
Home ভাষা ও সংস্কৃতি (Language and Culture) > যশোর জেলার লোকভাষা ও লোকসং®কৃতি- আপডেট চলছে
এই পৃষ্ঠাটি মোট 91347 বার পড়া হয়েছে
যশোর জেলার লোকভাষা ও লোকসং®কৃতি- আপডেট চলছে
যশোর জেলা বাংলাদেশের অন্তর্গত একটা প্রাচীন অঞ্চল। এই অঞ্চলটি সুদূর অতীতে একদা একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে গড়ে ওঠে। এবং অঞ্চলটি প্রশাসনিক নামকরণ হয়- ‘যশোহর রাজ্য’। তখন এই অঞ্চলের আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। এই বৈশিষ্ট্যের উদ্ভব ঘটে একটি সমাজ সং®কৃতির সংস্থাকে কেন্দ্র করে। এই নতুন সমাজ সংস্থাটির নাম ছিল- ‘যশোহর সমাজ’। অর্থাৎ উদ্দেশ্য ছিল সামন্ত তান্ত্রিক ধ্যান-ধারনায় এই সমাজ রাজ্যটিকে আলাদা একটি রূপে ও সত্তায় পরিচিতি দান করা। যশোর সমাজের কার্য ধারাও সেই আদর্শে শুরু হয়েছিল। তখন অভিজাত সমাজের ভাষা ছিল আরবি, ফার্সী ও দেশি ভাষা মিশ্রিত। অপর ভাষাটি ছিল সম্পূর্ণ লোকভাষা। উচ্চারণের মধ্যেও ছিল বিশেস পার্থক্য। যেসব ব্যক্তিগণ ‘যশোহর সমাজের’ অন্তর্গত ছিলেন, তাদের সুশিক্ষার জন্য ব্যবস্থা ছিল গুরু গৃহ, পাঠশালা কিংবা টোল। বর্ণমালার মাধ্যমে তারা উচ্চারণ পদ্ধতি এবং ভাষা লেখার কৌশল শিখতো। অনভিজাত শ্রেণীর জন্য ভাষা উচ্চারণ বা শিক্ষার কোন সুব্যবস্থা ছিল না। অর্থাৎ জনসাধারণের বিশাল একটা অংশ, যারা উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ঠ ছিল, তাদের মুখের ভাষা ছিল সম্পূর্ণ লৌকিক এবং নিজস্ব স্বকীয়তায় পরিপূর্ণ। অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে দরবারী ভাষার প্রাধান্য ছিল বেশী। নিজেদের কুলীনতার স্বার্থে তারা সচরাচর ব্যবহৃত লোকভাষাকে উপেক্ষা করতেন। সম্মান করতেন দরবারী ভাষা। ‘বাড়ি’ কে তারা ‘বাড়ি’ বলতেন না, বলতেন বাঢী। ‘জন্য’ শব্দটির পরিবর্তে ‘নিমিত্ত’ শব্দটি চালু করেছিলেন এবং ‘কাজ’-কে বলতেন ‘কার্য্য’। আরও তারা যে শব্দগুলি অহরহ ব্যবহার করতেন-সে শব্দগুলি হলোঃ আখের, আচানক, আদব, আদাব, আমল, আমানত, আসারি (ছাদহীন হাওদা), আরজ, আরজাদাস্ত, আশরুপি, আশাবরদার, ইক্তিয়ার, ইনাম, ইশারা, উকিল, উসুল, একজাই, একরাম, এতলা, এমারত, এলবাস, ওগয়রহ, ওজির, ওজিরজাদা, ওফাত, ওয়াকিফ, ওস্তাদ, কএদ, কবজ, কবুল, করার (প্রতিজ্ঞা), কাছারি, কাজিয়া, কানুনগো, কারওয়ান, কেল্লা, খয়রাত, খাতের জমা, খাতিবদারি, খানসামানি, খালিসা, খেতাব, খেদমত, খেলাত, গঞ্জ, গাফিল, গাবত (বিনষ্ট), গোলাম, চোপমার, ছাফ, ছে মহলা, জিম্মা, জাঁহাপনা, তক্ত, তকসিব, তদবির, তফসিল, তরফ, তরোবর, (নানা প্রকার) তহখানা, তহশিল, তাগিদ, তাহুত (দেয় খাজনা), তেজারত তেলকারি, তোষাখানা, দপ্তর, দপ্তরখানা, দহলিজ, দরখাস্ত, দস্তাখাতি, দাখিল, নকীব, নজর, নায়েব, নেজা (বর্শা), পাঞ্জা, পশন্দ, পোদ্দার, পোস্তাফরমাশ, ফশাদ, বকসিস, বজাজ (বস্ত্র বিক্রেতা), বদস্তুর, বরকন্দাজি, বরকবারি, বরাবরি, বহাল, বাগ, বাগিচা, বাদশাহ, বাদশাহী, বালখানা, বিদায়, বে-এক্তিয়ার, বেওয়ারিশ, মক্তব, মজবুতি, মঞ্জুর, মনছব, মসনব, মফস্বর, মুলুক, মহল, মহাল, মানা, মাল, মালখানা, গালগুজাবি, মুছদ্দি (মুৎসদ্দি) সাগরেদ, আলেম, মুছুল্লি, গোনাহার, শের, দিলদার, কুদরতি, বাহানা, আলিশান, মুজুরা (দরবার), মুরচা, মুহরি, মেওয়া, মেরামত, যাহঁপনা, রসদ, রাহি, রেয়রত, লওয়াজমা (যাবতীয় জিনিস), লস্কর, লাচার, সরঞ্জাম, সরবসর (সোজাসুজি), সরহর্দ্দ, সাবেক, সামিয়ানা, সিক্কা, সিক্কামারা (টাকা তৈরি করা), সুবা, সুবাদারি, সুমার, সোর (শব্দ), হাজির, হিসা, হুজুর, হিম্মত ইত্যাদি। উপরোক্ত শব্দগুলির মধ্যে অনেক শব্দই ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন লোকভাষায় রূপান্তর লাভ করেছে। আবার অনেক শব্দই প্রচলনের অভাবে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ যে শব্দগুলি ছিল কৃত্তিম তা জনগণ গ্রহণ করেনি। স্বাভাবিকভাবে সেই শব্দেরও মৃত্যু ঘটেছে। সেই আমলের ভাষার কিছুটা নিদর্শন পাওয়া যায় রামরাম বসুর ‘রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র’ গ্রন্থে। নিচের অনুচ্ছেটি পাঠ করলেই বোঝা যাবে সেই আমলে যশোর অঞ্চলের অভিজাত সমাজের ভাষা ছিল কি রকম ঃ
‘একদিন রাজার এক সাহিলি পলায়ন করিয়া কোথায় ছিল, তাহার ঠেকানা ছিল না। পরে চৌকিতে ধরা পড়িল। রাজা তাহার নষ্ট ক্কয়ার সাজা নিমিত্ত দুইস্তন কাটিয়া ফেলিল। ছুকরী স্তন কাটা জ্বালাতে নিতান্ত কাতরা হইয়া প্রাণত্যাগ করিতে* বলিল, ‘রাজা আমাকে বৃহত্ জন্ত্রনা দিয়া নষ্ট করিলা। কিন্তু তোমরা সর্ব্বনাশ হওনের সময় উপস্থিত জানিও। তাহারও আর বিস্তর কাল অপিক্ষা নাই। ত্বরাই সংহার হইবা। এই কহিতেই প্রাণত্যাগ করিল।’
‘ঠেকানা’, ‘ছুকরী’, ‘জ্বলাতে’, ‘করিলা’, ‘হওনের’, ‘অপিক্ষা’, ‘হইবা’ শব্দগুলি তৎকালীন যশোর অঞ্চলের লোকভাষা থেকে রামরাম বসু গ্রহণ করেছিলেন। মোগল আমলের যশোরের প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভিন্নরূপ নেয়। আঠারো শতকের শেষ দিকে কোম্পানী সরকার যশোহরকে জেলা হিসেবে রূপান্তরিত করে। ফলে ইংরেজি শব্দ নানা প্রয়োজনে স্বাভাবিক নিয়মে কথ্য ভাষার সঙ্গে মিশ্রিত হয়ে যায়। উদাহরণ ঃ চেয়ার, টেবল, বেঞ্চ, শ্লেট, পেনসিল, স্কুল, কোর্ট, জর্জ, মাস্টার, অফিস, অফিসার, পিয়ন, জেল, নম্বর, গ্লাস, ক্লাস, ডক্টর, পকেট, ফটো, প্লান ইত্যাদি। চেয়ার শব্দটি লোকভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে চিয়ার, টেবল হয়েছে টেবিল, বেঞ্চ হয়েছে বেনচি, পেনসিল হয়েছে পেনছিল, স্কুল হয়েছে এস্কুল, কোর্ট হয়েছে কোট্, জজ হয়েছে জোয়াজ, মাস্টার হয়েছে মাসটের, নম্বর হয়েছে লম্বর, গ্লাস হয়েছে গেলাস, ক্লাস হয়েছে কিলাস, শ্লেট হয়েছে ছেলেট, ডক্টর হয়েছে ডাগদার, পকেট হয়েছে পগেট, ফটো হয়েছে ফটোক,প্লান হয়েছে পিলান ইত্যাদি। যশোর অঞ্চলে ইংরেজি শব্দের ব্যবহার ইংরেজ আমলের শুরু থেকেই প্রাধান্য পেয়েছে। তার কারণ হলো এই যে, পূর্বে স্থানটি ছিল কলকাতার লাগোয়া। ইতিহাস থেকে জানা যায় যে কলকাতার পরেই যশোর ইংরেজ সাহেবদের বসবাসের এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের উপযুক্ত স্থান। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যশোর অঞ্চল ছিল ইংরেজ ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। আঠারো শতকের শেষলগ্নে (১৭৯৫) যশোরেই প্রথম ফ্যাক্টরী শিল্পের পতন ঘটিয়েছিল ইংরেজ ব্যবসায়ীরা ঃ
ঞযব সধহঁভধপঃঁৎব ড়ভ রহফরমড় নু ইৎরঃরংয বহঃৎবঢ়ৎবহবঁং নবমধহ রহ ঔবংংড়ৎব রহ ঔবংংড়ৎব যিবহ ইড়হফ, ধ ভৎবব সবৎপযধহঃ বংঃধনষরংযবফ ধ ভধপঃড়ৎু ধঃ জঁঢ়ফরধ হবধৎ ঘড়ঢ়িধৎধ. ওহ ঃযব নবমরহহরহম ড়ভ ১৭৯৫, ঐব ধিহঃবফ ঃড় বংঃধনষরংযবফ ধহড়ঃযবৎ ভধপঃড়ৎু ধঃ অষরহধমড়ৎ হবধৎ সরংংরড়হ ঃড় ংঃধৎঃ রহফরমড় ড়িৎশং রহ গড়যধসসধফংযধযর. ঞধুমষড়ৎ বংঃধনষরংযবফ রহফরমড় ভধপঃড়ৎরবং ধঃ গরৎঢ়ঁৎ রহ ১৮০০ ধহফ রহ ঃযব ংধসব ুবধৎ মবহহরহমং ড়ঢ়বহফ ধহফ রহফরমড় ভধপঃড়ৎু ধঃ ঔযরশধৎমধপযধ, হরহব সরষবং বিংঃ ড়ভ ঔবংংড়ৎব উড়পঃড়ৎ অহফবৎংড়হ, পরারষ ঢ়ঁৎমবধহ ড়ভ ঔবংংড়ৎব, ধষংড় ংঃধৎঃবফ রহফরমড় ড়িৎশং রহ ১৮০১ ধহফ বংঃধনষরংযবফ ভধপঃড়ৎরবং ধঃ ইধৎধহফর ধহফ ঘরষমড়হল. ডরঃযরহ ধ াবৎু ংযড়ৎঃ ঃরসব, ঃযব ধঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ ভড়ৎ পঁষঃরাধঃরহম রহফরমড় রহ হবি ষধহফং ধহফ ভড়ৎ বংঃধনষরংযসবহঃ ড়ভ ভধপঃড়ৎরবং নবহমধহ রহপৎবধংব রহ হঁসনবৎ ধহফ ঔবংংড়ৎব ধিং ড়াবৎ পৎড়বিফ রিঃয রহফরমড় ভধপঃড়ৎরবং নু ১৮১১. ঞযরং দধঢ়রফ রহপৎধংব রহ ঃযব পধষঃরাধঃরড়হ ড়ভ রহফরমড় ধহফ ঃযব বংঃধনষরংযসবহঃ ড়ভ ভধপঃড়ৎরবং সধু ঢ়ধৎঃরপঁষধৎষু নব ধংপৎরনবফ ঃড় ঃযব ভধপঃড়ৎরবং ভরৎংঃষু. ঞযব ংড়রষ ধহফ ঔবংংড়ৎব ধিং পষড়ংবফ ঃড় ধহফ বিষষ পড়হহবপঃবফ রিঃয ঈধষপঁঃঃধ.
যেমন কারখানা শিল্প উৎপাদনের পত্তন ঘটিয়েছিল, ঠিক তেমনি যশোরকে কেন্দ্র করে ইংরেজি বিদ্যালয়ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই বিদ্যালয়গুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্রীরামপুর মিশনারী কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। খৃষ্টান মিশনারীরা বাংলায় ইংরেজি শিক্ষা চালু করার জন্য প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৭৯৪ খৃষ্টাব্দে প্রথম কলকাতায় ধর্মতলায় ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং একই বছরে শ্রীরামপুরে মিশনারীরা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত করেন। এর পরপরই যশোরে শুরু হয় ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ-এর ফলে ইংরেজদের প্রভাবে যশোরের কথ্য ভাষায় ইংরেজী শব্দ ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা দেয় এবং আজও তার বাংলায় ব্যবহৃত হচ্ছে।
২
যশোর জেলার লোকজীবনের মানস ভূবন এবং তার সরূপ ও সত্তার প্রকৃত পরিচয় রয়েছে তার লোকভাষা ও লোক সং®কৃতির মধ্যে। আধুনিক জীবন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক কারণে সেই লোকভাষা ও সং®কৃতির ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। অতীতে যশোর অঞ্চল ছিল স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্রমণ্ডিত। জীবনযাপনের ক্ষেত্রেও যেমন ছিল আলাদা একটা রূপ-তেমনি তার লোকভাষা ও সং®কৃতিতেও ছিল নিজস্ব একটা স্বতন্ত্রতা। উচ্চারণের- ‘ধ্বনি রূপের’ মধ্যেও ছিল আরও একটা রসময় মাধুর্য। যশোর জেলায় চার ধরনের মৌখিক ভাষা বিশেষভাবে লক্ষ্যগোচর হয়। অশিক্ষিত নিরক্ষর চাষা-ভূসা, তাঁতী, কুমার, কামার অর্থাৎ খেটে-খাওয়া মানুষেরা যে বাক্য ভাবপ্রকারে জন্য উচ্চারণ করে, তার মধ্যে রয়েছে সহজ-সরল একটা গ্রাম্য স্বভাব বা প্রবণতা। এই প্রবণতাকে শিক্ষিতজনেরা মূর্খতা বলে কটাক্ষ করেন। প্রকৃতপক্ষে বলা যায় যে, এটা কোনক্রমেই মূর্খতা নয়- এটা হচ্ছে আদিম সারল্য। উচ্চারণের ক্ষেত্রে সবমুলুকেই কিছুটা পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন উদাহরণ হিসাবে বলা যায়- ‘র’ শব্দের উচ্চারণ। ‘র’ এর পরিবর্তে যশোর অঞ্চলের অশিক্ষিত জনগণ ‘অ’ উচ্চারণ করে থাকে। আবার কেউ কেউ ‘ন’ উচ্চারণ করে। যথাঃ
রান্না > আন্না বা নান্না।
রোদ > নোদ।
রক্ত > নক্ত।
রয়েছে > নয়েছে।
রসুন > নসুন।
রাজহাঁস > নাজহাঁস।
রাত > নাত।
রোববার > নোববার।
রহমান > নহমান।
রাজ্জাক > নাজ্জাক।
রাক্ষস > নাক্ষস
রসগোল্লা > নসগোল্লা।
ক্রিয়াপদের রূপ ও ধ্বনিতে পরিবর্তনও দেখা যায়। যথাঃ
করছে > কত্তিছে বা কত্তেছে বা কত্তিলো।
যেতে > যাতি।
খেতে > খাতি।
দিলো > দেলো বা দিলি।
বলতে > বলতি।
পাবে > পাবেনে বা পাবানে।
চলতে > চলতি।
যাবো > যাবানে।
হতে > হতি।
কইবো > কবানে।
যাসনে > যেসেনে।
চাইছে < চেতেছে।
গংযুক্ত ব্যঞ্জন শব্দের আদিতে থাকলে সেটাকে ভেঙ্গে সরলী করার ঝোঁকও দেখা যায়। যথা ঃ
জ্ঞান > গেয়ান।
গ্রাম > গেরাম।
ক্ষতি > খেতি।
ক্রমে ক্রমে > কেরমে কেরমে।
স্রোত > ছুরোত।
স্নান > ছেনান/ছ্যান।
ম্লান > মিলান।
গ্রাস > গেরাস।
যন্ত্র > যন্তর।
কারক বিভক্তির ক্ষেত্রেও ‘কে’ এর যায়গায় ‘রে’ এর প্রচলন। যথা ঃ
আমাকে > আমারে।
তোমাকে > তোমারে।
গাজিকে > গাজিরে।
