
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > যশোরের প্রাণ ভৈরব নদের করুন পরিনতি
এই পৃষ্ঠাটি মোট 4846 বার পড়া হয়েছে
যশোরের প্রাণ ভৈরব নদের করুন পরিনতি
যশোরের বুকচিরে বয়ে যাওয়া ভৈরব নদী দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের অন্যতম প্রধান ও তীর্থ নদী যার তীরে এক সময় আর্য সভ্যতা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। ভৈরব নদী তীরবর্তী জনপদগুলো হল মেহেরপুর, দামুড়হুদা, চুয়াডাঙ্গা, কোটচাঁদপুর, চৌগাছা, বারবাজার, যশোর, বসুন্দিয়া, নওয়াপাড়া, ফুলতলা, দৌলতপুর, খুলনা ও বাগেরহাট। ভারতবর্ষে এক নদীর নামে অন্য নদীর নাম আছে, কিন্তু ভৈরবের নামে অন্য কোন নদীর নাম নেই। দেখা যায় দক্ষিণ বঙ্গের বড় নদীগুলো প্রায়ই দক্ষিণ মুখী, কিন্তু ভৈরবের ক্ষেত্রে ভিন্ন। সুতরাং বহু নদীর সাথে ভৈরব নদীর সম্মিলন হয়েছে। ফলে ভৈরব নানা স্থানে নানা নদীর সাথে আত্নাহুতি দিতে দিতে নিজে সংকুচিত হয়ে যায়। না হলে এটা নামের অনুরূপ ভয়ংকর মূর্তিতে বিরাজ করতো। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের বিশ্বাস যে, তের শতকে হযরত খান জাহান আলীর অন্যতম শিষ্য হযরত গরীব শাহ (রঃ) একবার ভৈরব নদকে রাগকরে ভর্ৎসনা করেছিলেন বলে নদের স্রোত স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। জনসধারণ এখনও বিশ্বাস করে যে, দরবেশের জন্য নদে আজও স্রোত বয়না।
অতীতের গৌরব গাথা :
ভৈরব দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অন্যতম প্রধান ও বড় নদী। এটা গঙ্গানদী থেকে উৎপন্ন হয়ে বৃহত্তর যশোর জেলার মাঝামা

ভৈরব দক্ষিণে বারবাজার, মুড়োলি, কসবা, যশোর, বসুন্দিয়া, নওয়াপাড়া, ফুলতলা, দৌলতপুর, সেনহাটি, সেনের বাজার, আলীপুর, চাঁদপুর, ফকিরহাট, পানিঘাটা, বাগেরহাট, খলিফাবাদ ও কচুয়া প্রভৃতি প্রসিদ্ধ স্থান অতিক্রম করে বালেশ্বরে মিশেছে। কোটচাঁদপুর কালীগঞ্জ, যশোর ও অভয়নগর অংশে এই নদ ভৈরব নাম ধারণ করলেও খুলনা অংশে রূপসা নাম ধারণ করেছে এবং বঙ্গোপসাগরে মিলিত হবার আগে এর নাম হয়েছে শিবসা। ২৪৯ কিলোমিটার ভৈরব নদের অধিকাংশ স্থানই মৃতপ্রায়। স্থানভেদে ভৈরব নদীর প্রশস্ততা কোথাও এক থেকে দেড় কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তবে বর্তমানে তা মাত্র ১৫/২০ ফুটে এসে ঠেকেছে।
এই নদটির দু’টি অংশ আছে। একটি উজান ভৈরব, অন্যটি ভাটি ভৈরব। লোয়ার বা ভাটি ভৈরব এক সময় বৃহত্তর যশোরের প্রধান নদী হিসাবে পরিগণিত হত। কিন্তু বিগত শতাব্দীর বেশী সময় ধরে নদটির ক্রমাবনতি হতে থাকে। পলি জমার কারণে ১৭৯০ সালের দিকে এর প্রধান গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে তাহিরপুরের কাছে কপোতাক্ষ নদীর সাথে মিশে যায়। ১৭৯৪ সালে জেলার কালেক্টর প্রণীত প্রতিবেদনে তাহিরপুরের কাছে চরসৃষ্টির উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ ছিল যে, শুকনো মৌসুমে নদটিতে পানির অভাবের কারণে যশোর জেলার উন্নয়ন বাধাগ্রস্থ হয়। তিনি এসময় নদী খনন করার প্রস্তাব দেয়া হয়।
