
Home যশোর জেলা / Jessore District > ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর যশোরের ইপিসিপিএমএল’র ভূমিকা --- কমরেড বিমল বিশ্বাস
এই পৃষ্ঠাটি মোট 9697 বার পড়া হয়েছে
৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বৃহত্তর যশোরের ইপিসিপিএমএল’র ভূমিকা --- কমরেড বিমল বিশ্বাস
১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে বৃহত্তর যশোর জেলায় ইপিসিপিএমএল’র নেতা-কর্মী ও শুভানুধ্যায়ী জনগণের বীরোচিত লড়াই ও জীবনদানের স্মৃতিময় অধ্যায়
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ পাকবাহিনী কর্তৃক বাঙালি জাতি ও জনগণের উপর হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য নড়াইলের নেতা-কর্মীরা ২৬ শে মার্চ সকাল ১১টার মধ্যে নড়াইল ট্রেজারির অস্ত্র নিয়ে নেয়। এর মধ্যে ৯০ ভাগ অস্ত্রই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর হস্তগত হয় এবং ১০ ভাগ অস্ত্র আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের হাতে যায়। ২৮ শে মার্চ যশোর শহরের ট্রেজারীর অস্ত্র একইভাবে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ)-এর হস্তগত হয়। বলে রাখা প্রয়োজন নড়াইলে ট্রেজারীর অস্ত্র দখলে নেতৃত্ব দেন শহীদ মমতাজ উদ্দিন, সাঈফ হাফিজুর রহমান খোকন, শেখ সবুর, মনু জমাদারসহ অনেকে। যশোর শহর ও নড়াইলের পার্টি সদস্য ছিল হাতে গোনা। আমি পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে ৭০ সালের মার্চ থেকে আত্মগোপনে ছিলাম। ঐ দিন বড়ন্দার গ্রামে প্রয়াত কমরেড বামাচরণ গোলদারের বাড়িতে ছিলাম। সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন, শেখ সবুর বর্তমানে আওয়ামী লীগের নেতা, মনু জমাদার বিএনপি নেতা। ২৯ শে মার্চ ইপিআর বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও আমাদের পার্টির নেতাকর্মীরা যৌথভাবে যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ঝুমঝুমপুরে বিহারীরা তাদেরকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে রকেট লাঞ্চারের গোলাবর্ষণে পিছ্পা না হয়ে যশোর শহরে ঢুকে পড়ে, ঘোপ এলাকায় অবস্থিত যশোর কারাগার আক্রমণ করে কমরেড অমল সেন, বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, এ্যাড. সৈয়দ গোলাম মোস্তফা, গোকুল বিশ্বাসকে মুক্ত করে।
২৫ শে মার্চ ঢাকায় আক্রমণের পরে ২৬ শে মার্চ ইপিসিপিএমএল’র কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সভা হয়। সভায় ৫টি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১) পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ২) গ্রামাঞ্চলে পাকবাহিনীর দালালদের খতম করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। ৩) পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। ৪) আওয়ামী লীগের সাথে সাময়িক মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। ৫) মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে।
