
Home নড়াইল জেলা / Narail District > তেভাগা আন্দোলন ও নড়াইল / Tebhaga movement and Narail
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100023 বার পড়া হয়েছে
তেভাগা আন্দোলন ও নড়াইল / Tebhaga movement and Narail
তেভাগা আন্দোলন ও নড়াইল
Tebhaga movement and Narail
এদেশের কৃষক সংগ্রামের ইতিহাসের সব থেকে উজ্জ্বলতম অধ্যায় হল তেভাগা আন্দোলন। ১৯৪৬ সালে সংঘটিত এই আন্দোলনে অবিভক্ত বাংলার ৬০ লাখের বেশী কৃষক অংশ নিয়েছিল। পুলিশ ও জমিদার জোতদারের গুলিতে শহীদ হয়েছিল ৮৬ হাজার কৃষক, আহত হয়েছিল ১০ হাজার। সে সময় ৩ হাজার ১১৯ জন কৃষক গ্রেপ্তার হয়েছিল। নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল অগনিত। ১৯টি জেলায় বিস্তৃতি লাভ করে এই তেভাগা আন্দোলন।
গত ১৯৯৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের সূবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করেছে। নড়াইল ছিল তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান এলাকা। সেই কারণে সূবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান হয়েছিলে জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম মুলিয়া হাইস্কূল মাঠে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সে যুগের তেভাগা আন্দোলনের নেতা অমল সেন, রসিকলাল ঘোষ, ইলামিত্র, ভারতের লোকসভার সদস্য মাহবুব জাহেদীসহ অনেক নেতৃবৃন্দ।
তেভাগা আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে কারও কারও মতে এটি ছিল মার্কসবাদী ধ্যান ধারনার মাধ্যমে কৃষকদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা ক্ষমতা দখলের একটি প্রচেষ্টা। আবার কারও মতে এ সংগ্রাম স্বত:স্ফুর্ত হলেও ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন আসেনি। বরং এটি ছিল কৃষকের অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের গণআন্দোলন। যদিও শ্রেণী সংগ্রামের একটি চেতনা এর ভিতরে কাজ করেছিল, কিন্তু নেতৃত্ব পর্যায়ে ক্ষমতা দখলের চিন্তা ছিল অনুপস্থিত এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অবাস্তবও। কোন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়েও অনুমান করা যায় যে তেভাগা আন্দোলনের সেই সময়ের সংগ্রাম যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল, সেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সংগঠন ‘কৃষক সভা’র বক্তব্য সেদিন কি ছিল? তবে এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তাহলো দেশ ভাগের সেই পরিস্থিতিতে সমস্ত দেশের শহর ও নগর কেন্দ্রিক মানুষ যখন কংগ্রেস মুসলিম লীগ রাজনৈতিক দলের পিছনে সমবেত, তখন বাংলার গ্রামীণ জীবনে তেভাগার উপস্থিতি অত্যন্ত প্রবল। ঐ সময়ে দুই ধারার রাজনৈতিক দুই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কৃষকের স্বত:স্ফুর্ত সংগ্রাম অবশ্যই ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামপ্রদায়িকতার উর্ধে উঠে মুসলমান এবং হিন্দু কৃষক সেদিন একসাথে তেভাগার সংগ্রাম করেছে। একে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে তিনটি কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস আজও গৌরবোজ্জল হয়ে রয়েছে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রকৃতপক্ষে ঐটিই প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। নীলবিদ্রোহের অংশ নিয়েছিলেন বাংলার ৫০ লাখ কৃষক। অনেক গবেষকই বলেছেন “সন্ন্যাসী বিদ্রোহ” ও নীল বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় আসে তেভাগা সংগ্রাম। বস্তুত তিনটি কৃষক সংগ্রামই ছিল ইংরেজ শাসন ও শোষণের ফল। বিশেষ ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয় তার দরুণ তেভাগা আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর এর আগেই শুরু হয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেই। বাংলার কৃষকদের উপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যে শোষনের যাতাকলে তাদের মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও জমিদারদের মাধ্যমে নির্যাতন শুরু করে তার ফলে শুরু হয় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। মোট সাত পর্বে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৭৬৩ সালে প্রথম ঢাকা কুঠি আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই সন্ন্যাস বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহের শেষ হয় ১৮০০ সালে। বিদ্রোহীদের একক কোন নেতৃত্ব ছিলনা। সারাদেশের অসংখ্য কৃষক অংশগ্রহণ করে। ঐ সময় বাংলার গভর্ণর জেনারেল ছিলেন হেস্টিংস। ঐ সময় থেকে এই বিদ্রোহকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হয়। ঐ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। স্যার উইলিয়াম হান্টার অবশ্য এই সন্ন্যাস বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছে। নীল বিদ্রোহ বিভিন্ন পর্যায়ে হয়েছে। ১৭৭৭ সালে অবিভক্ত বাংলায় প্রথম নীলচাষ শুরু হয়। তখনো কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হয়নি। ইংরেজ নীলকরেরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করাতেন। ১৮৫৯-৬০ সালে নীল বিদ্রোহ দাউদাউ করে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকদের আন্দোলনের ফলে নীল কমিশন গঠিত হয়। নীল কমিশন তাদের রিপোর্টে বলে নীল চাষ করা বা না করা সম্পূর্ণ চাষীদের ইচ্ছাধীন। এভাবে কৃষকদের বিজয় অর্জিত হয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহের সাথে তেভাগা আন্দোলনের পার্থক্য, এখানে সে প্রথম দুটি সংগ্রামে কৃষকের শ্রেণী চেতনা ছিল অনুপস্থিত। আর তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রাম ছিল সরাসরি সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন। আর সামন্তবাদই ছিল বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির প্রধান খুঁটি। নীল বিদ্রোহে অনেক সামন্তবাদী পরিবার কৃষকের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে আবার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে তেভাগার দাবী মেনে নিয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ ধরণের নজির সম্ভবত তেভাগার ইতিহাসে নেই।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা ছাড়াও বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রাজস্ব আদায়ের জন্য সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতাসীন নাজিম নিয়োগ করেন, আর নাজিম এজেন্ট বা জমিদারদের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করে। এদেশের পাশাপাশি কোম্পানীর কর্মকর্তারা এদেশকে অবাধ লুন্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করে। কৃষকের ফসল ওঠার সাথে সাথে স্বল্প মূল্যে তা কিনে ব্যাপক মজুদ্দারী ব্যবসা শুরু করে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা। এভাবে শুরু হয় কৃত্রিম খাদ্য সংকট। ১৭৬৯-৭০ সালে বাংলা ও বিহার দারুণ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। সে বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পায়। বাংলা বিহারের দুর্ভিক্ষের কারণ স্পষ্ট হয়ে যায় লন্ডনের কিছু বিবেকবান মানুষের কাছে। এভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশের ভূমি ব্যবস্থার একটি মৌলিক পরিবর্তন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদাররা ভূমির উপর বংশগত কর্তৃত্ব অর্জন করেন। আর কৃষকেরা স্বত্ব হারান ভূমির উপর থেকে। খাজনা আদায়ের ধার্য বর্তায় জোতদারদের উপর। সময়মত কর প্রদানে ব্যর্থ হয়ে অনেক জমিদার জমিদারী হারান। আবার সেগুলি কিনে নিতে থাকে সে সময়ের সদ্য গজিয়ে ওঠা শহরভিত্তিক ব্যবসায়ীরা। খাজনা আদায়ে তারা পাওনাদার ও ভাগীদারদের নিয়োগ করেন। এভাবে একটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী গোষ্ঠী কৃষকের উপর শোষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এরা গ্রামে মহাজনী ব্যবসাও শুরু করে। বেআইনী বিভিন্ন ধরণের কর আদায় এবং মহাজনী প্রথার চক্রবৃদ্ধি সুদ কৃষক সমাজকে একেবারে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অথচ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে প্রাচীন আমল থেকে মোঘল শাসন পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরণের ভূমি ব্যবস্থা চালু থাকলেও কার্যত কৃষকই ছিল জমির মালিক। মোঘল আমলেও এক তৃতীয়াংশ ফসল কর হিসাবে দিতে হত। আর এটা দিতে হত উৎপাদন হলেই। কোন বাঁধা নিয়মে বা ব্যয়কৃত পরিমাণে নয়। এখানেই মোঘলদের সাথে ইংরেজদের পার্থক্য। মোঘলরা এদেশে শাসন কায়েম করে এখানেই স্থায়ী হয়েছে। সম্পদ অন্যত্র পাচার করেনি পক্ষান্তরে ইংরেজ শাসকদের কাছে এটা ছিল লুন্ঠনের ক্ষেত্র। যে কারণে উনবিংশ শতাব্দীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ বিশেষ করে বাংলাদেশে অনেক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত করে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ অন্যতম। এই বিদ্রোহের পর ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন চালু করা হয়। এতে এই সংস্থান রাখা হয় যে কোন কৃষক একটানা ১২ বছর জমি চাষ করলে তাতে তার দখলীস্বত্ব কায়েম হবে। যদিও এই আইন ততটা কার্যকর হয়নি।