
Home ঝিনাইদহ জেলা / Jhenidah District > মুক্তিযুদ্ধ - ঝিনাইদহ / Liberation - Jhenaidah
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99929 বার পড়া হয়েছে
মুক্তিযুদ্ধ - ঝিনাইদহ / Liberation - Jhenaidah
মুক্তিযুদ্ধ - ঝিনাইদহ
Liberation - Jhenaidah
মুক্তিযুদ্ধ বলতে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকেই বোঝায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিমা খানসেনাদের বিরুদ্ধে যে সর্বাত্নক প্রতিরোধ ও পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল সেই দীর্ঘ সশস্ত্র সংঘর্ষকে মুক্তিযুদ্ধ বলা হয়ে থাকে।
তবুও মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি ব্যাপক। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুগে যুগে এতদঞ্চলের নেতৃস্থানীয় যে মুক্তি সংগ্রাম সূচিত হয়েছিল, অগ্নিযুগের অগ্নিপুরুষ হরিণাকুন্ডুর সন্তান বাঘা যতীন তার জন্মের গৌরব ধন্য করে ঝিনাইদহে সেই মুক্তি মশালের দীপ্ত শিখা প্রজ্জ্বলিত করে রেখে গিয়েছিলেন।
তাঁরই উত্তরসূরী ঝিনাইদহের অধিবাসী ১৯৭১ সালে বারুদের স্তুপের মতো একযোগে বিষ্ফোরিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিশিখা জ্বেলেছিল শহরে-বন্দরে, গঞ্জে-গ্রামে।
স্তর বিন্যাসঃ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ধারাকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথম অসহযোগসহ প্রস্তুতি পর্ব, দ্বিতীয় প্রতিরোধ পর্ব, তৃতীয় নয়মাসের গেরিলা আক্রমণ ও চতুর্থ সশস্ত্র সম্মুখ সমরে বিজয় অর্জন।
এই চারটি পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইদহরে গুরুত্ব ও ভূমিকা সমধিক এ কারণে যে, পাকবাহিনীর কাছে ঝিনাইদহের পতন ঘটতে যেমন বিলম্ব হয়েছিল তেমনি ঝিনাইদহ পাক হানাদার মুক্ত হয়েছিল সত্বর। ১৬ই এপ্রিল ১৯৭১ ঝিনাইদহ পাক হানাদার কবলিত হয় এবং ৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পাক হানাদারদের হিংস্র থাবা থেকে মুক্ত করা হয় ঝিনাইদহকে। ঝিনাইদহের পতন ঘটাতে সুসজ্জিত সশস্ত্র পাক বাহিনীকে যে পরিমাণ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল অন্যত্র বোধ করিবা ততো ক্ষতি স্বীকার করতে হয়নি। পাক বাহিনীর সশস্ত্র তিন প্লাটুন সৈন্য কনভয় যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়েছিল মুক্তিকামী মানুষের প্রতিরোধ ব্যুহভেদ করতে। কিন্তু তাদের অধিকাংশই আর যশোর ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে পারেনি। তাই যশোর ক্যান্টনমেন্টের জিওসি প্রতিশোধমূলক আক্রমণ চালিয়েছিল ঝিনাইদহে সর্বাধিক। ফলে ঝিনাইদহ শহরের দোকান পাট ভস্মীভূত হয়েছিল, ধুলসাৎ হয়েছিল, প্রধান সড়কের আশপাশের গ্রামগঞ্জে আগুন জ্বলেছিল দাউ দাউ করে।
প্রস্তুতি পর্বঃ তদানীন্তন পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান যখন এই মর্মে রেসকোর্সের “এবারের সংগ্রাম- স্বাধীনতার সংগ্রাম” এবং “ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল” বলে আহবান জানালেন তখন ঝিনাইদহেও অবরোধের প্রস্তুতি ব্যাপক আকারে শুরম্ন হয়ে যায়। ৩ মার্চের গোপন নির্দেশের পর আওয়ামীলীগ অসহযোগসহ অবরোধের প্রস্তুতি নিতে থাকে এবং ঝিনাইদহে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এই সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক ছিলেন এ কে এম আব্দুল আজিজ এমসিএ, এবিএম গোলাম মজিদ এমজিএ (সদস্য), কাজী খাদেমুল ইসলাম (সদস্য), নুরুন্নবী সিদ্দিকী (সদস্য), এহিয়া মোল্যা (সদস্য), জনাব আব্দুল গফুর (শহীদ সদস্য), জনাব আব্দুল আমেন (সদস্য), জনাব সাজেদুর রহমান (সদস্য), মোঃ শহীদুল্লাহ (সদস্য), জনাব তাইজুদ্দিন (সদস্য), জনাব সিরাজুল হক (সদস্য), জনাব সিরাজুল ইসলাম (সদস্য) প্রমুখ।
