
Home নড়াইল জেলা / Narail District > নড়াইলের অতীতের শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি / Administrative procedures in the past of Narail
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100016 বার পড়া হয়েছে
নড়াইলের অতীতের শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি / Administrative procedures in the past of Narail
নড়াইলের অতীতের শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি
Administrative procedures in the past of Narail district
নড়াইল জেলার শাসনতান্ত্রিক পরিচিতি:
বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের কোনো ইতিহাস রক্ষিত হয়নি। ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা চলে ভারতবর্ষ মুসলমানদের দ্বারা পদানত হলে। তাই নড়াইল জেলার প্রাচীন শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের অনুমানের উপর নির্ভরশীল হতে হবে।
খ্রীষ্ট জন্মের পূর্বে মহাবীর আলেকজান্ডার পশ্চিম ভারত (বর্তমান পাকিস্তান) আক্রমণ করলে তিনি পূর্ব ভারতের শক্তিমান গঙ্গরিডি রাজ্যের রাজার ভয়ে আর অগ্রসর না হয়ে দেশে ফিরি যান। এ তথ্য গ্রীক ঐতিহাসিকদের রচনা হতে জানা যায়। ঐ গংগা বা গংগ বা বঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ছিল বর্তমান গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া বা মতান্তরে বারোবাজার। তবে নড়াইল জেলার বেশ কিছু গ্রাম, বিরান মাঠ ও বন-বানান্তে অতি প্রাচীনকালে লোক বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। বিশেষ করে অধিকাংশ ফসলী মাঠেই জমি চাষের সময় এ ভিটের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ভিটের জমিতে প্রাচীনকালের মেটে তৈজস পাত্রের চাড়া, তৎকালীন মুদ্রা, সামুদ্রিক কড়ি প্রভৃতি পাওয়া যায়।
রাজা শশাংকের শাসনামলে বৃহত্তর যশোর জেলা তথা বর্তমান নড়াইল জেলা তার শাসনাধীনে ছিল। রাজা শশাংকের মৃত্যুর কিছুকাল পর এ রাজ্য ও শাসন ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়। শত শত বছর সমগ্র বাংলা ‘মাৎস্যন্যায়’ শাসন ব্যবস্থা কায়েম থাকে। অসংখ্য রাজার আবির্ভাবের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র অঞ্চল বা ৪/৫ খানি গ্রাম নিয়েও একজন শাসকের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান নড়াইল সদর থানার নয়াবাড়ীর পাতালভেদী রাজাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগের রাজা বলে প্রাচীন ঐতিহাসিগণ ধারণা করেন। কালিয়া উপজেলা হতে নয়াবাড়ীর দূরত্ব ১০ মাইলের বেশী নয়। স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা যায় যে, জেলার কালিয়া উপজেলা এক সময় নয়াবাড়ীর রাজা কর্তৃক শাসিত হয়েছিল।
