
Home নড়াইল জেলা / Narail District > ঐতিহাসিক নড়াইল / Historical Narail
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100049 বার পড়া হয়েছে
ঐতিহাসিক নড়াইল / Historical Narail
ঐতিহাসিক নড়াইল
Historical Narail
আনুমানিক ২৫ হাজার বছর আগে যশোর, খুলনা ও নড়াইলের সমগ্র এলাকা ছিল সাগর গর্ভে। এর প্রমান পাওয়া যায় মাটির নিচ থেকে বিভিন্ন বস্তু উত্তোলিত হওয়ায়। যশোর সদর থানায় সাহাবাটী গ্রামের সাজ্জাদ মিয়ার ইটের ভাটার মাটি কাটার সময় ৮/৯ হাত নিচে আবিস্কার হয় একটা নৌকার ছাপ যা ৫২ ফুট লম্বা এবং ৫ ফুট চওড়া। মরিচা পড়া লোহাও ছিলো অনেক। বাঘারপাড়া থানার শ্রীরামপুর গ্রাম নিবাসী মকছেদ গাজী পুকুর খনন কালীন ৮/৯ হাত মাটির নিচে পেয়েছিলেন কুমিরের পঁচা মাথা ও কয়েকটা দাঁত।
এ থানার এগারোখান এলাকায় মাটির নিচে কেউ পেয়েছে সুন্দরী কাঠ, কূপের চাড়ি, পাকা ঘাট এবং বড় বড় মাটির ছাপের এক ঝাঁকা সুপারী। অভয়নগর থানার প্রেমবাগ গ্রামে মুচির পুকুর সংস্কার কালীন ৮/৯ হাত মাটির নীচে আবিষ্কার করা হয় একটা চল্লিশ হাত লম্বা বাইচের নৌকা। নৌকাটি ছিল পঁচা আমের আটিতে ভরা। সুতরাং অগ্রাহ্য করা যায় না যে এখানে এক সময় সাগর ছিল না।
কালের বিবর্তনে চর পড়ায় দ্বীপের সৃষ্টি হতে থাকে। পরবর্তীতে ওই সব দ্বীপে বিভিন্ন গাছপালা জন্মে হতে জঙ্গলে পরিনত হয়। দ্বীপগুলো অনেক কাল পর্যন্ত জঙ্গলে আবৃত থাকে। পর্যায়ক্রমে দ্বীপগুলোতে মানুষের আগমন ঘটতে থাকে।
তবে আর্য্য অনার্য্য যাই হোক তারা যে আদি মানব এবং তাদের বসতি যে ছিল আরব এলাকায় এতে সন্দেহ নেই। কালে কালে ওই সব অসভ্য আদি মানবদের বংশ বৃদ্ধির ফলে দেখা দেয় জায়গার অভাব। যে কারণে তাদের আগ্রহ জন্মে এদিকে আসার। তাছাড়া উত্তর ও পশ্চিমে বিশাল তপ্ত মরুভূমিতে বসবাসের অনুপযুক্ত হওয়ায় ঐ এলাকার মানুষ ভারত বর্ষের দিকে ধাবিত হয়। আর এভাবেই গড়ে উঠেছিল জন বসতি।
প্রথম দিকে ভারতের অংশে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তীতে তা অতিক্রম করে আসতে থাকে বাংলাদেশের দিকে। এদেশের গাছপালা এবং পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ঘর নির্মাণ করতে থাকে জঙ্গল বেষ্টনীর অভ্যন্তরে। প্রথম দিকে যারা আসে হয়তো তাঁরা ছিল চতুর এবং কিছুটা বিত্তশালী। পরবর্তীতে তারাই হয় কেউ জমিদার কেউ রাজার দাবিদার।
ওই শ্রেণীর ব্যক্তিগণ এসে গড়ে তোলেন রাজ্য বা জমিদারী। ঐ সময়ের মানুষ হয়তো জমির সঙ্গে তুলনা করত যমের। জমির কথা শুনে ভয় পেত বিধায় জমি ক্রয় দূরে থাক মাগনাও নিতে চায়তো না কেউ। সে কারণে আগে আসা চতুর ব্যক্তিগণ নিজের ইচ্ছানুযায়ী বৃহৎ রাজ্য বা জমিদারী পত্তন করার সুযোগ পেয়েছিলেন। জমি যে ভবিষ্যতের সম্পদ হবে সে ব্যাপারে তাঁরা বিচক্ষণ ছিলেন বিধায় জমির ওপরে দিয়েছিলেন অধিক গুরুত্ব।