১৭ মার্চ ১৯৭১ থেকে প্রকৃত পক্ষে এই সংগ্রাম পরিষদ কাজ করে। তাঁরা দিকে দিকে অবরোধ ও সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই ক্ষেত্রে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আগত ছাত্র নেতৃবৃন্দ অসহযোগ আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণকে সংঘবদ্ধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তাঁরা ঝিনাইদহ শহরে আলী ফার্মেসীতে এক গোপন বৈঠকে ঝিনাইদহ মহকুমার ছাত্রলীগের সভাপতি জনাব শহীদুল আলম জোয়ার্দার (বকুল), সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক আহমেদ, কে সি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি আঃ হাই, সাধারণ সম্পাদক মকবুল হোসেনসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাকে প্রতিরোধমূলক আন্দোলনের নির্দেশ দিয়ে যায়।
প্রতিরোধ পর্বঃ এরপর এলো সেই ২৫ মার্চের কালো রাত্রি। রাত ১০টার ভিতরেই সর্বত্র খবর ছড়িয়ে পড়ল যে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে সশস্ত্র পাক বাহিনী ট্যাংকসহ বেরিয়ে গিয়ে আক্রমণ চালিয়েছে পিলখানায়, ইপিআর কেন্দ্রে ও রাজার বাগ পুলিশ লাইনে। এ সংবাদ সকলকে উত্তপ্ত করলে এম. সি. এ. আজিজ সাহেব যশোরের এম. এন. এ. মশিউর রহমান সাহেবের সাথে যোগাযোগ করলেন। মশিউর রহমান সাহেব জানালেন, যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাক বাহিনী বেরিয়েছে যশোর শহরে হানা দিতে। ফলে সাথে সাথেই ঝিনাইদহে প্রতিরোধের আগুন জ্বলে উঠলো। আজিজ সাহেব ছুটে গেলেন তখনকার মহকুমা পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিন আহমদের কাছে, সভা বসলো থানাতে। প্রতিরোধের প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো ২৫ মার্চ রাত ১১ টায়। এস. ডি. পি. ও মাহবুব ও কাঞ্চন ঘোষাল দ্রুত থানার ‘কোষ’ অস্ত্রাগার খুলে জনসাধারণের মধ্যে অস্ত্র বিলি করে দিলেন এবং ট্রেনিং গ্রহণ করে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য সকলকে আহ্বান জানালেন। ২৫ মার্চ রাতেই থানা ও ট্রেজারীর অস্ত্রাগার খুলে চারশত রাইফেল পুলিশ ও আনছার সহ জনসাধারণের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হয়।
সাথে সাথে এস. ডি. পি. মাহবুব সাহেব যশোর থেকে টেলিফোন করলে যশোর টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে সামরিক কনভয় মুভমেন্ট এর খবর তাকে দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের এই পর্যায়ে বলা যেতে পারে প্রতিটি টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ছিল জনসাধারণের প্রকৃত গণমাধ্যম। এদের সাহায্যে পাকসেনাদের যেকোন গতিবিধির খবর দ্রুত মুক্তিকামী জনসাধারণের নিকট পৌঁছে যেত এবং গিয়েছিলও তাই তেমনি সেদিন।