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম ও ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এই দুটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হওয়ার পর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা স্বশাসন আকাঙ্খা তীব্রতর করে তোলে। যদিও প্রথম পর্যায়ে এই শ্রেণী ভারতের স্বাধীনতা চায়নি। মধ্যবিত্ত এই শ্রেণীটি সব সময় নিজেদের আর্থিক অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে উপনিবেশিক শক্তির শক্ত অবস্থানই কামনা করে এসেছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশক থেকে ক্রমান্বয়ে আর্থিক সংকট তীব্রতর হওয়ায় শিক্ষিত শ্রেণীর একটি অংশ সরাসরি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র পথকে মুক্তির পথ হিসাবে বেছে নেয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সে যুগে এ দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের সামনে একটি নতুন পথের সন্ধান দেয়। শ্রমিক এবং কৃষককে নিয়ে সংগঠন গড়ার উদ্যোগ দেখা দেয়। জন্ম হয় সমাজতান্ত্রীক আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন গ্রুপ ও সংগঠন। যদিও এসব গ্রুপ বা সংগঠনের কোন পরিকল্পিত সংগ্রাম ছিল না তবুও বিংশ শতাব্দীতে তেভাগা আন্দোলনের পথ সারা বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরা তাদের দাবী আদায়ের সংগ্রাম পরিচালনা করেন। প্রসঙ্গত এসব অবিভক্ত বাংলায় কোন সংগঠন তেমন কোন মূখ্য ভূমিকা পালন করে নাই। কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি প্রদেশ ভিত্তিক সংগঠন গড়ার চেষ্টা চলে ১৯২০ সালে। ১৯২৫ সালে বগুড়াতে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছিল নিখিলবঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি। কৃষকের ব্যবস্থাপক সভা (আইনসভা) নির্বাচনে এই সংগঠন বিজয়ী হয়। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় মন্ত্রীসভা। তারা জমিদারী উচ্ছেদ অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলের অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি শ্রেণী অবস্থার কারণে।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন নড়াইলের কৃতিসন্তান সৈয়দ নওশের আলী। সে সময় তিনি তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তবে ১৯৪০ সালে মন্ত্রী সৈয়দ নওশের আলীর প্রচেষ্টায় ঐ কমিশন উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবী বর্গাদারদের ন্যায্যতা স্বীকার করে নেয়। এ ঘটনা ছিল তেভাগা আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক। উল্লেখ্য তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবীই উৎপাদিত ফসলের দুই ভাগ কৃষকের জন্য রেখে এক ভাগ জোতদার জমিদারদের দেয়ার আন্দোলন। এর সাথে যুক্ত হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ দাবীও। কৃষকদের দাবী আদায়ে ১৯৩৬ সালের ১৫ই জানুয়ারী ভারতের বিহার প্রদেশের নিয়ামতপুরে এক সম্মেলনের মাধ্যমে এর নাম দেওয়া হয় কৃষক সভা। এটি কংগ্রেসের অঙ্গ সংগঠন হিসাবে কাজ শুরু করলেও কয়েক বছরের মধ্যে তা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর অঙ্গ সংগঠন হিসাবে পরিণত হয়। আর যার অনিবার্য পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীও কৃষকসভার কাঁধে চাপে। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নাৎসী জার্মানীর হামলা এবং ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন প্রভৃতি। এতে দেখা যায় সিপিআই যে কর্মসূচী নিয়েছে তা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে সমালোচিত হয়। এতে কৃষক আন্দোলনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তা স্বত্ত্বেও ১৯৪৬ সালে নড়াইলের উপকন্ঠে দুর্গাপুর গো-চার মাঠে (বর্তমানে পৌরসভার মধ্যে যেখানে গড়ে উঠেছে সার্কিট হাউস ও তার আশপাশে মহিলা কলেজ এবং অনেক দালানবাড়ী) এ অঞ্চলের প্রধান সংগঠক কমরেড নূরজালাল কর্তৃক আহুত এক বিরাট কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা কমরেড মোজাফ্ফর আহম্মদ প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। এই সমাবেশে এ অঞ্চলের সে যুগের বিশিষ্ট তেভাগা আন্দোলনের নেতা কমরেড অমল সেন, বটুদত্ত, কমরেড আব্দুল হক, রসিক লাল ঘোষ, কমরেড হেমন্ত সরকার, মুন্সী মোদাচ্ছের, সদর থানার শমশের আলী, কাসরলাল বিশ্বাস, রাধা রানী ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের অবদান আজও কৃষক ভুলে নাই। কমরেড অমল সেন আজ এসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে বেঁচে আছেন। ওয়ার্কাস পার্টির পলিট ব্যুরোর সাবেক সদস্য ও সাবেক সভাপতি কমরেড রসিক লাল ঘোষ, হেমন্ত সরকার ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে নড়াইলে ইন্তেকাল করেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ নড়াইলের কৃষক সমাবেশে বক্তৃতার পর থেকে এ অঞ্চলে আন্দোলন আরও দানা বেঁধে উঠে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটল। বেশীর ভাগ হিন্দু কমিউনিস্ট নেতা কলিকাতায় চলে যায়। তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দপ্তর কলিকাতায় থাকে। নতুন দেশ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে হিন্দু পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চাকুরীতে চলে যায়। এর ফলে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা প্রদেশের (এখন বাংলাদেশ) পুলিশ বাহিনী সে সময় বেশ কিছুটা দুর্বল ও অসংগঠিত ছিল। তেভাগা আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার আসামীদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ কয়েকবার দুর্গাপুর বাকড়ী, গুয়াখোলাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে গেলে আন্দোলনরত তেভাগা কর্মীদের হাতে নাজেহাল হয়। একবার নড়াইলের পুলিশ প্রধান কয়েকহাজার কৃষক দ্বারা একবার ডুমুরতলায় ঘেরাও হয়। সে সময় কংগ্রেস নেতা আব্দুল মালেক উকিলের মধ্যস্ততায় ঘেরাও থেকে রক্ষা পায়। এদিকে এই পরিস্থিতিতে মুসলমান ও হিন্দু জমির মালিকগণ কমিউনিস্ট ভীত হয়ে তেভাগা আন্দোলনকে বানচাল করার লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতার কাজ শুরু করে।
১৯৪৮ সালের মে মাসে কলিকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা তেভাগা আন্দোলন বানচাল করতে চায় এবং গোপনে সরকারকে সংবাদ দিতে যাবে তাদের দালাল বলে চিহ্নিত করে হত্যা করতে হবে। ঐ সময় পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এ সময় নড়াইল অঞ্চলের প্রখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের নেতা কমরেড নূরজালাল সাহেবের বড় ভাই নূরুল হুদা সাহেব ছিলেন দুর্গাপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং মুসলিম লীগের একজন বিশিষ্ট নেতা। তেভাগা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে সহযোগিতার কারণে তেভাগা আন্দোলনের নেতারা নুরুল হুদাকে খতম করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তাকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে দলজিতপুর গ্রামের এক জঙ্গলের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে নুরুল হুদার আপন ভাই তেভাগা আন্দোলনের শীর্ষনেতা কমরেড নূরজালাল সহ মোদাচ্ছের মুন্সী শ্যামাচরণ ১৯৪৯ সালে আত্মগোপন অবস্থায় কেশবপুরে এক গ্রাম থেকে গ্রেফতার হন। এই হত্যা মামলায় নূরজালাল, মোদাচ্ছের মুন্সীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। এই হত্যা মামলার রায়ের এক বছরের মধ্যে কমরেড অমলসেন গ্রেফতার হন ও বহু দিন কারাগারে থাকেন। এ সকল কারণে তেভাগা আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। জমির মালিকগণ পূর্বের ন্যায় উৎপাদিত পণ্যের অর্ধেক ভাগ আদায় করতে থাকে।