পাল শাসনামলে বর্তমান নড়াইল জেলা বৌদ্ধ পাল শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাল শাসকদের শাসনতান্ত্রিক কয়েকটি ইউনিট ছিল। ভাগ মন্ডল, বিষয়, বিথী ইত্যাদি। নড়াইল জেলায় ভাগ ও মন্ডল নামীয় (কখনো সামান্য পরিবর্তিত হয়ে) বেশকিছু গ্রামের নাম আজও বিদ্যমান। নড়াইল জেলা যে পাল শাসকদের প্রত্যক্ষ শাসনে ছিল এটা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
ইতিহাস হতে জানা যায়, সেন শাসনামলে বঙ্গ রাজ্যকে ৫টি ভূক্তি বা প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। ঐ ভুক্তির অন্যতম হল বাকড়ী ভুক্তি। নড়াইল বাকড়ী নামীয় একটি সুপ্রাচীন জনপদ আজও বিদ্যমান। বাকড়ী ভুক্তির রাজধানী ছিল সেখহাটি (পূর্বনাম শংখনাট)। শেখহাটি নড়াইল জেলার দক্ষিণে। এখানে রাজা লক্ষণ সেন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক পরাজিত ও বিতাড়িত হয়ে দীর্ঘদীন বাস করেছিলেন। লক্ষণ সেনের উত্তরাধিকারীরা সেখহাটিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন দক্ষিণ বাংলা শাসন করে।
সুলতানী শাসনামলে (তুর্ক আফগান শাসন) কালিয়া লোহগড়া থানা নলদী শাসন কেন্দ্র (নলদরি গাজীর মোকাম) হতে দীর্ঘদিন শাসিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। বর্তমান চাঁচুড়ি বাজারের উপরে সুলতানী শাসনামলে হয়তো কোন সেনানিবাস কিংবা শসন কেন্দ্র ছিল। ১৯৭০ সালে সরকারী পুকুর খননকালে বেরিয়ে আসে প্রাচীন ছোট ইটের গাঁথুনীর ইমারত। অনুমান ও লোক প্রবাদে বলা যায় খান জাহানের ভ্রাতা কিংবা জ্ঞাতি ভ্রাতা জাহান্দার খানের পুত্র (বহুকর্মকান্ডের পরে) ওয়ালী মাহমুদ খান বর্তমান লোহাগড়া থানার মহিশাপাড়া হতে বর্তমান কালাবাড়ীয়া গ্রামের সন্নিকটে শিবপুরে কেল্লাবাড়ী বা কেল্লা স্থাপন করেন। ওয়ালী মাহমুদের পূর্বপুরুষ সরকার-ই-লস্কর বা এলাকার প্রশাসক ছিলেন।
সুলতানী শাসনামলে বর্তমান নড়াইল জেলাসহ বিস্তৃত এলাকা খানজাহান কর্তৃক শাসিত হতো। লোহাগড়া থানাসহ জেলায় পীর খানজাহানের অনেক ঐতিহাসিক কীর্তি, প্রশাসন কেন্দ্র ও খাঞ্জালী দীঘির অবস্থান সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই হিসেবে পীর খানজাহানের ভ্রাতুষ্পুত্র যে এ এলাকা শাসন করেছেন তা কোন ক্রমেই অযৌক্তিক নয়। সরকার-ই-লস্কর ওয়ালী মাহমুদ এর প্রাচীন কেল্লবাড়ী-ই বর্তমান কালিয়া উপজেলার কলাবাড়ীয়া গ্রাম। মুঘল শাসনামলে মধুমতি নদীর তীরে লাহোরী খাঁ (বর্তমান লাহুড়িয়া গ্রাম যার নামে নামকৃত)। নলদীর গাজীর মোকামের প্রশাসকবৃন্দ সে সময় নড়াইল জেলা মুঘল সুবাদার ও ফৌজদারদের অধীনে শাসিত হতো।
১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে একান্ত অনুগত প্রসিদ্ধ ইসলাম খান চিশ্তি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ইসলাম খান বারভূঁইঞা ও তাদের অনুগামী বিশেষতঃ মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের পরাজিত করেন। সত্রাজিৎ কালিয়া উপজেলার উত্তর পূর্ব সীমান্তে মুঘল সেনাপতি ইফতেখারের নিকট পরাজিত হন। ইফতেখার সত্রাজিৎ রায়কে আঠারবাকী নদীর উপর দিয়ে বন্দী করে নিয়ে যান বর্তমান আলাইপুরে। আলাইপুরের