১৭৯৪ সালে যশোর জেলার কালেক্টরের চেষ্টার ফলে কপোতাক্ষ নদের বাঁধ দ্বারা স্রোত বন্ধ করে যশোর শহরের জন্য ভৈরবকে অব্যাহত রাখবার চেষ্টা করা হয়। প্রথমদিকে এই প্রকল্পটি সফলভাবে কাজ করে। কিন্তু পরবর্তীতে উজানে কপোতাক্ষ নদের কুল ভেঙ্গে প্রান্তর অতিক্রম করে পুরনো খাত দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। দুর্দান্ত স্রোতে কূল ভেঙ্গে গেলে ভৈরব আরো দুর্বল হয়ে পড়ে। দর্শনা স্টেশনের কাছে যেখানে ভৈরব মাথাভাঙ্গা চক্রাকৃতির বাঁক বিদ্যমান সেখানে ২০/২৫ বছর পরে নদীয়ার কলেক্টর শেক্সপিয়ার সাহেব একটি ক্ষুদ্র খাল কেটে ঐ বাঁকে মাথাভাঙ্গার পথ সোজা করে দেন। সোজাপথ পেয়ে সমস্ত পানি মাথাভাঙ্গা দিয়ে চলতে লাগল। ফলে ভৈরব অচিরেই মরে গেল। ১৮৩০ সাল পর্যন্ত আপার/ উজান ভৈরব নদী বর্ষার সময় বন্যার পানি বহন করত। জানা যায়, বৃটিশ সরকার ১৮৭২ সালে ভৈরব নদীর উৎস মুখ তাহিরপুরে চিনির কল নির্মাণ করে বর্জ্য নিষ্কাশন এবং পানি সরবরাহের জন্য ভৈরব নদ ব্যবহার করতো। ভৈরবের উৎসমুখে বাঁধ নির্মাণের ফলে ভৈরব ক্রমে একটি মরানদীতে পরিণত হয়। মূলত: অষ্টাদশ শতকের শেষভাগে তাহিরপুর থেকে যশোর শহর পর্যন্ত নদীতে পলি জমে মুখ বন্ধ হতে থাকে। গ্রীষ্মকালে এটা কয়েকটি সারিবদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়। বর্ষাকালে বৃষ্টির অতিরিক্ত পানি কোন কোন সময় এই নদী দিয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হতো। নদের নাব্যতা না থাকায় যশোর থেকে বামুনুয়া পর্যন্ত ছোট ছোট দেশী নৌকা আগাছা ভেদ করে অতিকষ্টে চলাচল করতো। তবে বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত ঘটলে যশোর থেকে রাজারহাট পর্যন্ত বড় নৌকা চলাচল করতো। বামুনুয়ার নিচে নদীটি সারা বছরই নাব্য থাকতো।
বর্তমান অবস্থা :
ফারাক্কা বাঁধ দ্বারা ভারতের একতরফা পানি শোষণ নীতির কারণে ভৈরব নদের অবস্থা করুণ আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে নদের যেটুকু প্রবাহ আছে সেইটুকুও বিপন্ন হবার পথে। নদের স্বাভাবিক পানি প্রবাহের পরিবেশ নেই। প্রভাবশালী মহল প্রশাসনের নাকের ডগায় নদের দুপাশের জমি দখল করে নিয়েছে। ভূমিদস্যুদের আগ্রাসী মনোভাব, অবৈধভাবে নদী দখল করে নির্মাণ করেছে বিশাল বিশাল ইমারত, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ব্যবসাকেন্দ্র। তৈরি করেছে মাছ চাষের ডোবা বা পুকুর। ভৈরব নদের দৈর্ঘ প্রায় ১৫৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে যশোর অংশের ২৫ কিলোমিটার এলাকা প্রায় শুকিয়ে গেছে। বর্তমানে ভৈরব নদকে মানুষ ডাস্টবিন হিসেবে ব্যবহার করছে। অনেকে মলমুত্র ত্যাগ করছে। ফলে পানি দূষিত হচ্ছে এবং মশা জন্মবিস্তার ঘটাচ্ছে। ১৯৭১ সালের পর থেকে অবৈধভাবে নদী দখল করে গড়ে ওঠা এ সমস্ত স্থাপনার পাশাপাশি স্থানীয় সরকার অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বিভিন্ন সময়ে ভৈরব নদে অপরিকল্পিতভাবে ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মাণ করে। ফলে দিনে দিনে নদীর নাব্যতা হ্রাস পায়। ১৯৮০ সালের দিকে বিভিন্ন স্থানে যথেষ্ট পানি ধারণ ক্ষমতা ছিলো। প্রভাবশালী মহল নদী খননের নামে ভৈরব নদের উজানে বেড়ি বাদ দিয়ে গড়ে তোলে বড় বড় পুকুর। