
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > বস্তি জীবনের যেখানে সংশয়
এই পৃষ্ঠাটি মোট 15786 বার পড়া হয়েছে
বস্তি জীবনের যেখানে সংশয়
“যে অবস্থায় প্রাণী বাঁচে না, মানুষ, আমাকে বাঁচতেই হবে।” অমর কথা শিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছোট গল্প প্রাগৈতিহাসিকের নায়ক ভিকুর এই সাহসী আত্মবল-উক্তি হৃদয়ে ধারণ করে জীবন সংগ্রামে নিরত রয়েছে যুগে যুগে এদেশের নিরন্ন-নিপীড়িত নিঃস্ব বস্তিবাসী। গ্রাম বাংলার হাজার বছরের নদী ভাঙ্গন ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতিই এই বস্তি জীবন। এর সাথে যোগ হয়েছে গ্রামীণ অভাব-অন্নের তাগিদ আর বেঁচে থাকার অদম্য ইচ্ছা। বাসস্থান যেখানে খুপড়ি, স্বাস্থ্য যেখানে স্বপ্ন, শিক্ষা যেখানে বিলাসিতা, যন্ত্রণা যেখানে নিত্যসঙ্গী এরই নাম বস্তি। দেশের কোটি কোটি জনসংখ্যার এক বিশাল অংকের মানুষ আজ বস্তিবাসী। প্রতিটি শহর-উপশহরেই গড়ে উঠেছে বৈধ-অবৈধ লক্ষ লক্ষ বস্তি। প্রাচীন শহর যশোর পৌর নগরীতেও এই বস্তি এবং বস্তিবাসীর সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, শহরে বস্তি আছে মোট ১১৫টি এবং মোট বস্তিবাসীর সংখ্যা ২৫,০০০ জন। বস্তির সংখ্যা ও এর জনসংখ্যার পরিমান সম্পর্কে জনা যায় যে প্রায় ২শ’টিতে ৪০,০০০ হাজারের কাছাকাছি মানুষ বসবাস করে। পৌর এলাকায় সামপ্রতিকালে যে বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে তার অধিকাংশই দেশের বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে এসেছে। অর্থাৎ বলা চলে পৌর শহর বর্তমানে বহিরাগতদের শহর। এখানকার অধিকাংশ মানুষের জন্ম এই শহরের বাইরে। পৌর এলাকায় পুনর্বাসিত বেশিরভাগ মানুষ দরিদ্র শ্রেণীভুক্ত। দুঃসহ দারিদ্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য প্রতিকূল অবস্থা তাদের গ্রামত্যাগী করেছে এবং সেই সাথে বৃহত্তর শহরের অর্থনৈতিক সুযোগের তুলনামূলক সম্ভাবনা তাদের শহরমুখি করেছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, খড়কি দক্ষিণপোড়া রেল লাইনের ধারে, খড়কি কবরস্থানের উত্তরে মরহুম গফফর চৌধুরীর বাড়ির পাশে, স্টেডিয়ামপাড়া সোনার দোকানের পশ্চিমে, খড়কী হাজামপাড়া রেল লাইনের ধারে, এম. এম. কলেজ পাড়া পানির ট্যাঙ্কের পিছনে, চাঁচড়া কামারখালি রোডের পাশে, রেলস্টেশন শাহনাজ হোটেলের বাম পাশে, স্টেশন কয়লা পট্টির তুলোতলা এলাকায়, টিবি ক্লিনিকের দক্ষিণে, বেজপাড়া আশ্রম মসজিদের পাশে, বেজপাড়া আনসার ক্যামপ এলাকায়, শংকরপুর রেল লাইনের ডানে ও বায়ে, বেজপাড়া বুনোপাড়া পুকুরের পাশে, বেজপাড়া মেঠোপাড়া এলাকায়, খুলনা স্ট্যান্ড সিটি কলেজের পূর্বে, হুঁশতলা চক্ষু হাসপাতালের