সে কারণে বিপুল জমির দখলদার হয়ে গরীব শ্রেণীকে প্রলোভন দেখিয়ে এদিকে আনতে থাকেন।
লোক আনার মূলে যুক্তিও ছিল প্রকট। যেহেতু মানুষ হচ্ছে সামাজিক জীব। জঙ্গল বেষ্টনীর অভ্যন্তরে একার পক্ষে বাস করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তাই এ এলকায় অন্যদের বসবাস করতে উদ্বুদ্ধ করতেন তারা। পর্যায়ক্রমে তারাই রাজা বা জমিদারের স্বীকৃতি পেতেন।
পরবর্তীতে ধারাবাহিকতা ছিল অব্যাহত, পর্যায়ক্রমে বৃহত্তম যশোর এলাকার যে জমিদারের উৎপত্তি হয়েছিল তাদের নাম রাজা সীতারাম রায়, রাজা রাম রায়, রাজা মুকুট রাম রায়, রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা বসন্ত রায়, রাজা কন্দর্প নারায়ণ, রাজা রত্নেশ্বর রায়, জমিদার আনন্দ মোহন চৌধুরী, জমিদার কালী শংকর রায় এবং জমিদার বনমালী বসু। যাদের কথা উল্লেখ করা হলো তাদের মধ্যে প্রথমে রাজা সীতারাম রায়ের বিষয় ব্যাখ্যা করা হচ্ছে।
এ রাজা ১৬২৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন কাটোয়ার মহাপতি গ্রামে মামা বাড়িতে। রাজা সীতা রামের জনক উদয় নারায়ণ চাকুরী করতেন রাজ মহলের নবাব সেরেস্তায়। সেখানে থাকা কালীন অথবা তারপরে নিজেই রাজ্য স্থাপন করেন ভূসনায়, পরবর্তীতে সুচারুভাবে এ রাজ্যটা পরিচালনা করতে থাকেন। কয়েক বছর পর সে রাজার মৃত্যু হলে স্থলাভিষিক্ত হন ছেলে সীতারাম রায়। রাজ্য প্রাপ্তির পর তিনি নির্বিবাদে পরিচালনা করতে থাকেন। অনেক দিন পর রাজ্যটা স্থানান্তরিত করার বাসনায় অনুসন্ধান করতে থাকেন নতুন জায়গায়।
সে উদ্দ্যেশ্যে এক দিন রওনা হলেন কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে। কিছু দূর যেতেই অতর্কিতে ঘোড়ার পা দেবে যায় শুকনা মাটিতে। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন মাটি থেকে পা তুলতে, তখন হতবাক হয়ে রাজা ভাবলেন নিশ্চয় কোন কারণ নিহিত আছে এতে। তাই ভেবে রহস্য উদঘাটনের জন্য নির্দেশ দিলেন মাটি খননের। রাজার নির্দেশে লোকেরা নিযুক্ত হয় মাটি খননের কাজে। কয়েক হাত খননের পর আবিষ্কৃত হয় একটা মন্দিরের চূড়া।
এতে আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় খনন কাজ থাকে অব্যাহত। আরও কিছু খনন হলে মাটির নিচ থেকে বের হয় একটা দেব মন্দির। সে মন্দিরটা আবিষ্কার হওয়ায় রাজা ভাবলেন নিশ্চয় এতে কোন কল্যাণ নিহিত আছে। তাই ভেবে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করেন নতুন রাজধানী। বেশ কয়েক বছর সুন্দরভাবে রাজ্য পরিচালনা করতে থাকেন। এরপর তিনি ভারত সম্রাটের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। সম্রাট এ খবর জানতে পেরে বিরোধীকে দমন করার জন্য অসংখ্য সৈন্য প্রেরণ করেন।