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতিতে এ সমস্ত পুকুরে শুরু হয় হাইব্রিড জাতের মাছ চাষ। ফলে প্রায় ৫০টিরও বেশি দেশী প্রজাতির মাছ হারিয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়ে যশোরের নওদাগা, নীলগঞ্জ, তাঁতী পাড়া, ঝুমঝুমপুর, বারান্দিপাড়া, ডাকাতিয়া, চুড়ামনকাটি, সাতমাইল ও হৈবতপুরসহ প্রায় ১০০টি গ্রামের ৫০ হাজারেরও বেশী জেলে পরিবার। ১৯৯৫ সালের দিকে সরকার ভৈরব নদের ওপর নির্মিত সবগুলো বেড়ি বাঁধ উচ্ছেদ ও হাইব্রিড মাছ চাষ বন্ধ করে দেয় এবং বসুন্দিয়া আকরঘাট থেকে তাহিরপুর পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কিলোমিটার ড্রেজিং এর জন্য ১৫ কোটি টাকার খসড়া প্রকল্প তৈরি করে জেলা প্রশাসন। যা বর্তমান সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দি অবস্থায় পড়ে আছে।
ভৈরব নদ দখলের প্রতিযোগিতা :
ভূমিদস্যুরা ভৈরব নদ দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। এককালের প্রলয়ংকারী এই নদের অস্তিত্ব এখন মারাত্বক হুমকির মুখে। দীর্ঘদিন সংস্কার বা পুনঃখনন না করায় ঐতিহ্যবাহী ভৈরব তার স্বকীয়তা হারিয়ে পরিণত হয়েছে শহর ও শহরতলীর মানুষের নোংরা পানি নিষ্কাশনের আধারে। বর্তমানে নাব্যতাহীন বন্ধ্যা ভৈরব শীর্র্ন সর্পিল আকারে প্রবাহিত। আর এ সুযোগে ভদ্রলোক নামধারী এক শ্রেণীর ভূমিদসু ভৈরবের বুকে রাজত্ব শুরু করেছে। তারা নদের জমি দখলের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অবৈধ দখলদাররা ভৈরবের বুকে পানিবিহীন অংশে ঘর-বাড়ি তৈরি করে রীতিমত বসতি স্থাপন করেছে। বিশেষ করে যশোর শহর এলাকার ভরাট অংশে স্থায়ী পাকা স্থাপনা গড়ে তুলে ভৈরবের প্রবাহকে চিরতরে রুদ্ধ করে দিচ্ছে। প্রভাবশালী ও বৃত্তশালী এক শ্রেণীর ভূমিদস্যুরা রীতিমত পাইলিং করে বহুতল বিশিষ্ট অট্টালিকা তৈরি করছে। এদের দেখাদেখি অনেকে বাঁশ খুটি দিয়ে ঘর করে দখল করছে নদের জমি। আবার অনেকে ট্রাকে করে মাটি ফেলে দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে। অপর এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মহল নদীটির যে অংশে পানি আছে সব অংশে বাঁশ ও বাঁশের পাটা দিয়ে দখল করে মাছের চাষ করছে। ভৈরবের বুকে বসতি স্থাপনকারীরা পুকুর কেটেও দখল করে রেখেছে। ভূমিদস্যূরা উজানের বিস্তীর্ণ এলাকা অনেক আগেই দখল করেছে। সেসব জমি এখন আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় যশোর শহরের প্রাণকেন্দ্র দড়াটানাসহ নদী এলাকার দু’পাশে ভূমি আগ্রাসী ছোবল অব্যাহত থাকলেও এবং দখল প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বহু আন্দোলন করলেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ভূমিদস্যুদের দৌরাত্ব বেড়েই চলেছে।
