
Home মাগুরা জেলা / Magura District > মাগুরা জেলার সার্বিক পরিচিতি / Description of Magura District
এই পৃষ্ঠাটি মোট 18648 বার পড়া হয়েছে
মাগুরা জেলার সার্বিক পরিচিতি / Description of Magura District
পরিচিতি :
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত মাগুরা জেলা। এই জেলার উত্তরে রাজবাড়ী জেলা পূর্বে রাজবাড়ী ও ফরিদপুর জেলা, দক্ষিণে নড়াইল ও যশোর জেলা এবং পশ্চিমে ঝিনাইদহ জেলা অবস্থিত। এটা ২৩০১৫ ও ২৩০১৫ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৯০১৫ ও ৮৯০৪২ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। মাগুরা জেলা শহরের উপর দিয়ে ৯০০ পূর্ব দাঘিমা রেখা চলে গিয়েছে। এ জেলাটির মোট আয়তন ১০৪৮.৬১ বর্গ কিলোমিটার। ৪০৪.৮৭ বর্গ মাইল। তার মধ্যে নদী সমৃদ্ধ ৩৫.২ বর্গকিলোমিটার (১৩.৫৬) মাইল।
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে এক সমৃদ্ধ জনপদের নাম মাগুরা। ইতিহাসে যশোর যেভাবে শিরোনাম এসেছে মাগুরা সে ভাবে আসেনি। ইতিহাস বিদগন এ ক্ষেত্রে এ অঞ্চলকে উপক্ষো করেছে। তবু তাদের কাছে আমরা মাগুরা বাসী ঋণী, কারণ তাদের বিভিন্ন লেখায় মাগুরা অঞ্চলকে নিয়ে যতটুকু রেফারেন্স এসেছে তা একেবারে কম নয়। মাগুরার ঐতিহাসিক পরিচয় নির্ধারণে তার গুরুত্ব অনেক। ১৭৮৬ সালে বৃটিশ আমলে বাংলা প্রদেশের প্রথম গঠিত জেলা যশোর। কিন্তু একজন জেলা কর্মকর্তার পরে এ বৃহৎ জেলার আইন শৃংখলা নিয়ন্ত্রণ ও প্রশাসনিক কাজ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুলত মগ জল দস্যুদের হাত থেকে এ জেলার উত্তরাঞ্চলের জন সাধারণকে রক্ষা করার জন্যই ১৮৪৫ সালে যশোর জেলার প্রথম মহকুমা করা হয় মাগুরাকে। মহকুমা গঠন করার পর প্রথম মহকুমা অফিসার হিসেবে আসেন মিঃ ককবার্গ। মহকুমা হবার আগে মাগুরা অঞ্চল ভূষণা ও মহম্মদপুর নামেই সুবিখ্যাত ছিল। পাল রাজত্বের সময় এ অঞ্চলের উত্তর ও উত্তর পূর্ব অংশ শ্রীপুর ও রাজাপুর নামে পরিচিত ছিলো। দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব অংশ ভূষনা। পরবর্তীতে দেশ স্বাধীন হবার পর প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসাবে মাগুরাকে ১৯৮৪ সালে মহকুমা থেকে জেলায় উন্নীত করা হয়। প্রথম ডেপুটি কমিশনার নিয়োগ করা হয়নি অরবিন্দু করকে। মাগুরা জেলা মোট ৪টি থানা নিয়ে গঠিত। যথা মাগুরা সদর, শ্রীপুর, শালিখা, মহম্মদপুর যা ২টি সংসদীয় নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত।
মাগুরা জেলা ও থানাসমূহের নামকরণের ইতিহাস এবং ভৌগলিক অবস্থান :
মাগুরার নামকরণ করা হয় মুঘল যুগে। এর নামকরণ কিভাবে হয়েছে তা স্থিরভাবে বলা দুস্কর। কিংবদন্তী থেকে জানা যায় এককালে সুন্দরবনের কাছাকাছি এই অঞ্চলে জল দস্যুদের দারুণ উৎপাত ছিল। কুমার ও নবগঙ্গার তীরে অবস্থিত বর্তমান মাগুরা শহরে ছিল তাদের আখড়া। নদী পথে তারা বর্গীদের মতো দস্যুপনা করতো। তাদের নামেই মগরা থেকে মাগুরা হয়েছে। নেত্রকোণাতে ও দেখা যায় সেখানে মগরা নাকে একটি নদীও রয়েছে। বাংলাদেশে মাগুরা নামে আরো বেশ কয়েকটি গ্রাম রয়েছে, তবে জেলার মর্যাদায় উন্নীত হওয়ায় আমাদের মাগুরা এখন শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। তবে কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে মুঘল নবাব মুর্শিদকুলী খার আমলে মগদের অগ্রযাত্রাকে যেখানে প্রতিহত করে ঘুরিয়ে দেওয়া হত সেই স্থানটির নাম রাখা হত মগ-ঘুরা। মগ-ঘুরাই পরবর্তীতে মাগুরা হয়েছে। মাগুরা তথা যশোর ফরিদপুর এলাকায় মগ-দস্যুদের অত্যাচার ও লুষ্ঠনের কাহিনী আজও ইতিহাসের এক বেদনাময় অধ্যায়। ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গ এলো দেশে’ প্রচলিত এই ছড়াটিও সে সময়ের প্রকৃত চিত্রই তুলে ধরেছে। মুহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায় ও যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্য মগ-বর্গী দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখেন। বলা চলে দস্যুদের এই দুই রাজাই প্রতিহত ও পরাজিত করেন। বহু মগ বর্গী সীতারামের কাছে আত্মসমর্পন করে এবং সেনাবাহিনী ও রাজ কর্মচারী হিসেবে নিয়োগ পান। আজকের মাগুরা শহরে তাদের নিবাসের ব্যবস্থাও করা হয়।
মাগুরা সদর :
জনসংখ্যা এবং আয়তনের দিক থেকে মাগুরা সদর থানা মাগুরা জেলার সবচেয়ে বড় থানা। ১৮৪৫ সালে এটা থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী মাগুরা সদর থানার মোট লোকসংখ্যা ২৮৬৯২৫ জন। সদর থানাটি ১৩টি ইউনিয়ণ, ১টি পৌরসভা, ২০৯টি মৌজা, ৪১টি হল্লা এবং ২৫২টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। গড়ে প্রত্যেক ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, মৌজা, মহল্লা এবং গ্রামে জনসংখ্যা যথাক্রমে - ১৯২৩০, ১২৩০, ৯০১ একং ৯৯২ জন। সদর থানার মোট আয়তন ৪০৬.৫০ বর্গ কিঃ মিঃ এবং নদীর আয়তন ১১.০৬ বর্গ কিঃ মিঃ। এটা ২৩০১৭ ও ২৩০৩৪ উত্তর অক্ষাংশে এবং ৮৯০১৭ ও ৮৯০৩২ পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। থানার উত্তরে শ্রীপুর, পূর্বে মহম্মদপুর এবং ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানা দক্ষিণে শালিখা এবং পশ্চিমে ঝিনাইদহ সদর থানা অবস্থিত।
মহম্মদপুর থানা :
আয়তন এবং জনসংখ্যার দিক দিয়ে ২য় বৃহত্তম থানা মহম্মদপুর। থানার জন্ম হয় ১৮৬৯ সালের ২৪ নভেম্বর ১৯৪১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী এ থানার মোট জনসংখ্যা ১৬০৩৪০ জন। থানাটি মোট ৮টি ইউনিয়ন, ১৩২টি মৌজা এবং ১৮২টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। গড়ে প্রত্যেক ইউনিয়ন মৌজা এবং গ্রামে জনসংখ্যা যাক্রমে ২০০৪২, ১২১৫ এবং ৮৮১ জন।
মহম্মদপুর নামের উৎপত্তি সন্বন্ধে নির্দিষ্ট কোন তথ্য জানা যায়নি। ইতিহাস বিশ্লেষনে জানা যায় পূর্বে এ এলাকাটির নাম ছিল ‘‘বাগজন’’। মোঘল সম্রাট আকবরের শাষণামলে ফকির মাহমুদশাহ নামে একজন সুফীর নামে এর নামকরণ করা হয় মহম্মদপুর। জানা যায় রাজা সীতারাম রায় এই সুফীর প্রতি খুবই অনুরক্ত ছিলেন। এখানে এক সময় একটি টাকশাল ও ছিল। ১৪০৪০ বর্গ কিলোমিটার নদীসহ মহম্মদপুর থানার আয়তন ২৩৪.২৯ বর্গ কিঃ মিঃ। এটা ২৩০১৭ ও ২৩০৩১ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯০২৯ ও ৮৯০৪২ পূর্ব দ্রাঘিমায় অবস্থিত। এ থানার উত্তরে ফরিদপুর জেলার মধুখালী থানা, পূর্বে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানা, দক্ষিণে নড়াইল জেলার লৌহাগাড়া থানা এবং পশ্চিমে মাগুরা সদর এবং শালিখা থানা অবস্থিত।
মাগুরার নদ-নদী :