ফতেপুর নামক স্থানে সত্রাজিৎ নবাব ইসলাম খার নিকট উপস্থিত হয়ে আঠারটি হস্থি উপহার দিয়ে নবাবের (সুবাদার) আনুগত্য ক্রয় করে। এই সময় মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারে দক্ষিণ মধ্য বাংলার জনজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠায় সুবাদার নবাব ইসলাম খার সফল আক্রমণে মগ ও পর্তুগীজরা বাংলা পরিত্যাগ করে। জেলার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ মগপর্তুগীজ দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল বলে মনে হয়। ধারণা করা হয়, বারোইপাড়া ও পুরুলিয়ার ৩ তলা বিশিষ্ট মন্দির ঐ সময় পর্তুগীজদের গোপন আবাসস্থল ছিল। পরবর্তীকালে ঐ ইমারত দুটি মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ঐ অঞ্চল হতে ১৯৮০/৮১ সালে মগ অত্যাচার সম্বন্ধে একটি লোকগান সংগ্রহীত আছে, যা নড়াইলের লোকসঙ্গীত গ্রন্থে বিদ্যমান। এ ছাড়া একটি শোকাবহ লোকগাথা ‘মগাইরাজা’ সমপ্রতি উদ্ধার করা হয়েছে। এই দুটি সংগ্রহের দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে জেলার কালিয়া উপজেলার দক্ষিণ-পুর্বাঞ্চল মগদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। এই সময় মগরা মধুমতি নদীর তীর দিয়ে এসে জেলার লোহাগড়া উপজেলার চরকরফা গ্রামের একটি বাড়ী লুণ্ঠন করে। যতদূর মনে হয় সুবাদার ইসলাম খানের বীরত্বে ও কৌশলে দস্যুরা এই অঞ্চল তথা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ত্যাগ করে।
সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের শেষ দিকে মীর জয়েনউদ্দীন ও মীর ধীরেন্দ্রনাথ বর্তমান কালিয়া উপজেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নড়াইল জেলার সার্কেলডাঙ্গা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। জয়েনউদ্দিন ও ধীরেন্দ্রনাথের নামের আগে মীর শব্দটি যুক্ত হয়েছে মীর-ই-বহর খেতাব থেকে। এরা মুঘল সম্রাটের বেতনভূক্ত নৌবাহিনীর কর্মচারী ছিলেন। মীর-ই-বহর এর কর্মে মীর জয়েন উদ্দীন ও মীর ধীরেন্দ্র নাথ ‘সরখৎ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ‘সরখৎ’ ফারসী শব্দ, এর অর্থ পুরুষানুক্রমে ভূমি প্রাপ্তির সন্ধিপত্র। ঐ ‘সরখৎ’ শব্দ থেকে সার্কেল শব্দটির জন্ম। সার্কেলডাঙ্গা গ্রামের নামটি মুঘল শাসনামলেরই সৃষ্টি। নড়াইল-কালিয়া রাস্তার পাশে এই গ্রামে মীর সার্কেল তথা মুঘল কর্মচারীদের দিয়ে খননকৃত মুঘল আমলের বিশাল দীঘি বিদ্যমান। ধারনা করা যায়, মীর জয়েনউদ্দিন ও মীর ধীরেন্দ্রনাথ সার্কেল নড়াইল ও কালিয়া উপজেলার অংশ বিশেষের শাসক ছিলেন। এই মীর জয়েনউদ্দীনের বংশধরেরা নিজেরদের নামের পূর্বে সৈয়দ লেখেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, আমাদের দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ সৈয়দ বংশদ্ভুত লোকেরা “চাদের সৈয়দ” নামে পরিচিত। শতকরা ২ ভাগ সৈয়দ “সিনের সৈয়দ” অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) এর