মাকে > মারে।
ভাইকে > ভাইরে।
করণকারকের ক্ষেত্রেও দেখা যায় একই রকম ব্যবহার বিধি। যথা ঃ
দিয়ে > দে।
নিয়ে > নে।
আবার ‘দ’ এর স্থলে ‘গ’ এর ব্যবহার হয়। যথা ঃ
আমাদের > আমগের।
তোমাদের > তোমাগের।
এছাড়াও কোন কোন স্থানে মিশ্রভাষারও সংযোগ ঘটেছে। গ্রাম্য একটি ছড়ায় আছে-
(ক) লক্ষণ পালের ঢ্যাবা ছাওয়াল
পিরিত কত্তেছে
নাঙা জামার বুক পগেডে
নুমাল নেখেছে।
ওই নুমালের মদ্যি আছে
সেই ছেম্ড়ির ফটোক॥
বুদ্দি করে এখনই গে
পাটাই দেরে ঘটক।
তা না হলে মারকেটে গে
আনবে কিনে বিষ
গুখেগোর ঐ মরা লাশটা লে-
মরগে তোলবে পুলিশ।
(খ) উঠোন ক্লিয়ার
গাছে ফ্লাওয়ার
ডোণ্ড কেয়ার
আই প্লেয়ার
লাম্বা হেয়ার
ঘরে দাও ফায়ার
ছাহেব ছেলাম
ইওর গোলাম।
(গ) আগ্ ধুম্সি
বাগ ধুমসি বাবুর ব্যাডা লো
ছেনাল মাগির কোচ্ছে শুয়ে পেরেম কত্তিলো
গা টেপলো
পা টেপলো গলায় দেলো হাত
ছেনাল মাগির জড়ায় ধরে কাটায় দেলো নাত।
আঞ্চলিক ভাষায় রচিত এই ধরণের লোকগান, ছড়াগান এবং লোক প্রবাদ যশোর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আবার বিভিন্ন জেলার লোক এই জেলায় বসতি করার ফলে মিশ্রভাষা ছিটিয়ে রয়েছে। অনেকক্ষেত্রে লোকভাষার ধ্বনি ও রূপগত বৈশিষ্ট্য বদলেও গিয়েছে। বর্তমান সমগ্র অঞ্চলে প্রচলিত যে সাধারণ বৈশিষ্ট্য বজায় রয়েছে তা মোটামুঠি নিম্নরূপ ঃ
অ > আ ঃ লাম্বা বা নাম্বা। লাম্বা লাম্বা দাড়ি। অকাট> আকাট। লোকটা আকাট মূর্খ)। নাষ্ট। ব্যাটা নাষ্টের গোঁড়া।
অ > উ ঃ অলক্ষণে > অলুক্ষণে। সামনে > সুমুক > একটু সুমুক চল, মন্দির > মুন্দির। মুন্দিরে ঘণ্টা বাজছে।
অ > এ ঃ প্রচ্ছব > পেচ্ছাব। প্রজা > পেরজা। আমরা রাজার পেরজা।
ই > এ ঃ নিত্য > নেত্য। নিঃসঙ্গ > নেসঙ্গ। লিখন > লেখন, ইত্যাদি > এত্যাদি, জীবন > জেবন।
ইয়া > অ্যা ঃ সিনান > চ্যান। শিয়াল > শ্যাল। বিহান > ব্যান। ব্যান বেলায় হাঁটতে হাঁটতে মাঠে গিয়েছিলাম।
ঋ > ই / এ ঃ সৃষ্টি > ছিষ্টি। কৃষ্টি > কিষ্টি। বৃষ্টি > বিষ্টি মূষল ধারায় বিষ্টি পড়ছে। গৃহস্থ > গেরস্থ। অদৃষ্ট > অদেষ্ট।
এ > আ ঃ যেতে > যাতি। খেতে > খাতি।
অন্ত্যএ > ই ঃ এবার > ইবার। এখানে > ইকানে। এটা > ইটা। বলতে > বলতি। করতে >কত্তি। মধ্যে > মদ্যি। দিলে > দিলি। মুখে > মুকি। মুকি মুকি কথা বলবি না লো।
এ > এ্যা > য়্যা > অ্যা ঃ মিয়া ভাই > ম্যা বাই, খেলা > খ্যালা। ঠেলা > ঠ্যালা। তেলা > ত্যালা। বেলা > ব্যালা। মেলা > ম্যালা। একটা > এ্যাকটা / য়্যাকটা / অ্যাকটা। একা > এ্যাকা। বেঁকা > ব্যাঁকা। বেড়া > ব্যাড়া। কেন > ক্যান। মেঘ > ম্যাঘ। আল্লাহ ম্যাঘ দে- পানি দে।
ও > উ ঃ শোন > শুন। কোন > কুন। বোন > বুন।
ঐ > ও ঃ বৈশাখ > বোশেখ। জ্যৈষ্ঠ > জোষ্ঠি। পৈঠা > পোঠে। খৈল > খোল।
ঔ > ও ঃ ঔষধ > ওষুধ।
ব্যঞ্জনধ্বনির উচ্চারণ ও পরিবর্তন লক্ষণীয় –
ক > গ ঃ শোক > শোগ। লোক > লোগ। সকল > সগল। বক > বগ। কাক > কাগ। কাগা করে কা কা - দুপর ব্যালা খা শা। শাক > শাগ।
ক > উ ঃ ঠাকুর > ঠাউর। কুকুর > কুউর। কুঁকড়ো > কুহুড়ো।
খ > ক ঃ চোখ > চোক চোক গেল, চোক গেল, ডাকছে রাতে পাখি।
ছ > ত ঃ করছি > কত্তিছি। বলছিলাম > বলতিলাম।
ঝ > জ ঃ সাঁঝের বেলা > সাজের বেলা। বুঝে > বুজে।
ট/ঠ > ড ঃ ব্যাটা > ব্যাডা। শরীরটা > শরীরডা। বেলাটা > বেলাডা।
ঠ > ট ঃ উঠোন > উটোন।
ন > ল ঃ নম্বর > লম্বর। নৌকা > লৌকা। নাঙল > লাঙল। নেপা > লেপা। নেবু > লেবু। নাউ > লাউ। নুঙ্গি > লুঙ্গি।
র > ন ঃ রেলগাড়ি > নেলগাড়ি। রিকশা > নিকশা। রঙিলা > নঙিলা। রয়েছে > নয়েছে।
ল > ন ঃ লজ্জা > নজ্জা। লক্ষণ > নক্ষণ। লক্ষ্মী > নক্ষ্মী, লুচি > নুচি। লুকানো > নুকানো। লবাব > নবাব। লোহা > নোহা। লবঙ্গ > নবঙ্গ। লাগতেছে > নাগতেছে। নাচতেছে > লাচতেছে।
স/শ > ছ/চ/হ ঃ সামিয়ানা > ছামিয়ানা। সোর > শোর, আপশোস > আপছোচ। সেপাই > ছেপাই। আসমান > আছমান। পশ্চিম > পচ্চিম। সেখানে > সেহানে।
যশোর অঞ্চলে লোকভাষার শব্দভাণ্ডারে এমন এমন শব্দ আছে যে-যা একান্তই এ জেলার নিজস্ব। উচ্চারণের মধ্যেও রয়েছে বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
উদারহরণ হিসাবে কয়েকটি শব্দের নমুনা এখানে তুলে ধরছি ঃ
(১) প্যাটেলি > পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, (২) খাবুর > নোংরা, (৩) হিন্দার < এই হেন, (৪) কিন্দার > কেমন, (৫) নুড়োয় > দৌড়োয়, (৬) জুতে > জুড়ে দেওয়া, (৭) টেমক > রাগ, (৮) ভেয়েনি > ভাইয়ের স্ত্রী, (৯) কুদাকুদি > ছোট ছেলেমেয়ে, (১০) হ্যারো-ব্যারো > যাদের জন্মের ঠিক ঠিকানা নাই, (১১) হোলডুব > পানির তলে ডুবে থাকা, (১২) খেরো > মাছ রাখার পাত্র (বাঁশের চটি দিয়ে তৈরি করা), (১৩) পয়েন > গরুর গাড়ির চাকায় তৈরি পথ, (১৪) চড়মাতালে > হঠাৎ রাগাম্বিত হয়ে চড় মারার জন্য মাতাল হওয়া, (১৫) হচ্যে > হচ্ছে, (১৬) ন্যাকরামে > রসিকতা।
একদা যশোর অঞ্চলে সম্বোধনসূচক দুটি শব্দ বহুল প্রচলিত ছিল। শব্দ দুটি হলো- ‘হ্যাগো’ এবং ‘ওলো’। বর্তমানে শব্দ দুটি প্রায় লোপ হওয়ার পথে। প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে এখনো কেউ কেউ পরষ্পর সম্বোধন করে শব্দ দুটি উচ্চারণ করে। পুরুষেরা বলে- ‘হ্যাগো’, মহিলারা বলে- ‘ওলো’। বাংলা সাহিত্যে যশোরের আঞ্চলিক ভাষার প্রথম সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তিনি তার ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো’ নাটকে পুরোপুরি যশোরের কথ্যভাষাকে ব্যবহার করেছেন ঃ
“হানি। কত্তাবাবু, সালাম করি।
ভক্ত। (অতি ব্যাকুলভাবে) এ কি! অ্যাঁ! এ আবার কি সর্বনাশ উপস্থিত?