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় মাগুরা জেলাতেও জালের মত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী, খাল-বিল। এককালের স্রোতাস্বিনী নবগঙ্গা, প্রমত্ত কুমার সভ্যতার কারিগর চিত্রা ও মধুমতি, কাকচক্ষু ফটকী, মাথাভাঙ্গা, গড়াই প্রভৃতি এ জেলার প্রধান প্রধান নদ নদী। এছাড়াও এ জেলায় অসংখ্য খালের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। মাগুরার ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রাচীনকালে এ জেলায় বড় বড় নদী রেনেলের ম্যাপে মাগুরার পাশ দিয়ে প্রবাহিত বড় বড় নদী দেখানো হয়েছে। শালিখা থানার আড়পাড়া থেকে সুইতলা পর্যন্ত আট মাইল চওড়া নদী ছিল বলে শোনা যায়। এই নদীর প্রকৃত নাম কি ছিল তা জানা যায় নাই। তবে এই নদীর অত্যন্ত খরস্রোতা ছিল বলে জানা যায়। মাঝিরা এ নদী পার হতে হিমশিম খেত। এ এলাকার বহু গ্রামের নামের সাথে যেমন নদীর সম্পর্ক বিদ্যমান তেমনি রাজাদের নামের সাথেও নদীর সম্পর্ক বিদ্যমান। সম্রাট রামপালের পুত্র কুমার পালের নাম অনুসারে কুমার নদ এবং ফটকী রাজার নাম অনুসারে ফটকী নদের উৎপত্তি বলে জনশ্রুতি আছে। কিন্তু নদী বহুল মাগুরা আজ তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। ফারাক্কার করাল গ্রামে এককালের স্রোতাস্বিনী নব গঙ্গা, মধুমতি, কুমার, চিত্রা, গড়াইসহ অন্যান্য নদী ও খাল আজ তার নাব্যতা হারিয়ে নৌ চলাচলের অনুপযুক্ত হয়ে পড়েছে।
কৃষি ব্যবস্থা :
কৃষি প্রধান বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় মাগুরা ও একটি কৃষি প্রধান জেলা। সংগত কারণেই এ জেলার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি কাজ। ১০৪৯ বগ কিঃ মিঃ আয়তন বিশিষ্ট মাগুরা জেলায় মোট আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ ৮১৮ বর্গ কিঃ (৭৮%) বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরো ১৯৮৩) যেখানে সমগ্র দেশের ক্ষেত্রে এ হার মাত্র ৬২ ভাগ। নদী বিধৌত পাললে সৃষ্ট মাগুরার জমি অত্যন্ত উর্বর। এছাড়া এ জেলার উত্তরাংশ গঙ্গা কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের অন্তর্ভূক্ত থাকায় এখানে আধুনিক চাষ পদ্ধতির প্রসার ঘটেছে। মাগুরা জেলার উৎপাদিত ফসলের মধ্যে ধান, পাট, তৈল বীজ, ডাল, এবং শীতকালের খেজুরের রস, আর গরমের তালের রস এর গুড় ও পাটালীর সুখ্যাতি তো আছেই। অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকা বিশিষ্ট মাগুরা জেলার কৃষি “জাতীয় উন্নয়নে” যথেষ্ঠ অবদান রাখছে। মাগুরা জেলায় দেশী বিদেশী উভয় জাতেরই পাট উৎপন্ন হয়। পাটের মূল্য স্তরের নিম্নগতি কৃষকদের মধ্যে পাট চাষের উৎসাহে ভাটা পড়লে ও গত ২০০১ সালে মূল্যের উর্দ্ধগতি এবং বর্তমান সরকার পাটজাত পণ্যের বহুবিধ ব্যবহার উদ্ভাবনের উপর জোর দেয়ায় কৃষকদের মধ্যে আবার পাট চাষে উৎসাহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সম্প্রতি বছরগুলোতে তরিতরকারী ও শাক সবজির চাষ যথেষ্ট বেড়ে গেছে এবং তা রাজধানীসহ দেখের অন্যান্য অঞ্চলে প্রেরিত হচ্ছে, যা মাগুরার অর্থনৈতিক উন্নয়নে যথেষ্ঠ অবদান রাখছে। এছাড়া শ্রীপুর, মহম্মদপুর ও শালিখাতে প্রচুর ধানের চাষ হয়। ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় এক সময় শালিখাতে প্রচুর “শালি” ধানের চাষ হতো এবং এ থেকে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে শালিখা। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলেও সত্য মাগুরার জেলা কৃষি নির্ভর হলেও বীজ সংরক্ষণ ও কীটনাশক দ্রব্য- রাখার কোন আধুনিক গুদামজাতকরণ ব্যবস্থা ও জেলাতে তৈরী হয়নি। যার ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। দেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানী পণ্য পাট ও জেলায় বিপুল পরিমাণ উৎপাদিত হওয়া সত্ত্বেও পাটের উত্তম বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা এবং পাট কল না থাকায় জেলাবাসী বিশেষতঃ কৃষকরা অর্থনৈতিক দিক থেকে অগ্রসর হতে পারছে না।