ফলে কৌশল গত কারণে যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে সামরিক কনভয়ের অগ্রযাত্রা ঝিনাইদহের সন্নিকটবর্তী হলে এসডিপি ও মাহবুব সাহেব তার পুলিশ দল ও সহযোগীদের নিয়ে প্রথম পর্যায়ে আত্নগোপনের কথা ভাবেন। কনভয় ঝিনাইদহে পৌঁছাইলে অকস্মাৎ গোটা ঝিনাইদহে বিদুৎ বন্ধ করে ব্লাক আউট করে দেওয়া হয় এবং মাহবুব সাহেবের নেতৃত্বে মুক্তিকামী সশস্ত্র ব্যক্তিবর্গ ক্যাডেট কলেজের বিপরীতে মাঠের মধ্যে অন্ধকারে আত্নগোপন করে। পাকসেনারা থানা ও অন্যত্র কোথাও কারো কোন হদিস না পেয়ে কুষ্টিয়ার দিকে চলে যায়। ২৬ মার্চ সকালে টিক্কা খানের বেতার ভাষণের পর প্রতিরোধের ধারা আরো উত্তপ্ত হলো। এসডিপিও মাহবুব ঝিনাইদহের আপামর জনসাধারণকে পোস্ট অফিসের সামনে সমবেত করে মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে এক জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। সাথে সাথে ছাত্র -জনতা দিকে দিকে প্রতিরোধ সংগ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। ঐ দিনই ঝিনাইদহ মহকুমার ভারপ্রাপ্ত এসডিও জনাব নেফাউর রহমান, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ এম. এম. রহমান, উপাধ্যাক্ষ করিম উদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক আঃ হালিম সহ অধিকাংশ উচ্চ পদস্থ সরকারী কর্মচারী মুক্তি সংগ্রামে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। তারপর ২৭ মার্চ থেকে সর্বত্র প্রতিরোধ, এই প্রতিরোধ প্রক্রিয়ায় কেসি কলেজ প্রাঙ্গনে ছাত্র- শিক্ষক-বুদ্ধিজীবিসহ মুক্তিকামী জনসাধারণের ট্রেনিং চলতে থাকে।
২৩ মার্চ পাকিস্তানে প্রজাতন্ত্র দিবসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে যে প্রতিবাদ ঝিনাইদহে সূচিত হয় তা রূপান্তরিত হয়েছিল প্রতিরোধে। পাকসেনাদের চলার পথে প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। ব্রীজ, কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বা গর্ত খুড়ে ফাঁদ তৈরী করার চেষ্টা করা হয়। গাড়াগঞ্জের ব্রীজে এমনি এক ফাঁদে আটকে গেল কুষ্টিয়া ফেরৎ পাক কনভয়। হতবুদ্ধি পাকসেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে অনাহারে মুক্তিকামী গ্রামবাসীদের হাতে ধরা পড়ে নিহত হলো। এ সময় কন্যাদহে প্রচন্ড যুদ্ধ হয় মুক্তিযোদ্ধা ও পাকসেনাদের মধ্যে। এই যুদ্ধে বর্তমান বিএনপির জেলা সেক্রেটারী জেনারেল সংসদ সদস্য জনাব মশিউর রহমান বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে পাকসেনাদের অনেককে খতম করেন। এ ক্ষেত্রে জনাব মশিউরের নেতৃত্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। গাড়াগঞ্জ, কন্যাদহের যুদ্ধসহ অন্যান্য মুক্তি সংগ্রামে আর যে দুই ব্যক্তিত্বের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করতে হয় তারা হলো ছাত্রনেতা গোলাম মোস্তফা ও নৌবাহিনী ফেরৎ মুক্তিযোদ্ধা জনাব নায়েব আলী। এ দিকে পলাতক বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই পি আর সদস্য ও আনসার বাহিনীর জোয়ানরা জনসাধারণের সাথে হাত মিলালেন। ফলে প্রতিরোধ সংগ্রাম হলো দুর্জয়। যশোর থেকে আগত কনভয়-এর গতিরোধ করার জন্য কালীগঞ্জ ও বিষয়খালীতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা হলো। কালীগঞ্জের প্রতিরোধের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম এম. এন. এ এবং ঝিনাইদহে মূলতঃ এস. ডি. পি. ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তীতে মেজর মাহবুব)।