বংশধর। মীর শদ্বের অর্থ প্রধান। সৈয়দ মীরের সমার্থক বিধায় মীর বহর বা মীর-ই-নওয়ারী (মুঘল কর্মচারী) কর্মচারীগণ ও তাদের উত্তর বংশধরগণ সৈয়দ নাম ধারণ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে মীর-ই-বহরের অসংখ্য কর্মচারী ছিল হিন্দু সমপ্রদায়। কিন্তু তারা মীর খেতাব গ্রহণ করেনি। মীরধীরেন্দ্রনাথ এর সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি কাপালী সমপ্রদায়ের লোক ছিলেন। তার কোন উত্তরাধিকারী বংশধরের পরিচয় পাওয়া যায়নি। বাংলার সুবাদারের অনুগ্রহে নলদী পরগনার তালুক পেয়েছিলেন মোহাম্মদপুরের সীতারাম রায়। ১৭১৩ সালে বিদ্রোহী সীতারাম মুঘল বাহিনীর হাতে পরাজিত ও নিহত হন। ১৭৫৭ সালে স্বাধীন নবাব সিরাজের পতন, ১৭৬৫ সালে দিলস্নীর সম্রাট মুহাম্মদ শাহের নিকট হতে ইংরেজ কোম্পানীর বাংলার দেওয়ানী গ্রহণ ও ১৭৯৩ সালে কোম্পানী সরকারের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ মুঘল শাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ শাষকগণ এ দেশ দুইশত বছর শাসন করে। তারপর ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি দেশ হয়। আমরা ছিলাম পূর্ব-পাকিস্তান নামে একটি প্রদেশের অধিবাসী। পাকিস্তান শাসন কর্তারা আমাদের এ অঞ্চলের বাঙ্গালী অধ্যুসিত জনগনের উপর ন্যায় বিচার করেনি। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ লোকই ছিল মুসলমান। পাকিস্তানী শাসন কর্তারা ইসলামের নাম করে আরেক ইসলামী ভাইয়ের উপর শোষন ও নির্যাতন চালিয়েছে। যার সর্বশেষ পরিণতি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলা সমীক্ষা ও স্থাননাম
লেখক: মহসিন হোসাইন
প্রকাশকাল: ২০০১
/
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক: আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান বিপুল
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২
বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের কোনো ইতিহাস রক্ষিত হয়নি। ইতিহাস সংগ্রহের চেষ্টা চলে ভারতবর্ষ মুসলমানদের দ্বারা পদানত হলে। তাই নড়াইল জেলার প্রাচীন শাসনতান্ত্রিক ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আমাদের অনুমানের উপর নির্ভরশীল হতে হবে।
খ্রীষ্ট জন্মের পূর্বে মহাবীর আলেকজান্ডার পশ্চিম ভারত (বর্তমান পাকিস্তান) আক্রমণ করলে তিনি পূর্ব ভারতের শক্তিমান গঙ্গরিডি রাজ্যের রাজার ভয়ে আর অগ্রসর না হয়ে দেশে ফিরি যান। এ তথ্য গ্রীক ঐতিহাসিকদের রচনা হতে জানা যায়। ঐ গংগা বা গংগ বা বঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ছিল বর্তমান গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া বা মতান্তরে বারোবাজার। তবে নড়াইল জেলার বেশ কিছু গ্রাম, বিরান মাঠ ও বন-বানান্তে অতি প্রাচীনকালে লোক বসতির চিহ্ন পাওয়া যায়। বিশেষ করে অধিকাংশ ফসলী মাঠেই জমি চাষের সময় এ ভিটের চিহ্ন পাওয়া গেছে। ভিটের জমিতে প্রাচীনকালের মেটে তৈজস পাত্রের চাড়া, তৎকালীন মুদ্রা, সামুদ্রিক কড়ি প্রভৃতি পাওয়া যায়।