শিল্পক্ষেত্রে মাগুরা :
কাঁচামালের প্রাচুর্য, উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা, শ্রমিকের আধিক্য, প্রভৃতি সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারী পৃষ্টপোষকতা এবং স্থানীয় উদ্যোক্ত শ্রেণীর অভাবে মাগুরা শিল্প ক্ষেত্রে অনগ্রসর। মাগুরা সদরের ভায়নায় অবস্থিত একমাত্র টেক্সটাইল মিলটিও দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ রয়েছে। সরকারী পৃষ্টপোষকতার অভাবে এ জেলার অতীব সম্ভাবনাময় তাঁত শিল্পও হারিয়ে যাচ্ছে। তাঁতীরা তাদের পৈতৃক ব্যবসা ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে শহরমুখী হচ্ছে। জেলার ছোট ছোট অন্যান্য কুটির শিল্পগুলো কোন মতে টিকে আছে। এরকম অবস্থায় মাগুরাবাসী যখন জেলার শিল্প উন্নয়নের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন ঠিক তখনই আমাদের আসার আলো দেখান জেলার অন্যতম প্রধান শিল্পপতি, বিশিষ্ট সমাজ সেবক, সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক (কামাল)। তিনি তাঁর নিজ মালিকানাধীন জি কিউ গ্রুপ অব কোম্পানীর কাছে আহবান জানাই বিসিক শিল্প উন্নয়নের মাধ্যমে এই সম্ভাবনায় জেলাটির উন্নতি সাধন করতে।
যোগাযোগ ব্যবস্থা :
দেশের বৃহত্তম স্থল বন্দর বেনাপোল এবং নৌ বন্দর মাংলার সাথে রাজধানী শহর ঢাকার প্রবেশরদ্বার হিসেবে খ্যাত মাগুরা জেলার সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ঠ উন্নত। রাজধানী শহর ঢাকার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী একমাত্র বিশ্বে রোডটি এ জেলার উপর দিয়ে ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, যশোর এবং খুলনার দিকে চলে গিয়েছে, যা এ জেলার যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্র যোগ করেছে। নব-নির্মিত আধুনিক বাস টার্মিনাল, ঢাকা, কলকাতা বাস সার্ভিসের জন্য নির্মিত মধ্যবর্তী বিশ্রামাগার, যশোর বিমান বন্দরের নৈকট্য যোগাযোগ ক্ষেত্রে এ জেলার গুরুত্বকে বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এছাড়াও মাগুরা জেলা শহরের সাথে উপজেলাগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থাও বর্তমানে যথেষ্ট উন্নত। মাগুরা শ্রীপুর সড়কে কুমার নদের উপর নির্মিত সেতু, নব গঙ্গার উপর নির্মিত সেতু, রাজাপুর ব্রীজ, ফটকী ও চিত্রা নদীর উপর নির্মিত ব্রীজ জেলার আভ্যন্তরীন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি স্বাক্ষর বহন করছে। বর্তমানে জেলার প্রায় অধিকাংশ গ্রামের রাস্তা পাকা। যা জেলার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও যথেষ্ট অবদান রাখছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থা :