যশোরের শিল্পশহর নওয়াপাড়ায় নদীর তীরবর্তী সরকারী খাসজমি দখল করে পণ্যের গুদাম, ঘাট, আবাসিক ও বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। ফলে ভৈরব নদের অবস্থা বিপন্ন হতে চলেছে। আর এর প্রভাব পড়েছে নওয়াপাড়ার শিল্প ও সার্বিক ব্যবসা বাণিজ্যের ওপর। ঐতিহ্যবাহী ভৈরব নদকে কেন্দ্র করে ষাটের দশকে নওয়াপাড়ায় অনেক শিল্প কলকারখানা গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ের দশকে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। এছাড়া নব্বই দশকের শুরুতে এখানে সার ব্যবসার প্রসার ঘটে। বর্তমানে নওয়াপাড়া দেশের দক্ষিণ পশ্চিয়াঞ্চলে সারের সবচেয়ে বড় বাজার। তাছাড়া ভারত থেকে রেলের ওয়াগানের মাধ্যমে স্থলপথে আমদানীকৃত পণ্যের শতকরা নব্বইভাগ পরিবহন ব্যয় সাশ্রয়ের জন্য আমদানীকারকরা নওয়াপাড়ায় মালামাল খালাস করে ভৈরব নদ দিয়ে কার্গো বা জাহাজে করে দেশের অন্যান্য স্থানে নিয়ে যায়। নওয়াপাড়ার শিল্প ও বাণিজ্য প্রসারের সাথে সাথে শুরু হয় ভৈরব নদ দখলের প্রতিযোগিতা। নদের তীরের সরকারী খাস জমিও অবৈধ দখলের আওতায় চলে যায়। রাজঘাট থেকে চেঙ্গুটিয়া বাজার পর্যন্ত প্রায় ১০ কিলোমিটার জায়গা এখন বেদখলে। আর দখলকারীরা অবৈধ নামপত্তন এমনকি রেকর্ড সংশোধন করে নিয়েছে বলে জানা যায়। জাহাজ থেকে পণ্য ওঠানো নামানোর সুবিধার জন্য নির্বিচারে দখল এবং নদের ইট, বালু, পাথর ও সিমেন্টের বস্তা ফেলে ঘাট সমপ্রসারণের ফলে ভৈরব নদ সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে এর নাব্যতা মারাত্নকভাবে হ্রাস পাওয়ায় নওয়াপাড়ার সামাজিক ও ব্যবসা বাণিজ্যে চরম স্থবিরতার সৃষ্টি হয়েছে।
খননের অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত :
বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে নদের পাড়ের কয়েক হাজার বিঘা জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। মৃত প্রায় নদে মাছ না পেয়ে দুরবস্থার শিকার ৫০ হাজার জেলে পরিবার। দেখা যায় ভৈরব পুনঃখননের অভাবে যশোর অংশের ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলে কৃষকরা প্রতি বছর ৪৪ হাজার মেট্রিক টনের বেশি খাদ্যশস্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একইভাবে বর্ষা মৌসুমে পানি নিষ্কাষিত হতে না পেরে স্থায়ী জলাবন্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। এতে প্রতি বছর প্রায় ৪৪ হাজার মেট্রিকটন ফসল থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হচ্ছে। যার মূল্য অন্ততঃ ৪৪ কোটি টাকা। এসব কারণে ভৈরব পুনঃখননের দাবি ওঠে। এতদঞ্চলের ভুক্তভোগী জনগণ দীর্ঘদিন ভৈরব পুনঃখননের দাবিতে বিভিন্ন মহলে ধর্না দিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এলাকার অন্ততঃ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদনের পথ সুগম হবে। বার্ষিক শষ্য নিবিড়তা শতকরা ৭৫ ভাগ থেকে বেড়ে ১৭০ ভাগে উন্নীত হবে। ফলে বার্ষিক বর্ধিত খাদ্যশস্য উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৪ হাজার মেট্রিকটন।