রাজা শশাংকের শাসনামলে বৃহত্তর যশোর জেলা তথা বর্তমান নড়াইল জেলা তার শাসনাধীনে ছিল। রাজা শশাংকের মৃত্যুর কিছুকাল পর এ রাজ্য ও শাসন ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়। শত শত বছর সমগ্র বাংলা ‘মাৎস্যন্যায়’ শাসন ব্যবস্থা কায়েম থাকে। অসংখ্য রাজার আবির্ভাবের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়। ক্ষুদ্র অঞ্চল বা ৪/৫ খানি গ্রাম নিয়েও একজন শাসকের উল্লেখ পাওয়া যায়। বর্তমান নড়াইল সদর থানার নয়াবাড়ীর পাতালভেদী রাজাকে ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগের রাজা বলে প্রাচীন ঐতিহাসিগণ ধারণা করেন। কালিয়া উপজেলা হতে নয়াবাড়ীর দূরত্ব ১০ মাইলের বেশী নয়। স্বাভাবিকভাবে অনুমান করা যায় যে, জেলার কালিয়া উপজেলা এক সময় নয়াবাড়ীর রাজা কর্তৃক শাসিত হয়েছিল।
পাল শাসনামলে বর্তমান নড়াইল জেলা বৌদ্ধ পাল শাসকদের দ্বারা শাসিত হয়েছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। পাল শাসকদের শাসনতান্ত্রিক কয়েকটি ইউনিট ছিল। ভাগ মন্ডল, বিষয়, বিথী ইত্যাদি। নড়াইল জেলায় ভাগ ও মন্ডল নামীয় (কখনো সামান্য পরিবর্তিত হয়ে) বেশকিছু গ্রামের নাম আজও বিদ্যমান। নড়াইল জেলা যে পাল শাসকদের প্রত্যক্ষ শাসনে ছিল এটা তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
ইতিহাস হতে জানা যায়, সেন শাসনামলে বঙ্গ রাজ্যকে ৫টি ভূক্তি বা প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। ঐ ভুক্তির অন্যতম হল বাকড়ী ভুক্তি। নড়াইল বাকড়ী নামীয় একটি সুপ্রাচীন জনপদ আজও বিদ্যমান। বাকড়ী ভুক্তির রাজধানী ছিল সেখহাটি (পূর্বনাম শংখনাট)। শেখহাটি নড়াইল জেলার দক্ষিণে। এখানে রাজা লক্ষণ সেন ইখতিয়ার উদ্দিন মোহম্মদ বখতিয়ার খলজি কর্তৃক পরাজিত ও বিতাড়িত হয়ে দীর্ঘদীন বাস করেছিলেন। লক্ষণ সেনের উত্তরাধিকারীরা সেখহাটিকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন দক্ষিণ বাংলা শাসন করে।
সুলতানী শাসনামলে (তুর্ক আফগান শাসন) কালিয়া লোহগড়া থানা নলদী শাসন কেন্দ্র (নলদরি গাজীর মোকাম) হতে দীর্ঘদিন শাসিত হয়েছে বলে ধারণা করা যায়। বর্তমান চাঁচুড়ি বাজারের উপরে সুলতানী শাসনামলে হয়তো কোন সেনানিবাস কিংবা শসন কেন্দ্র ছিল। ১৯৭০ সালে সরকারী পুকুর খননকালে বেরিয়ে আসে প্রাচীন ছোট ইটের গাঁথুনীর ইমারত। অনুমান ও লোক প্রবাদে বলা যায় খান জাহানের ভ্রাতা কিংবা জ্ঞাতি ভ্রাতা জাহান্দার খানের পুত্র (বহুকর্মকান্ডের পরে) ওয়ালী মাহমুদ খান বর্তমান লোহাগড়া থানার মহিশাপাড়া হতে বর্তমান কালাবাড়ীয়া গ্রামের সন্নিকটে শিবপুরে কেল্লাবাড়ী বা কেল্লা স্থাপন করেন। ওয়ালী মাহমুদের পূর্বপুরুষ সরকার-ই-লস্কর বা এলাকার প্রশাসক ছিলেন।
