আনা এবং চাঁচড়ার ছিল বার আনা। বর্তমানে নোয়াখালী জেলার বহু দরিদ্র কৃষক পরিবার রাজবাড়ীর আশেপাশে পরিত্যক্ত ভিটায় বসবাস করছে। এই হচ্ছে ব্রাহ্মণনগরের কথা। গাজীর সাথে মুকুট রায়ের যুদ্ধ শেষে চম্পাবতী মুসলমান শিবিরে নীত হলে গাজীর সাথে তার বিবাহের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। শেষ পর্যন্ত গাজী ভক্তগণের অনুরোধে চম্পাবতীকে বিবাহ করেছিলেন। এই দাম্পত্য জীবনের ইতিহাস অজ্ঞাত। মুসলমানী পুঁথিতে আছে যে, গাজী সাহেব চম্পাবতীকে বিবাহ করার কিছুদিন পর তাকে পরিত্যাগ করেছিলেন। কেউ কেউ বলেন যে, গাজীর সাথে চম্পাবতীর বিবাহ হয়নি। ইসলামদ্বেষী রাজা মুকুট রায়কে শাসন করার জন্যই এ ব্যবস্থা করেছিলেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল ইসলাম প্রচার। তাই গাজী কামুক পুরুষ ছিলেন এ কথা আমাদের অবিশ্বাস্য। অন্যান্য গাজী গানের চরিত্র আলোচনা করলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে, গাজী সাহেব নরপিশাচদের মত ইন্দ্রিয়সেবী ছিলেন না। যাই হোক, আমরা মোদ্দা কথায় এসে বলতে চাই যে, ফকির গাজীর সংসার বিরাগী হওয়ার জন্য চম্পাবতীর সাথে শেষ পর্যন্ত বিচ্ছেদ ঘটেছিল। এই মহান গাজীর কবর সিলেট জেলায় এবং চম্পাবতীর কবর খুলনা জেলার পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। উভয়ে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে বসবাস করলে সমাধি একই জায়গায় থাকতো। শেষ জীবনে রাজনন্দিনী চম্পাবতী ধর্ম সাধনায় নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। তার সঞ্চিত সব সম্পত্তি পরসেবায় দান করে দিয়েছিলেন। এই জন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে তাকে মা বলে ডাকতো, মায়ের মত ভক্তি ও শ্রদ্ধা করতো। এই মহিলার নাম হওেয়ছিল ‘মা চম্পা বিবি’। তার মৃত্যুর পর ভক্তগণ স্মৃতি রক্ষার জন্য তার সমাধির উপর একটি সুন্দর ও বৃহৎ এক গম্বুজ বিশিষ্ট স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে দেন। তিনি মুসলমানের পত্নী ছিলেন বলে তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। ‘মা চম্পা’র দরগা আজও স্মৃতি রক্ষা করে চলছে। খুলনা জেলার পশ্চিম সীমান্তে এবং সাতক্ষীরা শহরের তিন মাইল উত্তরে লাবসা গ্রামে তার দরগা অবস্থিত। বারাসতের নিকট ঘোলা গ্রামে ‘মা চম্পা’র একটি প্রসিদ্ধ আস্তানা আছে। কালের করাল গ্রাসে তার সমাধি সৌধ মৃত্তিকা খনন করে তা বের করা হয়। দরগার উপরে একটি চম্পক ফুলের গাছ। দুইটি বটগাছ, একটি নিম গাছ ও অন্যান্য বৃক্ষলতা স্থানটিতে জঙ্গলের ন্যায় করে রেখেছে। এই দরগা সংস্কার করা প্রয়োজন। পূর্বে এখানে মেলা বসতো। লোকে মেলায় মুরগী ও ছাগল মানত করতো। দরগায় হিন্দুগণ শনি ও মঙ্গলবার পূজা করতো। বর্তমানে আলেমগণের ফতোয়ার কারণে এই আচার বন্ধ রয়েছে। গাজী কালুর ন্যায় চম্পাবতীর জীবন কাহিনী সম্পর্কে ইতিহাস একেবারে অজ্ঞ। খুলনা গেজেটিয়ার প্রণেতা মিঃ ওমালী সাহেব প্রবাদের উপর ভিত্তি করে বলেছেন, চম্পা বাগদাদ নগরীর খলিফা বংশের অবিবাহিত কন্যা। ইসলাম ধর্ম প্রচার ও প্রসারের জন্য তিনি মহানগরী বাগদাদ হতে সুদূর বঙ্গদেশে আগমন করেছিলেন। ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে চম্পা একদিন নৌখালী নদীর মধ্য দিয়ে নৌকাযোগে যাবার সময় লাবসা গ্রামে তার নৌকাডুবি হয়। তিনি ও তার সঙ্গীরা এই দুর্ঘটনা হতে রক্ষা পান এবং তখন হতে নদীতীরে লাবসা গ্রামে আস্তানা স্থাপন করেন। সেখানে তার শিষ্যগণতদীয় সমাধির উপর এক স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেন। স্বয়ং ওমালী সাহেব এই গল্পকে অবিশ্বাস করেন তিনি উল্লেখ করেন যে, চম্পাবতী হিন্দু রাজকন্যা ছিলেন। তবে তিনি ঐতিহাসিক সূত্র পরিবেশন করতে পারেননি। এখন আমরা গাজীর ইতিহাসের উপর যবনিকা পতন ত্বরান্বিত করার জন্য সামনের দিকে অগ্রসর হবো। জানা যায় যে, গাজী ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য যশোরাঞ্চ হতে আসামের দিকে অগ্রসর হন। কথিত আছে যে, সিলেট জেলার গাজীপুরে তার শেষ জীবন অতিবাহিত হয়। এবং রেসখানে তার নামে দরগা দেখতে পাওয়া যায়। এখানে বিশেগাঁও তথা গাজীপুর গ্রামে তার সমাধি ও আস্তানা অক্ষতরূপে বিদ্যমান থেকে গাজীর শৌর্যবীর্য ও ইসলাম প্রচারের কাহিনী সগৌরবে মাথা উঁচু করে ঘোষণা করছে। ১৮৮৫ খৃষ্টাব্দে প্রকাশিত সৈয়দ আব্দুল আফগর কর্তৃক লিখিত তরপের ইতিহাসে আছে, “মা গাজী বিলগ্রামের অন্তবর্তী গাজীপুরে তার দরগা আছে। সৈয়দ নাসিরউদ্দিন মা গাজীর সহায়তায় ত্রিপুরার রাজাকে পরাজিত করে তরফ দখল করেন।” স্টেপেলটন সাহেব বৈশগাঁও গ্রামের গাজীর সমাধির কথা উল্লেখ করেছেন।
এখন আমরা দক্ষিণ রায় ও গাজীর কথায় শেষ পরিচয় লিপিবদ্ধ করবো। দক্ষিণ রায় ও বনবিবির আধিপত্য সর্বত্র বিরাজমান। নৌকার মাঝিরা বনের মধ্যে প্রবশ করে তাদের নাম স্মরণ করে। কিন্তু এই বনদেবতা বনবিবি কে ? ইতিহাস শত চেষ্টা করেও তা নির্ণয় করতে পারেনি। সুন্দরবনাঞ্চলে সর্বত্র বনবিবির আজগুবি গল্পের কথা শোনা যায়। প্রবাদ আছে যে, বনবিবিকে গহীণ অরন্যে এক বৃক্ষ হতে অপর বৃক্ষে যাতায়াত করতে দেখা যায়। বনের সব হিংস্র জীবজন্তু তার অনুগত। সাধারণ লোকে এই কাহিনী বিশ্বাস করে।
‘বনবিবির জহুরনামা’ নাম মুসলমানী কেতাবে ‘বনবিবি’র কাহিনী বর্ণিত আছে। পুঁথিতে আছে যে, মক্কাবাসী নির্বাসিত হন। সেই সময় তিনি সন্তান সম্ভবা ছিলেন। বনের মধ্যে শাহ জঙ্গুলী ও বনবিবি নামে দুই জমজ পুত্র-কন্যা জন্মগ্রহণ করেন। জানা যায় যে, বনবিবি’র বাল্যকাল রোমাঞ্চকর কাহিনীর সাথে জড়িত ছিল। পুঁথিতে আছেঃ
বনের হরিণ সব খোদার মেহের ॥
হামেশা পালন করে বনবিবি তরে ॥
বেহেশতের হুর এসে কোলে কাখে নিয়া
তুষিয়া মায়ের মত ফেরে বেড়াইয়া ॥
ভাটিশ্বর দক্ষিণ রায়ের কবল হতে দুঃখী ও দুর্বলকে রক্ষা করবার জন্য আলাহর আদেশে বনবিবি ও তার ভ্রাতা সুন্দরবনে থেকে যায়। দক্ষিণ রায় সম্পর্কে বনবিবির পুঁথিতে আছেঃ
“এখানে দক্ষিণ রায় ভাটির ঈশ্বর
নানা শিষ্য কৈল সেই বনের ভিতর।”