হানি। (হাস্যমুখে) কত্তাবাবু, আমি ঘরে আস্যে ফতিরি তল্লাস কল্লাম, তা সকলে কলে যে সে এই ভাঙ্গা মন্দিরির দিকে পুঁটির সাথে আয়েছে, তাই তারে ঢুডডি আস্যে পড়িছি। আপনার যে মোছলমান হতি সাধ গেছে তা জানতি পাল্লি ভাবনা কি ছিল? ফতি তো ফতি, ওর চায়েও সোনার চাঁদ আপনারে আন্যে দিতি পাত্তাম, তা এর জন্যি আপনি তজদি নেলেন কেন? তোবা! তোবা!
ভক্ত। (চিন্তা করিয়া নম্রভাবে) বাবা হানিফ, আমি সব বুঝেছি, তা আমি যেমন তোমার উপর অহেতুক অত্যাচার করেছিলাম, তেমনি তার বিধিমত শাস্তিও পেয়ে্িরভাবে) বাবা হানিফ, আমি সব বুঝেছি, তা আমি যেমন তোমার উপর অহেতুক অত্যাচার করেছিলাম, তেমনি তার বিধিমত শাস্তিও পেয়েছি, আর কেন? এখন ক্ষান্ত দাও! আমি বরঞ্চ তোমাকে কিছু দিতেও রাজি আছি কিন্তু বাপু একথা যেন আর প্রকাশ না হয়, এই ভিক্ষাটি আমি চাই। হে বাবা, হাত ধরি!
হানি। সে কি কত্তাবাবু ? আপনি যে নাড়্যেেদর এত গাল পাড়তেন, এখনে আপনি খোদ সেই নাড়্যে হতে বসেছেন, এর চেয়ে খুশির কথা আর কি হতি পাওে ? তা একথা তো আমার জাত কুটুমগো কতিই হবে।
ভক্ত। সর্বনাশ!- বলিস কি হানিফ?.........
বান্ত। (ঈষৎ হাস্যমুখে) ও হানিফ, একবার এদিকে আয় দেখি.........
ভক্ত। রাধে-রাধে-এমন বিভ্রাটে মানুষ পড়ে!......
ফতে। (অগ্রসর হইয়া সহাস্য বদনে) কেন কত্তাবাবু? নাড়্যরে মায়্যে কি এখনে আর পছন্দ হচ্ছে না ?
ভক্ত। দূর হ, হতভাগি..........
ফতে। সে কি কত্তাবাবু? এই মুই আপনার কলজে হচ্ছেলাম, আরো কি কি হচ্ছেলাম; আবার এখনে মোরে দূর কত্তি চাও।”
মাইকেল মধুসূদন দত্তের এই নাটকের হানিফ এবং ফতেমার চরিত্রের কথোপকথনের মধ্যেই রয়েছে খাঁটি যশোর অঞ্চলের কথ্যভাষা। তিনি এমনভাবে সংলাপ তৈরি করেছেন যে, এখানকার লোকদের কি রকম বাকভঙ্গিমা এবং কি রকম উচ্চারণ ধ্বনি, তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘আস্যে ফতিরি তল্লাস কল্লাম’, ‘সকলে কলে’, ‘মন্দিরি’, ‘আয়েছে’, ‘ঢুঁড়তি ঢুঁড়তি আস্যে পড়িছি’, ‘জানতি পাল্লি’, ‘ওর চায়ে’, ‘আন্যে দিতি পাত্তাম’, ‘নাড়্যরে মায়্যে’, ‘কলজে হচ্ছেলাম’, ‘দূর কত্তি চাও’ ইত্যাদি শব্দ আজও গ্রাম সমাজে অবিকল টিকে রয়েছে।
৩
মানুষের ইতিহাসে ধারাবাহিক কালপ্রবাহে যে চিন্তা-চেতনা, মানস অভিজ্ঞান এবং জীবনচর্চার যে রূপ দেখি-তারই নাম সং®কৃতি। এর উদ্ভব হয়েছে জীবন থেকে, চিন্তার কর্ষণ থেকে ও ব্যবহারিক জীবন ব্যবস্থা থেকে। ব্যক্তিমানুষ এবং সমষ্টিমানুষ বুদ্ধি ও ভাবের দ্বারা তার ইচ্ছা, তার আনন্দ-বেদনা, অর্থাৎ তার সমগ্র চেতনাকে বিশেষভাবে ব্যক্ত করে তুলেছে, বা তার দ্বারা প্রকাশমান হয়ে উঠেছে, সেই প্রকাশমান রূপকে আমরা বলি সংষ্কৃতি। ঋ-শব্দের অর্থ হলো চাষ। বলা যায় যে, জীবন মানে চাষ বা সংষ্কৃতি। এর মধ্যে রয়েছে দেশ ও কাল-ভাবনা, যুগবাহিত শিক্ষাদীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও নানা রকম ব্যবহারিক নীতি। রয়েছে চারুকারু, শিল্পকলা, সঙ্গীত, বুদ্ধি ও বোধের আবেদন এবং ধর্মবিশ্বাসের নীতি। লোকালয় সংষ্কৃতিমাত্রই অনুভবেদ্য এবং তা মানসিক। যশোরের লোকায়ত মানবিক সং®কৃতির রূপমাত্র একটি। এই অঞ্চলের জীবনচর্যা ভূমিকেন্দ্রিক। তাই সবকিছু গড়ে উঠেছে ভূমি ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে। নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, সং®কৃতির সর্বাংশেই কৃষিভিত্তিক। অবিভক্ত বাংলার লোকায়ত সং®কৃৃতি সম্পর্কে ডঃ নিহারঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস, আদি পর্ব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন- “লোকায়িত আচারানুষ্ঠানের অনেকগুলিই মুলত গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজের প্রাচীনতম ও আদিমতম ভয়-বিষ্ময়-বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। বাঙালীর এই লোকায়িত ধর্মকর্মানুষ্ঠানের উপাদান-উপকরণ বাঙলার সর্বত্র পথে-ঘাটে বাঙালীর জীবনচর্যার নানা ক্ষেত্রে ইতস্তত ছড়াইয়া আছে।” ডক্টর রায়ের এই উক্তি যথার্থ। এই জেলার লোকজীবন এবং সাংস্কৃতিক রূপ লোকাঅয়ত কৃষিভিত্তিক। স্পষ্টভাবে আমরা লক্ষ্য করি যে এখানকার লোকায়াত সংস্কৃতি ত্রিভৌমক ভাবনাকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে। এই ত্রিভৌমিক ভাবনার মধ্যে রয়েছে- লোয়াকত ধর্মকর্ম, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা, লোকায়ত চারু-কারু ও অন্যান্য শিল্পকলা এবং অদৃষ্টনির্ভর লোকায়ত সাহিত্য রচনা, গীতিকা, ছড়া, ধাঁধা, ভূতপ্রেতের গল্প, পশু-পাখির গল্প, ব্রতকথাসহ নানারকম লোকমুখে প্রচলিত অলিখিত সাহিত্যধারা। আবহমানকাল থেকে বাঙালীর নিজস্ব যে সঙ্গীতধারা বাউল, ভাটিয়ালী, জারি, বারোমাসি, কবিগান, ভাবগান, মুর্শিদী গান, ধুয়ো রাখালিয়া, এই জেলার মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে আজও উচ্চকিত। এই গানের মধ্যে যশোর অঞ্চলের লোকায়িত দর্শনের পরিচয় রয়েছে। যশোর অঞ্চলের লোকায়ত সাহিত্যের ধারা আজও জীবন্ত হয়ে টিকে রয়েছে। এ রকম দাবি আমরা করিনা-তবে বলতে পারি যে, অনেক ভাবসম্পদই এখন আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এককালে যশোর অঞ্চলে শোনা যেত মানিক পীরের গান, গাজীর গান, বন বিবির গান ও সত্যপীরের পাঁচালী। লৌকিক গীত প্রাণতায় যে সুরের ঝঙ্কার মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করে তুলতো- সেই ঝঙ্কার আজ কোনখানেই শোনা যায় না। মুর্শিদ হলে তত্ত্বজ্ঞানী শিক্ষক। মুর্শিদীগান জটিল ও দুর্বোধ্য নয়। প্রাচীন বাংলার কৃষিজীবী সমাজের উৎপাদন পদ্ধতির আওতায় এই গানের উৎপত্তি। মুর্শিদী গানের শ্রেষ্ঠ রূপকার পাগলা কানাই। তার রচনার মধ্যে বিশুদ্ধ মুর্শিদ-মারফতি গান যেমন আছে, তেমনি আছে জারি ও বাউল গান। পাগলা কানাইয়ের গানে নদীমাতৃক