সুলতানী শাসনামলে বর্তমান নড়াইল জেলাসহ বিস্তৃত এলাকা খানজাহান কর্তৃক শাসিত হতো। লোহাগড়া থানাসহ জেলায় পীর খানজাহানের অনেক ঐতিহাসিক কীর্তি, প্রশাসন কেন্দ্র ও খাঞ্জালী দীঘির অবস্থান সেকথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই হিসেবে পীর খানজাহানের ভ্রাতুষ্পুত্র যে এ এলাকা শাসন করেছেন তা কোন ক্রমেই অযৌক্তিক নয়। সরকার-ই-লস্কর ওয়ালী মাহমুদ এর প্রাচীন কেল্লবাড়ী-ই বর্তমান কালিয়া উপজেলার কলাবাড়ীয়া গ্রাম। মুঘল শাসনামলে মধুমতি নদীর তীরে লাহোরী খাঁ (বর্তমান লাহুড়িয়া গ্রাম যার নামে নামকৃত)। নলদীর গাজীর মোকামের প্রশাসকবৃন্দ সে সময় নড়াইল জেলা মুঘল সুবাদার ও ফৌজদারদের অধীনে শাসিত হতো।
১৬০৮ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীরের শাসনামলে একান্ত অনুগত প্রসিদ্ধ ইসলাম খান চিশ্তি বাংলার সুবাদার নিযুক্ত হন। ইসলাম খান বারভূঁইঞা ও তাদের অনুগামী বিশেষতঃ মগ ও পর্তুগীজ দস্যুদের পরাজিত করেন। সত্রাজিৎ কালিয়া উপজেলার উত্তর পূর্ব সীমান্তে মুঘল সেনাপতি ইফতেখারের নিকট পরাজিত হন। ইফতেখার সত্রাজিৎ রায়কে আঠারবাকী নদীর উপর দিয়ে বন্দী করে নিয়ে যান বর্তমান আলাইপুরে। আলাইপুরের ফতেপুর নামক স্থানে সত্রাজিৎ নবাব ইসলাম খার নিকট উপস্থিত হয়ে আঠারটি হস্থি উপহার দিয়ে নবাবের (সুবাদার) আনুগত্য ক্রয় করে। এই সময় মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের অত্যাচারে দক্ষিণ মধ্য বাংলার জনজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠায় সুবাদার নবাব ইসলাম খার সফল আক্রমণে মগ ও পর্তুগীজরা বাংলা পরিত্যাগ করে। জেলার দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের অধিবাসীবৃন্দ মগপর্তুগীজ দস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল বলে মনে হয়। ধারণা করা হয়, বারোইপাড়া ও পুরুলিয়ার ৩ তলা বিশিষ্ট মন্দির ঐ সময় পর্তুগীজদের গোপন আবাসস্থল ছিল। পরবর্তীকালে ঐ ইমারত দুটি মন্দির হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। ঐ অঞ্চল হতে ১৯৮০/৮১ সালে মগ অত্যাচার সম্বন্ধে একটি লোকগান সংগ্রহীত আছে, যা নড়াইলের লোকসঙ্গীত গ্রন্থে বিদ্যমান। এ ছাড়া একটি শোকাবহ লোকগাথা ‘মগাইরাজা’ সমপ্রতি উদ্ধার করা হয়েছে। এই দুটি সংগ্রহের দ্বারা প্রমাণ করা যায় যে জেলার কালিয়া উপজেলার দক্ষিণ-পুর্বাঞ্চল মগদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয়। এই সময় মগরা মধুমতি নদীর তীর দিয়ে এসে জেলার লোহাগড়া উপজেলার চরকরফা গ্রামের একটি বাড়ী লুণ্ঠন করে। যতদূর মনে হয় সুবাদার ইসলাম খানের বীরত্বে ও কৌশলে দস্যুরা এই অঞ্চল তথা জেলার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ত্যাগ করে।
