
Home নড়াইল জেলা / Narail District > মহান মুক্তিযুদ্ধে জেলার ঘটনাবলী / Events of Liberation
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100065 বার পড়া হয়েছে
মহান মুক্তিযুদ্ধে জেলার ঘটনাবলী / Events of Liberation
মহান মুক্তিযুদ্ধে জেলার ঘটনাবলী
Events of Liberation
Events of Liberation
১৯৭১ সাল। মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ! পাকিস্তানের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে। সেনাপতি ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের পদ দখল করে আছেন। সংবিধান অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করার কথা, কিন্তু নানা টালবাহানা করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হচ্ছে না। আলোচনার নামে অহেতুক কালক্ষেপন করা হচ্ছে। দীর্ঘ দুই যুগ ধরে পাকিস্তানী শাসকদের শোষণ, ঘৃণা, আর নির্যাতনে বাঙ্গালীরা ক্ষুদ্ধ। স্বাধীকারের চেতনার প্রতীক বাঙ্গালীর বুকে আগুন জ্বলছে। নির্বাচনী রায়কে উপেক্ষা করে ২৫শে মার্চ, শান্ত নিস্তদ্ধ রাত্রি, নগরবাসী ঘুমে আচ্ছন্ন হঠাৎ পাক বাহিনীর জোয়ানদের রাইফেল-কামানের গর্জন কাঁপিয়ে তুললো নগরীকে। পাইকারী হত্যালীলা চলতে থাকল। খুঁজে খুঁজে হত্যা করতে লাগল দেশ প্রেমিক নেতা বুদ্ধিজীবিদের। নিরীহ জনগনের বিরুদ্ধে সে এক অঘোষিত যুদ্ধ। শেখ মুজিবকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হলো পাকিস্তানে। এদিকে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র দখল করে মেজর জিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন।
ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা যে ফলপ্রসু নয় তা নড়াইলের নেতৃবৃন্দ আগেই আশংকা করেছিলেন। তারাও বুঝেছিলেন যে পরিস্থিতি বাঙ্গালীদের একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেজন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে ঢাকা থেকে আসা জেলার মহিশাহ পাড়া নিবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব নূর মোহাম্মদ মিঞা, জনাব আনোয়ারুজ্জামান (তৎকালীন লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক), জনাব মুন্সী আতিয়ার রহমান, জনাব মুন্সি শামসুল আলম (আমানত মিয়া) প্রমূখের নেতৃত্বে মার্চের ১০/১২ তারিখে প্রতিরোধ বাহিনী তথা মুক্তি বাহিনী সংগঠিত করে প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া আরম্ভ হলো। ২৬ মার্চ সকালে লোহাগড়া কলেজের ছাত্র পটু শরীফ তৎকালীন লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান সাহেবের বাসায় ওয়্যারলেস মারফত যুদ্ধের ঘোষণা পৌঁছে দেন। ঐ বাসায় নূর মোহাম্মদ মিঞাও অবস্থান করছিলেন। সাথে সাথে জনাব নূরমোহাম্মদ মিঞা সে সময় লোহাগড়ার তরুণ ঔষধ ব্যবসায়ী অজয় মজুমদার (পরবর্তীতে ইউ পি চেয়ারম্যান) ও লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমানকে সাথে নিয়ে একটি মটর সাইকেল যোগে নড়াইল ছুটে যান। সে সময় নূরমোহাম্মদ মিঞার নেতৃত্বে একদল মুক্তি বাহিনী নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ করল, কিন্তু নড়াইল শহরে এই অস্ত্র রাখার জন্য কেউ সাহস করল না। জনাব আনোরুজ্জামান অস্ত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি তার নিজের বাসা এবং পরে লোহাগড়া হাইস্কুলকে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পরিনত করলেন। আরম্ভ হলো মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন। লোহাগড়ায় একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হল। জনাব নূর মোহাম্মদ মিঞা ,আনোয়ারুজ্জামান, অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান, মোঃ মতিয়ার রহমান, চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ সর্দার, তোবারক হোসেন মোল্লাহ, মাহবুব হক বিশ্বাস (বাবু বিশ্বাস) অধ্যাপক ওলিয়ার রহমান প্রমূখ এর নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। ছুটিতে আসা সেনা, নৌ, তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিডিআর), আনছার এবং পুলিশের জওয়ানরা এবং এসব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এল। তাছাড়া স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ক্ষেতে কারখানায় কাজ করা শ্রমিকরাও স্বত:স্ফুর্তভাবে দলে দলে এসে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ভীড় জমাতে লাগল। লক্ষীপাশা ক্লাবে আর একটা ক্যাম্প খোলা হলো। সংগ্রাম কমিটির এসব কাজে যারা সর্বপ্রকার সাহযোগিতা করলেন তাদের মধ্যে সেই ইতনা হাইস্কুলের হেড মাস্টার আমীরুজ্জামান (মনু মিয়া), লোহাগড়া হাইস্কুলের মাস্টার আসাদুজ্জামান (বর্তমানে নিউইয়র্কে কর্মরত) বিশিষ্ট ঔষধ ব্যবসায়ী পরবর্তীকালে লোহাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান অজয়কান্তি মজুমদার, ইসাহাক মিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখযোগ্য। লোহাগড়া ক্যাম্প থেকে যশোর ক্যান্টমেন্টের দিকে মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো বেশী সময় সাপেক্ষ বলে নড়াইল এ একটা ক্যাম্প স্থাপন করা বিশেষ জরুরী হয়ে পড়ল। পাক বাহিনী যশোর শহর অবরুদ্ধ করে রাখায় নড়াইলবাসী তখন অত্যন্ত আতংকগ্রস্থ। নেতৃবৃন্দ অনেকেই শহর ত্যাগ করেছেন। শুধু মাত্র বি. এম. মতিয়ুর রহমান কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নিজ বাসভবনে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। এই সময় নূর মোহাম্মদ মিঞাম আনোয়ারুজ্জামান, মতিয়ার রহমান (বাদশাহ মিয়া) প্রমুখ নড়াইল ডাকবাংলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করলেন। কয়েকদিনের মধ্যে নড়াইলের তদানিন্তন মহকুমা প্রশাসক জনাব কামাল সিদ্দিকী স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করলেন। এতে নড়াইলে এক নতুন গতি