বাংলাদেশ এবং কৃষিনির্ভর সমাজের পরিচয় বিদ্যমান। নদীর চিত্রকল্প দিয়েই তিনি তার সাধনতত্ত্বের ব্যাখা রীতি প্রচলন করেছিলেন। পাগলা কানাইয়ের কৃষিজীবন নির্ভর গান একমাত্র তুলনা করা যায় রামপ্রসাদের গানের সঙ্গে। তাঁর গানে ষোল পোয়া জমি চাষ করতে না পারার বেদনা বাক্সময় হয়ে উঠেছে- “একটা কথা শুধাই তোমায় ওরে আমার মন চাষা/তুমি কেন হলে বুদ্ধিনাশা, সর্বনাশা/ এই মানব জমি আবাদ করলে না তাই হলো তোমার দুরদশা/ তুমি ধান না বুনে বুনলে চিনা- বছর ভরে খাবে কিন্যা/ নাই তোমার কোনই ভরসা।” শাক্ত সঙ্গীতের ভাষায় তিনি তুলে ধরেছেন জলদস্যুদের উপদ্রব এবং পরিশ্রমী মানুষের বিষয়সমূহ। সমকালের বহু আলোচিত বিষয়কে উপজীব্য করে তিনি রচনা করেছিলেন তার সাধনতত্ত্ব। তাঁর অধিকাংশ গান সুফিতত্ত্ব বিষয়ক হলেও তার মধ্যে রয়েছে বাউল সাধন তত্ত্বের ধারা। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ্য- “ ও ফুল ফুটেছে বটে, দেখে প্রান চমকে ওঠে ও আচ্ছা মজার ফুল/ সে ফুর নাগরে না সাগরে মহিতাষ করে কুহুকারে, ফুলে ফল ধরে আছে দশমাসে দশযুক্ত, ভাবতে হয় সুক্ত/ সে ফুল যে পাড়ে সেই হবে অন্যেক কি সন্ধান পাবে? কোন কষ্ট কল্পনা নয়- সহজ কল্পনা। আজব গাছই হচ্ছে মানব দেহ। তন্ত্রোক্তো ষটচক্র স্থিত দ্বাদশ দলযুক্ত পদ্মের পূর্ণ বিকাশকেও ফুল ফোটা বলা যায়। বাউলরা রমনী দেতে রজঃ বা ঋতুর আবির্ভাবকে গুহ্যভাষায় বলেন- ‘ফুল ফোটা।’ রজঃশীরা রমণী অর্থই হলো সৃজনশীলতা। কানাই বলেছেণ, “শূন্যোস্থিত ‘এক দোরক্ত’। মাসে মাসে সেই গাছে ফুল ফোটে।” তিনি আরো বলেছেন, “নদীর পাশে এক গাছে ফুল ফোটে আছে জবা।” কিংবা “কালিন্দায় আজব ফুল ফোটে অমাবস্যা-পূর্ণিমায়।” ‘রজঃ”-কে বাউলরা অভিহিত করেছেন- ‘অমাবস্যার উদয়’ বলে। সাপকে রূপক হিসাবে ব্যবহার করে কানাই বলেছেন যে ভাটির জেলা পাটখালিতে গিয়ে সাপধরার উপাখ্যান। সাধককে দেহের নিম্ন দিক থেকে সাধন শুরু করতে হয় এবং ষোলোটা বাঁশের সঙ্গে শক্ত করে পেচিয়ে সাপকে আয়ত্তে আনতে হয়। এর অর্থ হলো যে, দশ ইন্দিয় ও ষড় রিপু নিয়ন্ত্রণ করে দেহকে কামাতীত পর্যায়ে আনতে হয়। এই ভাবনাকল্পনার মধ্যে রয়েছে টোটেম বিশ্বাস। কানাই বলেছেন- “বাগিয়া ছাড়া সর্পধরা কেউ পাইল না ওই জগতে/ নেশ সারে না কাল সাপিনী মন্ত্র গুপেতে/ গুণী যারা যায় তারা আগে বাদিয়ার বাড়ি/ শিখিয়া লয় ফুত পাতা আর এক গাছি জড়ি/ হায়রে মন্ত্রগুণে সর্পব্যাঙে আহার করে একই সাথে।”সতেরো শতকের দ্বিতীয়ভাগ থেকে বাউল মতের আবির্ভাব। উনিশ সতকে লালন ফকিরের মাধ্যমে এই ধর্ম মতের তাত্ত্বিক ও কাব্যিক বিকাশের চূড়ান্ত রূপ ধারণ করেছে। বাউল সাধনা মৈথুন ও যোগতত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। ডক্টর শশীভূষণ দাস গুপ্ত বলেছেন যে, বাউল ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে বৌদ্ধ সহজিয়া, বৈষ্ণব সহজিয়া এবং সুফিবাদ ধারার ঐকিজ্যকে কেন্দ্র করে। সুফিমতের প্রধান দুটি ধারা- মরমিয়া সাধনা এবং কায়া সাধনা। উভয় সাধনার উদ্দেশ্য আল্লাহর স্বরূপের চিন্তা। মরমিয়া সাধনা প্রেমমার্গীয়। এতে যোগ সাধনার প্রভাব নিহিত। কায়া সাধনা দেহকে ভিত্তি করে। বাউল সাধনা জাত পাতের উর্ধ্বে এবং প্রেমভিত্তিক। তারা ঘর ছাড়া বৈরাগী। এটা হলো যোগভিত্তিক। বাউল সাধনার মধ্যে রয়েছে আবার মৈথুনতত্ত্ব। এখানেই গরমিল সুফি সাধনার সঙ্গে। সুফিসাধনায় মৈথুনতত্ত্ব নেই। বাউল সাধনার মিল রয়েছে সহজিয়া সাধনার সঙ্গে। সেহেতু বাউলতত্ত্ব একটা ভিন্নতত্ত্ব। তবে এ প্রসঙ্গে বলা য়ায় যে, বাউল ধর্মে যারা দীক্ষিত হয়েছিলেন, তারা অনেকেই ছিলেন সুফিবদ দ্বারা প্রভাম্বিত। বাউল গানের যখন উদ্ভব ঘটেছে, তখন পুরোপুরি বাংলাদেশ ছিল সুফিবাদে ভাবাপন্ন। বাউল তত্ত্বে রয়েছে ‘মনের মানুষের’ অনুসন্ধান। মনের মানুষকে বাউলরা নানা অভিধায় অভিহিত করেছেন- ‘অধর মানুষ’, ‘অটল মানুষ’, ‘আলেক সাঁই’ ও ‘অচিন মানুষ’। বাউলদের এই ‘মনের মানুষ’ মানবদেহের চিৎ-সত্তার স্বরূপ হিসাবে বিরাজিত। ‘মনের মানুষ’ অদৃশ্য, তাই ‘অধরা মানুস’। সুফিবাদেও আছে এই অদৃশ্য সত্তার তত্ত্ব। আহরদ্দিন নামক একজন বাউল কবি বলেন, “আল্লাহ রূপে সেই অধর, মনের মানুষই ‘ইলা-ই-লাহা, লা শারিকা লা/ ধরতে চাও লা- শারিকা লা/ লাহুত নাছুত মলকুত জবরুত/ পঞ্চমেতে আছে হাহুত/ তার মাঝার এই বারিতা’লা।” প্রসঙ্গক্রমে বলা যায় যে, বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা লালন ফকির। লালন ফরিকেরর অনেক গানে ‘আলেক সাঁই’ বিরাজিত। ‘আলেক সাঁই’ হলেন এক রহস্যময় পুরুষ সত্তা। তিনি ছিলেন সুফিবাদের কাদেরিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত একজন সাধক। তাই তার চিন্তায় ‘আলেক সাঁই’ পরমেশ্বর উপলদ্ধি বিদ্যমান। দাদু বলেছেন, “অলখ অলাহ কা কহ কৈসা হৈ নূর। ‘সাঁই’ শব্দটির অর্থ মালিক বা প্রভু। সুফি সাধকগণ স্রষ্টাকে ‘নিরঞ্জন’ নামে অভিহিত করেছেন। ‘নিরঞ্জন’ শব্দের ভাবার্থ আল্লাহ। লালন বলেছেন, “আগে জান সা ‘কা’ ল্লুলা/ আয়নাল হক আল্লা। যারে মানুষ বলে।’ যিনি স্বীয় সত্তার স্বরূপ উপলদ্ধি করতে পারেন, তিনিই আল্লার স্বরূপ উপলদ্ধি করতে পারেন। লালন বলেছেন, “এই বেলা তোর মনের মানুষ চিনে সাধন কর? মানুষ পালাইবে দেহ ছেড়ে পড়ে রবে শুধু ঘর॥? ঘরের মধ্যে তের তিন তের কোণ দরজা করছে সার।/ ঘরের মধ্যে সাস্তু খুঁটী সেইটা করগা মূলাধার॥” শুধু লালন নয়- অনেক মুসলমান ফকিরের কাছে ‘মারেক আল্লা’ হলেন মনের মানুষ। লালনের গানে যে আরশি নগরের কথা বলা হয়েছে, সুফি সাধকরা ঐ আরশি নগরকে বলে লতিফা। সুফিবাদের মোকামতত্ত্বকে বাউলরা বলেছেন আঠারো মোকাম। ‘এই আঠারো মোকামের বারামখানায়’ আহেদ লাসানি সাঁই- এর অবস্থান।” শেখ চাঁদ তার “তালিবনামা’য় উল্লেখ্য করেছেন যে, “আব আতস-খাক-বাত চারি করে পাক।/ বাপের চারি মানবদেহে-মন-আত্মা আঠারো চিজ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তার মধ্যে মা কর্তৃক প্রদত্ত চারটি চিজ হলো- রক্ত, মাংস, চর্ম ও লোম। পিতা কর্তৃক প্রদত্ত চারটি চিজ হলো- অস্থি, রগ, বিন্দু ও মগজ। সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক প্রদত্ত দশটি চিজ হলো- দৃষ্টি, শ্রবণ, বাক, গন্ধ, আত্মা, লোভ, দীল, বুদ্ধি, ইমা ও বায়ু। এই আঠারো মোকামের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে আরো চার মোকাম- নাসুত, মলকুত, জবরুত ও লাহুত। বাউল সাধনায় মোট কল্পিত অস্তিত্ব দেহের মধ্যে রয়েছে মোট বাইশটি।