এভাবে নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবুও কোন দিন কোন গণসংগ্রাম পুরোপুরি ব্যার্থ হয়ে যায় না। তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালে ব্যর্থ হলেও ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ করা হয়। এর পরও এদেশে ভূমি সংস্কার হয়নি। কৃষকের সংগ্রাম রয়েই গেছে। তা স্বত্ত্বেও এ দেশের কৃষক সংগ্রাম তেভাগা অধ্যায় স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শান্ত ঘুমিয়ে থাকা যে আগ্নেয়গিরি জেগে উঠতে পারে অধিকার আদায়ে, জীবন বাজি রাখতে পারে ৫৫ বছর আগে সংঘটিত তেভাগা সংগ্রাম তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক : আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২
গত ১৯৯৬ সালে তেভাগা আন্দোলনের সূবর্ণজয়ন্তী অতিক্রম করেছে। নড়াইল ছিল তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রধান এলাকা। সেই কারণে সূবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠান হয়েছিলে জেলার প্রত্যন্ত একটি গ্রাম মুলিয়া হাইস্কূল মাঠে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সে যুগের তেভাগা আন্দোলনের নেতা অমল সেন, রসিকলাল ঘোষ, ইলামিত্র, ভারতের লোকসভার সদস্য মাহবুব জাহেদীসহ অনেক নেতৃবৃন্দ।
তেভাগা আন্দোলনের স্বরূপ নিয়ে বিভিন্ন নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে কারও কারও মতে এটি ছিল মার্কসবাদী ধ্যান ধারনার মাধ্যমে কৃষকদের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা ক্ষমতা দখলের একটি প্রচেষ্টা। আবার কারও মতে এ সংগ্রাম স্বত:স্ফুর্ত হলেও ক্ষমতা দখলের প্রশ্ন আসেনি। বরং এটি ছিল কৃষকের অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের গণআন্দোলন। যদিও শ্রেণী সংগ্রামের একটি চেতনা এর ভিতরে কাজ করেছিল, কিন্তু নেতৃত্ব পর্যায়ে ক্ষমতা দখলের চিন্তা ছিল অনুপস্থিত এবং তৎকালীন প্রেক্ষাপটে অবাস্তবও। কোন তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে না গিয়েও অনুমান করা যায় যে তেভাগা আন্দোলনের সেই সময়ের সংগ্রাম যাদের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল, সেই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি এবং কৃষক সংগঠন ‘কৃষক সভা’র বক্তব্য সেদিন কি ছিল? তবে এই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ, তাহলো দেশ ভাগের সেই পরিস্থিতিতে সমস্ত দেশের শহর ও নগর কেন্দ্রিক মানুষ যখন কংগ্রেস মুসলিম লীগ রাজনৈতিক দলের পিছনে সমবেত, তখন বাংলার গ্রামীণ জীবনে তেভাগার উপস্থিতি অত্যন্ত প্রবল। ঐ সময়ে দুই ধারার রাজনৈতিক দুই স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কৃষকের স্বত:স্ফুর্ত সংগ্রাম অবশ্যই ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। সামপ্রদায়িকতার উর্ধে উঠে মুসলমান এবং হিন্দু কৃষক সেদিন একসাথে তেভাগার সংগ্রাম করেছে। একে ছোট করে দেখার কোন অবকাশ নেই। অবিভক্ত বাংলার ইতিহাসে তিনটি কৃষক সংগ্রামের ইতিহাস আজও গৌরবোজ্জল হয়ে রয়েছে। সন্ন্যাসী বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রকৃতপক্ষে ঐটিই প্রথম কৃষক বিদ্রোহ। নীলবিদ্রোহের অংশ নিয়েছিলেন বাংলার ৫০ লাখ কৃষক। অনেক গবেষকই বলেছেন “সন্ন্যাসী বিদ্রোহ” ও নীল বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় আসে তেভাগা সংগ্রাম। বস্তুত তিনটি কৃষক সংগ্রামই ছিল ইংরেজ শাসন ও শোষণের ফল। বিশেষ ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্ণওয়ালিশের সময় যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হয় তার দরুণ তেভাগা আন্দোলন অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর এর আগেই শুরু হয়েছিল সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগেই। বাংলার কৃষকদের উপর ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী যে শোষনের যাতাকলে তাদের মধ্যস্বত্ত্বভোগী ও জমিদারদের মাধ্যমে নির্যাতন শুরু করে তার ফলে শুরু হয় সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। মোট সাত পর্বে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৭৬৩ সালে প্রথম ঢাকা কুঠি আক্রমণের মধ্য দিয়ে শুরু হয় এই সন্ন্যাস বিদ্রোহ। আর এই বিদ্রোহের শেষ হয় ১৮০০ সালে। বিদ্রোহীদের একক কোন নেতৃত্ব ছিলনা। সারাদেশের অসংখ্য কৃষক অংশগ্রহণ করে। ঐ সময় বাংলার গভর্ণর জেনারেল ছিলেন হেস্টিংস। ঐ সময় থেকে এই বিদ্রোহকে সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বলে অভিহিত করা হয়। ঐ নামে পরিচিত হয়ে আসছে। স্যার উইলিয়াম হান্টার অবশ্য এই সন্ন্যাস বিদ্রোহকে কৃষক বিদ্রোহ বলে অভিহিত করেছে। নীল বিদ্রোহ বিভিন্ন পর্যায়ে হয়েছে। ১৭৭৭ সালে অবিভক্ত বাংলায় প্রথম নীলচাষ শুরু হয়। তখনো কৃত্রিম নীল আবিষ্কৃত হয়নি। ইংরেজ নীলকরেরা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে চাষীদের নীল চাষে বাধ্য করাতেন। ১৮৫৯-৬০ সালে নীল বিদ্রোহ দাউদাউ করে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কৃষকদের আন্দোলনের ফলে নীল কমিশন গঠিত হয়। নীল কমিশন তাদের রিপোর্টে বলে নীল চাষ করা বা না করা সম্পূর্ণ চাষীদের ইচ্ছাধীন। এভাবে কৃষকদের বিজয় অর্জিত হয়। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ ও নীল বিদ্রোহের সাথে তেভাগা আন্দোলনের পার্থক্য, এখানে সে প্রথম দুটি সংগ্রামে কৃষকের শ্রেণী চেতনা ছিল অনুপস্থিত। আর তেভাগা আন্দোলনের সংগ্রাম ছিল সরাসরি সামন্তবাদ বিরোধী আন্দোলন। আর সামন্তবাদই ছিল বৃটিশ উপনিবেশিক শক্তির প্রধান খুঁটি। নীল বিদ্রোহে অনেক সামন্তবাদী পরিবার কৃষকের পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছিল। অনেকে আবার নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। ইচ্ছাকৃতভাবে তেভাগার দাবী মেনে নিয়ে আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ ধরণের নজির সম্ভবত তেভাগার ইতিহাসে নেই।
১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা ছাড়াও বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী রাজস্ব আদায়ের জন্য সর্ব্বোচ্চ ক্ষমতাসীন নাজিম নিয়োগ করেন, আর নাজিম এজেন্ট বা জমিদারদের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকদের নিকট থেকে খাজনা আদায় করে। এদেশের পাশাপাশি কোম্পানীর কর্মকর্তারা এদেশকে অবাধ লুন্ঠনের ক্ষেত্রে পরিণত করে। কৃষকের ফসল ওঠার সাথে সাথে স্বল্প মূল্যে তা কিনে ব্যাপক মজুদ্দারী ব্যবসা শুরু করে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা। এভাবে শুরু হয় কৃত্রিম খাদ্য সংকট। ১৭৬৯-৭০ সালে বাংলা ও বিহার দারুণ দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ে। বাংলার এক তৃতীয়াংশ মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। সে বছর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজস্ব আদায় বৃদ্ধি পায়। বাংলা বিহারের দুর্ভিক্ষের কারণ স্পষ্ট হয়ে যায় লন্ডনের কিছু বিবেকবান মানুষের কাছে। এভাবে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়। ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত এদেশের ভূমি ব্যবস্থার একটি মৌলিক পরিবর্তন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে জমিদাররা ভূমির উপর বংশগত কর্তৃত্ব অর্জন করেন। আর কৃষকেরা স্বত্ব হারান ভূমির উপর থেকে। খাজনা আদায়ের ধার্য বর্তায় জোতদারদের উপর। সময়মত কর প্রদানে ব্যর্থ হয়ে অনেক জমিদার জমিদারী হারান। আবার সেগুলি কিনে নিতে থাকে সে সময়ের সদ্য গজিয়ে ওঠা শহরভিত্তিক ব্যবসায়ীরা। খাজনা আদায়ে তারা পাওনাদার ও ভাগীদারদের নিয়োগ করেন। এভাবে একটি মধ্যস্বত্ত্বভোগী গোষ্ঠী কৃষকের উপর শোষণের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। এরা গ্রামে মহাজনী ব্যবসাও শুরু করে। বেআইনী বিভিন্ন ধরণের কর আদায় এবং মহাজনী প্রথার চক্রবৃদ্ধি সুদ কৃষক সমাজকে একেবারে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অথচ চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের আগে প্রাচীন আমল থেকে মোঘল শাসন পর্যন্ত ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে নানা ধরণের ভূমি ব্যবস্থা চালু থাকলেও কার্যত কৃষকই ছিল জমির মালিক। মোঘল আমলেও এক তৃতীয়াংশ ফসল কর হিসাবে দিতে হত। আর এটা দিতে হত উৎপাদন হলেই। কোন বাঁধা নিয়মে বা ব্যয়কৃত পরিমাণে নয়। এখানেই মোঘলদের সাথে ইংরেজদের পার্থক্য। মোঘলরা এদেশে শাসন কায়েম করে এখানেই স্থায়ী হয়েছে। সম্পদ অন্যত্র পাচার করেনি পক্ষান্তরে ইংরেজ শাসকদের কাছে এটা ছিল লুন্ঠনের ক্ষেত্র। যে কারণে উনবিংশ শতাব্দীতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরবর্তীকালে ভারতবর্ষ বিশেষ করে বাংলাদেশে অনেক কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত করে। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের কৃষক বিদ্রোহ অন্যতম। এই বিদ্রোহের পর ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন চালু করা হয়। এতে এই সংস্থান রাখা হয় যে কোন কৃষক একটানা ১২ বছর জমি চাষ করলে তাতে তার দখলীস্বত্ব কায়েম হবে। যদিও এই আইন ততটা কার্যকর হয়নি।