লাভ করল। এস. ডি. ও’র বাসভবনটি তখন মুক্তিযুদ্ধের শিবিরে পরিণত হলো। এই সময় এম. এম. এ খোন্দকার, কে. এ. হাফিজ, এম. সি. এ লেঃ মতিউর রহমান ও শাহেদ আলী, কালিয়ার জনাব এখলাছ উদ্দিন, জনাব আব্দুস সালাম (প্রধান শিক্ষক) মহকুমার অনেক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করার ফলে ১১ খান (নমশুদ্র গ্রাম) সহ নড়াইল লোহাগড়ার বহু সাধারণ অধিবাসী দলে দলে এসে মুক্তিযুদ্ধের কাতারে সামিল হতে লাগল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যশোর শহরে আক্রমণ পরিচালনা করা হল। পাকবাহিনী বিডিআর ক্যাম্প এবং যশোর শহর ছেড়ে ক্যান্টনমেন্ট এ আশ্রয় নিল। যশোর শহর আক্রমণের সময় হাল্কা অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর পিছনে ঢাল সড়কি বলস্নম এবং তার পিছনে ঢাক ঢোল হাতে হাজার হাজার জনতা যেভাবে উৎসাহ দান করেছিল তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ সৈন্যদের চারিদিক থেকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হল। ক্ষুধার তাড়না সহ্য করতে না পেরে অনেক খান সেনা বেসামরিক পোষাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাতে যেয়ে ধরা পড়ল। এই ভাবে প্রায় বিশজন খান সেনা নড়াইলে নিহত হয়। চাঁচড়া, চাড়াভিটা, নীলগঞ্জ এবং যশোরের ই, পি, আর ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতে থাকে। ক্যান্টনমেন্টের একটা অংশ থেকে বাঙ্গালী সৈন্যরা গোলাগুলিসহ বেরিয়ে এসে এদের সাথে যোগ দিল। কয়েকদিন ধরেই আশা করা হচ্ছিল, যশোর ক্যান্টনমেন্ট শ্বেতপতাকা উড়বে এবং পাক সেনারা আত্মসমর্পন করবে। কিন্তু নড়াইল এবং যশোরে উপর্যুপরি বিমান হামলায় এবং নাপাম বোমার আঘাতে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী প্রথমে যশোর এবং পরে নড়াইল শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দাইতলা ব্রিজে একটি প্রতিবন্ধক ব্যুহ পাক সেনাদের সাথে প্রবল যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদের মৃত্যুর পর ভেংগে যায়। শহরে বা সদর এলাকায় ক্যাম্প রাখা আর সমীচীন নয় বলে পল্লীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন শিবির স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি অব্যাহত রাখার চেষ্টা চলতে থাকল। জেলার ইতনা হাইস্কুলের সামনে কাশিয়ানী থানার রাতৈল নিবাসী ক্যাপ্টেন দোহার নেতৃত্বে যে ক্যাম্পটি খোলা হয়েছিল তা, বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মে মাসের মাঝামাঝি অবস্থায় আরও অবনতি হল। পাক বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে আগুন জ্বালাতে লাগল, দোকানপাট লুট করতে আরম্ভ করল এবং অবলীলাক্রমে নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করতে আরম্ভ করল। যুবক দেখলেই তারা তাকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে গুলি করত। অবলা শিশু-নারী এবং বৃদ্ধরাও তাদের বুলেটের আঘাত থেকে নিষ্কৃতি পেতনা। প্রত্যন্ত গ্রামের লোকেরাও তখন নিদারুণ শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এমতাবস্থায় মুক্তিবাহিনী বাধ্য হল এপার বাংলা ছেড়ে বন্ধুদেশ ওপার বাংলায় আশ্রয় নিতে। যুবকরা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের পিছু নিল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে। সেই সাথে আরম্ভ হল দলে দলে বাঙ্গালীর ভিটে মাটির মায়া ত্যাগ করে শরণার্থী হিসাবে ভারতে পাড়ি দেয়া।
১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হলে দলে দলে সরকারী কর্মচারী, সামরিক বাহিনীর জোয়ান ও কর্মকর্তা, শিক্ষক শ্রমিক বুদ্ধিজীবী আত্মীয় পরিজন বাড়ী ঘর ফেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য গ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদিকে মুজিবনগর সরকারের অধীনে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হল। প্রত্যেক কর্মসূচী ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীন দেশ পরিচালনার আদর্শে সঞ্জিবীত। লেঃ মতিয়ার রহমান টালিখোলা এবং চাপাবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা শিবিরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এ্যাডভোকেট ওলিয়ার রহমান, তবিবর রহমান রুনু (সাবেক পরিচালক পিএসসি), মরিচপাশা গ্রামের সিরাজুল হক (পরবর্তীতে যশোর জেলা পরিষদে চাকুরি করতেন) ক্যাম্প পরিচালনায় তাঁর সহকারী ছিলেন। আমীরুজ্জামান একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরের রাজনৈতিক মটিভেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আনোয়ারুজ্জামান মুজিবনগরে সর্ব পর্যায়ের শিক্ষক বুদ্ধিজীবি স্বমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহকারী সম্পাদক হিসেবে শরনার্থী শিক্ষকদের নিয়ে ক্যাম্প স্কুল পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ পত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ মিশনের সহায়ক শক্তি হিসাবে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচার এবং সাহায্য সহযোগিতার আবেদনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিডিআর এর সমর্থন আদায়ের পিছনে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর দেশমুক্ত হবার পরও শরনার্থী এবং মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্যে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে এতদঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ বিদেশে ট্রেনিং গ্রহণ করে সংগঠিত অবস্থায় নড়াইল জেলায় আসে। জেলার লোহাগড়ার গ্রামাঞ্চলে তখন নক্সালদের খুব প্রতাপ। মার্চ-এপ্রিলের দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নামে অস্ত্র হাতে নিয়ে কিছু সংখ্যক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে নিষ্ক্রিয় থাকে। একটা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা মুজিবনগরে পাড়ি জমাবার পর এরা একটা ভিন্নরূপী বাহিনী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অস্ত্রধারী বলেই এরা নিরীহ লোকদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে অবৈধভাবে অর্থসংগ্রহ করে এবং নির্যাতন হত্যা চালিয়ে যায়। কোন কোন অঞ্চলে নিজেদের শক্তিশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে এরা মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। মাগুরার পুলুমের একটি অংশের সাথে মিশে এরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাগমণে বাধা সৃষ্টি করে কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। এটা মুক্তিযুদ্ধে এক বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করে মুক্তিবাহিনী তাদের সাথে সংঘাতে আসতে বাধ্য হয়। ২৭শে আগস্ট মহিশাহপাড়ায় এবং এর কয়েকদিন পরেই কুমারকান্দায় ইউনুস আলী ও আবুল ইসলাম খোকন এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ ও দাউদ হোসেনের নেতৃত্বে ২১ জন নক্সাল অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্নতা ঘোষণা করে। এর অব্যবহিত পরেই আড়িয়ারা ক্যাম্প থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে ইউনুস গন্তব্যে যেয়ে নক্সালদের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করে এবং মমতাকে ধরে আনে। পড়ে আড়িয়ারা হাইস্কুলের সামনে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ প্রকাশ্যে জনতার সামনে মমতাকে হত্যা করে। তার সহযোগীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন স্থান থেকে নক্সালরা লাহুড়িয়ায় জমা হয়ে এখানে তাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। সেপ্টেম্বরের শেষ শুক্রবারে ইউনুস, খোকন, মাহমুদ, কালনায় আঃ রাজ্জাক, আলফাডাঙ্গার হেমায়েত, মাকড়াইলের কবীর, কামরুল, লাহুড়িয়ার বাদশা মিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে একটি বিরাট দল কালীগঞ্জ বাজারের পাশে এই নক্সালদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলার পর নক্সালরা পরাভূত হয় এবং বরগুনার খসরু ও লাহুড়িয়ার আহম্মদ এই সংঘর্ষে নিহত হয়। কয়েকজন নক্সাল ধরা পড়ে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।
নক্সালদের সাথে মুক্তিবাহিনীর আর একটি বড় সংঘর্ষ হয় কুমড়িতে। যোগীয়ায় ঈদ্রিস ওরফে যতুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নক্সালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। লুৎফর বিশ্বাস সহ বেশ কয়েকজন এতে যোগ দেন। কিন্তু এ সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী বিপর্যস্ত হয়। ঈদ্রিস আহমদ, কোলার তরুণ ছাত্র ইয়ার আলী, বাটিকাবাড়ির আব্দুল মান্নানসহ তালবাড়িয়া ও অন্যান্য গ্রামের ৬জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও নক্সাল আহত হয়। এরপর ইউনুস, চোরা আক্রমণ চালিয়ে একসময় ওদের নেতা উজীর আলীকে গ্রেনেডসহ ধরে ফেলে। অন্যান্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সার্বিক মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা ছাড়াও লোহাগড়া ও নড়াইলকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই পাক সেনারা শহরে, গ্রামে ঢুকে জ্বালাও পোড়াও আর লুটতরাজের বিভীষিকা চালিয়ে যায়। নড়াইল ও লোহাগড়া থানায় তারা স্থানীয় লোকদের মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক লোককে রাজাকার হিসাবে দলে ভিড়ায়। এরা ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনীর সহচর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আছে জানতে পারলেই তারা তাকে সদরে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করত। এদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে লাগল। ৫ই ডিসেম্বর এড়েন্দার কাছে ১০০ বস্তা আলু ও ১৫০ বস্তা গমসহ ওদের সশস্ত্র প্রহরারত রসদের নৌকা এরা আক্রমণ করে খাদ্যদ্রব্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয় এবং লোহাগড়া উপজেলার সিপাহীদের ৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পালন না করায় থানা আক্রমণের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ৭ই ডিসেম্বর সকালেই চারিদিক থেকে থানাকে ঘিরে ফেলা হয় এবং আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। লক্ষ্মীপাশার তালুকদার খোকন, ইউনুস, কোলার লুৎফর মাস্টার, মঙ্গল হাটার আব্দুর রউফ, আলী মিয়া, শরীফ খসরুজ্জামান (সাবেক সাংসদ), মহিশাহ পাড়ার শেখ মতিয়ার রহমান (বন বিভাগে কর্মরত ছিলেন), ইতনার আকবর, শেখ মিজানুর রহমান (ঝিলু), মাছেম জমাদ্দার, চাচই গ্রামের মুনছুর মোল্লাহ, পাচুড়িয়ার আলিম মল্লিক, চাচই এর ইলিয়াছ (বর্তমান ব্যাংক অফিসার) সহ অনেকের গ্রুপই এই আক্রমণে অংশ নেয়। ভোর ৫টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলার পর থানা আত্মসমর্পণ করে। রাজাকার কমান্ডার জল্লাদ আশরাফ সহ ওরা ৭জন নিহত হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোলার হাবিবর রহমান এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২জন শাহাদৎ বরণ করেন। শেষোক্ত একজনকে ইতনায় আর একজনকে বড়দিয়ায় কবর দেওয়া হয়। আমডাঙ্গা গ্রামের আবুল হোসেন গামা সহ অনেকেই আহত হন।
৮ ডিসেম্বর রাজাকারদের হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হল লোহাগড়া কলেজের ছাত্র মিজানুর রহমান। ঐ রাত্রে রাজাকারদের সহায়তা দানের অপরাধে নড়াইলের এসডিওকে মুক্তিবাহিনীর আবু গাজী গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ৯ই ডিসেম্বর কুখ্যাত সুলাইমান রাজাকার এর বাহিনী এবং রেঞ্জারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এক ভীষণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। নড়াইলের জিন্নাহ, উজীর আলী, হুমায়ুনহ অধিকাংশই লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিচালনা করে। রাজাকার রেঞ্জাররা সহজেই আত্মসমর্পণ করল। এ ছাড়া রূপগঞ্জ ওয়াপদার বাংলোর সামনে ১৯জন রেঞ্জার বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করল। হাওয়াই ব্রীজ ওড়ানো লোহাগড়া মুক্তিবাহিনীর এক উজ্জল কীর্তি।