২৩ মার্চ কালীগঞ্জে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠানে ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম বক্তৃতা প্রসংগে বলেছিলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যদি তার সন্তানদের জীবন বিসর্জন দিতে হয় তবে তিনি তার জন্যও প্রস্তুত।” তাঁর সেই বক্তৃতা সত্যে পরিণত হয়েছিলো। বিষয়খালীর যুদ্ধে তার এক পুত্র গোলাম মোস্তফা এবং অন্যত্র আর এক পুত্র আলেকজান্ডার পাকসেনাদের গুলীতে শহীদ হন।
১ এপ্রিল ১৯৭১-এ শুরু হলো বিষয়খালীর প্রতিরোধ সংগ্রাম। এই সম্মুখ সংগ্রামে ই পি আর ও জনসাধারণ ৩০৩ রাইফেল নিয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল, পক্ষান্তরে সুসজ্জিত সশস্ত্র পাকবাহিনী ভারী কামান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেও দুপুরের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈতিক শক্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করে ব্যর্থতায় গ্লানি নিয়ে ফিরে গিয়েছিল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। বিষয়খালীর ব্যারিকেড ও ব্রীজ তারা অতিক্রম করতে পারেনি। এ যুদ্ধের খবর সে সময় বিশ্বব্যাপী গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছিল।
বিষয়খালীর যুদ্ধ জয় ছিল প্রকৃত পক্ষে মুক্তিকামী জনতার বিজয় এবং একে কৌশলগত বিজয়ও বলা যেতে পারে। ঝিনাইদহে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী এসডিপিও মাহবুব সাহেবের ভাষায়ঃ “২০টি মাইকসহ জয়বাংলা শ্লোগান দিয়ে জনতা এগিয়ে গেলে পাকবাহিনী তাকে লক্ষ জনতার ঢলের প্রতিরোধ বলে ভেবে নিতে বাধ্য হয়ে এতো বড় জনপ্রতিরোধ রুখতে সাহস পায়নি। ফলে তারা পিছু হটে।” বস্তুতঃ মাহবুব সাহেবের রণকৌশলগত চাতুর্য বিষয়খালীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
এরপর প্রতিরোধ অব্যাহত থাকে। কিন্তু ১৬ এপ্রিল অন্যান্য স্থানের মত ঝিনাইদহের পতন হয় পাকসেনাদের হাতে। তখন মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী নেতৃবর্গ চুয়াডাঙ্গার পথে দেশ ত্যাগ করে আশ্রয় নেয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রে। সেখানে তারা সংগঠিত হয়ে গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন হবে বলে নেতৃবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় তারা ঝিনাইদহে অবস্থিত ন্যাশনাল ব্যাংকসহ অন্যান্য ব্যাংক ও ট্রেজারী থেকে প্রায় সমুদয় টাকা ও সোনা তাদের সাথে নিয়ে যায়। এ টাকার পরিমাণ প্রায় আড়াই কোটি এবং তারা দুই কেজি সোনাও নিয়ে যায়।
২৮ মার্চ ঝিনাইদহ দিয়ে কলকাতায় গিয়েছিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তাঁর সাথে ছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম। জনাব তাজউদ্দিন ছদ্মনাম মোহাম্মদ আলী ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম-রহমত আলী ছদ্মনামে সীমান্ত অতিক্রম করেন। তাদের সীমান্ত অতিক্রমে সহায়তা করেন এমসিএ আব্দুল আজিজ সাহেব ও এসডিপিও মাহবুব সাহেব। তাজউদ্দিন সাহেব ও আমিরুল সাহেব নিজেদেরকে মোহাম্মদ আলী ও রহমত আলী বলে পরিচয় দিলে এসডিপিও মাহবুব সাহেব অনুরূপ ভাষায় বলেছিলেন, “আমি অধম কেরামত আলী”।