পরিবেশ বিপর্যয় :
এক কালের খরস্রোতা ভৈরব এখন মৃত। বন্ধ্যা ভৈরবের বুকে এখন আর নৌকা চলে না। পাড়ের মানুষ অনেক আগেই ভুলে গেছে নদের পানির ব্যবহার। নদের বিরাট অংশ কচুরিপানায় গ্রাস করেছে। যাতে মশককুলের বিস্তার ঘটছে। তাছাড়া শহর-গ্রামসহ ভৈরবপাড়ের মানুষেরা নদকে ময়লা নিষ্কাশনের ম্যানহোল হিসেবে ব্যবহার করে যা পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। অথচ যশোর সদর, চৌগাছা ও ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জসহ উজান এলাকার ৫০ হাজার ৫শ’ ২০ হেক্টর জমির পানি নিষ্কাশনের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে ভৈরব নদ। কিন্তু সংস্কারের অভাবে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে হাজামজা নদীতে পরিণত হয়েছে। দীর্ঘদিন যাবৎ ভরাট থাকার কারণে এতদঞ্চলের পরিবেশের ভরসাম্য বিনষ্ট হচ্ছে এবং নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে।
আন্দোলন সংগ্রামে যশোরবাসী :
অবৈধ দখলমুক্ত ও সংস্কারের দীর্ঘদিনের দাবি উপেক্ষা করে ভৈরব নদের অংশবিশেষ আবারো ইজারা দেয়ায় যশোরবাসী আন্দোলন সংগ্রামে ফুঁসে উঠেছে। দাবি পুরণ না হলে ভৈরব নদ সংস্কার আন্দোলন কমিটি বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছে। মরা ভৈরবের বেশির ভাগ এলাকা দখল হয়ে যাওয়ায় দখলকারীদের কবল থেকে নদীকে মুক্ত করে পুন:সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে গত সরকারের আমলে ইজারা বাতিল করে নদী সংস্কারের জন্য ৮৪ কোটি টাকার একটি প্রকল্প নেয়া হয়। এ প্রকল্পের আওতায় ছিল বসুন্দিয়া থেকে রাজারহাট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার ড্রেজার দিয়ে খনন, রাজারহাট থেকে কালিগঞ্জের তাহিরপুর পর্যন্ত ৭৮.৫ কিলোমিটার শ্রমিক দিয়ে খনন, ৫০ কিলোমিটার খাল খনন, ২০টি ব্রিজ নির্মাণ ও পানি নিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো নির্মাণ। কিন্তু আজ পর্যন্ত সে প্রকল্প আলোর মুখ দেখেনি।
জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, পৌর এলাকায় ভৈরব নদের ৫৪৬ ও ৩২২ দাগে মোট ১৫ একর জমি আছে। এর মধ্যে বেদখল হয়েছে পৌনে ৪ একর, যার মূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। দখলদার উচ্ছেদে খরচ হবে মাত্র আড়াই লাখ টাকা। উচ্ছেদ অভিযান সফল করতে জেলার রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের নেতাদের সাথে মতবিনিময় করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উচ্ছেদ অভিযান সফল হয়নি। এরই মধ্যে স্বার্থন্বেষী একটি মহল ভৈরব নদকে মৃত দেখিয়ে মাছ চাষের জন্য অংশ বিশেষ লিজ নিয়েছে। যশোর সদর উপজেলার ভৈরব নদের অংশবিশেষ নিমতলী, ঘোপ, ঝুমঝুমপুর, রূপদিয়া, নরেন্দ্রপুর, জিরেট ও জিংগের খাল পর্যন্ত অংশের মোট ১৫৬.