শিল্প ক্ষেত্রের ন্যায় চিকিৎসা ক্ষেত্রে মাগুরার দৈন্যদশা যেন দেখার কেউ নেই। মাগুরা সদর হাসপাতালের অবস্থা খুবই জরাজীর্ণ। প্রয়োজনীয় ঔষধ পত্রের অভাব, স্বল্প সংখ্যক সিট, অভিজ্ঞ ডাক্তারের অনুপস্থিতি এ হাসপাতালের নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে বেশ কিছু আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত প্রাইভেট ক্লিনিক গড়ে উঠলেও উচ্চ চিকিৎসা ব্যয় এর কারণে সাধারণ মাগুরাবাসী এর থেকে কোন সুফল ভোগ করতে পারছে না। এতসব সীমাবদ্ধতার মাঝেও মাগুরার চিকিৎসা ব্যবস্থায় ধীরে হলেও উন্নতির ছোয়া লাগতে শুরু করেছে। মাগুরাবাসীর দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে সমপ্রতি বিশিষ্ট শিল্পপতি কাজী সালিমুল হক (এম.পি) আজ অর্থ ব্যয়ে একটি ডায়াবেটিকস হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ঘোষনা দিয়েছেন।
মাগুরা সদরের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ছোয়া লাগালে এর উপজেলাগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই করুণ। থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রায় সময়ই ডাক্তার পাওয়া যায় না। আর ইউনিয়ন পর্যায়ের সবুজ ছাতা ক্লিনিকের তো চলে ঔষধ চুরির মহোৎসব। গ্রামের সাধারণ গরীব মানুষের জন্য প্রেরিত ঔষধের প্রায় সবটায় চলে যায় গ্রামের ঔষধের দোকান গুলোতে। তাই সরকারের উচ্চ পর্যায়ে এবং স্থানীয় দু’জন সংসদ সদস্যের কাছে মাগুরা জেলা সমিতি রাঃ বিঃ এর আবেদন চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আপনাদের নেকনজর মাগুরা বাসীকে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে।
ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্য নিদর্শন এবং মাগুরার আদিবাসী সম্প্রদায় :
মাগুরা জেলা বাংলাদেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জনপদ। এ জেলায় জন্মেছে অনেক কীর্তিমান মনীষি যারা কালের বহমান ধারায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন ঠিকই কিন্তু রেখে গিয়েছেন তাদের মূল্যবান স্মৃতিচিহ্ন বা নিদর্শন। সেসব নিদর্শন আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাদের কথা। যথাযথ সংরক্ষণের অভাবে সেসব নিদর্শন এর অধিকাংশই আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তারপরও এখনো যা টিকে আছে তার প্রতি সরকার যথাযথ দৃষ্টি দিলে মাগুরা এক আকর্ষনীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
মাগুরা জেলার ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপত্য নিদর্শনসমূহ :
১। রাজা সীতারাম রায়ের রাজবাড়ী :
যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের সমসাময়িক ছিলেন রাজা সীতারাম রায়। সীতারাম রাজার বাবা উদয়নারায়ণ ছিলেন ফৌজদারের একজন তহশীলদার। রাজা সীতারাম গাগুরার একজন বড় স্বাধীন নৃপতি। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয়। তার রাজধানী ছিল মহম্মদপুরে। রাজধানীকে কেন্দ্র করে তিনি একটি দুর্গ গড়ে তোলেন, যা ছিল চতুষ্কোন বিশিষ্ট। এর প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ছিল ২ কিঃ মিঃ এর চেয়ে বেশী। প্রাচীরের বাহিরে বড় বড় পুকুর বা পরিখা। যেগুলি সাগর নামে পরিচিত ছিল। যথা- রামকৃষ্ণ সাগর, দুধসাগর, ক্ষীর সাগর, সুন সাগর, পদ্ম পুকুর ইত্যাদি। এসব একদিকে রাজ্যের নিরাপত্তা বিধান করত। অন্য দিকে জন সাধারণের পানি সমস্যার সমাধান করত।