‘বাইশ মোকামে রয়েছে ঘোড়া
চৌষষ্ট্র্যি কুঠুরি আছে রসেতে পোরা
মানুষ চৌদ্দভুবন নিশায় ফিরায় রে
মানুষ দ্বিদলে উদয় কিরণ।’
লালনের অনেক গানে বিভিন্ন কক্ষযুক্ত ঘরের বর্ণনা আছে। তার মধ্যে একটি ঘর চার কক্ষবিশিষ্ট। সুফি সাধনার গৃঢ়তত্ত্বে চার কক্ষ ঘরের কথা আছে। প্রথম ঘর- ‘ফানাকিস’, দ্বিতীয় ঘর- ‘ফানাফের’, তৃতীয় ঘর-‘ফানাফিল্লাড’, শেষ ঘরটি- ‘বাকাবিল্লাহ’। প্রথম ঘরটির অর্থ গুরুর মধ্যে বিলীন হওয়া, দ্বিতীয় ঘরটির অর্থ রসুলের মধ্যে বিলীন হওয়া, তৃতীয় ঘরটির অর্থ নূর বা সৃষ্টিকর্তার জ্যোতির মধ্যে বিলীন হওয়া এবং শেষ ঘরটির অর্থ সৃষ্টিকর্তার লয় প্রাপ্তি। লালন এটাকে বলেছেন, “মনের মানুষের মধ্যে নিজেকে বিলোপ।” অর্থাৎ বাউল তত্ত্বে- ‘জ্যান্তে মরা।’ লালনের গানে আছে- ‘ত্রিপিনির তীর ধারে মীনরূপে সাই, চলে ফেরে।’ তিনটি ধারাবিশিষ্ট এক নদীর তীরে একটি ক্রীড়ারত মীন, এই মীনের চিত্রকল্প হলো মনের মানুষ। মীন সাধনার উপযুক্ত সময় সর্ম্পকে তিনি নির্দেশ করেছেন- “মাস অন্তর মহাযোগ হয়।” অর্থাৎ প্রকৃতি দেহের ঋতুকালই হলো সাধনার মোক্ষম সময়। দেহবাদকে সাধনার মধ্যমণি করে নিজের ভাবচেতনা প্রকাশ করেছেন তিনি। লালন ছিলেন সংষ্কারমুক্ত মানুষ। তার কাছে কোন জাতের ভেদ ছিল না। শব্দ ব্যবহারের মধ্যেও ছিল না কোন সম্প্রদায়গত মনোভাব। নিঃসঙ্কোচে তিনি ‘বারো মাসে চব্বিশ ফুল ফোটে’ বলে অভিহিত করেছেন। এই ছিল তার ‘গুহ্য রস সাধনা’। প্রকৃতপক্ষে এই জেলার আধিবাসীদের ধর্মকর্ম-নৃত্যগীত ও সংস্কৃতির ইতিহাস খুঁজলে তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে কৌম জীবনচর্যার আদিরূপ। জীবনচর্যার মধ্যে রয়েছে তাদের পুজো, আচার-অনুষ্ঠান, ভয়, বিশ্বাস ও সংস্কার। আমাদের এখন যা কিছু সাংস্কৃতিক সম্পদ, তার প্রায় সকল অংশ আমরা লাভ করেছি অতীতের আর্য্য- ব্রাক্ষ্মন্য বা বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি সম্প্রদাযের ধর্মকর্ম, শ্রাদ্ধ, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু প্রভৃতি সংক্রান্ত বিশ্বাস সংস্কার ও আচারানুষ্ঠান, নানা দেব-দেবির রূপ ও কল্পনা, আহার-বিহার ও আদব-কায়দা থেকে। হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্মান্তরবাদ, পরলেক সম্পর্কীয় ধারণা এবং তারত পুজা-পার্বণ রীতিনীতির মধ্যে আজও বিদ্যমান রয়েছে কালবাহিত আদিবাসীর জীবন ধারার ঐতিহ্য। অতীতের আদি কৌম সমাজের আদিরূপ, পরবর্তীতে কৃষি ব্যবস্থার রূপান্তরিত রূপ এবং সেই গ্রামীন জীবনব্যবস্থায় বৃক্ষ, পশু, পাথর, ফলমুল ও পাখিতে দেবত্ব আরোপ করে পুজো করা হয়েছে। আজও সামজে প্রচলিত রয়েছে শুভ ও মঙ্গলের প্রতীক হিসাবে আলপনা, ধান দুর্বা দিয়ে আশির্বাবদ, হলুদ-সুপারি পান-নারকে-গোবর-কড়ি-সিন্দুর-কলাগাছ-ঘট কিংবা ঘটের উপর নানা আলপনা বা প্রতীক চিহ্নের ব্যবহার। আজও আমাদের অঞ্চলে অব্যাহতভাবে চলছে গ্রাম-দেশে চড়কপুজো, হোলি, ষষ্ঠীপুজো, চণ্ডীদুর্গা ও মনসার পুজো। মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পৌষ পার্বণ ও নবান্ন উৎসব এখনো সমারোহে পালিত হয়ে আসছে। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আদিম কৌম গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজে। অন্যজেলার মতো এই অঞ্চলে বারমাসের তের পার্বণের নানা রকম আচারানুষ্ঠান প্রচলিত। জেলার বর্ণ, বর্গ ও সম্প্রদায়ের ধর্মভিত্তিক জীবনচারণের মধ্যে রয়েছে ঃ
(১) গ্রাম দেবতা ঃ ধ্বজাপুজা ঃ বৃক্ষপুজো ; গ্রাম বন্ধন অনুষ্ঠান (২) চণ্ডী (ওলা বিবি, সাতবিবির থান) ঃ ষষ্ঠী ঃ শীতলা ঃ মনসা পুজো ও (৩) শস্য উৎসব।
আদিম সামাজিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনভাবনা থেকে উৎপত্তি হয়েছে গ্রামদেবতা। তাই ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম দেবতার অবস্থান লক্ষ্যযোগ্য। সাধারণত গ্রামের প্রান্তসীমায় খোলা আকাশের নিচে কোন বৃক্ষতলদেশে দেবতার থান প্রতিষ্ঠিত। গ্রাম দেবতার পুজোর ব্যাপারে নির্দিষ্ঠ কোন দিনক্ষণ মানা হয় না। মড়ক-মহামারি-অনাবৃষ্টিতে গ্রাম জীবনে সংকট নেমে এলে তার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে দেবতার পুজো করা হয়। ধ্বজা পুজো গ্রামদেবতার নিরাকার প্রতীক হিসাবে রক্ত বর্ণের পতাকা নির্দিষ্ট গাছের ছায়ায় মাটির থানে পুতে রাখা হয়। ধ্বজা পুজো হলো কোন বিশেষ গোষ্ঠীর বিশিষ্ট কৌমগত পুজো। কোন কোন গবেষক উল্লেখ্য করেছেন যে, এই ধ্বজা আদিতে খেজুর বা এ জাতীয় দীর্ঘজীবী বৃক্ষের প্রতীক হিসাবে এসেছে। আজকের চড়কপুজো, ধর্মপুজো, অশত্থ বা অন্যান্য বৃক্ষপুজার গভীর অস্তিত্বে এই বিশেষ ধ্বজাবিশিষ্ট দেবপ্রতীকত্তার আদিম অবশিষ্ট হয়ে জড়িয়ে রয়েছে।
