
Home নড়াইল জেলা / Narail District > জমিদার ও জমিদারীর ইতিহাস / Lords and landlords history
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100135 বার পড়া হয়েছে
জমিদার ও জমিদারীর ইতিহাস / Lords and landlords history
জমিদার ও জমিদারীর ইতিহাস
Lords and landlords history
তুর্ক, আফগান বা সুলতানী শাসনমলে আমাদের দেশে জমিদারী ব্যবস্থা ছিলো বলে ঐতিহাসকগণ জোর দাবী করেন। বাংলার স্বাধীন সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের শাসনামলে বনগাঁ কাগজ পুকুরিয়ার জমিদার রাজস্ব দিতে অস্বীকার করলে জমিদার রামচন্দ্র খাঁ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করে তাকে পরাজিত ও স্বপরিবারে নিহত করা হয়। মুঘল শাসনামলে ভূমি ব্যবস্থার নতুন নতুন সংস্কারের ফলে গ্রামের পদমর্যাদাশীল ব্যক্তিবর্গ রাজস্ব আদায়ের ভর নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ সামরিক সাহায্য ও সহযোগিতা দিয়ে দিল্লীশ্বরে সরাসরি জায়গীরদারী, জমিদারী ও ইজারাদারী পেয়ে একটি অভিজাত সমাজ গঠন করেছিলেন। তখন ভূমি কর প্রজাসাধারণের ক্ষমতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ১৭৫৭ সালে স্বাধীন নবাব সরাকারের পতন ও ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মুঘল সম্রাটের নিকট হতে বাংলা ও বিহারের দেওয়ানী বা ইজারাদারী গ্রহণ করে। কোম্পানীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্যবসায় মুনাফা ও ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ করা। কোম্পানী সরকার তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য সমস্ত অমানুষিক নির্যাতন উৎপীড়ন ব্যবস্থা প্রজাসাধারণের উপর চাপিয়ে ছিলো। মুঘল সরকারের ব্যবস্থা মোতাবেক জমিদারদের উপর ভূমিরাজস্ব আদায়ের ভার ছিলো। কিন্তু বাংলা বিহারের ইজারা নিয়ে কোম্পানী দেশীয় জমিদারদের সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। জমিদারদের রাজস্ব আদায়ের হিসাব নিকাশ তদারকের জন্য কোম্পানী সরকার প্রত্যেক জমিদারী কার্যালয়ে একজন ‘সুপারভাইজার’ নিযুক্ত করে। ‘সুপারভাইজারগণ’ সরকারীভাবে হিসাব পত্র পরীক্ষা করতো এবং বেসরকারীভাবে উৎকোচ গ্রহণ করতো। এই ভাবে রাজস্ব ব্যবস্থায় জনসাধারণের উপর প্রথম নিপীড়ন শুরু হয়। ‘সুপারভাইজারদের’ প্রতি কোম্পানী সন্তুষ্ট না থাকায় গভর্ণর জেনারেল হেস্টিং সুপারভাইজারের পদ লোপ করে দিয়ে প্রতি জেলায় একজন করে ইংরেজ কালেক্টর নিযুক্ত করেন। এছাড়া জনসাধারণের উপর বর্ধিত হারে রাজস্ব আদায়ের জন্য একটি কমিশন গঠন করেন। ১৭৭২ সালের এই নতুন কর আদয়ের ভিত্তিতে জমিদারদের সঙ্গে সরকারের একটি পাঁচশালা বন্দোবস্ত চুক্তি হয়। জনসাধারণ রাজস্ব দিতে অস্বীকার করলে কোম্পানীর সামরিক বাহিনী (লাঠিয়াল বাহিনী) রাজস্ব আদায়ে অমানুষিক নিপীড়ন করতো। এখানে উল্লেখ করা যায় যে ১৭৬৫ সালে কোম্পানীর বাংলা বিহারের ইজারা লাভের পর ‘অভিজাত জমিদার গোষ্ঠি’ (যারা মুঘল সরকারের নিয়োগকৃত) প্রায় বিলিন হয়ে যায়। এর মধ্যে মুসলমান জমিদারীর সংখ্যাই বেশী ছিল যা বাংলা ও বিহার থেকে প্রায় বিলীন হয়ে যায়। ঐ স্থানসমূহ দখল করে ইংরেজ সরকারের পা-চাটা দালাল, অত্যাচারী ও নিপীড়নকারী কুখ্যাত কিছু লোক যাদের নিকট ধর্মাধর্ম ও ন্যায়-অন্যায় বলে কোন কথা ছিল না।