৮৬ একর জমি দায়তলা ও ফতেপুর মৎসজীবী সমবায় সমিতির সম্পাদক শ্রী নারায়ণ চন্দ্র শিকদারের নামে পাঁচ বছরের জন্য লিজ দেয়া হয়। আন্দোলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক আফসার আলী, সদস্য ইকবাল কবির জাহিদ ও অনিল বিশ্বাস ঢাকায় ভূমি প্রতিমন্ত্রীর সাথে দেখা করে লিজ বাতিলের দাবি জানান। যশোর জেলা সমিতি ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টনারশিপ সেন্টার (BDFC) ২০০৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর এক সভায় ভৈরব ও কপোতাক্ষ নদ পুনঃখননের দাবি জানিয়েছে। ডা. কাজী রবিউল হক ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ফরাজী শাহাদৎ হোসেন বাদী হয়ে শিগগিরই ভৈরবের লিজ বাতিলের দাবিতে উচ্চ আদালতে মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন।
ভবিষ্যৎ কুয়াশাচ্ছন্ন :
ভৈরব নদী পুনরুজ্জীবিত করতে যশোরের সর্বস্তরের মানুষের মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রকল্প নেয়া হলেও দখলদার প্রভাবশালী মহলের চাপ ও ভৈরব নদ অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ এবং সীমানা নির্ধারণ সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়াতে ঐ প্রকল্প অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়। জেলা প্রশাসক বলেন, যশোর শহরে ভৈরব অংশের উচ্ছেদ অভিযান মামলার কারণে আটকে আছে। উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ করতে ১১টি মামলা হয়েছে। মামলার নিষ্পত্তি সাপেক্ষে উচ্ছেদ অভিযান আবার শুরু হবে। দেখা যায়, ভৈরব নদের দুই পাশে কয়েক শ’ বিঘা জমির বেশিরভাগই রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তির অধিকারে। এমনকি সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামের জন্মভুমি ঘোপ এলাকায় ভৈরব নদ দখল ও ভরাট করে প্রভাবশালী মহল হাসপাতাল ও বেশ কয়েকটি বহুতল বিশিষ্ট বণিজ্যিক ভবন নির্মাণ করেছে।
“ভৈরব বাঁচাও” আন্দোলনের অন্যতম নেতা অধ্যাপক আফসার আলী জানান, ভৈরব নদ যশোর শহরের প্রাণ। শত বছরের ঐতিহ্য এই যশোর শহরকে বাঁচানো বা রক্ষার পূর্বশর্ত হচ্ছে ভৈরব নদ বাঁচানো। ভৈরব নদের যে অংশকে মৃত দেখিয়ে ইজারা দেয়া হয়েছে ওই অংশের নদী আদৌ মৃত নয়। নদীতে পানি আছে জোয়ার ভাটা হয়।
সম্ভাবনার সোনালী দিগন্ত :