পাশে, পূর্ববারান্দি ফুলতলা এলাকায়, মোল্লাপাড়া বাঁশতলা এলাকায়, ষষ্ঠিতলা বাবুলের বস্তি, ইদ্রিস বিহারী ও নাকিম বিহারীর বস্তি, মুচিপাড়া ঘোপ কবরস্থান পাড়া এলাকায়, সাবেক পৌর চেয়ারম্যান ও এমপি আলি রেজা রাজুর বস্তি, রফিকের বস্তি, জাসদ নেতা রবিউল আলমের বাড়ির সামনে জামাল মোল্লার বস্তি, হানিফের বস্তি, পুরাতন কসবা কাঁঠালতলা ঢাকা রোডের উত্তরে, মানিকতলা এলাকায়, কমিশনার নীরার বাড়ির পাশে, টালি খোলা ঘোষপাড়া এলাকার, সেবাসংঘের পাশে কাইয়ুমের জমিতে গড়ে উঠেছে বস্তি। বস্তিবাসীর একটি সূত্র জানিয়েছে, এর মধ্যে পৌর চেয়ারম্যানের বস্তিতেই আছে ২৫০০ ঘর। এ ছাড়াও রয়েছে অনেকগুলি রিকসা মেস, যে জীবন কোনভাবেই বস্তি জীবন থেকে পৃথক নয়। এর মধ্যে অধিক সংখ্যায় রিকসা চালকের মেস রয়েছে নীলগঞ্জে দুটি, কাজীপাড়া আবু তালেব সড়কের মোড়ে একটি, আরবপুর বাঁচতে শেখা অফিসের সামনে একটি, রেলগেট চোরমারা দীঘির পাশে একটি, চাঁচড়া ডালমিল এলাকা মৎস্য হ্যাচারির পাশে দুটি ও টালিখোলায় একটি।
আলাপে জানা গেছে, এরা এসেছে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বিশেষ করে ফরিদপুর, বরিশাল, মাদারীপুর, ট্যাকের হাট, নড়াইল, লোহাগড়া, মাগুরা এমনকি খোদ রাজধানী জেলা ঢাকার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও; যার কারণে ঘোপ অঞ্চলে একটি বস্তির নামও হয়েছে ঢাকাইয়া পট্টি। এছাড়াও রয়েছে যশোর জেলার সুদূর গ্রাম থেকে উঠে আসা অভাবী মানুষের অনেকে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, নদী ভাঙনসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কারণে ছিন্নমূল গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও নিঃস্ব মানুষ যশোর শহরে উঠে এসে মানবেতর জীবন যাপন করছে। হয়তো বিধ্বস্ত এই গ্রামের মানুষ শহরের বর্ধিত পরিসরে কর্মসংস্থানের কোন একটা সুযোগ পাচ্ছে, তবে হারিয়েছে তারা অনেক হাসি আনন্দ আর আবহমান কালের গ্রামীণ জন সমাজের প্রেম-মূল্যবোধ।
প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ভেসে আসা হাজারো অভাবী মানুষের মধ্য দিয়ে পৌর এলাকায় গড়ে উঠেছে দু’ধরনের বস্তি : বৈধ-অবৈধ। বৈধ বস্তি, যেগুলি ব্যক্তি মালিকানার আওতাধীন এবং অবৈধ বস্তি, যেগুলো রেল লাইন, মহাসড়কের ধারে ও খাস জমিতে গড়ে উঠেছে। অবৈধ বস্তিগুলিকে ঘরভাড়া দিতে হয় না ঠিকই কিন্তু সন্ত্রাসীদের নিয়মিত চাঁদাসহ অনেক কিছুই মাসোহারা দিতে হয়। বৈধ বস্তির খুঁপড়ি ঘর প্রতি মালিককে ২৫০ থেকে ৫শ’ টাকা পর্যন্ত ভাড়া দিতে হয়। এদের বেশির ভাগ রিকসা চালানো, ফেরি করা, কাঁচামাল বিক্রি, ঠেলাগাড়ি চালানো, কুলিগিরি, ইট ভাঙা, ধানের চাতালে কাজ করা, দিন মজুরি খাটা, মাছ বেচা, হোটেলে কাজ করা, ভারতীয় শাড়ি বিক্রি ও বিভিন্ন কারিগরি পেশায় নিয়োজিত থাকে। মেয়েরা হোটেলে ছুটা কাজ বা ঘরে ঝি-এর কাজ করে। এসব কাজগুলি স্ব-নিয়োজিত, অস্থায়ী ও মৌসুমী ধরনের। শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করেও এরা বঞ্চিত মৌলিক সব ধরনের অধিকার থেকে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান সব কিছুই এদের কাছে যেন বিলাসিতা; জীবনের যেখানে সংশয়। ৩৯টি বস্তি সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ বস্তিতে খাবার পানির সরবরাহ নেই। নেই পয়ঃনিষ্কাশনের সুষ্ঠু কোন ব্যবস্থা। কাঁচা পায়খানায় ভরপুর যা বছরের পর বছর ধরে পরিষ্কার করা হয় না। বৈদ্যুতিক আলোর সুবিধা যারা জীবনেও পায়নি। গাঁজা, ফেনসিডিলসহ হিরোইনের মত মারাত্মক সব জীবননাশী দ্রব্যের বিকিকিনি কেন্দ্র এই সমস্ত বস্তি। এ যেন অপরাধ জগতের উৎপত্তিস্থল।
এমনি একটি বস্তির নাম জালাল মোল্লার বস্তি। শহরের শাসক পাড়া হিসেবে ঘোপ সেন্ট্রাল রোডের জাসদ নেতা রবিউল আলমের বাড়ির সামনে-জনাব জামাল মোল্লা এ বস্তির মালিক। ১শ’র ঘর আছে এখানে। ছোট ছোট খুঁপড়ি, মাটি, চটা, পাটখড়ির দেয়াল, গোল পাতার ছাউনি। সারিবদ্ধ এই ঘরের মাঝে পাটিশন, চাটাই। ফাঁকা দিয়ে শুধু দেখাই যায় না, শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যায় পাশের ঘর থেকে। এমনি ঘরে কোন রকমে ধরে একটি চৌকি, এরই মধ্যে রান্নার কাজসহ বাবা-মা’র পাশাপাশি ৪ সদস্যের বসবাস। শহরের প্রাণ কেন্দ্রে অবস্থিত বলে ঘর প্রতি ভাড়াও বেশ চড়া। ২শ’ থেকে ৬শ’ টাকা পর্যন্ত। বর্তমানে এই বস্তিতে ৬০/৭০ জন পরিবার ভাড়াটিয়া আছে। মোট পরিবারের সদস্য সংখ্যা ২৮০ জন প্রায়। এই ব্যাপক সংখ্যক মানুষের খাবার পানির চাহিদা পুরণের জন্য টিউবওয়েল মাত্র একটি। কিন্তু সেটিও অকেজো হয়ে আছে দীর্ঘদিন ধরে। বর্তমানে বিশুদ্ধ পানির কোন ব্যবস্থা নেই। বহু পুরাতন ভাঙাচোরা আধাপাকা পায়খানা আছে ৪টি। ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় ভাড়াটিয়াদের। সেফটিকট্যাঙ্ক একটি যার ঢাকনা নেই। বছরের পর বছর ধরে পরিষ্কার না করায় মল-মূত্র উপচে পড়ছে। এর সাথে যুক্ত করে দেয়া হয়েছে ঘরের গা ঘেঁষে উঠনের চৌ সিমানায় কাটা ড্রেন, যেখানে মাগুর মাছের চাষ করছে বস্তি মালিক জামাল মোল্লা। ভাড়াটিয়াদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে মালিক মলমূত্র পরিষ্কার করে না কারণ তা রাক্ষুসে মাগুরের খোরাক। এরপরও এই ড্রেনে মাছের প্রোটিন হিসেবে দেয়া হয় মরা কুকুর, গরু-ছাগল, হাঁস, মুরগির নাড়ি-ভুড়িসহ নানা ধরনের বিষাক্ত বর্জ। বিদ্যুতের সংযোগ না দেয়ায় প্রায়ই রাতে ছোট শিশুসহ বড় মানুষ ও পড়ে যায় ঐ অস্বাস্থ্যকর