তাদের সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য রাজা সীতারাম যুদ্ধের প্রস্তুতি নিলেন। যুদ্ধে যাবার প্রাক্কালে তিনি সঙ্গে একটা পোষা কবুতর নিয়ে বললেন, যুদ্ধে যদি পরাজিত হই তাহলে আমার বদলে ফিরে আসবে এই কবুতরটা। তাই বরে তিনি রওনা হলেন যুদ্ধের অভিমুখে। গন্তব্যে যেতেই শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে উভয় পক্ষের সৈনিক হতাহত হয়। জয় পরাজয় হবার পূর্বেই অতর্কিতে সঙ্গে নেয়া কবুতরটা উড়াল দেয় পাখা মেলে।
ক্ষণেকের মধ্যে উপস্থিত হয় ভুষণার রাজধানীতে। রাজার বদলে শুধু কবুতরটাকে ফিরে আসতে দেখে রাজ পরিবারের লোকেরা ভাবলো নিশ্চয় রাজা পরাজিত হয়েছেন যুদ্ধে। তা না হলে কবুতর একা ফিরে আসতো না। সে ধারণার বশবর্তী হয়ে রাজা সীতারামের বংশধরগণ প্রকান্ড এক দীঘির পানিতে আত্মহনন করে। এ আত্মহনন থেকে মুক্তি পায়নি রাজ বংশের কোন একটা প্রাণী।
এদিকে রাজা সীতারাম বিপক্ষের সৈনিকদেরকে বিতাড়িত করে যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে তিন দিন পরে ফিরে এলেন রাজধানীতে। আসার পর ঘটনা শুনে এবং প্রত্যক্ষ করে শোকে তাপে হলেন মর্মাহত। ফলে পরিবার বর্গদের বিচ্ছেদে তিনিও হলেন তাদের অনুসারী অর্থাৎ ওই দীঘির পানিতে ডুবে করলেন আত্ম বিসর্জন। অদ্যাবধি যে দীঘিটা চর্তুদিকে গড়ের ন্যায় পরিবেষ্টিত। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে নিস্কৃতি পাবার জন্য সেই সময় ওই ধরণের গড়ের প্রথা চালু ছিল রাজা বাদশাদের মধ্যে।
কিন্তু রাজা সীতারাম সম্পর্কে কারো দ্বিমত ও আছে। কারো মতে রাজা যুদ্ধে পরাজিত হওয়ায় বন্দী অবস্থায় প্রেরিত হন রানী ভবানীর কারাগরে। তারপর অপমানের গ্লানী সহ্য করতে না পেরে সে কারাগারেই মৃত্যুবরণ করেন ১৭১৪ খ্রীষ্টাব্দে। সে রাজা ধরাধামে না রইলে ও অটুট বাড়ি সহ তার অনেক কীর্তির মধ্যে রাম সাগর, সুখ সাগর, কৃষ্ণ সাগর এবং সাগর দীঘি নামে বড় বড় এসব পুকুর রয়ে গেছে কালের সাক্ষী হিসেবে।
শ্রীরাম রাজা:
শ্রীরাম রাজার রাজধানী ছিল বারোবাজারের বাদুরগাছা মৌজার ছাপাই নগরে। সে রাজার আদি বাড়ি ছিল নাকি তার থেকে কিছু দূরে মাসলে হাসিলবাগ গ্রামে। কিংবদন্তীর গাজী কালু ব্রাহ্মণা নগরে যাচ্ছিলেন এ রাজার রাজধানীর ভেতর দিয়ে। কিন্তু শ্রীরাম রাজা তাদেরকে যেতে না দিয়ে গতি রোধ করে বলে জানা যায়। এতে গাজী-কালু ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিলে অতর্কিতে সে রাজার রাজধানীতে আগুন ধরে যায়।