১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম ও ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এই দুটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হওয়ার পর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লোকেরা স্বশাসন আকাঙ্খা তীব্রতর করে তোলে। যদিও প্রথম পর্যায়ে এই শ্রেণী ভারতের স্বাধীনতা চায়নি। মধ্যবিত্ত এই শ্রেণীটি সব সময় নিজেদের আর্থিক অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে উপনিবেশিক শক্তির শক্ত অবস্থানই কামনা করে এসেছে। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম ও দ্বিতীয় দশক থেকে ক্রমান্বয়ে আর্থিক সংকট তীব্রতর হওয়ায় শিক্ষিত শ্রেণীর একটি অংশ সরাসরি ভারতের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র পথকে মুক্তির পথ হিসাবে বেছে নেয়। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর সে যুগে এ দেশের রাজনৈতিক কর্মীদের সামনে একটি নতুন পথের সন্ধান দেয়। শ্রমিক এবং কৃষককে নিয়ে সংগঠন গড়ার উদ্যোগ দেখা দেয়। জন্ম হয় সমাজতান্ত্রীক আদর্শে বিশ্বাসী বিভিন্ন গ্রুপ ও সংগঠন। যদিও এসব গ্রুপ বা সংগঠনের কোন পরিকল্পিত সংগ্রাম ছিল না তবুও বিংশ শতাব্দীতে তেভাগা আন্দোলনের পথ সারা বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে কৃষকরা তাদের দাবী আদায়ের সংগ্রাম পরিচালনা করেন। প্রসঙ্গত এসব অবিভক্ত বাংলায় কোন সংগঠন তেমন কোন মূখ্য ভূমিকা পালন করে নাই। কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণে একটি প্রদেশ ভিত্তিক সংগঠন গড়ার চেষ্টা চলে ১৯২০ সালে। ১৯২৫ সালে বগুড়াতে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত হয়েছিল নিখিলবঙ্গ কৃষক প্রজা সমিতি। কৃষকের ব্যবস্থাপক সভা (আইনসভা) নির্বাচনে এই সংগঠন বিজয়ী হয়। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হয় মন্ত্রীসভা। তারা জমিদারী উচ্ছেদ অর্থাৎ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাতিলের অঙ্গীকার করলেও তা বাস্তবায়নে সক্ষম হয়নি শ্রেণী অবস্থার কারণে।
শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভার মন্ত্রী ছিলেন নড়াইলের কৃতিসন্তান সৈয়দ নওশের আলী। সে সময় তিনি তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন। তবে ১৯৪০ সালে মন্ত্রী সৈয়দ নওশের আলীর প্রচেষ্টায় ঐ কমিশন উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশের দাবী বর্গাদারদের ন্যায্যতা স্বীকার করে নেয়। এ ঘটনা ছিল তেভাগা আন্দোলনের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক। উল্লেখ্য তেভাগা আন্দোলনের মূল দাবীই উৎপাদিত ফসলের দুই ভাগ কৃষকের জন্য রেখে এক ভাগ জোতদার জমিদারদের দেয়ার আন্দোলন। এর সাথে যুক্ত হয় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উচ্ছেদ দাবীও। কৃষকদের দাবী আদায়ে ১৯৩৬ সালের ১৫ই জানুয়ারী ভারতের বিহার প্রদেশের নিয়ামতপুরে এক সম্মেলনের মাধ্যমে এর নাম দেওয়া হয় কৃষক সভা। এটি কংগ্রেসের অঙ্গ সংগঠন হিসাবে কাজ শুরু করলেও কয়েক বছরের মধ্যে তা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর অঙ্গ সংগঠন হিসাবে পরিণত হয়। আর যার অনিবার্য পরিণতিতে কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এর বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীও কৃষকসভার কাঁধে চাপে। যেমন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু ও সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর নাৎসী জার্মানীর হামলা এবং ১৯৪২ সালে কংগ্রেসের ভারত ছাড় আন্দোলন প্রভৃতি। এতে দেখা যায় সিপিআই যে কর্মসূচী নিয়েছে তা সে সময়ের প্রেক্ষাপটে সমালোচিত হয়। এতে কৃষক আন্দোলনও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তা স্বত্ত্বেও ১৯৪৬ সালে নড়াইলের উপকন্ঠে দুর্গাপুর গো-চার মাঠে (বর্তমানে পৌরসভার মধ্যে যেখানে গড়ে উঠেছে সার্কিট হাউস ও তার আশপাশে মহিলা কলেজ এবং অনেক দালানবাড়ী) এ অঞ্চলের প্রধান সংগঠক কমরেড নূরজালাল কর্তৃক আহুত এক বিরাট কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রখ্যাত নেতা কমরেড মোজাফ্ফর আহম্মদ প্রধান অতিথি হিসাবে