সম্পাদক মন্ডলীর পাঁচ পস্তাব যশোর জেলা কমিটির হাতে এসে পৌঁছায় এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমানের মাধ্যমে। প্রয়াত: হাবিবুর রহমান মৃত্যুর কিছুদিন আগে জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ছিলেন কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার, কমরেড তোয়াহা ও কমরেড আবদুল হক। সম্পাদক ছিলেন কমরেড সুখেন্দু দস্তিদার। ৬ জনের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের বাকী ৩ জন কমরেড শরদিন্দু দস্তিদার কমরেড অজয় ভট্টাচার্য্য ও হাবিবুর রহমান। বৃহত্তর যশোর জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন ৬ জন সম্পাদক কমরেড হেমন্ত সরকার, কমরেড সুধাংশু দে, কমরেড মহিউদ্দীন আলী আক্তার, কমরেড শামসুর রহমান, কমরেড খবির উদ্দিন ও আমি।
উল্লেখ্য কমরেড অমল সেন শ্রেণী শত্রু খতমের লাইনকে বিরোধীতা করে ১৯৭০ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর অভয়নগরের বাঘুটিয়া ও কোদলা গ্রামের জেলা কমিটির সভা থেকে অব্যাহতি নিয়েছিলেন। ঐ সভায় কেন্দ্রের পক্ষ থেকে উপস্থিত ছিলেন কমরেড নজরুল ইসলাম। ৭১ এর ৩রা এপ্রিল যশোর জেলা সম্পাদক মন্ডলীর সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, ঐ সভার সিদ্ধান্ত সার্কুলার আকারে পাঠানো হয়। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল শালিখা থানার কাটিগ্রামে প্রয়াত কমরেড আবুল কালামের বাড়ীতে যশোর জেলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঐ সভায় কমরেড অমল সেন উপস্থিত ছিলেন। ঐ সভার সমগ্র আলোচনা ও কমরেড শচীন বোসের কাছে লেখা কমরেড অমল সেনের চিঠিকে কেন্দ্র করে কিছু আলোচনা কমরেড অমল সেনকে আহত করে। ঐ সভার পর থেকে ১৯৭১ এর ১৩ই জুন পর্যন্ত ছাবড়ী অঞ্চলে কমরেড অমল সেন অবস্থান করেন। ১৩ জুন ভারতে চলে যান।
১৯৭১ সালের ২৩ শে এপ্রিল আউড়িয়া থেকে আগত বড়ন্দার গ্রামে অবস্থানকারী এক হিন্দু ভদ্রলোককে পাকবাহিনীর প্রথম গড়ে ওঠা শান্তি বাহিনী যখন ধরে নিয়ে যায়, কিছুক্ষণ পর আমরা খবর পেলে সশস্ত্র শান্তি কমিটির লোকদের আক্রমণ করে ঐ হিন্দু ভদ্রলোককে মুক্ত করতে সক্ষম হই।
এ ঘটনার পরে ২৪শে এপ্রিল সূর্য্য ওঠার আগেই পাক হানাদার রেঞ্জার বাহিনী রকেট লাঞ্চারের গোলা বর্ষণ করতে করতে গোবরার রাস্তা ধরে বড়ন্দারে দিকে এগোতে থাকে। আমাদের মাত্র ১৩ জন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ছিল। প্রবল আক্রমণে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বড়ন্দারের খাল পেরিয়ে বীড় গ্রামে যখন পৌঁছাই তখন রেঞ্জার বাহিনী গোবরার রাস্তা ধরে বীড় গ্রামে ঢুকে জ্বালাও পোড়াও শুরু করে। সেদিন সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন, সুধাংশু রায়, সরোয়ার জান মোল্লা, ইমরান, বট্ট, হাফিজ ও আমি ওদের আক্রমণের মাত্র ৫০ গজের মধ্যে থেকেও বেঁচে গেছিলাম যা ভাবতেও অবাক লাগে। কয়েকটি বাড়ী-ঘরের আড়ালের কারণে আমরা বেঁচে যাই। পরে ধান খেতের মধ্য দিয়ে ক্রলিং করে গোয়াইল বাড়ীর উত্তর পার্শ্বে হিজলতলায় ১৩ জন একত্রিত হই। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রামনগরচরের স্কুল মাঠে এসে প্রয়াত ডাঃ জ্ঞানেন্দ্র নাথ বালা, প্রফেসর হরিপদ বিশ্বাস, ভবেশ বিশ্বাস সহ স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম এই সংখ্যালঘু অঞ্চলে জনগনের নিরাপত্তা দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় বরং শরনার্থী হয়ে ভারতে চলে যেতে সাহায্য করা উচিত হবে। সেভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে যশোরের বাঘারপাড়া থানার ভাঙ্গুড়া পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আমরা পোড়াডাঙ্গায় এসে বর্তমানে ইংরেজীর শিক্ষক সুশান্ত বিশ্বাসের