দুর্গের অভ্যন্তরে রাজপ্রসাদ বিলাস ঘর, মলঘর, তোষাখানা, নহবত খানা, গোলা ঘর, ইত্যাদি ছিল। যা এখন পশু পাখি আর বাদুরের ঘরে পরিণত হয়েছে। আর ৭টি দীঘি যা সাগর নামে খ্যাত ছিল। তার ২টি ইতিমধ্যে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ১টি ভরাট হয়ে গেছে এবং ৪টি এখনও বর্তমান আছে। তিনি পরাজয়ের লজ্জা থেকে রক্ষা পাবার জন্য রামকৃষ্ণ সাগরে ডুবে আত্মহত্যা করেন বলে জনশ্রুত আছে। মাগুরা শহর থেকে ২৬ কিঃ মিঃ পূর্বে মহম্মদপুর বাজার অবস্থিত। মহম্মদপুরের বাজারের ২কিঃ মিঃ এর মধ্যে রাজা সীতারামের সমস্ত কীর্তি অবস্থিত।
২। নীলকার মালাই সাহেব এর কবর :
শ্রীপুর থানার তারা উজিয়াল গ্রামে এক জংগলের পার্শ্বে ইংরেজ নীলকর মালাই সাহেবের কবর রয়েছে। সংরক্ষণের অভাবে কবরটি আজ ধ্বংসে স্তুপে পরিণত হয়েছে। যা আজও মাগুরাবাসীদের ইংরেজী নীলকরদের অত্যাচারের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
৩। নীল কুঠিয়ালদের বাড়ী ও নীল শোধনাগার :
মালাই সাহেবের কবরের ৫০ গজ পশ্চিমে বনের মধ্যে রয়েছে নীল শোধনাগারের ধ্বংসাবশেষ এবং আরো পশ্চিমে রয়েছে নীলকরদের কুঠি। যা আজ প্রায় সম্পূর্ণটা মাটির মধ্যে চাপা পড়ে আছে। মাগুরাতে আরো একটি নীল শোধনাগার দেখতে পাওয়া যায় শালিখা থানার গংগারামপুর ইউনিয়নের বাফুনখালী গ্রামে। পুলুম বাজার থেকে দক্ষিণে অবস্থিত এ গ্রামের ঘন বনের মধ্যে প্রায় অক্ষত একটি নীল শোধানাগার রয়েছে। এটির চারিদিকে উঁচু ইটের প্রাচীর দেওয়া। প্রাচীরটি প্রায় ৩.৫ ফুট চ্ওড়া। ভিতরে যাবার জন্য এটির উত্তর প্রান্তে একটি সিড়ি রয়েছে। বর্তমানে এটি গ্রামের ঈদগা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
মাগুরার আদী বাসী সম্প্রদায় :
বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার ন্যায় মাগুরা জেলাতেও আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসবাস লক্ষ্য করা যায়। মাগুরা বিশেষত বৃহত্তর যশোর ও ফরিদপুর জেলাতে আদিবাসী সমপ্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত। অনুন্নত, অনগ্রসর বানিয়াম (বানুয়া) সম্প্রদায় বসবাস করেন। প্রায় ২ শত বছর পূর্বে ইংরেজরা ভারতের বিহার প্রদেশের হাজারীবাগ এলাকা থেকে বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর ফরিদপুর, যশোর এবং ঢাকা জেলায় আবাদী জমি তৈরী করার জন্যে এবং নীল চাষের শ্রমিক হিসেবে উক্ত সম্প্রদায়টিকে এই অঞ্চলে আনে। মাগুরা জেলায় প্রায় ২৬৬০ জন বানিয়াম (বনুয়া) আদীবাসী সম্প্রদায় বসবাস করেন। এর মধ্যে মাগুরা সদর থানায় ১২০০ জন, মহম্মদপুর থানায় ৮১০ জন এবং শ্রীপুর থানায় ৬৫০ জন। অবহেলিত অনগ্রসর আদিম যুগের এসব মানুষ বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন গ্রামে বসবাস করছেন। আর সমগ্র বাংলাদেশে এই অবহেলিত বানিয়াম (বনুয়া) আদিবাসীর সংখ্যা পঞ্চাশ হাজার হবে বলে অনুমান করা হয়। বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের অনেকে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে।
এই বানিয়াম (বনুয়া) সম্প্রদায়ের বুনো হিসাবে তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। এরা মূলত কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে। এরা খুবই পরিশ্রমী এবং এদের গায়ের রং কালো। মাগুরাতে এরা স্থানীয়ভাবে “বাগদী” বলে পরিচিত।
সম্পাদনা :
মো: হাসানূজ্জামান বিপুল
তথ্য সূত্র :
অজ্ঞাত