সম্রাট আকবরের রাজত্বকালের শেষ দিকে মীর জয়েনউদ্দীন ও মীর ধীরেন্দ্রনাথ বর্তমান কালিয়া উপজেলার উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে নড়াইল জেলার সার্কেলডাঙ্গা অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। জয়েনউদ্দিন ও ধীরেন্দ্রনাথের নামের আগে মীর শব্দটি যুক্ত হয়েছে মীর-ই-বহর খেতাব থেকে। এরা মুঘল সম্রাটের বেতনভূক্ত নৌবাহিনীর কর্মচারী ছিলেন। মীর-ই-বহর এর কর্মে মীর জয়েন উদ্দীন ও মীর ধীরেন্দ্র নাথ ‘সরখৎ’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। ‘সরখৎ’ ফারসী শব্দ, এর অর্থ পুরুষানুক্রমে ভূমি প্রাপ্তির সন্ধিপত্র। ঐ ‘সরখৎ’ শব্দ থেকে সার্কেল শব্দটির জন্ম। সার্কেলডাঙ্গা গ্রামের নামটি মুঘল শাসনামলেরই সৃষ্টি। নড়াইল-কালিয়া রাস্তার পাশে এই গ্রামে মীর সার্কেল তথা মুঘল কর্মচারীদের দিয়ে খননকৃত মুঘল আমলের বিশাল দীঘি বিদ্যমান। ধারনা করা যায়, মীর জয়েনউদ্দিন ও মীর ধীরেন্দ্রনাথ সার্কেল নড়াইল ও কালিয়া উপজেলার অংশ বিশেষের শাসক ছিলেন। এই মীর জয়েনউদ্দীনের বংশধরেরা নিজেরদের নামের পূর্বে সৈয়দ লেখেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, আমাদের দেশের শতকরা ৯৮ ভাগ সৈয়দ বংশদ্ভুত লোকেরা “চাদের সৈয়দ” নামে পরিচিত। শতকরা ২ ভাগ সৈয়দ “সিনের সৈয়দ” অর্থাৎ হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সঃ) এর বংশধর। মীর শদ্বের অর্থ প্রধান। সৈয়দ মীরের সমার্থক বিধায় মীর বহর বা মীর-ই-নওয়ারী (মুঘল কর্মচারী) কর্মচারীগণ ও তাদের উত্তর বংশধরগণ সৈয়দ নাম ধারণ করেছেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে মীর-ই-বহরের অসংখ্য কর্মচারী ছিল হিন্দু সমপ্রদায়। কিন্তু তারা মীর খেতাব গ্রহণ করেনি। মীরধীরেন্দ্রনাথ এর সম্বন্ধে জানা যায়, তিনি কাপালী সমপ্রদায়ের লোক ছিলেন। তার কোন উত্তরাধিকারী বংশধরের পরিচয় পাওয়া যায়নি। বাংলার সুবাদারের অনুগ্রহে নলদী পরগনার তালুক পেয়েছিলেন মোহাম্মদপুরের সীতারাম রায়। ১৭১৩ সালে বিদ্রোহী সীতারাম মুঘল বাহিনীর হাতে পরাজিত ও নিহত হন। ১৭৫৭ সালে স্বাধীন নবাব সিরাজের পতন, ১৭৬৫ সালে দিলস্নীর সম্রাট মুহাম্মদ শাহের নিকট হতে ইংরেজ কোম্পানীর বাংলার দেওয়ানী গ্রহণ ও ১৭৯৩ সালে কোম্পানী সরকারের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ মুঘল শাসন ও রাজস্ব ব্যবস্থার অবসান ঘটায়। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরেজ শাষকগণ এ দেশ দুইশত বছর শাসন করে। তারপর ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি দেশ হয়। আমরা ছিলাম পূর্ব-পাকিস্তান নামে একটি প্রদেশের অধিবাসী। পাকিস্তান শাসন কর্তারা আমাদের এ অঞ্চলের বাঙ্গালী অধ্যুসিত জনগনের উপর ন্যায় বিচার করেনি। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ লোকই ছিল মুসলমান। পাকিস্তানী শাসন কর্তারা ইসলামের নাম করে আরেক ইসলামী ভাইয়ের উপর শোষন ও নির্যাতন চালিয়েছে। যার সর্বশেষ পরিণতি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলা সমীক্ষা ও স্থাননাম
লেখক: মহসিন হোসাইন
প্রকাশকাল: ২০০১
/
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক: আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান বিপুল
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২