এতদিন ধরে সহায়ক শক্তির সাথে লড়বার পর এইবার লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি খান সেনাদের সাথে লড়াইয়ের পালা এল। যশোর থেকে পাক সেনাদের গাড়ী ভর্তি সৈন্য, অস্ত্র এবং রসদ লোহাগড়ার উপর দিয়ে ভাটিয়াপাড়ায় পাঠাত। নভেম্বরের শেষে ঈদের দিন সকালে কালনার রাস্তায় এদের সাথে মুক্তিবাহিনীর তুমুল লড়াই হয়। মাহমুদ, মতিয়ার, খোকন, ইউনুস, দাউদ, মান্নান, মোতাহার, মাছেম জমাদ্দার, তাইফুর মোল্লাহ, হুমায়ুন, চাচই গ্রামের মনছুর মোল্যা, চরকরফার আখতার, আকবর, মহিশাহপাড়ার মোশারফ হোসেন, মন্টু, তুষার, মিজানুর মিয়া, মঙ্গলহাটার আব্দুর রউফ, খসরুজ্জামান প্রমুখ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে অংশ নেন। স্থানীয় লোকেরাও স্বত:স্ফুর্তভাবে এতে যোগ দেন। যুদ্ধে ৭/৮জন খান সেনা নিহত হয়। একজন ধরা পড়ে যাকে কালিয়ায় পাঠানো হয়। এ যুদ্ধে সাঈদ অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে চাইনিজ এল. এম. জি. ছিনিয়ে আনেন এবং দবির খানদের কাছ থেকে যুদ্ধের ম্যাপ উদ্ধার করেন। যুদ্ধে চাচই এর হাবিবুর রহমান এবং কালনা গ্রামের আকমাল মুন্সীর ভাই নজরুল ইসলাম শাহাদৎ বরণ করেন।
ভাটিয়াপাড়াকে পাক সেনারা ছোটখাট ক্যান্টনমেন্ট হিসাবে গড়ে তুলেছিল। ওখান থেকে বেরিয়েই হানাদার বাহিনী মধুমতির ওপারে গোপালগঞ্জের হেমায়েত বাহিনী, আলফা ডাঙ্গার আঃ মান্নান বীর বিক্রমের বাহিনীর সাথে লোহাগড়ার মুক্তিবাহিনীর একটি বড় অংশ যোগ দেয়। কিন্তু ৪টা বোমারু বিমানের একাধিক হামলায় এবং বোমার আঘাতে মুক্তিবাহিনী ছত্রভংগ হয়ে ফিরে আসে এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকেও একইভাবে একবার মুক্তিবাহিনীকে হটে আসতে হয়। একাধিকবার বিপর্যস্ত হবার পর মুক্তিবাহিনী ভাটিয়াপাড়ায় একটা বড় ধরণের আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল। ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ মুক্ত হয়। পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ২১শে ডিসেম্বর আলফাডাঙ্গা থানার আব্দুল মান্নান বীরবিক্রম, মালাগ্রামের সৈয়দ ইকরামুল হক সহ এপার ওপারের বিশিষ্ট মুক্তিবাহিনী ছাড়াও লেঃ কমল সিদ্দিক, ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর মঞ্জুর এ যুদ্ধের নেতৃত্বদান করেন। সারাদিন গোলাগুলির পর কমল সিদ্দিকী গুরুতরভাবে আহত হবার পর মুক্তিবাহিনী ঐ দিনের মত পশ্চাদপসারণ করে। কিন্তু তাদের মনোবল ভাঙ্গে না। পরদিন ২২শে ডিসেম্বরের শেষ বারের মত হানাদার বাহিনীর উপর মরণ আঘাত হানা হয়। এ জীবন মরণ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা দাউদ বাঙ্কার থেকে একজন খান সেনাকে ধরে আনেন। দীর্ঘ কয়েকঘন্টা যুদ্ধের পর খান সেনারা পরাভূত হয়। উভয় পক্ষে কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রচুর গোলাবারুদ হাতে আসে। ৪৮জন পাঞ্জাবী এবং বেলূচী সৈন্যকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। এ যুদ্ধে যারা কৃতিত্বের সাথে লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আলমডাঙ্গা গ্রামের তাইফুর মোল্লাহ, হুমায়ুন কবির, চাচই গ্রামের মুনছুর মোল্লাহ, মাছেম জমাদ্দার, মোতাহার, মোচড়া গ্রামের আসাদুজ্জামান আছাদ, চরকালনার বাদশা, কুমার কান্দার গোলাম মোস্তফা (সাবেক ইউপি সদস্য), চাচই ধানাইড় এর আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক খুরশিদ আলম, মঙ্গল হাটার আঃ রউফ, চরকরফার আক্তার, আকবর, মহিশাহ পাড়ার কিউবার, নুরমোহাম্মদ, মিজানুর রহমান মিয়া, মাকড়াইলের কামরুজ্জামান, কবির হোসেন কবির, তৎকালীন মহকুমার মুজিব বাহিনীর প্রধান মরহুম জাহিদুর রহমান জাহিদ, শিকদার আনোয়ারুল ইসলাম, মহিশাহ পাড়ার সরোয়ার রহমান, লোহাগড়া গ্রামের এ. কে. এম আনোয়ারুজ্জামান মিঞা, ইতনার মাহফুজুর রহমান লুলু, কোলা গ্রামের আব্দুল হান্নান, চাচই গ্রামের ইদ্রিস মিয়া, ধলাইতলা গ্রামের সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ লুলু, ইতনার-দৌলতপুর গ্রামের শিশির রঞ্জন সাধুখা (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ফকির মফিজুল ইসলাম। এছাড়া জেলার মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী জেলা মাগুরা এবং খুলনার শিরোমনি প্রভৃতি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। এর মধ্যে জয়পুর নিবাসী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছলেমান সরদার বাবু, খুলনার শিরোমনিতে যুদ্ধ করে কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি অনেক স্থানেই যুদ্ধ করেছেন এবং আহত হয়েছেন। বর্তমানে সাইকেলের মিস্ত্রি। জানা অজানা যে সমস্ত সূর্য সন্তানেরা সেদিন দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য সর্ব প্রকার ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আত্মবিসর্জন দিয়েছেন জাতি চিরকাল তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেদিনের যে যুবক সেদিন যুদ্ধ করেছিল স্বাধীন জাতির জন্য, কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠিকে সমর্থন না করলে তাদের দৃষ্টিতে সে মুক্তিযোদ্ধা নয়। এ ধরণের অনেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে। নড়াইল জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি বিশেষ মহলের একগুয়েমিতে জেলার লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। উল্লেখ্য বাংলাদেশের মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার পরে নড়াইল জেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে আবার লোহাগড়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা জেলার মধ্যে বেশি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ফকির মফিজুল ইসলাম দীর্ঘদিন যাবত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বিভিন্ন সরকারের আমলে তুলে ধরলেও সমাধান করতে পারে নাই। আজও এ জেলার শতশত মুক্তিযোদ্ধা তাদের পরিবার বর্গসহ মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক : আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবের আলোচনা যে ফলপ্রসু নয় তা নড়াইলের নেতৃবৃন্দ আগেই আশংকা করেছিলেন। তারাও বুঝেছিলেন যে পরিস্থিতি বাঙ্গালীদের একটা স্বাধীনতা যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সেজন্য প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসাবে ঢাকা থেকে আসা জেলার মহিশাহ পাড়া নিবাসী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব নূর মোহাম্মদ মিঞা, জনাব আনোয়ারুজ্জামান (তৎকালীন লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক), জনাব মুন্সী আতিয়ার রহমান, জনাব মুন্সি শামসুল আলম (আমানত মিয়া) প্রমূখের নেতৃত্বে মার্চের ১০/১২ তারিখে প্রতিরোধ বাহিনী তথা মুক্তি বাহিনী সংগঠিত করে প্রাথমিক ট্রেনিং দেয়া আরম্ভ হলো। ২৬ মার্চ সকালে লোহাগড়া কলেজের ছাত্র পটু শরীফ তৎকালীন লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান সাহেবের বাসায় ওয়্যারলেস মারফত যুদ্ধের ঘোষণা পৌঁছে দেন। ঐ বাসায় নূর মোহাম্মদ মিঞাও অবস্থান করছিলেন। সাথে সাথে জনাব নূরমোহাম্মদ মিঞা সে সময় লোহাগড়ার তরুণ ঔষধ ব্যবসায়ী অজয় মজুমদার (পরবর্তীতে ইউ পি চেয়ারম্যান) ও লোহাগড়া কলেজের অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমানকে সাথে নিয়ে একটি মটর সাইকেল যোগে নড়াইল ছুটে যান। সে সময় নূরমোহাম্মদ মিঞার নেতৃত্বে একদল মুক্তি বাহিনী নড়াইল ট্রেজারী ভেঙ্গে অস্ত্র সংগ্রহ করল, কিন্তু নড়াইল শহরে এই অস্ত্র রাখার জন্য কেউ সাহস করল না। জনাব আনোরুজ্জামান অস্ত্র সংরক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তিনি তার নিজের বাসা এবং পরে লোহাগড়া হাইস্কুলকে মুক্তিযোদ্ধাদের শিবিরে পরিনত করলেন। আরম্ভ হলো মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন। লোহাগড়ায় একটি স্বাধীনতা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হল। জনাব নূর মোহাম্মদ মিঞা ,আনোয়ারুজ্জামান, অধ্যক্ষ ওয়াহিদুর রহমান, মোঃ মতিয়ার রহমান, চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ সর্দার, তোবারক হোসেন মোল্লাহ, মাহবুব হক বিশ্বাস (বাবু বিশ্বাস) অধ্যাপক ওলিয়ার রহমান প্রমূখ এর নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন। ছুটিতে আসা সেনা, নৌ, তৎকালীন ইপিআর (বর্তমান বিডিআর), আনছার এবং পুলিশের জওয়ানরা এবং এসব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ স্বেচ্ছাপ্রনোদিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এল। তাছাড়া স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। ক্ষেতে কারখানায় কাজ করা শ্রমিকরাও স্বত:স্ফুর্তভাবে দলে দলে এসে মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পে ভীড় জমাতে লাগল। লক্ষীপাশা ক্লাবে আর একটা ক্যাম্প খোলা হলো। সংগ্রাম কমিটির এসব কাজে যারা সর্বপ্রকার সাহযোগিতা করলেন তাদের মধ্যে সেই ইতনা হাইস্কুলের হেড মাস্টার আমীরুজ্জামান (মনু মিয়া), লোহাগড়া হাইস্কুলের মাস্টার আসাদুজ্জামান (বর্তমানে নিউইয়র্কে কর্মরত) বিশিষ্ট ঔষধ ব্যবসায়ী পরবর্তীকালে লোহাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান অজয়কান্তি মজুমদার, ইসাহাক মিয়া প্রমুখ নেতৃবৃন্দের নাম উল্লেখযোগ্য। লোহাগড়া ক্যাম্প থেকে যশোর ক্যান্টমেন্টের দিকে মুক্তিযোদ্ধা পাঠানো বেশী সময় সাপেক্ষ বলে নড়াইল এ একটা ক্যাম্প স্থাপন করা বিশেষ জরুরী হয়ে পড়ল। পাক বাহিনী যশোর শহর অবরুদ্ধ করে রাখায় নড়াইলবাসী তখন অত্যন্ত আতংকগ্রস্থ। নেতৃবৃন্দ অনেকেই শহর ত্যাগ করেছেন। শুধু মাত্র বি. এম. মতিয়ুর রহমান কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে নিজ বাসভবনে আতংকে দিন কাটাচ্ছেন। এই সময় নূর মোহাম্মদ মিঞাম আনোয়ারুজ্জামান, মতিয়ার রহমান (বাদশাহ মিয়া) প্রমুখ নড়াইল ডাকবাংলায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প স্থাপন করলেন। কয়েকদিনের মধ্যে নড়াইলের তদানিন্তন মহকুমা প্রশাসক জনাব কামাল সিদ্দিকী স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করলেন। এতে নড়াইলে এক নতুন গতি লাভ করল। এস. ডি. ও’র বাসভবনটি তখন মুক্তিযুদ্ধের শিবিরে পরিণত হলো। এই সময় এম. এম. এ খোন্দকার, কে. এ. হাফিজ, এম. সি. এ লেঃ মতিউর রহমান ও শাহেদ আলী, কালিয়ার জনাব এখলাছ উদ্দিন, জনাব আব্দুস সালাম (প্রধান শিক্ষক) মহকুমার অনেক নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধে এগিয়ে এলেন। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সৃষ্টি করার ফলে ১১ খান (নমশুদ্র গ্রাম) সহ নড়াইল লোহাগড়ার বহু সাধারণ অধিবাসী দলে দলে এসে মুক্তিযুদ্ধের কাতারে সামিল হতে লাগল। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে যশোর শহরে আক্রমণ পরিচালনা করা হল। পাকবাহিনী বিডিআর ক্যাম্প এবং যশোর শহর ছেড়ে ক্যান্টনমেন্ট এ আশ্রয় নিল। যশোর শহর আক্রমণের সময় হাল্কা অস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনীর পিছনে ঢাল সড়কি বলস্নম এবং তার পিছনে ঢাক ঢোল হাতে হাজার হাজার জনতা যেভাবে উৎসাহ দান করেছিল তা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা।
ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ সৈন্যদের চারিদিক থেকে খাদ্য ও পানীয় সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হল। ক্ষুধার তাড়না সহ্য করতে না পেরে অনেক খান সেনা বেসামরিক পোষাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালাতে যেয়ে ধরা পড়ল। এই ভাবে প্রায় বিশজন খান সেনা নড়াইলে নিহত হয়। চাঁচড়া, চাড়াভিটা, নীলগঞ্জ এবং যশোরের ই, পি, আর ক্যাম্পে বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান করতে থাকে। ক্যান্টনমেন্টের একটা অংশ থেকে বাঙ্গালী সৈন্যরা গোলাগুলিসহ বেরিয়ে এসে এদের সাথে যোগ দিল। কয়েকদিন ধরেই আশা করা হচ্ছিল, যশোর ক্যান্টনমেন্ট শ্বেতপতাকা উড়বে এবং পাক সেনারা আত্মসমর্পন করবে। কিন্তু নড়াইল এবং যশোরে উপর্যুপরি বিমান হামলায় এবং নাপাম বোমার আঘাতে টিকতে না পেরে মুক্তিবাহিনী প্রথমে যশোর এবং পরে নড়াইল শহর ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দাইতলা ব্রিজে একটি প্রতিবন্ধক ব্যুহ পাক সেনাদের সাথে প্রবল যুদ্ধে নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা বশীর আহমদের মৃত্যুর পর ভেংগে যায়। শহরে বা সদর এলাকায় ক্যাম্প রাখা আর সমীচীন নয় বলে পল্লীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন শিবির স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং এবং যুদ্ধ প্রস্তুতি অব্যাহত রাখার চেষ্টা চলতে থাকল। জেলার ইতনা হাইস্কুলের সামনে কাশিয়ানী থানার রাতৈল নিবাসী ক্যাপ্টেন দোহার নেতৃত্বে যে ক্যাম্পটি খোলা হয়েছিল তা, বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
মে মাসের মাঝামাঝি অবস্থায় আরও অবনতি হল। পাক বাহিনী অতর্কিত হামলা চালিয়ে বিভিন্ন গ্রামে-গঞ্জে আগুন জ্বালাতে লাগল, দোকানপাট লুট করতে আরম্ভ করল এবং অবলীলাক্রমে নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করতে আরম্ভ করল। যুবক দেখলেই তারা তাকে মুক্তিযোদ্ধা মনে করে গুলি করত। অবলা শিশু-নারী এবং বৃদ্ধরাও তাদের বুলেটের আঘাত থেকে নিষ্কৃতি পেতনা। প্রত্যন্ত গ্রামের লোকেরাও তখন নিদারুণ শঙ্কা নিয়ে দিন কাটাচ্ছে। এমতাবস্থায় মুক্তিবাহিনী বাধ্য হল এপার বাংলা ছেড়ে বন্ধুদেশ ওপার বাংলায় আশ্রয় নিতে। যুবকরা ঝাঁকে ঝাঁকে তাদের পিছু নিল মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং গ্রহণ করে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে দেশ স্বাধীন করার ব্রত নিয়ে। সেই সাথে আরম্ভ হল দলে দলে বাঙ্গালীর ভিটে মাটির মায়া ত্যাগ করে শরণার্থী হিসাবে ভারতে পাড়ি দেয়া।
১৭ই এপ্রিল মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠিত হলে দলে দলে সরকারী কর্মচারী, সামরিক বাহিনীর জোয়ান ও কর্মকর্তা, শিক্ষক শ্রমিক বুদ্ধিজীবী আত্মীয় পরিজন বাড়ী ঘর ফেলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুজিবনগর সরকারের আনুগত্য গ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদিকে মুজিবনগর সরকারের অধীনে বিভিন্ন সামরিক ও বেসামরিক কর্মসূচী গ্রহণ করা হল। প্রত্যেক কর্মসূচী ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং স্বাধীন দেশ পরিচালনার আদর্শে সঞ্জিবীত। লেঃ মতিয়ার রহমান টালিখোলা এবং চাপাবাড়িয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অভ্যর্থনা শিবিরের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। এ্যাডভোকেট ওলিয়ার রহমান, তবিবর রহমান রুনু (সাবেক পরিচালক পিএসসি), মরিচপাশা গ্রামের সিরাজুল হক (পরবর্তীতে যশোর জেলা পরিষদে চাকুরি করতেন) ক্যাম্প পরিচালনায় তাঁর সহকারী ছিলেন। আমীরুজ্জামান একটি মুক্তিযোদ্ধা শিবিরের রাজনৈতিক মটিভেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আনোয়ারুজ্জামান মুজিবনগরে সর্ব পর্যায়ের শিক্ষক বুদ্ধিজীবি স্বমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সহকারী সম্পাদক হিসেবে শরনার্থী শিক্ষকদের নিয়ে ক্যাম্প স্কুল পরিচালনা, মুক্তিযুদ্ধ ক্যাম্পের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ওষুধ পত্র সংগ্রহের প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশ মিশনের সহায়ক শক্তি হিসাবে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রচার এবং সাহায্য সহযোগিতার আবেদনের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। প্রাথমিক পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিডিআর এর সমর্থন আদায়ের পিছনে তার উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর দেশমুক্ত হবার পরও শরনার্থী এবং মুক্তি যোদ্ধাদের সাহায্যে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে এতদঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের একটা অংশ বিদেশে ট্রেনিং গ্রহণ করে সংগঠিত অবস্থায় নড়াইল জেলায় আসে। জেলার লোহাগড়ার গ্রামাঞ্চলে তখন নক্সালদের খুব প্রতাপ। মার্চ-এপ্রিলের দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের নামে অস্ত্র হাতে নিয়ে কিছু সংখ্যক যুবক মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করে নিষ্ক্রিয় থাকে। একটা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা মুজিবনগরে পাড়ি জমাবার পর এরা একটা ভিন্নরূপী বাহিনী হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। অস্ত্রধারী বলেই এরা নিরীহ লোকদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে অবৈধভাবে অর্থসংগ্রহ করে এবং নির্যাতন হত্যা চালিয়ে যায়। কোন কোন অঞ্চলে নিজেদের শক্তিশালী হিসাবে প্রতিষ্ঠা করে এরা মুক্তিযোদ্ধাদেরও বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। মাগুরার পুলুমের একটি অংশের সাথে মিশে এরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাগমণে বাধা সৃষ্টি করে কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেয়। এটা মুক্তিযুদ্ধে এক বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করে