সে আগুনে দাউ দাউ করে পুড়তে থাকে গোটা রাজ্যটা। সে আগুন নেভাবার সাধ্য কারো হয়নি। রাজবাড়ি সহ গাছ পালা ও পুড়ে হতে থাকে ভস্বীভূত অবশেষে রাজার পরিবার বর্গ সহ সবাই পুড়ে মরেছিল সে আগুনে। তখন গাজী-কালু নির্বিবাদে যেতে থাকেন গন্তব্যের দিকে। শ্রীরাম রাজার রাজ্যের ঘটনাগুলো কখন যে সংগঠিত হয়েছিল তার কোন সাল তারিখ উল্লেখ নেই কোন ইতিহাসে। তবে সে রাজার কীর্তির মধ্যে আছে একটা বড় গড় সহ দীঘি।
অত্র এলাকায় একটা প্রাচীন হাটের সন্নিকটে আছে গাজীর দরগা, কিংবদন্তীর এ গাজী কালুর দরগা বা মাজার সারা দেশে কত যে আছে তার হিসেব নেই। এ ধরণের ভিত্তিহীন যে কোন বস্তুর উপর সমাজবাসী ভ্রান্ত মানুষ গড়ে তোলে স্বপ্নের তাজমহল। তারপর তা নিয়ে ব্যবসার পথ করে নেয় প্রশস্ত। এ কুসংস্কারের উপরে আকৃষ্ট সব শ্রেণীর মানুষ। যারা জ্ঞানী গুনী তাঁরা যে বাদ আছে তা নয় সবাই ওই পন্থী।
মুকুট রাম রাজার রাজধানীর কথা জানা যায় দুই জায়গায়। ঝিনাইদহ জেলার বিজয়পুরে এবং যশোরের ঝিকরগাছা থানার লাউজানী গ্রামে। সে রাজার মেয়ে চম্পাবতীকে ঘাত সংঘাতের পর যাকে বিয়ে করেছিলেন গাজী। তাছাড়া ও সময় ছাপাই নগর গ্রামের নাম ছিল ব্রাহ্মণা নগর। সে গ্রামে বাড়ি ছিল মুকুটরাম রাজার, অথচ গাজী কালুর জন্মস্থানের উল্লেখ আছে ছাপাই নগর গ্রামে। যাহোক গাজীর বউ ছিল না কোন অলৌকিক মহিলা, তবু তার মাজার ঝিনাইদহের বারো বাজারে এবং শ্যামনগর থানার লাবসা গ্রামে।
আরো এক রাজার নাম জানা যায় বিষ্ণুদাস হাজরা তিনি ছিলেন ফরিদপুর জেলার ভাবরাসুরা গ্রামের অধিবাসী। বাল্যকালে এ রাজা ঝুঁকে পড়েন ধর্ম কর্মের দিকে। সংসার ত্যাগ করে ভবঘুরে হন। ফলে ঘোরাঘুরির মধ্য দিয়ে উপনীত হন ঝিনাইদহের ব্যাংক নদীর তীরে। সেখানে একটা গাছের নিচে বসে লিপ্ত হন মহাপ্রভুর আরাধনায়। পরবর্তীতে তিনি হয়েছিলেন নরডাঙ্গার রাজা। এর বেশী আর কোন তথ্য পাওয়া যায় নি।
রাজ্যটার অভিষেক কিভাবে হয়েছিল তারও তথ্য নেই কোন ইতিহাসে। আবার সে রাজার শেষ বংশধরের নাম ইন্দ্রভূষণ। তার আগের সে রাজার সন্তান যারা ছিল তাদের কথা এবং ইন্দ্রভূষনের রাজ্য প্রাপ্তি তাও রয়ে গেছে অজ্ঞাত। সমাপ্তিকাল তারও কোন সাল তারিখ নেই। মনে হয় পূর্বেকার রাজাদের সমসাময়িক কালে অথবা আগে পরেও হতে পারে।