এরপর এপ্রিলের কোন এক সময় ঝিনাইদহ হয়ে কলকাতায় গিয়েছিলেন পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মন্ত্রী শ্রী ফনি মজুমদার ও জনাব আব্দুর রব সেরনিয়াবাৎ।
বিষয়খালীর যুদ্ধঃ
১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার ১৯৭১ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ ব্যুহভেদ করার জন্য যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ভারী কামান ও মেশিনগান সজ্জিত হয়ে এক সশস্ত্র কনভয় বারোবাজার ও কালীগঞ্জের পতন ঘটিয়ে এগিয়ে এল ঝিনাইদহের দিকে। কিন্তু বিষয়খালীর নিকট বেগবতী নদীর দক্ষিণ তীরে তাঁরা হলো বাঁধাপ্রাপ্ত। মোবারকগঞ্জ চিনি কলের সামনে পাকবাহিনী হত্যা করেছিল ঝিনাইদহ নিউ একাডেমীর মুক্তি পাগল কিশোর ছাত্র ইকবাল আনোয়ারুল ইসলামের পুত্র আলেকজান্ডারকে। কিন্তু বিষয়খালীতে এসে শুধু হত্যা নয়, প্রতিরোধের মুখে অনেকেই নিহত হলো পাক সেনাদের। মুক্তিসেনারা বিষয়খালীর ব্রীজের ক্ষতিসাধন করে রেখেছিল, তদপুরি মুসলিম লীগের সদস্য আমির মিয়ার সহায়তায় বড় বড় গুড়ি কেটে নদীর দক্ষিণ দিকে দুর্লংঘ্য ব্যারিকেড সৃষ্টি করে রেখেছিল। এদিকে মুক্তিবাহিনী প্রধান মাহবুব সাহেব ঝিনাইদহ সদর হাসপাতালে বেঙ্গল রেজিমেন্টের এবং ইপিআর-এর আহত জোয়ানদের অবস্থা দেখতে ব্যস্ত ছিলেন। তখন তিনি আরএমও ডাক্তার নাজির হোসেন, হেলথ অফিসার ডাঃ আব্দুল হাকিম, ডাঃ আজিজ, ডাক্তার নির্মল প্রমুখের সঙ্গে আলাপে রত। এমন সময় দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ হঠাৎ খবর আসলো হানাদার বাহিনীর বিষয়খালী আক্রমণের। তড়িৎ গতিতে তিনি প্রতিরোধ বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলেন বিষয়খালী অভিমুখে। উভয়পক্ষে সামনা সামনি যু্দ্ধ হলো। এটাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম সম্মুখ সমর। ভীষণ যুদ্ধ সংঘটিত হলো ঠিক দুপুর একটার সময়। পাক সেনাদের মনোবাঞ্ছনা পূর্ণ হলো না। আমাদের তরুণরা অনভিজ্ঞ এবং ভারী অস্ত্রও তাদের ছিল না। কিন্তু তাতে কি। মাতৃভূমির পবিত্রতা রক্ষা করতে তারা মরণকে হাসিমুখে বরণ করতে রাজী। কামানের গোলা ব্যর্থ হয়ে গেল তাদের অসীম সাহসের কাছে। হানাদার বাহিনী অতিক্রম করতে পারলো না বিষয়খালীর নদী, তারা ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল যশোর ক্যান্টনমেন্টে। যাওয়ার পথে চালালো হত্যাযজ্ঞ, ঝিনাইদহের অমিততেজী দামাল তরুণ দল বাংলাদেশের ইতিহাসে যুদ্ধ বিজয়ের গৌরবের প্রথম মাইল ফলক স্থাপন করলো এই বিষয়খালীর যুদ্ধে। এই যুদ্ধের কাহিনী প্রথম বিদেশী রেডিও বিবিসি, ফরাসী বার্তা সংস্থা এবং অস্ট্রেলীয় রেডিও এবিসিতে প্রচারিত হয়। এই সম্মুখ যুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন যশোর সেনানিবাস ফেরৎ বেঙ্গল রেজিমেন্টের এবং ইপিআর-এর জোয়ানরা। বাহিনী প্রধান ছিলেন মাহবুব সাহেব। এই যুদ্ধে শাহাদৎ বরণ করেন আনসার বাহিনীর সদর উদ্দীন, দুঃখু মোহাম্মদ, আব্দুল কুদ্দুস, খলিলর রহমান, নিউ একাডেমীর ছাত্র এবং এম এন এ ইকবাল আনোয়ারুল ইসলামের পুত্র গোলাম মোস্তফা, ভুটিয়ারগাতীর কাজী নাজির উদ্দিন এবং আরো কয়েকজন। ঝিনাইদহ মুক্ত এলাকারূপে থাকলো। এ অবস্থা চললো ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য ও রসদ সরবরাহ করছিল গ্রামের জনগণ, এর নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাডেট কলেজের অধ্যক্ষ লেঃ কর্ণেল এম এম রহমান (শহীদ), ভেলুমিয়া, মশিউর রহমান প্রমুখ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এই অবস্থার সমন্বয় সাধনে এক সময় এগিয়ে আসেন ঢাকা থেকে আগত আওয়ামীলীগ নেতা এম এন এ জনাব কামরুজ্জামান।