ড্রেনে। বস্তিবাসী জানিয়েছে গর্তে পড়ে ইতিমধ্যে মারাও গেছে একজন। একটি গরু পড়ে গিয়েছিল পায়খানার খোলা সেফটিকট্যাঙ্কের ভিতরে। বর্তমানে পৌরসভার একটি টিপকলে (স্ট্রিট হাইড্রেন) খাবার পানি, ধোয়া পাখলা ও গোসলের কাজ সারতে হচ্ছে ভাড়াটিয়াদের। এমনিতেই স্যাতসেঁতে ভিজে, প্রায় কাদা ঘরের মেঝে; তার ওপরে এই বর্ষার সময় মাঝে মধ্যেই পায়খানার মলমূত্রে উঠান ভেসে যায়। কখনো কখনো ঘরের মধ্যেও ঢুকে যায়। এমনি মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর জীবনযাপন করছে জামাল মোল্লার ভাড়াটিয়ারা। আলাপে জানা গেছে এদের বেশির ভাগই এসেছে বরিশাল ও ফরিদপুর থেকে। মাগুরা এবং যশোর জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষও আছে কয়েক ঘর। এত কষ্টের মধ্যেও তারা তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শেখাতে চায়। অধিকাংশ শিশুরা একটি বেসরকারি সংস্থার স্কুলের ছাত্র/ছাত্রী। অভাবের তাড়নায় এদের শিক্ষাজীবন ছয় ক্লাসের দেওয়াল কখনো টপকাতে পারে না। বস্তিবাসীদের একজন জানালো, এই ভাড়াটিয়াদের কেউ কেউ গাঁজা বিক্রি করে। এলাকার অনেক উঠতি বয়সী ছেলেই এর খরিদ্দার। সে আরো জানালো, এই বস্তিতে হাতে নির্মিত বোমাও তৈরি করে বিক্রি করা হয়। জানা গেছে, রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের সাথে এদের যোগাযোগ আছে, ফলে ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। এক প্রশ্নের উত্তরে তারা জানায়, কোনদিনও পৌরসভার লোকজন (স্যানিটারি ইন্সপেক্টর) তাদের এই পয়ঃনিষ্কাশনহীন অস্বাস্থ্যকর জীবন দেখতে আসেনি। জনপ্রতিনিধিদের তৎপরতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা জানায়, “আমরা ভোট দিই, সে সময় আমাইগের কষ্ট দেহে দরদে সবার পরান-ডা উথলে উঠে, ভোটের পরে আর তাদের দেহা যায় না।”
ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে জানা গেছে, তাদের মালিকের তিন বউ, একজন মারা গেছে, ছেলে মেয়ে মোট ১৭ জন। কথা হলো মালিকের সাথে। জানালেন, “ভাড়াটিয়া বেশি নেই ২০/৩০ ঘর আছে মাত্র। ভাড়া দেয় ৩০/৪০ টাকা করে তাও ঠিকমত দেয় না। গরীব মানুষ তো! কিভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবো বলেন?”
যে পরিবেশে বনের পশু বাঁচে না, সেখানে মানুষ বাঁচে। সমস্থ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজের বাসযোগ্য করে নেয়ার এই অসম্ভব মতার কারণেই হয়তো বা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বিশাল অতিকায় প্রাণী কিন্তু টিকে আছে মানুষ।
তথ্য সূত্র :
প্রকাশিত গদ্য
লেখক : বেনজিন খান
সম্পাদনা :
মোঃ হাসনূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
০১.০৪.২০১১