
Home নড়াইল জেলা / Narail District > নড়াইল জেলার নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ / Cultivation indigo and indigo uprisings of Narail
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100000 বার পড়া হয়েছে
নড়াইল জেলার নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ / Cultivation indigo and indigo uprisings of Narail
নড়াইল জেলার নীল চাষ ও নীল বিদ্রোহ
Cultivation indigo and indigo uprisings of Narail
ইংরেজ শাসনামলের নীলচাষ এবং তজ্জনিত কারণে প্রজা শোষণের কাহিনী আজও বাংলার মানুষের কাছে সুবিদিত। অনেকেই তৎকালীন নীল গাছ ও নীল উৎপাদন সম্বন্ধে ধারণা রাখেন না। কিন্তু নীলকরদের অত্যাচার, ধর্ষণ, লুন্ঠন, হত্যা ও কয়েদ রাখার কাহিনী মানুষ মুখে মুখে ধরে রেখেছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পদে খনিজ নীল আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত বাংলা তথা যশোর ও নদীয়া জেলায় অন্যান্য জেলা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট নীল প্রস্তুত হতো। তাই যশোর ও নদীয়া জেলায় অসংখ্য বেনিয়া ইংরেজ ও দেশীয় মুৎসুদ্ধি জমিদারগণ জমিদারী তালুকদারীর সঙ্গে নীল জমিদারী সৃষ্টি করেছিলেন। নবাবী তথা মুঘল শাসনের পতনের পরে আমেরিকা থেকে জনৈক ফরাসী বণিক লুই বোর্ড নীল উৎপাদন প্রণালী আমাদের দেশে আনয়ন করেন। ১৭৭৭ সালে ঐ ফরাসী বণিক বাংলার তাযাঙ্গা ও গোমুলে দুটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। এরপর তিনি মালদেহে একটি নীলের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। লুই বোনার্ড মুসলমানদের গোরস্থান খরিদ করে মৃতের হাড়ের সাহায্যে চূর্ণ প্রস্তুত করতেন। চূর্ণ বিক্রয়ে যখন অর্থ উপার্জন হতো সঙ্গে সঙ্গে নীল উৎপাদনেও সহায়ক ভূমিকা আসতো। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, নীল উৎপাদনে চূর্ণের প্রচুর ব্যবহার ছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে বৃহত্তর যশোর জেলায় নীল চাষ শুরু করেন মি বন্ড। তিনি যশোরের রূপদিয়াতে একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। গোটা যশোর জেলায় ১৮১০ সাল হতে ১৮৮০ সাল পর্যনত্ম নীল চাষের চরম উৎকর্ষতার কাল। নীল ব্যবসায় অতি লাভজনক বিধায় ইংরেজ কোম্পানী সরকারের সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীবৃন্দ নিজ নিজ পেশায় ইস্তফা দিয়ে নীলচাষে প্রবৃত্ত হন। এ ছাড়া ১৭৬৫ সালে কোম্পানী দেওয়ানী লাভের পর বুনিয়াদী জমিদারদের নায়েব, তহশীলদার ও চাকরান ভোগী একটি শ্রেণী কালোপথে জমিদারী তালুকদারী পেয়ে কোম্পানী সরকারের সর্বপ্রকার দুষ্কর্মের ভাগীদার হয়। সুপ্রকাশ রায় তার ‘ভারতের কৃষক বিদ্রোহ ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম’ গ্রন্থে এদের বলেছেন, মুৎসুদ্দী বা পা-চাটা জমিদার-তালুকদার (এরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে মধ্যস্বত্ত্ব পেয়েছিল)। নড়াইলের রামরতন রায় এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