অল্পদিনের মধ্যে শিবদাহ, চাঁদখালি, রায়মঙ্গল ও আন্ধারমানিক প্রভৃতি স্থান তাদের অধীনতা স্বীকার করে। দক্ষিণ রায় এই অধীনতা সহ্য করতে পারলেন না। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি বনবিবির বিরুদ্ধে সমরায়োজন করলেন। পুরুষ হয়ে তিনি নারীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন না। শেষ পর্যন্ত তিনি মাতা নারায়ণীকে বনবিবির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে প্রেরণ করলেন। যুদ্ধে নারয়ণী পরাজিত হয়ে বনবিবির সাথে সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ হলেন। এই সন্ধি অনেকদিন পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। পুঁথিতে আছে যে, বরিজহাটিতে ধোনাই মোনাই নামে দুই ভাই বাস করতো। একদিন তারা সপ্তডিঙ্গা সাজিয়ে সুন্দরবনে মধু সংগ্রহ করতে গেল। তাদের সাথে এক দুখিনী মায়ের এক পুত্র দুঃখেও গিয়েছিল। তারা গড়খালি নদীতে পৌঁছালে দক্ষিণ রায় নরবলি দাবী করলেন এবং দুঃখকে বেছে নিলেন। ধোনাই ও মোনাই অসহায় অবস্থায় দুঃখকে রেখে গেল। দুঃখের মা বনবিবির সাহায্য প্রার্থনা করলেন।
কহে মা বনবিবি কোথা রইলে এই সময়,
জলদি করে এসে দেখ তোমার দুঃখে মারা যায়।
কড়াল দিয়াছো মগো যদি না পালিবে,
ভাটি মধ্যে তোমার কলঙ্ক রয়ে যাবে।
দুখী মায়ের করুণ ক্রন্দনে তিনি সাড়া দিলেন। তিনি দুর্বল দুঃখের পক্ষ নিলেন এবং দক্ষিণ রায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। যুদ্ধে দক্ষিণ রায় পরাজিত হয়ে বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করলেন। এইভাবে বনবিবির কৃপায় দুঃখ রক্ষা পায়। বনবিবি এইভাবে অনাথিনী মায়ের অন্ধত্ব এবং বধিরত্ব ঘুচালেন। দুঃখে বহু ধন-সম্পত্তির মালিক হলো এবং ধোনাইয়ের কন্যা চম্পার সাথে বিবাহ হয়েছিল। সেই থেকে বনবিবি, বনদেবতা বা মানস সুন্দরী দেবী। পুঁথিতে আছে, আমাদের আলোচ্য বরখান গাজী (রঃ) বনবিবির বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন। এই কথাইা পুঁথির মূলকথা। গাজীর সাথে সম্পর্কিত কয়েকজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি সম্পর্কে যৎকিঞ্চিত সত্য স্বীকার করা হয়েছে কিন্তু বনবিরি কাহিনী নিছক কল্পিত। এই কল্পিত কাহিনী মক্কাবাসীর জীবনের কাহিনী অবলম্বনে রচিত হয়েছে। এতে ইতিহাস নেই। আছে শুধু রোমাঞ্চকর কল্পিত কাহিনী। বনবিবির নাম সুন্দর বনাঞ্চলে খুবই পরিচিত। উপরোক্ত আলোচনা হতে আমরা স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হতো পারি যে, সেকেন্দার শাহের সাথে বরখান গাজীর পিতা-পুত্র সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। আবার সেকেন্দোর শাহের রাজত্বকালে তার আবির্ভাব হলেও তাকুরবরে ইতহাসের সাথে মেলে না। পূর্বে বলা হয়েছে যে, ঠাকুরবর প্রায় ১০০ বছর জীবিত ছিলেন। জানা যায় যে, সুন্দরবনের বাঘ মহারাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বকালে রাজধানীতে কাভালোর হত্যাকালে অর্থাৎ ১৬০৩ খৃষ্টাব্দে বৃক্ষ ফকির জীবিত ছিলেন। রাজা মুকুট রায়ের মৃত্যুর তারিখ আনুমানিক ১৫১৫ খৃষ্টাব্দের দিকে হবে। তাহলে আনুমানিক ১৫/২০ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৫০০ খৃষ্টাব্দে বরখান গাজীর সুন্দবন অঞ্চলে আবির্ভাব ঘটছিল। তাই গাজীর আবির্ভাব সেকেন্দার শাহের সময় হয়নি। কেননা সেকেন্দার শাহের রাজত্বকালে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলাদেশে একদল গাজীর আবির্ভাব ঘটেছিল। তাদের মধ্যে বরখান গাজী অন্যতম ছিলেন।
তথ্য সূত্র:
অজ্ঞাত
সর্বশেষ আপডেট :
২০.০৮.১১