রাজা প্রতাপাদিত্যের বাপের নাম শ্রীহরি। তিনি চাকরী করতেন দাউদ কররাণীর সেরেস্তায়। সেখান থেকে প্রাপ্ত হন সুন্দরবনের তালুক। ওটা কেনার পর চাকরী ছেড়ে চলে আসেন নতুন তালুকে। এরপর রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে তিনি আত্মনিয়োগী হন। নতুন জায়গায় এসে নতুন বিক্রমাদিত্য নামে হন পরিচিত। কররানীর সেরেস্তায় চাকরী ছেড়ে আসার সময় খুড়াতো ভাই জানকি বল্লভকেও সঙ্গে এনেছিলেন বিক্রমাদিত্য।
জানকি বল্লভও ভাইয়ের সঙ্গে চাকরী করতেন একই সেরেস্তায়। তিনিও চাকরী ছেড়ে নতুন বসন্ত রায় নামের সনদ নিয়ে এসেছিলেন ভাইয়ের সঙ্গে। আসার পর দু’ভাই যৌথভাবে সৌহার্দের সঙ্গে সুন্দরবনের নতুন রাজ্যটা পরিচালনা করতে থাকেন সুচারুভাবে। কিছু দিন রাজ্য চালাবার পর হঠাৎ করে রাজা বিক্রামদিত্য পরলোকগমন করেন। ফলে রাজ্যটা হয় মুকুটহীন রাজার ন্যায়।
এ অবস্থায় বসন্তরায় যদিও রাজার পদে প্রতিষ্ঠিত হবার যোগ্য তবু নিজে না হয়ে রাজ পদে অধিষ্ঠিত করেন ভাই বেটা প্রতাপকে। প্রতাপ রাজ্য প্রাপ্তির সঙ্গে লিপ্ত হন ষড়যন্ত্রে। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন যদিও চাপে পড়ে রাজ্যটা আমাকে প্রদান করতে বাধ্য হয়েছেন, কিন্তু সুযোগ পেলে পরবর্তীতে দখল করা থেকে বিরত থাকবেন না। তাই ভেবে পথটা নিষ্কন্টক করার বাসনায় কৌশলে সুযোগ বুঝে হত্যা করেন চাচা বসন্তরায়কে।
চাচার সঙ্গে তার পরিবার বর্গকেও নিষ্কৃতি দেননি। প্রত্যেককে হত্যা করেন নির্মম ভাবে। এ হত্যা থেকে রক্ষা পায় শুধু রামু নামের বসন্ত রায়ের ছোট ছেলে কচু বনে লুকিয়ে থেকে। পরক্ষণে সে কচু ড়্গেত থেকে বেড়িয়ে সবার অলক্ষ্যে চলে যায় অজানার উদ্দেশ্যে। পরবর্তীতে ভারত সম্রাটের পৃষ্ঠপোষকতায় যুদ্ধে অবর্তীণ হয় ভাই প্রতাপের সঙ্গে। সে যুদ্ধে রাজা প্রতাপকে হত্যা নয় বিতাড়িত করে দখল করে সুন্দরবনের রাজ্যটা।
যশোর-খুলনার ইতিহাসে এসব বিবরণ উল্লেখ রইলেও শুধু যশোরের ইতিহাসে ভিন্নতর অর্থাৎ কারো সঙ্গে নেই কোনটার সামঞ্জস্যতা। ফলে ইতিহাসগুলো রূপ নিয়েছে অন্ধদের হাতি দেখার শামিল। অন্ধরা হাতি দেখতে গিয়ে কুলো, মূলো, লাঠি বা খুটির বর্ণনা করেছে জীবন্ত হাতির। যেখানে যে হাত দিয়েছিল তারই ব্যাখ্যা তারা করেছিল। সুতরাং যেসব ইতিহাস লেখা হয়েছে সেগুলো সঠিকের স্থলে মন্তব্যের উপরে।
রাজা প্রতাপাদিত্য সম্পর্কে এর অধিক আর কিছু পাওয়া যায়নি কোন ইতিহাসে। সে রাজার রাজধানী সুন্দরবন এলাকার ধুমঘাটের ইশ্বরীপুরে উল্লেখ রইলেও বেশ কিছু মতান্তর আছে। কারো কারো অভিমত রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ছিল যশোরের চাঁচড়ায়। এ ধরণের দ্বিমতের অন্ত নেই। এর সঠিক বেঠিক নির্ণয় করা দুষ্কর। তবে অনেকের অভিমত চাঁচড়ার আদি রাজা কন্দর্প নারায়ণ প্রতাপ নয়। কন্দর্প রায় চাঁদ খাঁ নামক ব্যক্তির কাছ থেকে গাতি কিনে রাজ্য প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন ১৬১৯ খ্রীষ্টাব্দে।