গ্রামবন্ধন ঃ গ্রামবন্ধন অনুষ্ঠান সর্বধর্মমতের। কেউ কেউ বলেন, মুসলিম জীবনভাবনা থেকে এই অনুূষ্ঠানের উৎপত্তি। গ্রাম জীবনকে ভয়ঙ্কর বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য এ এক প্রতœ মানসচেতনা। এই অনুষ্ঠান কৃষিভিত্তিক। গ্রামীণ কৃষিজীবন কোনভাবে বিঘিœত বা মড়ক মহামারিতে কবলিত হলে তারই প্রার্থনা এই গ্রামবন্ধন অনুষ্ঠান। সপ্তাহকালব্যাপী গ্রামের লোক গ্রাম প্রদক্ষিণ করতো। সপ্তাহ শেষে আলো চাউল, দুধ, কলা কোন এক বৃহৎ পাত্রের মধ্যে ঢেলে চটকায়ে সকলকে খাওয়ার জন্য বিতরণ করা হতো এবং গ্রামের চার কোণে বাঁশের খুঁটি পুতে মন্ত্রপুত পাত্রটি বাঁশের আগায় টাঙিয়ে রাখা হতো। মনসাপুজো আদিম অস্ট্রেলিয় নর গোষ্ঠরি কৌম সমাজে নারীর প্রতিরূপ ছিল সাপ। সাপ উর্বরতা বা প্রজনন শক্তির প্রতীক। কৌম সমাজে প্রজনন শক্তির পুজো হিসাবেই মনসা পুজোর উৎপত্তি। মনসা বাস্তুদেবতা, আরোগ্য দেবতা, এবং সম্পদের দেবতারূপে পরিচিত। এ প্রসঙ্গে নীহারঞ্জন রায় বলেছেন, “বাংলাদেশের যেসব মনসা দেবীর প্রতিমা পাওয়া গিয়েছে তাহার প্রায প্রত্যেকটিতে মনসাদেবীর সঙ্গে একাধিক সর্পেও, ক্রোড়াসীন একটি মানবশিশুর একটি ফলের এবং কোথাও কোথাও একটি পূর্ণ ঘটের প্রতিকৃতি বিদ্যমান। ইহাদের প্রত্যেকটিই প্রজনন শক্তির প্রতীক - বাংলার ইতিহাস আদি পর্ব।
খষ্ঠী বা শীতলাপুজো ঃ মানবশিশুর রক্ষাকর্ত্রী এবং কল্যাণদেবী হলেন ষষ্ঠী দেবী। এমনকি সন্তানদের অধিকারও তাঁর। তাই জেলার লোকায়ত হিন্দু গ্রামীণ নারী সমাজের প্রিয় আরাধ্যদেবী হলেন প্রজননশক্তির উৎস ষষ্ঠীদেবী। এই জেলার সব পল্লীর হিন্দুবাড়িতে শিশুর জন্মমুহুর্তে তার রক্ষণ ও কল্যাণ কামনায় ছয় দিনের মাথায় ষষ্ঠী পুজো হয়ে থাকে। ঠিক একই রকমের একটি অনুষ্ঠান মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যেও বিদ্যমান। শিশুর জন্মের ছয়দিন পূর্ণ হলে শিশুর মাথা কামানো, তার নাম রাখা এবং শিশুর কল্যাণের উদ্দেশ্যে একটি অনুষ্ঠান পালন করা হয়। অনুষ্ঠানটির নাম ছয় রাত।
শস্য উৎসব ঃ এই জেলার আদি অস্ট্রেলিয় নরগোষ্ঠীর সমাজে খাদ্য সংগ্রহের উপকরণ হিসেবে কৃষিতন্ত্রের যে সূচনা দেখা যায় এবং তাকে ঘিরে যে লোকায়ত উৎসবের অনুষ্ঠান শুরু হয়, তার নাম শস্য উৎসব। কালে এই লোকায়ত কৃষিকেন্দ্রিক জীবনভাবনাকে নিয়ে গ্রামীণ কৃষিজীবী সমাজে নানা শস্য উৎসবের সূচনা হয়েছে। জেলার লোকায়ত কৃষক সমাজের সর্বপ্রধান শস্য উৎসব হলো নবান্ন উৎসব। এই নবান্ন পর্বাণে মূলত নারী ও শিশুরা বিশেষভাবে অংশ নিয়ে থাকে। এই উপলক্ষ্যে গ্রাম্য শিশুরা ধান লক্ষ্মীকে উদ্দেশ্য করে নানা রকম ছড়া কাটে। এ রকম একটি ছড়া হলো-
‘এমনি করে এসো মা লক্ষী এমনি করে এসো
জনম জনম মোদের ঘরে এমনি চেপে বসো।
এসো মা লক্ষ্মী বড় ঘরে এসো মা চাষার খামারে
উপোস যেনো না যাই মোরা আর কোন বছরে॥’
লোকায়ত গ্রামীণ এই পার্বণ উৎসবে হিন্দু মুসলমান সকলেই অংশগ্রহণ করতো। উল্লেখ্য যে, ধানকে কৃষকরা লক্ষ্মী বলে ডাকে। এ রকম আরো অনেক অনুষ্ঠানের খোঁজ পাওয়া যেতে পারে। তুর্কী আক্রমনের পর বাংলাদেশের হিন্দু মুসলমান দীর্ঘকালব্যাপী পাশাপাশি বাস করে আসছে। এখানে ধর্মীয় ব্যাপারে কোন সংঘাত সৃষ্টি হয়নি। বরং উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ভাববিনিময়ের বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় বিদ্বেষের অচলায়তন ভেঙ্গে গড়ে উঠেছির এক নতুন সাংস্কৃতিক ঐক্য। বাংলায় ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু হয় সম্ভবত নবম শতকে। অর্থাৎ বাংলায় তখন চলছিল পাল বংশের শাসন। সুকুমার সেন বলেছেন, ‘সেক শুভোদয়ার গল্প কাহিনীতে যদি কিছু সত্যের অস্তিত্ব মানা হয়, তবে স্বীকার করতে হবে যে, বাংলাদেশে মুসলমান অধিকারের আগে থেকেই মুসলমান সাধুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুসন্তদের প্রভাব অনুভুত হচ্ছিল। পরাজয় হলে, বাধ্য হয়ে সবদেশের লোকেই সবকালে তা’ স্বীকার করেছে। আমাদের দেশে তার চেয়ে বেশি করেছে, শুধু স্বীকার করেনি- বিধির অমোঘ বিধান বলে নিশ্চয় করে মেনে নিয়ে পূর্বাগত জীবন ধারাকে যথাসম্ভব নিস্তরঙ্গ রাখতে চেয়েছে। নিজের দোষকে অদৃষ্টের উপর চাপিয়ে হাফছাড়া আমাদের প্রকৃতিগত অভ্যাস। সেই অভ্যাসের বশে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যে মুসলমান শাসনকে স্বীকার করে নিয়ে তাকে জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে গোড়া থেকেই চেষ্টা করবেন তা বিষ্ময়ের কথা নয়। ইসলাম ধর্মের প্রচারকেরা বাংলার নিম্নবর্ণ ও নিম্নজাতির জন্য একটা মিলন ভুমি যে তৈরি করেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। এই ধারণা মতে বলা যায় যে, যশোরে ও তুর্কী আগমনের আগে থেকেই ইসলাম প্রচারের জন্য পীরদরবেশেরা আস্তানা পেড়েছিলেন। এবং ইসলাম ধর্মের সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধের কারণে এখানকার সাধারণ নিম্নবর্ণের মানুষ ইসলাম ধর্ম স্বেচ্ছায় গ্রহণ করে। ধর্মান্তরিত হওয়ার কার্য কারণের মধ্যে ছিল হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ ও বর্ণভেদ প্রথা। শুধু যে হিন্দুরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন তা নয়- বৌদ্ধরাও ধর্মান্তরিত হয়েছিল। যারা এদেশে ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন, তারা ছিলেন প্রায় সকলেই সুফী মতাবলম্বী। সেইহেতু হিন্দু সমাজের অনেক রীতি নীতি মুসলিম সমাজে সহজেই অনুপ্রবিষ্ট হয়। এ ব্যাপারে সুফী মতাবলম্বীরা ধর্মের ক্ষেত্রে ইসলামী আচার-আচরণ প্রয়োগের পক্ষে কখনো কঠোরতা দেখাননি। তারা যেমন ছিলেন হিন্দু রীতিনীতির প্রতি সহনশীল তেমনি ছিলেন উদারনীতির প্রতি বিশ্বাস। বরং ধর্মের গোড়ামী থেকে মুক্ত হওয়ার বাণী প্রচার করেছিলেন। এই কারণে ইসলামের শিকড় গেড়ে উঠেছিল সুফি মতাদর্শের ওপরেই। তাই দেখা যায় মুসলমানদের মধ্যেও ধর্ম নিয়ে কোন্দল শুরু হয়েছিল। একদিকে ছিলেন উলেমারা- অন্যদিকে ছিলেন সুফীরা। গোটা চতুর্দশ শতাব্দীর গোড়া থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চলেছিল উলেমাদের সঙ্গে সুফীদের ধর্ম নিয়ে বিরোধ। উলেমারা ছিলেন কুরআন-সুন্নাহর ধ্যান