উল্লেখিত জমিদারবর্গ শুধু ইংরেজ দোসরদের শোষণের সহায়তাই করেন নাই, ইংরেজ নীলকরদের নীল চাষের পত্তনী দিয়ে শোষনের সহায়তা করেছেন। এছাড়া এরা সকলেই নিজ নিজ জমিদারী ও তালুকের মধ্যে নীলচাষ করে নিরীহ প্রজা উৎপীড়ন করে সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি করেছেন। নড়াইলের জমিদার রামরতন রায় ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রজা শোষণ করতেন। তার নীলকুঠির একজন ম্যানেজার ছিলো জেমস মেই নামক এক ইংরেজ। একজন নীলকরের সঙ্গে অন্য নীলকরের গোলযোগ হতো নীলচাষকে কেন্দ্র করেই। কখনো কখনো দেশীয় মুৎসুদ্দী নীলকর ও ইংরেজ নীলকরদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতো। প্রকৃতপক্ষে তাতে সাধারণ নিরীহ প্রজাদের শোষণের কোন ব্যতিক্রম ঘটত না। অবশ্য মুৎসুদ্দী তালুকদার জমিদার নীলকরদের পক্ষে প্রজা লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে এবং ভিটাবাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। ইংরেজ নীলকরদের সঙ্গে দেশীয় নীলকরেরা মিতালী রেখে শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা করেছেন এবং মাঝখানে তারা বীরের খেতাবটি পেয়েছেন। বৃহত্তর যশোরে এমন একজন খ্যাতিমান নীলকর ও তালুকদার হলেন শ্রীরামপুরের (খুলনা) শিবনাথ ঘোষ।
নীলকরদের শোষণ, শাসন ও অত্যাচারে বাংলা তথ্য বৃহত্তর যশোর একটি শ্মশানের রূপ ধারণ করে। নীলকরেরা কৃষকের ধান ও পাট চাষ করা জমিতে নীলের দাগ দিয়ে আসতো। তাদের জোরপূর্বক দাদন দিয়ে ধানের ও পাটের জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করতো। জানা যায় এক বিঘা জমিতে নীল উৎপাদন হতো ৮ থেকে ১২ বান্ডিল। ১০ বান্ডিলের মূল্য ছিলো ১ টাকা। পরে ১০ বান্ডিলের স্থলে চার বান্ডিল করা হয়েছিল টাকায়। এভাবে হিসাব করে দেখা যায় নীল চাষ করে কৃষকেরা যে টাকা পেত তা লোকসানের নামান্তর। পক্ষান্তরে নীলকরেরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করতো। নীলচাষীগণ পুত্র পরিজন নিয়ে অনাহারে দিন কাটাতো, গৃহত্যাগী হয়ে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতো। এইভাবে কতো বাঙ্গালী পরিবার যে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে তা আজ অনুমানের বাইরে। কোনো ইউরোপীয় ঐতিহাসিক নীলকে কৃষকের নীল রক্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক নিরপেক্ষ ইংরেজ ঐতিহাসিক ও সরকারী কর্তা ব্যক্তি নীলচাষকে কৃষকের মরণ ফাঁদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু দেশীয় মুৎসুদ্দী জমিদার-তালুকদার দালালীর চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে কৃষক শোষণের পক্ষে সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন। রাজা রামমোহন ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বৃটিশ পার্লামেন্ট নীলকরদের নীলচাষের পক্ষে স্মারকলিপি দান করেন। রামমোহনের মত ছিল “নীলকর সাহেবদের সম্বন্ধে আমার মত সবিনয়ে উল্লেখ করছি। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন জেলা আমি পরিদর্শন করেছি। আমি দেখিয়াছি নীল চাষের জমির নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান অন্যান্য অঞ্চলের জীবনযাত্রা মানের তুলনায় উন্নততর। নীলকরদের দ্বারা হয়তো সামান্য কিছু ক্ষতি সাধিত হইতে পারে, কিন্তু সরকারী কিংবা বেসরকারী যত ইউরোপীয় এখানে আছেন তাদের যে কোন অংশের তুলনায় নীলকর সাহেবগণ এদেশীল সাধারণ মানুষের অকল্যাণের তুলনায় কল্যাণই বেশ করেছেন।” দ্বারকানাথ ঠাকুর লিখেছেনঃ “আমি দেখিয়াছি, নীলের চাষ এদেশের জনসাধারণের পক্ষে সর্বিশেষ ফলপ্রসু হইয়াছে। জমিদারগণের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং কৃষকদেরও বৈষয়িক উন্নতি সাধিত হইয়াছে। অবশ্য বাংলার কিছু মুসলমান জমিদারগণ ও বুদ্ধিজীবি দেশপ্রেমিকগণ নীলকরদের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়েছিলেন।” ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায়, “ইহারা অবশ্য বাংলার রামমোহন দ্বারকানাথের ন্যায় মুৎসুদ্দী জমিদার ছিলেন না, ইহারা ছিলেন বাংলাদেশের বুনিয়াদী জমিদার। সেই সময় নড়াইল জেলা ইংরেজ শাসনামলে ব্যাপক নীলচাষের ক্ষেত্র বলে পরিচিতি লাভ করে। আমি ব্যাপক অনুসন্ধান করে জেলার মোট ৩৯টি নীলকুঠি ও ২টি নীল উৎপাদন কেন্দ্রের সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে সদর থানায় ৯টি, কালিয়া থানায় ১১টি ও লোহাগড়া থানায় ১১টি।
নড়াইল তথা বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের নীল চাষ ও উৎপাদন সম্বন্ধে বলা যায় কৃষক জনসাধারণ প্রথম দিকে নীল চাষের কুফল সম্বন্ধে জ্ঞাত না থাকায় দালালদের কথা মতো নীলচাষে প্রবৃত্ত হয়ে চরম দুর্দশায় পতিত হয়। প্রতিটি কুঠি নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন ম্যানেজার রাখত কর্তৃপক্ষ। তাকে বলা হতো বড় সাহেব। বড়ো সাহেবের সাহায্যকারী বা সহকারীকে বলা হতো ছোট সাহেব। দেশীয় কর্মচারীদের প্রধানকে বলা হতো নায়েব বা দেওয়ান। নায়েবের মাসিক বেতন ছিলো ৫০ টাকা। নায়েবের অধীনে থাকতো একজন করে গোমস্তা। গোমস্তাগণ বড়ো সাহেব ও ছোট সাহেবের দুষ্কর্মের হোতা হিসেবে কাজ করতো। কখনো কখনো নীলকরদের ফাঁকি দিতো, কখনো কৃষকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে নীলকরদের ঠকানোর চেষ্টা করতো। আর ঐ সব দুষ্কর্ম ফাঁস হয়ে গেলে সাহেবদের পদাঘাতে জীবন ধন্য করতো তারা। নীলচাষের জমির সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রতি কুঠিতে একজন আমিন রাখা হতো। নীল পরিমাপের জন্য রাখা হতো ওজনদার। কুলির কাজ পরিচালনার জন্য রাখা হতো জমাদার। নীলগাছ প্রহরায় রাখার জন্য ছিলো খালাসী। কুলি ও নীল জ্বালের কাজ করতো শাওতাল পরগণা হতে আনা অবাঙ্গালী শ্রমিক। এদেশীয় লোকদের কাছে তারা বুনো বলে পরিচিত। এসব বুনো আজও জেলায় বাস করে।
তথ্য সূত্র:
নীল বিদ্রোহের অজানা ইতিহাস
মহসিন হোসাইন
প্রকাশকাল ২০০১
/
নড়াইল জেলা সমীক্ষা ও স্থাননাম
লেখক: মহসিন হোসাইন
প্রকাশকাল: ২০০১
/
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক : আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২