কারো অভিমত চাঁচড়ার রাজা কন্দর্প নারায়ণের রাজধানী ছিল মুরলীতে। হাজী মহসীন বিদ্যালয়ের সন্নিকটে যে আধা ভাঙ্গা মন্দিরটা বিদ্যমান ওখানেই ছিল সে রাজার বাড়ি এবং রাজধানী। এর অদুরের পশ্চিম সড়কে লাগোয়া বিদ্যমান দুটো জোড়া মন্দির ও রাজা কর্ন্দপ নারায়ণের নির্মিত। তার পূর্ব দক্ষিণ পাশের ঈমাম বাড়িটাও সে রাজার কীর্তি। পরবর্তীতে দানবীর হাজী মুহাম্মাদ মহসীন এসব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।
আবার রাজা কর্ন্দপ নারায়ণ ছিলেন মুকুটরাম রাজার সন্তান। বিভিন্ন ইতিহাসে এ ধরণের মতবাদ। তাছাড়া রাজা প্রতাপাদিত্যের জন্ম এবং জন্ম স্থানের বিষয়টা পাওয়া যায় না কোন ইতিহাসে। যা যায় তাও আদি মানব আর্য্য অনার্য্য গণেরই শামিল। এ আদি মানবের জন্মভূমি যে কোথায় ছিল সে ব্যাপারে ইতিহাস গুলো মুখ খুলতে নারাজ বিধায় হয়তো নীরব ভূমিকা পালন করাটাই উত্তম ভেবেছিল।
এরপর আনন্দ মোহন চৌধুরীর কথা যত দুর জানা যায় তিনি হাজার খ্রীস্টাব্দের দিকে জমিদারী পত্তন করেছিলেন যশোরের বকচরে। প্রথমে তিনি বাঘারপাড়া থানার রাধানগর গ্রামে এসে বসতি শুরু করেন। কোন দেশ থেকে এলেন তারও কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না কোথাও। অথচ বহিঃ শত্রুর অক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য অনেক উঁচু করে মাইল খানেক ব্যাপী যে গড়টা তৈরী করেছিলেন তা আজও বিদ্যমান। তবে কিছুটা ক্ষয় প্রাপ্ত হয়েছে।
পরবর্তীতে আনন্দ মোহন জমিদারী পত্তন করেন বকচরে গিয়ে। তার সে জমিদারী কতদিন স্থায়ী ছিল এবং বংশ পরম্পরের ধারাবাহিকতা ছিল কিনা তারও কোন সঠিক তথ্য নেই। তবে সে জমিদারের কীর্তির মধ্যে একটা জীর্ণ মন্দির আছে বকচরে। মুরলীর জোড় মন্দিরটাও সে জমিদারের নির্মিত বলে অভিমত বা ধারণা এলাকাবাসীদের। ভিন্ন জনের ভিন্ন মন্তব্য রইলেও আদি কাল থেকে চাঁচড়ায় বসবাসকারী ঘোষদের মতে প্রকৃত চাঁচড়ার রাজা ছিলেন প্রতাপাদিত্য ছাড়া আর কেউ নয়।
এ বক্তব্য চাঁচড়ার বাসিন্দা শিব চরণ ঘোষের। তিনি দাবি করেন তার পূর্ব পুরুষ গণ রাজা প্রতাপাদিত্যের সমকাল থেকে এখানে বসবাস করছেন। সে দাবির প্রেক্ষিতে সরকারের বিপক্ষে মামলা করে বিজয়ীও হয়েছেন। ফলে ঘোষের মন্তব্য উপেক্ষা করার উপায় নেই। সুতরাং রাজা প্রতাপাদিত্যের এবং রাজা কন্দর্প নারায়ণ উভয়ের মধ্যে প্রকৃত চাঁচড়ার রাজা যে কে সে সম্পর্কে যদি কারো জানার আগ্রহ থাকে তাহলে তা নির্ণয় করার দায়িত্ব অর্পণ করা হলো।
রাজা রত্নেশ্বর রায়ের অবস্থাও তদ্রুপ কোন তথ্য নেই। কোথায় সে রাজার জন্ম বা জন্মস্থান উল্লেখ নেই কোথাও। তথ্য পাওয়া যায় তা হচ্ছে তিনি বহুকাল আগে একটা কালী মন্দির নির্মাণ করেছিলেন অভয়নগর থানার নওয়াপাড়া বাজারে। তবে সাল তারিখ জানা নেই কারো। যদিও সব কিছু জানার বাইরে তবু সে মন্দির টিকে আছে কালের সাক্ষী হিসেবে। আড়ম্বরের সঙ্গে সে মন্দিরে পূজো পার্বণ ও হয় মাঝে মধ্যে।
পরবর্তীতে বনমালী বসু নামে আরো এক জমিদার ছিলেন অভয়নগরের পাথালিয়া গ্রামে। এ জমিদারের বিষয় উল্লেখ ছিল ঐতিহাসিক যশোরে বিধায় পুনরায় ব্যাখ্যা নিষপ্রয়োজন। সমসাময়িকে আরো কত খুদে জমিদারদের উদ্ভব যে হয়েছিল যেখানে সেখানে তার ঠিক নেই। তবু সেদিকে ভ্রক্ষেপ না করে কলমের দিক পরিবর্তন করে নেওয়া হলো নড়াইলের দিকে।
যশোর খুলনার ইতিহাসে জানা যায় নড়াইলের আদি জমিদার কালী শংকর রায়ের জন্ম ১৭৪৪ খ্রীষ্টাব্দে নড়াইল এলাকায়। তার জনকের নাম রূপরাম দত্ত। তিনি ছিলেন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যক্তি। ফলে ছেলে কালী শংকরকে নিযুক্ত করেছিলেন রাণী ভবানীর সেরেস্তায় চাকরীতে। তিনি সেখান থেকে কয়েকটা পরগনা কিনে ১৭৯৬ সালে জমিদারী পত্তন করেন নড়াইলে। সেই হিসেবে নড়াইলের আদি বাসিন্দা রূপরাম দত্তকে বলা যায়।
রূপরামের আগে হয়তো নড়াইল এলাকায় আর কোন মানুষের আগমন ঘটেনি। তিন শতাধিক বছর আগে এসে তিনি জঙ্গল বেষ্টনীর অভ্যন্তরে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে এনেছিলেন কয়েকঘর লোক। আগতরা আসার পর অনুরূপ জঙ্গল কেটে ছোট ছোট ঘর নির্মাণ করতে থাকে। সুতরাং তিন শতাধিক বছর আগে নড়াইলের ময় এলাকা জঙ্গলে যেমন ছিল আচ্ছাদিত তেমন জলাশয়ে ভরপুর। এর পরিবর্তন করেন কালী শংকর।
তিনি জমিদারী পত্তনের সঙ্গে বিভিন্ন দিক থেকে লোক এনে বসতি গড়ে তোলেন। এভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছিল জনসংখ্যা। আগতরা প্রজায় রুপান্তরিত হয়ে জমিদারকে দিতে থাকে স্বল্প খাজনা। কালে কালে সে জমিদারের বংশধরগণ ওয়ারেম সূত্রে জমিদারী করেছিলেন পরিচালনা। ১৯৪৭ সাল দেশ বিভাগের সঙ্গে নড়াইলের জমিদারগণ মাতৃভূমি ত্যাগ করে গমন করেন ভারতের উদ্দেশ্যে। তারা গেলেও তাদের আশ্রিত গরীব বুনো বাগদীরা মাটি কামড়ে পড়ে ছিল এদেশে।
পরবর্তীতে নড়াইল মহকুমায় রূপান্তরিত হয়ে সংযুক্ত হয় যশোর জেলার সঙ্গে। তারপর নড়াইল জেলায় উন্নীত হয় ১৯৮৪ সালে। তিনটা থানা নিয়ে এ জেলার উৎপত্তি। এ তিন থানায় দুটি পৌরসভা, ৩৭ ইউনিয়ন এবং ৬৭৭টা গ্রাম আছে।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক: আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান বিপুল
আপডেট :
এপ্রিল ২০১২