মুক্তিবাহিনী তাদের সাথে সংঘাতে আসতে বাধ্য হয়। ২৭শে আগস্ট মহিশাহপাড়ায় এবং এর কয়েকদিন পরেই কুমারকান্দায় ইউনুস আলী ও আবুল ইসলাম খোকন এর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ ও দাউদ হোসেনের নেতৃত্বে ২১ জন নক্সাল অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্নতা ঘোষণা করে। এর অব্যবহিত পরেই আড়িয়ারা ক্যাম্প থেকে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে সাথে নিয়ে ইউনুস গন্তব্যে যেয়ে নক্সালদের একটি ঘাঁটি আক্রমণ করে এবং মমতাকে ধরে আনে। পড়ে আড়িয়ারা হাইস্কুলের সামনে মুক্তিযোদ্ধা ইউনুছ প্রকাশ্যে জনতার সামনে মমতাকে হত্যা করে। তার সহযোগীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন স্থান থেকে নক্সালরা লাহুড়িয়ায় জমা হয়ে এখানে তাদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। সেপ্টেম্বরের শেষ শুক্রবারে ইউনুস, খোকন, মাহমুদ, কালনায় আঃ রাজ্জাক, আলফাডাঙ্গার হেমায়েত, মাকড়াইলের কবীর, কামরুল, লাহুড়িয়ার বাদশা মিয়া প্রমুখের নেতৃত্বে একটি বিরাট দল কালীগঞ্জ বাজারের পাশে এই নক্সালদের সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ৮টা থেকে ১১টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলার পর নক্সালরা পরাভূত হয় এবং বরগুনার খসরু ও লাহুড়িয়ার আহম্মদ এই সংঘর্ষে নিহত হয়। কয়েকজন নক্সাল ধরা পড়ে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।
নক্সালদের সাথে মুক্তিবাহিনীর আর একটি বড় সংঘর্ষ হয় কুমড়িতে। যোগীয়ায় ঈদ্রিস ওরফে যতুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী নক্সালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। লুৎফর বিশ্বাস সহ বেশ কয়েকজন এতে যোগ দেন। কিন্তু এ সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী বিপর্যস্ত হয়। ঈদ্রিস আহমদ, কোলার তরুণ ছাত্র ইয়ার আলী, বাটিকাবাড়ির আব্দুল মান্নানসহ তালবাড়িয়া ও অন্যান্য গ্রামের ৬জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত এবং বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা ও নক্সাল আহত হয়। এরপর ইউনুস, চোরা আক্রমণ চালিয়ে একসময় ওদের নেতা উজীর আলীকে গ্রেনেডসহ ধরে ফেলে। অন্যান্যরা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।
সার্বিক মুক্তিযুদ্ধে গৌরবজনক ভূমিকা ছাড়াও লোহাগড়া ও নড়াইলকে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। মে মাসের মাঝামাঝি থেকেই পাক সেনারা শহরে, গ্রামে ঢুকে জ্বালাও পোড়াও আর লুটতরাজের বিভীষিকা চালিয়ে যায়। নড়াইল ও লোহাগড়া থানায় তারা স্থানীয় লোকদের মধ্যে থেকে কিছু সংখ্যক লোককে রাজাকার হিসাবে দলে ভিড়ায়। এরা ইয়াহিয়া খানের জল্লাদ বাহিনীর সহচর। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আছে জানতে পারলেই তারা তাকে সদরে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করত। এদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য মুক্তিবাহিনী সংগঠিত হতে লাগল। ৫ই ডিসেম্বর এড়েন্দার কাছে ১০০ বস্তা আলু ও ১৫০ বস্তা গমসহ ওদের সশস্ত্র প্রহরারত রসদের নৌকা এরা আক্রমণ করে খাদ্যদ্রব্য গরীবদের মধ্যে বিতরণ করে দেয় এবং লোহাগড়া উপজেলার সিপাহীদের ৬ই ডিসেম্বরের মধ্যে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। নির্দেশ পালন না করায় থানা আক্রমণের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ৭ই ডিসেম্বর সকালেই চারিদিক থেকে থানাকে ঘিরে ফেলা হয় এবং আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। লক্ষ্মীপাশার তালুকদার খোকন, ইউনুস, কোলার লুৎফর মাস্টার, মঙ্গল হাটার আব্দুর রউফ, আলী মিয়া, শরীফ খসরুজ্জামান (সাবেক সাংসদ), মহিশাহ পাড়ার শেখ মতিয়ার রহমান (বন বিভাগে কর্মরত ছিলেন), ইতনার আকবর, শেখ মিজানুর রহমান (ঝিলু), মাছেম জমাদ্দার, চাচই গ্রামের মুনছুর মোল্লাহ, পাচুড়িয়ার আলিম মল্লিক, চাচই এর ইলিয়াছ (বর্তমান ব্যাংক অফিসার) সহ অনেকের গ্রুপই এই আক্রমণে অংশ নেয়। ভোর ৫টা থেকে ৯টা পর্যন্ত গোলাগুলি চলার পর থানা আত্মসমর্পণ করে। রাজাকার কমান্ডার জল্লাদ আশরাফ সহ ওরা ৭জন নিহত হয়। এদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কোলার হাবিবর রহমান এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২জন শাহাদৎ বরণ করেন। শেষোক্ত একজনকে ইতনায় আর একজনকে বড়দিয়ায় কবর দেওয়া হয়। আমডাঙ্গা গ্রামের আবুল হোসেন গামা সহ অনেকেই আহত হন।
৮ ডিসেম্বর রাজাকারদের হাতে নৃশংসভাবে শহীদ হল লোহাগড়া কলেজের ছাত্র মিজানুর রহমান। ঐ রাত্রে রাজাকারদের সহায়তা দানের অপরাধে নড়াইলের এসডিওকে মুক্তিবাহিনীর আবু গাজী গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ৯ই ডিসেম্বর কুখ্যাত সুলাইমান রাজাকার এর বাহিনী এবং রেঞ্জারদের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনী এক ভীষণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হল। নড়াইলের জিন্নাহ, উজীর আলী, হুমায়ুনহ অধিকাংশই লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ পরিচালনা করে। রাজাকার রেঞ্জাররা সহজেই আত্মসমর্পণ করল। এ ছাড়া রূপগঞ্জ ওয়াপদার বাংলোর সামনে ১৯জন রেঞ্জার বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করল। হাওয়াই ব্রীজ ওড়ানো লোহাগড়া মুক্তিবাহিনীর এক উজ্জল কীর্তি।