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ ভৈরব নদের এ মরণ দশা অবস্থা থেকে মুক্তি চায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভৈরব নদকে মাত্র ২৫ কিলোমিটার খনন করলে আবার যৌবন ফিরে পাবে এবং সেটা করা হলে যশোরের চেহারা পাল্টে যাবে। নদে প্রাণ প্রবাহ সৃষ্টি হলে যশোরেই গড়ে উঠবে বন্দর, শহর, কলকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এক্ষেত্রে যশোরের শিল্প শহর নওয়াপাড়ার কথা উল্লেখ করা যায়। একমাত্র ভৈরব নদই নওয়াপাড়ার চেহারা পাল্টে দিয়েছে। তাই শুধু যশোর থেকে নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের উজান মুখ পর্যন্ত খনন করে কার্গো লঞ্চ চলাচলের ব্যবস্থা করতে পারলে ভৈরব পাড়ের জনপদে আবার নবজাগরণ সৃষ্টি হবে।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভৈরব নদকে খননের মাধ্যমে জোয়ার ভাটার ব্যবস্থা করতে পারলে দেশের অন্যান্য বন্দরগুলো থেকে কার্গো লঞ্চ সহজে নওয়াপাড়া হয়ে যশোর আসতে পারবে। একথা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, বসুন্দিয়া হাট, সিঙ্গিয়া রেলস্টেশন, রূপদিয়া হাট ও স্টেশন, রাজারহাট এবং যশোর সদর প্রভৃতি জায়গায় নদ সংলগ্ন মোকাম গড়ে উঠেছিলো পানি পথে যাতায়াতের সুবিধার জন্য। কিন্তু বর্তমানে কালের পরিবর্তন হয়েছে। সরকারী আন্তরিকতায় বিদেশী প্রযু্ক্িততে ভৈরব নদ খনন করতে পারলে মংলা থেকে দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে।
শেষ কথা :
সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার তথ্যানুযায়ী, দেশের বড় ও মাঝারি আয়তনের প্রায় ২৩০টি নদ-নদীর মধ্যে ১৭০টির অবস্থা করুণ। ফলে ক্ষতিগ্রন্থ হচ্ছে কৃষি, নৌ চলাচল, ব্যবসা বাণিজ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশ। পানির অভাবে ও দেশের উত্তর পশ্চিমাঞ্চলসহ ব্যাপক এলাকায় মরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেশের নৌপথ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে পড়ছে। বর্ষা মৌসুমে বন্যা ও সেই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসের পাশাপাশি নদী ভাঙ্গানের প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ভূমিহীন ছিন্নমুল মানুষের সংখ্যা। এ সমস্ত কারণে দেশে ২৪ হাজার কিলোমিটার আয়তন নদ-নদীর মধ্যে বর্ষাকালে বাণিজ্যিক নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাত্র ছয় হাজার কিলোমিটার। নদী এ দেশের প্রাণ। ভৈরব নদের করুণ পরিণতি খুবই দুঃখজনক। নদী ধ্বংস বা এর স্বাভাবিক দূষণের বিরূপ প্রভাবে পৃথিবীর অনেক সভ্যতাই ধ্বংস হয়ে গেছে। মিশরীয় সভ্যতা যেমন ‘The gift of rhe Nile" তেমনি “যশোরীয়” সভ্যতা '''the gift of the Bhairab''। তাই ভৈরব নদের অবদানের কথা ভুলে না গিয়ে তাকে রক্ষা করার জন্য সম্পূর্ণ দখলমুক্ত ও ড্রেজিং এর মাধ্যমে আাগের ন্যায় নদীর প্রশস্ততা ও নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এজন্য সরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি যশোরের সর্বস্তরের মানুষের স্বচেতনতা ও সহযোগিতা প্রয়োজন।
সম্পাদনা :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
০১.০৪.২০১১