সাহায্যে নৌকায় নদী পার হয়ে তারপর নড়াইলের আরেকটি নদী পার হয়ে শালিখা থানার বামনখালী গ্রামে পৌঁছাই। এসেই জেলা নেতা কমরেড শামসুর রহমানের সংগে যোগাযোগ করি। এসেই খবর পেলাম পুলুম স্কুলের জনপ্রিয় শিক্ষক মোতালেব মাষ্টারকে পাক হানাদার বাহিনীর দালালেরা যশোর শহরে (স্কুলের কাজে গিয়ে ছিলেন) হত্যা করেছে। কয়েকদিন পর শেখ আজিজুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুর মোহাম্মদ সাহেব ও নড়াইয়ের মহকুমা প্রশাসক কামাল সিদ্দিকীকে নিয়ে পুলম অঞ্চলে উপস্থিত হয়।
ইতোমধ্যে অভয়নগরের বাঘুটিয়ায় শান্তি কমিটির লুটপাট ও অগ্নি সংযোগকে প্রতিরোধ করতে গিয়ে পার্টি সদস্য হানিফ গাজী ৮ই এপ্রিল শহীদ হন। এপ্রিল মাসের মধ্যেই অভয়নগরের শংকরপুরে কমরেড আলাল ও কোদলার কমরেড নিরাপদ বিশ্বাস রাজাকারদের হাতে শহীদ হন। এপ্রিল মাসের কোন এক সময় চন্দ্রপুরের কমরেড গোলাম (কমরেড জাকির হোসেন হবির বড়ভাই) নিখোঁজ হন। যার আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
যশোর শহরের অস্ত্র দখলের পর কমরেড আবদুল মতিন মুনীর এর নেতৃত্বে কমরেড তোজ, কমরেড শান্তি কমরেড আসাদ, কমরেড মানিক কেশবপুর অঞ্চলের দিকে চলে যান। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ কমরেড নটু (কমরেড ছবির ছোট ভাই) ও বর্তমান ন্যাপ নেতা কমরেড নূর জালাল ভাইয়ের ছোট ভাই (নাম মনে নেই) নিখোঁজ হন। যশোর এমএম কলেজের ৬৬-৬৭ সালের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক কমরেড নজরুল ইসলাম পাকবাহিনীর হাতে অস্ত্রসহ গ্রেফতার হন।
যশোর ক্যান্টমেন্টে অনেকদিন থাকার পর তাকে পাকবাহিনী হত্যা করে। (ক্যন্টনমেন্টে থাকার তথ্য পেয়েছি যুগ্ম সচিব লোহাগাড়ার তালবেড়ে গ্রামের কাতেবুর এর কাছ থেকে) মনিরামপুরের কমরেড ফজলু, ঝিকরগাছার মেধাবী ছাত্র কমরেড আবু বকর সিদ্দিকীসহ আরও ১ জন পাকবাহিনীর হাতে নিহত হন। যশোর শহর থেকে কমরেড নূর মোহম্মদ ও কমরডে আবু বকর জাফরউদ্দোলা দীপু মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পুলুম অঞ্চলে চলে আসেন। এই সময়কালে কমরেড নূর মোহাম্মদের সাথে পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। ১৯৭১ সনে ১৪ই জুন জেলা কমিটির সভা হয়। কমরেড নূর মোহম্মদ তার লিখিত বক্তব্য উপস্থিত করেন। জেলা কমিটি সর্ব সম্মতিক্রমে ঐ দলিল গ্রহণ করে। দলিলের মূল বক্তব্য যতদূর মনে পড়ে পাকবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আওয়ামীলীগ এর (দেশ প্রেমিকদের) সাথে ঐক্য গড়ে তোলা ও সংঘাত এড়িয়ে চলা। ঐ সময় কমরেড শামসুর রহমানকে সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য কমরেড নূর মোহম্মদ কমরেড বিমল বিশ্বাস ও কমরেড খবির উদ্দীনকে নিয়ে সামরিক কমিশন গঠিত হয়। যার আহ্বায়ক ছিলেন কমরেড নূর মোহম্মদ। কমরেড নূর মোহম্মদ পলিটিক্যাল কমিশনার ও সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। কিছুদিন পরেই বিমল বিশ্বাসকে বহিনীর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয়। ঐ সভায় মুক্তাঞ্চল ও বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্তের পরে পুলুম স্কুলকে কেন্দ্র করে এবং ঐ অঞ্চলে প্রতিটি গ্রামে বিপ্লবী কমিটি গঠন, সেনাবাহীনীর স্থানীয় সদস্য এবং কেন্দ্রীয়ভাবে একটি বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। যে বাহিনীর অস্ত্র প্রশিক্ষণ সহ সকল ধরনের ট্রেনিং পুলুম স্কুলেই দেওয়া হত।