ধারণার বাহক- আর সুফীরা ছিলেন আধ্যাত্মিক গুরুবাদী। সুফীদের মধ্যে চিস্তিয়া ও ফিরদৌসী তরিকার পীর কামেলরা এমন সমস্ত ধ্যান-ধারণা ও আচার-পদ্ধতির সমর্থক ছিলেন, যেগুলো ছিল হিন্দুধর্মের ধ্যান-ধারণা ও আচার-বিচারের অপেক্ষাকৃত নিকটবর্তী। যশোর জেলায় এই গুরুবাদীদের অসংখ্য আস্তানা বিদ্যমান ছিল। এই আস্তানাগুলো এখনো পীরের দরগাহ বা পীরের থান নামে পরিচিত। এই দরগাহ বা থান হয়ে উঠেছিল অদৃষ্টনির্ভর ভাববাদী হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের তীর্থক্ষেত্র। যশোর জেলায় অনেকক্ষেত্রে বিশেষ করে কৃষি সমাজে একটা মিশ্র সংস্কৃতির উদ্ভব ঘটেছিল। বোশেখ মাসে ধান বপনের ক্ষেত্রে এবং ফসল কর্তনের পর ধান গোলায় রাখার ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক প্রথা ছিল একই প্রকৃতির। বোশেখের শুরুতেই ক্ষেতে ধান বোনার হিড়িক পড়ে যেত। যেদিন কৃষকরা মাঠে বীজ ছগিয়ে দিত এই বীজ ছড়িয়ে দেওয়াকে বলা হতো ধান মুষ্ঠি। এবং ওই দিন চাষী গৃহস্থের বাড়িতে নানা রকমের শাক সংগ্রহ করে শাক ভাত খাওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত ছিল। আবার ফসল যখন ঝাড়াই-মাড়াই করে গোলায় তুলতো তখন গোলার দরজার উপরের কাঠে সিঁদুর দিয়ে লক্ষ্মীর প্রতীক চিহ্ন এঁকে শুরু হতো ধান তোলার পালা। মুসলমানদের অবশ্য বারো মাসে তের পার্বণ ছিল না। তবুও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যেত হিন্দু পালা-পার্বণে মুসলমানদের অংশগ্রহণ করতে। বিশেস বিশেস দিবসে মুসলমানদের ছিল নিজস্ব ধর্মীয় উৎসব। ঈদ ও নবী দিবস ছাড়াও মুসলমানরা ছিল আর একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান গুরুত্বের সঙ্গে পালন করতো। এই অনুষ্ঠান ছিল মিলাদ মাহফিল। মিলাদ অনুষ্ঠানটি চালু করেন পারস্য থেকে আগত ধর্মীয় গুরুরা। এই অনুষ্ঠানুটি একমাত্র ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পারস্য দেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন দেশের মুসলমানেরা পালন করেন না। এই অনুষ্ঠানটি সম্পূর্ণই একটি গুরুবাদী অনুষ্ঠান। যশোর জেলায় পারসা থেকে আগত অনেক পীর-দরবেশ এসে আস্তানা গেড়েছিলেন। সেই হেতু এই অনুষ্ঠানটি এই জেলার মুসলমানরা গুরুত্বের সঙ্গে নিষ্পন্ন করেন। কোন কোন স্থানে পীর-দরবেশের মাজারও ভক্তিবাদীদের আঁখড়া হয়ে উঠেছির। মূলত সুফীরা ছিলেন ‘মজহাবে ইশকি’। তাদের নিজস্ব ধর্মীয় ধ্যান-ধারণা থাকলেও সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতা ধর্ম বিশ্বাসে ছিল না। প্রেমই তাদের সমাজ। সুফীবাদের উৎস পরিপূর্ণ ইসলামী ধ্যান-ধারনা থেকে নয় তবে ইসলামকে ঘিরেই তার প্রসার ঘটেছে। বাংলায় সুফী সাধনা কোরান শাসিত নয়। বাংলার সুুফী কবিগণ বৌদ্ধ-বৈষ্ণব-নাথ প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সাহিত্য ও শাস্ত্রের মধ্যে যেখানেই খুঁজে পেয়েছেন ভাব ও দর্শনের মিল সেখানেই তারা সংস্কারমুক্ত মনে সেই আদর্শ গ্রহণ করেছেন। সুফীরা তাদের ধর্মের মূল স্রোত থেকে সরে এসে বাংলাদেশে সর্বধর্ম সমন্বয় করেছিলেন। এ কথা মনে করার কোন হেতু নেই। তারা ছিলেন উদারপন্থী কিন্তু একেশ্বরবাদী। তাদের দর্শনের মূলকথা আল্লাহর একত্ব ও অদ্বিতীয়ত্ব। যশোরে যারা সুফী দর্শনের সাধনা করেছেন তারাও ছিলেন একই পথের অধিকারী। ধর্মীয় প্রেরণা থেকেই সৃষ্টি হয়েছিল মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব সাহিত্য, নাথ, সহজিয়া সাহিত্য ও শাক্ত সাহিত্য। এই জেলায়ও অনুসন্ধান করে পাওয়া যায় বৈষ্ণব সাহিত্য, সহজিয়া সাহিত্য এবং শাক্ত সাহিত্য। একেশ্বরবাদী কবিরা সাকারভাবে কৃষ্ণ উপাসনা করেছেন, রাধাকে কৃষ্ণের ‘হলাদিনী’ শক্তি ভেবে রাধাকৃষ্ণের যুগ্মতনুকে গোপীভাবে সেবা করেছেন এমন অনুমান কষ্ট কল্পনামাত্র। এই জেলার শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব কবি সনাতন গোস্বামী। তিনি অনেক পদ রচনা করেছিলেন। শ্রী চৈতন্য প্রবর্তিত উদার অসাম্প্রাদায়িক প্রেমধর্ম সনাতন গোস্বামীকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি রাজপদ পরিত্যাগ করে বৈষ্ণব মতে বিশ্বাস অর্জন করেন। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন তার ভ্রাতা রূপ গোস্বামী এবং ভ্রাতুষ্পুত্র জীব গোস্বামী। বৈষ্ণব সাহিত্যে তাঁরা আজও অমর হয়ে আছেন। জারি ও কবি গানের দেশ হিসাবে যশোরেরও আরও একটি পরিচয় রয়েছে। এই জেলায় এখনো গ্রামগঞ্জ জারিগান ও কবি গানের ঝঙ্কার শোনা যায়। এক সময় ঝুমুর গানও শোনা যেত যশোরের বিভিন্ন পল্লীতে। শোনা যেত কীর্তনের বোলও। একসময় যশোরের কিন্নর সম্প্রদায় নৃত্য এবং গানের সুরে উভয় বাংলায় একটা সাংস্কৃতিক জোয়ার এনেছিল। এ রকম আরো অনেক দৃষ্টান্ত উল্লেখ্য করা যায়। মোটের উপর এইটুকু বলা চলে যে, বাংলার কৃষি সংস্কৃতির মূলসূত্র অনুসন্ধান করলে এই জেলার এই সব কৃষিভিত্তিক লোকায়ত সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠান ও পার্বণের বহু অজানা তথ্যের আমনা সন্ধান পেতে পারি। পরিশেষে বলতে চাই, যশোর জেলাা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জেলা। এই জেলায় লোকায়ত সংস্কৃতির বহু উপাদান ও নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে চারুকারু ও অন্যান্য শিল্পকলার আলপনা, নকসী কাঁথা, মৃৎশিল্প, পটচিত্র, বিয়ের গান, ধাঁধা, ছড়াগান, ঢাকঢোল কাঁসি ও নানারকম বাদ্যযন্ত্র। এগুলোর বিস্তারিত আলোচনা এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে সম্ভব নয়। তবে আমি মনে করি যে, বিশ্ব সংস্কৃতির সার্বভৌম প্রতিমা নির্মাণে মানবিক সত্তার অন্তর্লীন প্রবাহে যশোর জেলার লোকভাষা ও লোকায়ত সংস্কৃতির এক মহান অবদান রয়েছে।
তথ্যসূত্র: যশোরাদ্য দেশ
লেখক: হোসেন উদ্দিন হোসেন