এতদিন ধরে সহায়ক শক্তির সাথে লড়বার পর এইবার লোহাগড়ার মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি খান সেনাদের সাথে লড়াইয়ের পালা এল। যশোর থেকে পাক সেনাদের গাড়ী ভর্তি সৈন্য, অস্ত্র এবং রসদ লোহাগড়ার উপর দিয়ে ভাটিয়াপাড়ায় পাঠাত। নভেম্বরের শেষে ঈদের দিন সকালে কালনার রাস্তায় এদের সাথে মুক্তিবাহিনীর তুমুল লড়াই হয়। মাহমুদ, মতিয়ার, খোকন, ইউনুস, দাউদ, মান্নান, মোতাহার, মাছেম জমাদ্দার, তাইফুর মোল্লাহ, হুমায়ুন, চাচই গ্রামের মনছুর মোল্যা, চরকরফার আখতার, আকবর, মহিশাহপাড়ার মোশারফ হোসেন, মন্টু, তুষার, মিজানুর মিয়া, মঙ্গলহাটার আব্দুর রউফ, খসরুজ্জামান প্রমুখ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধারা এ যুদ্ধে অংশ নেন। স্থানীয় লোকেরাও স্বত:স্ফুর্তভাবে এতে যোগ দেন। যুদ্ধে ৭/৮জন খান সেনা নিহত হয়। একজন ধরা পড়ে যাকে কালিয়ায় পাঠানো হয়। এ যুদ্ধে সাঈদ অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে চাইনিজ এল. এম. জি. ছিনিয়ে আনেন এবং দবির খানদের কাছ থেকে যুদ্ধের ম্যাপ উদ্ধার করেন। যুদ্ধে চাচই এর হাবিবুর রহমান এবং কালনা গ্রামের আকমাল মুন্সীর ভাই নজরুল ইসলাম শাহাদৎ বরণ করেন।
ভাটিয়াপাড়াকে পাক সেনারা ছোটখাট ক্যান্টনমেন্ট হিসাবে গড়ে তুলেছিল। ওখান থেকে বেরিয়েই হানাদার বাহিনী মধুমতির ওপারে গোপালগঞ্জের হেমায়েত বাহিনী, আলফা ডাঙ্গার আঃ মান্নান বীর বিক্রমের বাহিনীর সাথে লোহাগড়ার মুক্তিবাহিনীর একটি বড় অংশ যোগ দেয়। কিন্তু ৪টা বোমারু বিমানের একাধিক হামলায় এবং বোমার আঘাতে মুক্তিবাহিনী ছত্রভংগ হয়ে ফিরে আসে এর আগে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকেও একইভাবে একবার মুক্তিবাহিনীকে হটে আসতে হয়। একাধিকবার বিপর্যস্ত হবার পর মুক্তিবাহিনী ভাটিয়াপাড়ায় একটা বড় ধরণের আক্রমণের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকল। ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশ মুক্ত হয়। পাক হানাদার বাহিনী ঢাকায় মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। ২১শে ডিসেম্বর আলফাডাঙ্গা থানার আব্দুল মান্নান বীরবিক্রম, মালাগ্রামের সৈয়দ ইকরামুল হক সহ এপার ওপারের বিশিষ্ট মুক্তিবাহিনী ছাড়াও লেঃ কমল সিদ্দিক, ক্যাপ্টেন হুদা এবং মেজর মঞ্জুর এ যুদ্ধের নেতৃত্বদান করেন। সারাদিন গোলাগুলির পর কমল সিদ্দিকী গুরুতরভাবে আহত হবার পর মুক্তিবাহিনী ঐ দিনের মত পশ্চাদপসারণ করে। কিন্তু তাদের মনোবল ভাঙ্গে না। পরদিন ২২শে ডিসেম্বরের শেষ বারের মত হানাদার বাহিনীর উপর মরণ আঘাত হানা হয়। এ জীবন মরণ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা দাউদ বাঙ্কার থেকে একজন খান সেনাকে ধরে আনেন। দীর্ঘ কয়েকঘন্টা যুদ্ধের পর খান সেনারা পরাভূত হয়। উভয় পক্ষে কয়েকজন হতাহত হয়। মুক্তিবাহিনীর প্রচুর গোলাবারুদ হাতে আসে। ৪৮জন পাঞ্জাবী এবং বেলূচী সৈন্যকে যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাঠানো হয়। এ যুদ্ধে যারা কৃতিত্বের সাথে লড়াই করেছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আলমডাঙ্গা গ্রামের তাইফুর মোল্লাহ, হুমায়ুন কবির, চাচই গ্রামের মুনছুর মোল্লাহ, মাছেম জমাদ্দার, মোতাহার, মোচড়া গ্রামের আসাদুজ্জামান আছাদ, চরকালনার বাদশা, কুমার কান্দার গোলাম মোস্তফা (সাবেক ইউপি সদস্য), চাচই ধানাইড় এর আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক খুরশিদ আলম, মঙ্গল হাটার আঃ রউফ, চরকরফার আক্তার, আকবর, মহিশাহ পাড়ার কিউবার, নুরমোহাম্মদ, মিজানুর রহমান মিয়া, মাকড়াইলের কামরুজ্জামান, কবির হোসেন কবির, তৎকালীন মহকুমার মুজিব বাহিনীর প্রধান মরহুম জাহিদুর রহমান জাহিদ, শিকদার আনোয়ারুল ইসলাম, মহিশাহ পাড়ার সরোয়ার রহমান, লোহাগড়া গ্রামের এ. কে. এম আনোয়ারুজ্জামান মিঞা, ইতনার মাহফুজুর রহমান লুলু, কোলা গ্রামের আব্দুল হান্নান, চাচই গ্রামের ইদ্রিস মিয়া, ধলাইতলা গ্রামের সৈয়দ ওবায়দুল্লাহ লুলু, ইতনার-দৌলতপুর গ্রামের শিশির রঞ্জন সাধুখা (বর্তমানে কানাডা প্রবাসী) ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ফকির মফিজুল ইসলাম। এছাড়া জেলার মুক্তিযোদ্ধারা পার্শ্ববর্তী জেলা মাগুরা এবং খুলনার শিরোমনি প্রভৃতি রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে অনেক কৃতিত্ব অর্জন করেছেন। এর মধ্যে জয়পুর নিবাসী বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছলেমান সরদার বাবু, খুলনার শিরোমনিতে যুদ্ধ করে কৃতিত্ব অর্জন করেন। তিনি অনেক স্থানেই যুদ্ধ করেছেন এবং আহত হয়েছেন। বর্তমানে সাইকেলের মিস্ত্রি। জানা অজানা যে সমস্ত সূর্য সন্তানেরা সেদিন দেশ-মাতৃকার মুক্তির জন্য সর্ব প্রকার ত্যাগ স্বীকার করেছেন, আত্মবিসর্জন দিয়েছেন জাতি চিরকাল তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
কিন্তু আজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করা হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় সেদিনের যে যুবক সেদিন যুদ্ধ করেছিল স্বাধীন জাতির জন্য, কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠিকে সমর্থন না করলে তাদের দৃষ্টিতে সে মুক্তিযোদ্ধা নয়। এ ধরণের অনেকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে। নড়াইল জেলার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের একটি বিশেষ মহলের একগুয়েমিতে জেলার লোহাগড়া ও কালিয়া উপজেলার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা বর্তমান তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। উল্লেখ্য বাংলাদেশের মধ্যে টাঙ্গাইল জেলার পরে নড়াইল জেলায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে আবার লোহাগড়া উপজেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা জেলার মধ্যে বেশি। উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ফকির মফিজুল ইসলাম দীর্ঘদিন যাবত মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা বিভিন্ন সরকারের আমলে তুলে ধরলেও সমাধান করতে পারে নাই। আজও এ জেলার শতশত মুক্তিযোদ্ধা তাদের পরিবার বর্গসহ মানবেতর জীবনযাপন করছে।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক : আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২
এপ্রিল ২০১২