লোহাগড়ার লাহুড়িয়া, সরুশুনা এবং লোহাগড়া শহরের উপকণ্ঠে মসিয়াপাড়া অঞ্চলেও একই ভাবে বিপ্লবী কমিটি ও বাহিনী গঠন করা হয়। মোহাম্মদপুর থানার রোনগর, দেউলী, যশোবন্তপুর, ঝামা, হরেকৃষ্ণপুর অঞ্চলে বিপ্লবী কমিটি ও স্থানীয় বাহিনী গড়ে তোলা হয়। ইপিসিপিএমএল’র বাহিনী এবং দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা যৌথভাবে ৩ দিন ব্যাপী লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে রাজাকার কমান্ডার সোলেমানের নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীকে পরাভূত করা হয়। ৩ দিন পর নদী সাতরিয়ে থানা ঘেরাও করে ফেললে ট্রাক যোগে রাজাকাররা পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের গুলিতে শহীদ হন পাঁচুড়িয়া গ্রামের কমরেড মিজানুর রহমান। জুলাই মাসে কোন একদিন সন্ধ্যায় বীরডুমুরতলার পথে বিশাল ৪টি নৌকাযোগে শরণার্থীরা যখন আসছিলো তখন আমাদেরকে খবর দেওয়া হলো রাজাকারদের নৌকা পুলুম অঞ্চলকে আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসছে। সাথে সাথে আমরা অন্ধকারের মধ্যেই নৌকাগুলোকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ শুরু করি। ঐ নৌকা থেকে শরণার্থীরা যখন চিৎকার শুরু করে তখন আমরা বুঝতে পারি এগুলো শরণার্থীদের নৌকা। ঘটনাচক্রে ঐ নৌকায় গৌরী রায়সহ অঞ্চলের মানুষেরা ভারতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলো। বিয়ের পর গৌরী রায়ের কাছ থেকে জানতে পারি।
ইপিসিপিএমএল’র ১৯৭১ সালে ৪ঠা সেপ্টেম্বর এর আক্রমণসহ শালিখা থানা ঘাঁটি ৩ বার আক্রমণ করা হয়। ২ বার আক্রমণে থানা দখল করতে সক্ষম হয় ও রাজাকাররা পালিয়ে যায়। কিন্তু ৪ঠা সেপ্টেম্বর এর আক্রমণে (যুদ্ধ কৌশলগত কারণে সে আক্রমণের আমি তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছি) ঐ আক্রমণে মেধাবী ছাত্র হরিশপুরের আবুল বাশার শহীদ হন। নড়াইলের কমরেড ইমরান (আনিস) শহীদ হন। যার কবর পুলুম স্কুলের পশ্চিম পার্শ্বে নদীর পাড়ে এখনও আছে। এলএমজি পরিচালনা করতেন অন্তাই খোলার ভূমিহীন কমরেড মুরাদ (আসল নাম মনে নেই)। ঐ আক্রমণে শহীদ হন খাজুরার কমরেড বিশ্বনাথ ঘোষ (রাজু) সহ আরও কয়েকজন। কমরেড ইমরানকে ক্রলিং করে আনতে গিয়ে আর একজন এলএমজি চালক নড়াইলের বট্ট আহত হন।
আমি ৪ঠা সেপ্টেম্বর রাতেই নড়াইলের সাইফ হাফিজুর রহমান খোকনসহ ফাজার খালী রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের জন্য চলে যাই। প্রচণ্ড বর্ষা ও অন্ধকারের মধ্যে ফাজার খালি ঘাঁটি আক্রমণ করতে ব্যর্থ হয়ে সিনিয়া গ্রামে মিজানুরের এক আত্মীয় বাড়িতে আশ্রয় নেই। কমরেড নুর মোহম্মদ ভোরে আমাকে চিঠি লেখেন, আজও সেই চিঠির বক্তব্য ভুলি নাই। নুর মোহাম্মদ ভাই লিখেছিলেন, “আনিস, বাশার নিহত, বট্ট আহত, মুরাদ রাজুর খোঁজ নেই সমগ্র অঞ্চলে পার্টি বাহিনী ও জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড হতাশা আপনি দ্রুত চলে আসেন।”