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে এসডিপিও মাহবুব সাহেব মুক্তিবাহিনী প্রধান হিসাবে লিখিত নিয়োগপত্র সহকারে মোশারফ হোসেন, ঝিনাইদহ থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান রফিক দাদ রেজা ও মহকুমা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিক আহমেদকে লিয়াঁজো অফিসার নিয়োগ করে কলকাতা পাঠালেন খাদ্য ও ঔষধ আনার ব্যবস্থা করতে।
বিষয়খালীর যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে পাক বাহিনী ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহের উপর চালালো প্রচন্ড সাঁড়াশি আক্রমণ। ঐ দিনই পতন হলো ঝিনাইদহের পাক সেনাদের হাতে।
ঝিনাইদহের পতনের পর কয়েকজন সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বের করতে লাগলো। তাদের হাতে নিহত হন মহকুমা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ আঃ গফুর, গোলাম মহিউদ্দিন, সাংবাদিক শেখ হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
গেরিলা আক্রমণঃ
মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দানকারী নেতৃবর্গ প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিয়ে কলকাতা কেন্দ্রীক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে। এই চেষ্টার ফলশ্রুতিতে ভারত সরকারের সহায়তায় কল্যাণী, বনগাঁ ও বেতাই-এ-মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং-এর দায়িত্বে ছিলেন লেঃ মতিউর রহমান ও ফাইন্যান্স ডিরেক্টর এবং মূল তত্ত্বাবধানে ছিলেন জনাব ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম এন.এন.এ। তাঁদের নিকট থেকে ট্রেনিং ও রসদ পেয়ে গোলাম মোস্তফা, বকুল প্রমুখ মুক্তিযোদ্ধারা মাঝে মধ্যে ঝিনাইদহ, কোটচাঁদপুর, শৈলকুপা এলাকায় গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের বিব্রত করে রাখতো। জুনের মাঝামাঝি মুক্তিযুদ্ধে ভাটা পড়লো। ঝিনাইদহে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। তবুও শৈলকুপা আবাইপুর, ইত্যাদি এলাকায় মাঝে মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ চলতে থাকে।
বেতাই ক্যাম্পে ভারতীয় ব্রিগেডিয়ারের সহায়তায় প্রায় এক হাজার মুক্তিযোদ্ধার ট্রেনিং দিতেন ঝিনাইদহ সরকারী কে. সি. কলেজের কলেজের সহকারী অধ্যাপক তদানীন্তন মুক্তিযোদ্ধা জনাব গোলাম মোস্তফা।
পাকবাহিনী ঝিনাইদহ দখল করে নেওয়ার পর কিছু সুবিধাবাদী লোক এবং অনেকে বাধ্য হয়ে পাক দখলদার শাসকের তৈরী শান্তি কমিটি ও আলবদর, আল শামস-এ যোগদান করে।