বক্তব্য রাখেন। এই সমাবেশে এ অঞ্চলের সে যুগের বিশিষ্ট তেভাগা আন্দোলনের নেতা কমরেড অমল সেন, বটুদত্ত, কমরেড আব্দুল হক, রসিক লাল ঘোষ, কমরেড হেমন্ত সরকার, মুন্সী মোদাচ্ছের, সদর থানার শমশের আলী, কাসরলাল বিশ্বাস, রাধা রানী ঘোষ প্রমুখ নেতৃবৃন্দের অবদান আজও কৃষক ভুলে নাই। কমরেড অমল সেন আজ এসব নেতৃবৃন্দের মধ্যে বেঁচে আছেন। ওয়ার্কাস পার্টির পলিট ব্যুরোর সাবেক সদস্য ও সাবেক সভাপতি কমরেড রসিক লাল ঘোষ, হেমন্ত সরকার ১৯৯৬ ও ১৯৯৮ সালে নড়াইলে ইন্তেকাল করেছেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফ্ফর আহমেদ নড়াইলের কৃষক সমাবেশে বক্তৃতার পর থেকে এ অঞ্চলে আন্দোলন আরও দানা বেঁধে উঠে। এই পরিস্থিতির মধ্যে ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলো। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটল। বেশীর ভাগ হিন্দু কমিউনিস্ট নেতা কলিকাতায় চলে যায়। তেভাগা আন্দোলনের প্রধান দপ্তর কলিকাতায় থাকে। নতুন দেশ সৃষ্টি হওয়ার সাথে সাথে হিন্দু পুলিশ ও অন্যান্য কর্মকর্তা কর্মচারীরা ভারতের পশ্চিম বঙ্গে চাকুরীতে চলে যায়। এর ফলে পাকিস্তানের পূর্ব বাংলা প্রদেশের (এখন বাংলাদেশ) পুলিশ বাহিনী সে সময় বেশ কিছুটা দুর্বল ও অসংগঠিত ছিল। তেভাগা আন্দোলনের কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার আসামীদের গ্রেফতার করার জন্য পুলিশ কয়েকবার দুর্গাপুর বাকড়ী, গুয়াখোলাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে গেলে আন্দোলনরত তেভাগা কর্মীদের হাতে নাজেহাল হয়। একবার নড়াইলের পুলিশ প্রধান কয়েকহাজার কৃষক দ্বারা একবার ডুমুরতলায় ঘেরাও হয়। সে সময় কংগ্রেস নেতা আব্দুল মালেক উকিলের মধ্যস্ততায় ঘেরাও থেকে রক্ষা পায়। এদিকে এই পরিস্থিতিতে মুসলমান ও হিন্দু জমির মালিকগণ কমিউনিস্ট ভীত হয়ে তেভাগা আন্দোলনকে বানচাল করার লক্ষ্যে সরকারের বিভিন্ন প্রকার সহযোগিতার কাজ শুরু করে।
১৯৪৮ সালের মে মাসে কলিকাতায় কমিউনিস্ট পার্টির এক সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, যারা তেভাগা আন্দোলন বানচাল করতে চায় এবং গোপনে সরকারকে সংবাদ দিতে যাবে তাদের দালাল বলে চিহ্নিত করে হত্যা করতে হবে। ঐ সময় পাকিস্তান সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
এ সময় নড়াইল অঞ্চলের প্রখ্যাত তেভাগা আন্দোলনের নেতা কমরেড নূরজালাল সাহেবের বড় ভাই নূরুল হুদা সাহেব ছিলেন দুর্গাপুর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট এবং মুসলিম লীগের একজন বিশিষ্ট নেতা। তেভাগা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের সাথে সহযোগিতার কারণে তেভাগা আন্দোলনের নেতারা নুরুল হুদাকে খতম করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তাকে বাড়ী থেকে ধরে নিয়ে দলজিতপুর গ্রামের এক জঙ্গলের মধ্যে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এই হত্যার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে নুরুল হুদার আপন ভাই তেভাগা আন্দোলনের শীর্ষনেতা কমরেড নূরজালাল সহ মোদাচ্ছের মুন্সী শ্যামাচরণ ১৯৪৯ সালে আত্মগোপন অবস্থায় কেশবপুরে এক গ্রাম থেকে গ্রেফতার হন। এই হত্যা মামলায় নূরজালাল, মোদাচ্ছের মুন্সীর যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। এই হত্যা মামলার রায়ের এক বছরের মধ্যে কমরেড অমলসেন গ্রেফতার হন ও বহু দিন কারাগারে থাকেন। এ সকল কারণে তেভাগা আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। জমির মালিকগণ পূর্বের ন্যায় উৎপাদিত পণ্যের অর্ধেক ভাগ আদায় করতে থাকে।
এভাবে নড়াইলের তেভাগা আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। তবুও কোন দিন কোন গণসংগ্রাম পুরোপুরি ব্যার্থ হয়ে যায় না। তেভাগা আন্দোলন ১৯৪৬ সালে ব্যর্থ হলেও ১৯৫০ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বিলোপ করা হয়। এর পরও এদেশে ভূমি সংস্কার হয়নি। কৃষকের সংগ্রাম রয়েই গেছে। তা স্বত্ত্বেও এ দেশের কৃষক সংগ্রাম তেভাগা অধ্যায় স্বমহিমায় উজ্জ্বল। শান্ত ঘুমিয়ে থাকা যে আগ্নেয়গিরি জেগে উঠতে পারে অধিকার আদায়ে, জীবন বাজি রাখতে পারে ৫৫ বছর আগে সংঘটিত তেভাগা সংগ্রাম তার উজ্জ্বল উদাহরণ।
তথ্য সূত্র:
নড়াইল জেলার অতীত ও বর্তমান
লেখক : আকরামুজ্জামান মিলু
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
আপডেট:
এপ্রিল ২০১২