পাঁচশালা বন্দোবস্ত, প্রজাসাধারণের নিকট মরণ ফাঁদ হয়ে দেখা দেয়। নতুন জমিদার সমপ্রদায় ও কোম্পানীর অবাধ লুণ্ঠনের ফলে ১৭৭০ খৃষ্টাব্দে (বাংলা ১১৭৬ সালে) বাংলায় ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। এ সময় বাংলার এক তৃতীয়াংশ লোক অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। এর পর কোম্পাণীর গভর্ণর- জেনারেল লর্ড কর্ণওয়ালিশ কোন একটি প্রতিকার হিসেবে জমির পরিমাপ ও উহার উৎপাদন শক্তির কোনো প্রকার হিসাব গ্রহণ না করেই ১৭৯৩ সালে বোর্ড অব ডাইরেক্টরস’ নির্দেশে ‘চিরস্থায়ী’ বন্দবস্ত ঘোষণা করেন। জমিদারগণ কোম্পানী সরকার কর্তৃক নতুন ভূমি ব্যবস্থার আওতায় নিজ নিজ জমিদারীতে ‘রাজা লোক’ নিযুক্ত হন। ভারতবর্ষের ইতিহাসে কোম্পানী এই প্রথম ভূমির প্রকৃত মালিক সেজে বসে। আর এই ভূমির উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হলো মধ্যস্বত্তাধিকারী জমিদারের উপর। জমিদারগণ প্রজা ও সরকারের মধ্যে রাজস্ব আদায়ের ব্যাপারে সংযোজক শক্তি হিসাবে কাজ করতে থাকে।
কমপক্ষে একটি পরগনার ইজারাদারদের জমিদারী হিসেবে গণ্য করা হয়। এই জমিদারগণ সরকারকে দেয় রাজস্ব কালেক্টরীতে জমা দিতে বাধ্য থাকে। এছাড়া খন্ড তালুক ও খন্ড জমিদারীর প্রাপ্ত গাতিদারগণও কালেক্টরীতে তাদের রাজস্ব দিতে বাধ্য হয়। ঐ তিন সংখ্যক মধ্যস্বত্তাধিকারী ছাড়াও বাংলা ও বিহারে আরো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মধ্যস্বত্তভোগীর জন্ম দেয়। যারা তাদের দেয় সরকারী রাজস্ব নিজ নিজ এলাকার জমিদারদের কাচারীতে জমা দিতে বাধ্য থাকে। এই জেলায় এইরূপ কয়েকজন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মধ্যস্বত্তভোগী ও সমপ্রদায়ের নাম উল্লেখ করা হল- নড়াইলের লোহাগড়ায় রায়, মজুমদার ও সরকার, কাশিপুরের মুখোপাধ্যায় ও চট্টপাধ্যায়, কচুবাড়িয়ার সমাদ্দার, লক্ষ্ণীপাশার ব্যানার্জি, মুখার্জি ও চক্রবর্তী, জয়পুরের ভট্টাচার্য ও সেন, কোটাকোলের সরকার, মল্লিকপুরের ভট্টাচার্য, ইতনার ঘোষ, সেন ও ভট্টাচার্য এবং ধোপাদহের মিত্ররা, কালিয়া উপজেলার সেন, সরকার, দাস প্রভৃতি। এদের মধ্যে কয়েকজনের বর্ণনা দেওয়া হলো:
শীতল সরকার:
কলাবাড়িয়ার অধিবাসী ছিলেন। খড়রিয়া মেজ জিলা সিন্ডিকেট কোং লিঃ হতে ৫৬ বিঘা জমি লাখেরাজ ও বিরাট গাতিদারী শীতল সরকার মৌরসী সম্পত্তি হিসেবে প্রাপ্ত হন। শীতল সরকার জেলে ও প্রামাণিকদের নিষ্কর জমি দান করে বাড়িতে জাকজমকের সঙ্গে দোল, দোর, লক্ষ্মীপূজা, দুর্গাপুজা, কালীপূজা সম্পাদনা করতেন। শীতলের পৌত্র কালিপদ সরকার ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত পুরান পূঁজা পর্বের সামান্য অংশ পালন করেছিলেন।
শিবরতন রায় বাহাদুর:
বিখ্যাত গাতিদার। কলাগাছি গ্রামে রতনবাবু কাচারী বাড়ী নির্মাণ করে সেখানে অবস্থান করতেন। তার গাতিদারী সীমানার মধ্যে মুসলমানদের ধর্মীয় কাজ কোরবানী এক প্রকার নিষিদ্ধ ছিলো। তিনি বিশেষ অত্যাচারী ছিলেন বলে আজও প্রবাদ আছে।
চন্দ্রনাথ দাস:
বহিরাগত এই ক্ষুদ্র গাতিদার মাউলী গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন। চন্দ্রনাথ অত্যাচারী গাতিদার হিসেবে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আড়ম্বরের সংগে ধর্মীয় অনুষ্ঠান করতেন।
মোজাম মোল্লাহ:
বাঐসোনা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। এই পরোপকারী গাতিদার অতিথি সেবার জন্য ৮ বিঘা জমি দান করেছিলেন।
মুহাম্মদ হামিদ সরদার:
বাঐসোনা গ্রামের অধিবাসী ছিলেন। হামিদ সরদার আচার আচরণে অতি আভিজাত্যের পরিচয় দিতেন। তিনি অতিথি সেবার জন্য চেরাকী জমি ও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় অর্থদান করেছিলেন।
পরশউল্লাহ শিকদার:
জানবাজারের রাণী রাসমনির জমিদারী এস্টেটের মধ্যে গোপালগঞ্জ অঞ্চলের কাচারীর নায়েবের সঙ্গে জনৈক ঘটু সিকদারের বিশেষ সম্পর্ক সৃষ্টি হয়। ঘটু শিকদার মকিমপুর পরগনার পুটিমারী গ্রামে গাতিদারী পেয়ে ঐ স্থানে বসতি স্থাপন করেন। পরশউল্লাহ ঘটু সিকদারের উত্তর বংশধর। তিনি মকিমপুর পরগণায় ভাটীর রাজা বলে পরিচিত ছিলেন। কোন কারণে রাসমনি এস্টেটের সঙ্গে গোলযোগ হওয়ায় পরশউল্লাহ তার মৌরসী গাতিদারী হারান। পূর্ব কালিয়ায় কিছু কিছু শিকদার নামধারী লোকেরা পরশউল্লাহর ধান সেলামী দিয়ে তারা বংশীয় সুনাম ক্রয় করতে চেষ্টা করেছিলেন। এলাকার মানুষ তাদেরকে ধানো সিকদার বলে।
মুহাম্মদ জকি মোল্লাহ:
কলাবাড়ীয়ায় জন্ম। যতদুর জানা যায় কালিয়া উপজেলার সবচেয়ে প্রতাপশালী গাতিদার ছিলেন। জকি মোল্লাহর জীবন যাত্রা ছিলো মধ্যযুগীয় সামান্তের ন্যায়। তিনি কলাবাড়িয়া নীল কুঠির নীলকর এল, এম, কাশি ডানলপকে বিতাড়িত করেন। জিয়ার ফেরাংক ও টিআর গ্রান্ড প্রমুখ ইংরেজ কর্মকর্তা এবং কোটাকোলে সরকার তাকে যথেষ্ট সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। কোটাকোলের সরকার তালুকদারেরা জকি মোল্লাহর জনৈক ভ্রাতুষ্পুত্র আরশাদকে চোরখালী (বড়দিয়ার সন্নিকটে) মহাল থেকে অপহরণ করে নিয়ে গেলে তিনি নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে কোটাকোল থেকে আরশাদকে মুক্ত করেন। কলাবাড়ীয় সহ বাঐসোনা, খাশিয়াল ও জয়নগর ইউনিয়ন ছাড়াও খুলনা জেলার বেশ কেয়েকটি মৌজা ‘জকি মোল্লাহর এ্যাস্টেটের’ অন্তর্ভূক্ত ছিলো। জকি মোল্লাহ একাধিক অশ্বছিপ ও লাঠিয়াল বাহিনী রাখতেন। তিনি বহু লোককে নিষ্কর জমি দান করায় তাকে অধিক অভিজাত ও রাজোচিত করে তুলেছিলো পূর্বপুরুষের চাকরান জমি দিয়ে পোষণ করা ধোপা পরামানিক জেলে ও দাই সমপ্রদায়। জেলার অন্য মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ছিলো কল্পনার অতীত।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক: আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
এপ্রিল ২০১২