উল্লেখিত জমিদারবর্গ শুধু ইংরেজ দোসরদের শোষণের সহায়তাই করেন নাই, ইংরেজ নীলকরদের নীল চাষের পত্তনী দিয়ে শোষনের সহায়তা করেছেন। এছাড়া এরা সকলেই নিজ নিজ জমিদারী ও তালুকের মধ্যে নীলচাষ করে নিরীহ প্রজা উৎপীড়ন করে সম্পদের পাহাড় সৃষ্টি করেছেন। নড়াইলের জমিদার রামরতন রায় ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রজা শোষণ করতেন। তার নীলকুঠির একজন ম্যানেজার ছিলো জেমস মেই নামক এক ইংরেজ। একজন নীলকরের সঙ্গে অন্য নীলকরের গোলযোগ হতো নীলচাষকে কেন্দ্র করেই। কখনো কখনো দেশীয় মুৎসুদ্দী নীলকর ও ইংরেজ নীলকরদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত হতো। প্রকৃতপক্ষে তাতে সাধারণ নিরীহ প্রজাদের শোষণের কোন ব্যতিক্রম ঘটত না। অবশ্য মুৎসুদ্দী তালুকদার জমিদার নীলকরদের পক্ষে প্রজা লড়াই করে প্রাণ দিয়েছে এবং ভিটাবাড়ী থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। ইংরেজ নীলকরদের সঙ্গে দেশীয় নীলকরেরা মিতালী রেখে শ্রেণী স্বার্থ রক্ষা করেছেন এবং মাঝখানে তারা বীরের খেতাবটি পেয়েছেন। বৃহত্তর যশোরে এমন একজন খ্যাতিমান নীলকর ও তালুকদার হলেন শ্রীরামপুরের (খুলনা) শিবনাথ ঘোষ।
নীলকরদের শোষণ, শাসন ও অত্যাচারে বাংলা তথ্য বৃহত্তর যশোর একটি শ্মশানের রূপ ধারণ করে। নীলকরেরা কৃষকের ধান ও পাট চাষ করা জমিতে নীলের দাগ দিয়ে আসতো। তাদের জোরপূর্বক দাদন দিয়ে ধানের ও পাটের জমিতে নীলচাষ করতে বাধ্য করতো। জানা যায় এক বিঘা জমিতে নীল উৎপাদন হতো ৮ থেকে ১২ বান্ডিল। ১০ বান্ডিলের মূল্য ছিলো ১ টাকা। পরে ১০ বান্ডিলের স্থলে চার বান্ডিল করা হয়েছিল টাকায়। এভাবে হিসাব করে দেখা যায় নীল চাষ করে কৃষকেরা যে টাকা পেত তা লোকসানের নামান্তর। পক্ষান্তরে নীলকরেরা প্রচুর মুনাফা অর্জন করতো। নীলচাষীগণ পুত্র পরিজন নিয়ে অনাহারে দিন কাটাতো, গৃহত্যাগী হয়ে অনিশ্চিত জীবন বেছে নিতো। এইভাবে কতো বাঙ্গালী পরিবার যে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়েছে তা আজ অনুমানের বাইরে। কোনো ইউরোপীয় ঐতিহাসিক নীলকে কৃষকের নীল রক্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন। অনেক নিরপেক্ষ ইংরেজ ঐতিহাসিক ও সরকারী কর্তা ব্যক্তি নীলচাষকে কৃষকের মরণ ফাঁদ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু দেশীয় মুৎসুদ্দী জমিদার-তালুকদার দালালীর চরম উদাহরণ সৃষ্টি করে কৃষক শোষণের পক্ষে সাধ্যাতীত চেষ্টা করেছিলেন। রাজা রামমোহন ও প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর বৃটিশ পার্লামেন্ট নীলকরদের নীলচাষের পক্ষে স্মারকলিপি দান করেন। রামমোহনের মত ছিল “নীলকর সাহেবদের সম্বন্ধে আমার মত সবিনয়ে উল্লেখ করছি। বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন জেলা আমি পরিদর্শন করেছি। আমি দেখিয়াছি নীল চাষের জমির নিকটবর্তী অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান অন্যান্য অঞ্চলের জীবনযাত্রা মানের তুলনায় উন্নততর। নীলকরদের দ্বারা হয়তো সামান্য কিছু ক্ষতি সাধিত হইতে পারে, কিন্তু সরকারী কিংবা বেসরকারী যত ইউরোপীয় এখানে আছেন তাদের যে কোন অংশের তুলনায় নীলকর সাহেবগণ এদেশীল সাধারণ মানুষের অকল্যাণের তুলনায় কল্যাণই বেশ করেছেন।” দ্বারকানাথ ঠাকুর লিখেছেনঃ “আমি দেখিয়াছি, নীলের চাষ এদেশের জনসাধারণের পক্ষে সর্বিশেষ ফলপ্রসু হইয়াছে। জমিদারগণের সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য বহুগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে এবং কৃষকদেরও বৈষয়িক উন্নতি সাধিত হইয়াছে। অবশ্য বাংলার কিছু মুসলমান জমিদারগণ ও বুদ্ধিজীবি দেশপ্রেমিকগণ নীলকরদের বিরুদ্ধে দন্ডায়মান হয়েছিলেন।” ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায়ের ভাষায়, “ইহারা অবশ্য বাংলার রামমোহন দ্বারকানাথের ন্যায় মুৎসুদ্দী জমিদার ছিলেন না, ইহারা ছিলেন বাংলাদেশের বুনিয়াদী জমিদার। সেই সময় নড়াইল জেলা ইংরেজ শাসনামলে ব্যাপক নীলচাষের ক্ষেত্র বলে পরিচিতি লাভ করে। আমি ব্যাপক অনুসন্ধান করে জেলার মোট ৩৯টি নীলকুঠি ও ২টি নীল উৎপাদন কেন্দ্রের সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে সদর থানায় ৯টি, কালিয়া থানায় ১১টি ও লোহাগড়া থানায় ১১টি।
আর সেগুলির মধ্যে যেসব কুঠিতে বেশি অত্যাচার হতো তার কয়েকটি উল্লেখ করা হলো: |
দেবদুন নীল কুঠি, নড়াগাতী নীল কুঠি বাঐসোনা নীল কুঠি, কলাবাড়ীয়া নীল কুঠি টোনা নীল কুঠি, মাধবপাশা নীলকুঠি নোয়াগ্রাম নীল কুঠি চাঁচুড়ি নীল কুঠি সুমেরু খোলা নীল কুঠি কাঠাদুরা নীল কুঠি পাটনা নীল কুঠি। মলিস্নকপুর নীল কুঠি ইতনা নীল কুঠি উলা নীল কুঠি আমডাঙ্গা নলি কুঠি (নদী গর্ভে বিলীন) ঘোড়াখালী নীল কুঠি রাধানগর নীল কুঠি কুমার গঞ্জ নীল কুঠি কালিয়া নীল কুঠি মহিষ খোলা নীল কুঠি (বর্তমান নড়াইল শহরে) দুটি উৎপাদন কেন্দ্র হলোঃ মাউলী ও লক্ষ্মীপাশা। |
নড়াইল তথা বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের নীল চাষ ও উৎপাদন সম্বন্ধে বলা যায় কৃষক জনসাধারণ প্রথম দিকে নীল চাষের কুফল সম্বন্ধে জ্ঞাত না থাকায় দালালদের কথা মতো নীলচাষে প্রবৃত্ত হয়ে চরম দুর্দশায় পতিত হয়। প্রতিটি কুঠি নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন ম্যানেজার রাখত কর্তৃপক্ষ। তাকে বলা হতো বড় সাহেব। বড়ো সাহেবের সাহায্যকারী বা সহকারীকে বলা হতো ছোট সাহেব। দেশীয় কর্মচারীদের প্রধানকে বলা হতো নায়েব বা দেওয়ান। নায়েবের মাসিক বেতন ছিলো ৫০ টাকা। নায়েবের অধীনে থাকতো একজন করে গোমস্তা। গোমস্তাগণ বড়ো সাহেব ও ছোট সাহেবের দুষ্কর্মের হোতা হিসেবে কাজ করতো। কখনো কখনো নীলকরদের ফাঁকি দিতো, কখনো কৃষকের কাছ থেকে উৎকোচ নিয়ে নীলকরদের ঠকানোর চেষ্টা করতো। আর ঐ সব দুষ্কর্ম ফাঁস হয়ে গেলে সাহেবদের পদাঘাতে জীবন ধন্য করতো তারা। নীলচাষের জমির সীমানা নির্ধারণের জন্য প্রতি কুঠিতে একজন আমিন রাখা হতো। নীল পরিমাপের জন্য রাখা হতো ওজনদার। কুলির কাজ পরিচালনার জন্য রাখা হতো জমাদার। নীলগাছ প্রহরায় রাখার জন্য ছিলো খালাসী। কুলি ও নীল জ্বালের কাজ করতো শাওতাল পরগণা হতে আনা অবাঙ্গালী শ্রমিক। এদেশীয় লোকদের কাছে তারা বুনো বলে পরিচিত। এসব বুনো আজও জেলায় বাস করে।
তথ্য সূত্র:
নীল বিদ্রোহের অজানা ইতিহাস
মহসিন হোসাইন
প্রকাশকাল ২০০১
/
নড়াইল জেলা সমীক্ষা ও স্থাননাম
লেখক: মহসিন হোসাইন
প্রকাশকাল: ২০০১
/
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক : আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২