ভারতে ট্রেনিং প্রাপ্ত ঝিনাইদহ জেলার নওজোয়ানরা মুক্তিবাহিনীর নির্দেশ মতো নিজেদের ভিতরে এবং বাইরে ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলারা অসীম সাহস ও বুদ্ধির দ্বারা জেলার সর্বত্র হানাদার বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকারদের সমূলে ধ্বংস করতে থাকে। এমন কয়েকটা প্রচন্ড গেরিলা যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল শৈলকূপা উপজেলায়। উলেস্নখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে: (১) শৈলকূপা থানা আক্রমণ (২) কামান্নার যু্দ্ধ (৩) আবাইপুর হাইস্কুল প্রাঙ্গণের যুদ্ধ (৪) আলফাপুরের যুদ্ধ। কামান্নায় ২৭ জন এবং আবাইপুর ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা মারা যায়। কামান্নায় মুক্তিযোদ্ধাদের নেতা নজরুল ইসলাম শহীদ হন। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর কামান্নাতে নিহত ২৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। আলফাপুরে নেতৃত্ব দেন শৈলকূপা থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান মন্টু, আবু আহমেদ, সোনা মোল্যা এবং শ্রীপুরে আকবার চেয়ারম্যান। হানাদার বাহিনীর ২জন ক্যাপ্টেন, ৩জন সিপাহী এবং ৪জন রাজাকার নিহত হয়। গেরিলাদের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। শহরের এবং গ্রামগঞ্জের অধিকাংশ লোক গেরিলাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করে স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত করে তোলে।
স্টপ জেনোসাইডঃ
বাংলাদেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ পৃথিবীর রাজনৈতিক অংগনে ও বুদ্ধিজীবী মহলে সে সময়ে আলোড়ন তুলেছিল। বনগাঁ, রানাঘাট অঞ্চল থেকে স্টপ জেনোসাইডের চিত্রায়ন ঘটেছিল বহুলাংশে, স্টপ জেনোসাইডে বিশ্ব নেতৃবর্গের উদ্দেশ্যে ইংরেজী ভাষায় যে বক্তৃতা রেকর্ড করা হয় তার কন্ঠে ও ভাষা দিয়েছিলেন কালীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ. জনাব ইকবাল আনোয়ারুল ইসলাম। তাঁর সেই ইংরেজী বক্তৃতা বিশ্ব নেতৃবর্গের হৃদয়ে আবেদন রাখতে সক্ষম হয়েছিল।
গেরিলা যুদ্ধের এক পর্যায়ে ঝিনাইদহ মুক্তিযুদ্ধের নায়ক মেজর মাহবুব ভোমরায় অপারেশনকালে পাকসেনাদের গুলীতে গুরুতর আহত হন।
প্রত্যক্ষ ও সম্মুখ সমরঃ
১৯৭১-এর নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে একদিকে গেরিলা যুদ্ধ চরম আকার ধারণ করে অপর দিকে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তি বাহিনী যৌথভাবে (মিত্রবাহিনী) সীমান্ত অতিক্রম করে ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং মুক্ত এলাকার সৃষ্টি করে। ডিসেম্বরের ৩/৪ তারিখে মহেশপুর, কোটচাঁদপুর এবং চুয়াডাঙ্গা এলাকা দিয়ে কপোতাক্ষ ও চিত্রানদী অতিক্রম করে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ পৌঁছে। মিত্র বাহিনীকে পাক হানাদার বাহিনী বাঁধা না দিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। ৬ ডিসেম্বর ঝিনাইদহ শহর তথা সমগ্র জেলা হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।
দলমত নির্বিশেষে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের ৭/৮ ডিসেম্বর হত্যা করার হানাদারদের নীলনক্সা বিফল হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ঝিনাইদহ হল স্বাধীন। যে ঝিনাইদহ প্রথম সম্মুখ সমরে বিষয়খালীর যুদ্ধে জয়লাভ করে সেই ঝিনাইদহ-ই সমগ্র দেশের স্বাধীনতা লাভের আগে স্বাধীনতা লাভ করে।
তথ্য সূত্র:
ঝিনাইদহের ইতিহাস
লেখক : মীর্জা মোহাম্মদ আল-ফারুক
সংগ্রহ:
এ্যাড: হাসান শহীদ কামরুজ্জামান (দূর্বা)
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
১০.১২.০৬