১৯৭১ সালের ১২ই অক্টোবর ধলগ্রাম সুঁই তলার পথ হয়ে পাক বাহিনী রাজাকাররা পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করে, হাটবাড়িয়া বুনোগাতি কুয়োতপুরের পথে উত্তর দিক থেকে পাক বাহিনী ও রাজাকারদের আক্রমণ এবং নড়াইলের পোড়াডাঙ্গা মাগুরা হয়ে লঞ্চ পথে আক্রমণে প্রথম শহীদ হন পোড়াডাঙ্গা গ্রামের কমরেড অনিল বিশ্বাস। ঐ দিন সাইফ হাফিজুর রহমান খোকনকে নিয়ে বামনখালী ঘোষগতি, পুলুম, সোনাকুড়ে আমাদের নিয়োজিত বাহিনীকে দৌড়িয়ে সাহস সঞ্চার করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হই। কিন্তু বিকেল বেলায় জেলা নেতৃবৃন্দের এক বর্ধিত সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় আজ রাতের মধ্যেই এই অঞ্চল পরিত্যাগ করতে হবে। ১২ই অক্টোবর রাতেই বন্দুকধারী যোদ্ধা বাদে এলএমজি মাসকেট থ্রিনট থ্রি এসএমজিসহ ঐ সময়কার আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত বাহিনী নিয়ে পূর্ব দিকে যাত্রা শুরু করি। বস্তুত পক্ষে এটা ছিল এক ধরনের লক্ষ্যহীন যাত্রা। ১৩ই অক্টোবর সকালবেলা মিঠাপুরে এসে পৌঁছাই। নদী পথে নৌকায় চাল ডাল গোলাবারুদ নিয়ে পাহারার মাধ্যমে মিঠাপুরের পাড়ে নৌকা ভিড়ানো হয়। উল্লেখ্য এই যাত্রাপথে সম্মুখ সারিতে আমি, কাফি, মিজানুরসহ একটি শক্তিশালী স্কোয়াড ছিলাম, পেছনে কমরেড নুর মোহাম্মদের নেতৃত্বে যে স্কোয়াড ছিল তার মধ্যে নুর মোহম্মদ ভাইকে বিশাল ওজনের এক খোড়া কমরেডকে সারা পথে কাধে নিয়ে আসতে হয়। ঐ সময়ে রাজাকারদের হাতে নিহত হন মধুখালীর কমরেড লালমিয়া ও কমরেড ওহাব।
২০ শে আগস্ট থেকে ২৪ শে আগস্ট যশোর জেলা কমিটির সভা হয়েছিল। (যে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঘোষগাতির বাদশাদের বাড়ীতে) ঐ সভায় কেন্দ্রের পক্ষে কমরেড আব্দুল হক উপস্থিত ছিলেন। ঐ সভায় কেন্দ্রের এক নম্বর ও ২ নম্বর দলিল আমরা পাই কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে ঐ বিতর্কিত দলিল জেলা কমিটির সভায় আলোচনা হয়নি। যশোর জেলায় স্বাধীনতা যুদ্ধে জেলা কমিটি যেভাবে ভেবেছে সেভাবেই যুদ্ধে অংশ নেয়া হয়েছে। ২০-২৪ শে আগস্ট জেলা কমিটির সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ সেপ্টেম্বর যশোর জেলা নিয়মিত বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়।
এই একই সময়ে নড়াইলের রাজাকারদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন কমরেড মন্মর্থ বিশ্বাস, কমরেড বিনয় গোলদার ও কমরেড কুটি মিয়া ১৩ই অক্টোবর সকালে মিঠাপুরের একটি পরিত্যক্ত বাড়ীতে সকল শ্রান্ত ক্লান্ত বিধ্বস্ত বাহিনী সদস্যদেরসহ সকলে মিলিত হই। কিন্তু সমস্যা হলো নৌকা থেকে খাদ্য, অস্ত্র গোলাবারুদ নামিয়ে আনা এক কঠিন ব্যাপার হয়ে গেল। কারণ ফাজারখালী রাজাকার ঘাঁটির রাজাকাররা নদীর ওপারে অবস্থান নিয়ে নেয়। আমাদের বাহিনীর সদস্যরা এমন ক্লান্ত শ্রান্ত বিধ্বস্ত ছিল যে শত শত বন্দুক হাতে নেওয়ার কেউ নেই। তখন সিদ্ধান্ত নিয়ে পাশের পুকুরে সব বন্দুকগুলো নুর মোহাম্মদ ভাই এবং আমি ফেলে দেই। এই বন্দুক ফেলার সহযোগীতার জন্যও তেমন কাউকে পাচ্ছিলাম না। ইতোমধ্যে সন্ধ্যা নেমে এল, নৌকা থেকে গোলাবারুদ ও খাদ্য নামাবার জন্য নুর মোহাম্মদ ভাই নৌকার কাছে চলে গেছেন। আমি খবর পাওয়ার সাথে সাথে শরুশোনার ভূীমহীন কমরেড আকরকে নিয়ে এক দৌড়ে নদী ঘাটে গিয়ে নুর মোহম্মদ ভাইকে বললাম “আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?” শিঘ্রীই উপরে উঠে আসেন। একটি নারিকেল গাছকে আঁড় করে আমি দাঁড়িয়ে নুর মোহাম্মদ ভাইকে একটি গাছের আড়ালে দাঁড়াতে বললাম। কমরেড আকর সমস্ত গোলাবারুদ, খাদ্য তুলে দিল এবং কয়েকজন কমরেড সহযোগীতায় ঐ গুলো যথা স্থানে পাঠিয়ে দিলাম।
হঠাৎ আকস্মিকভাবে আমাদের অবস্থানরত বাহিনীর এলাকায় ৩ দিক থেকে গুলিবর্ষন শুরু হল। ঐ গুলির মধ্যেই নুর মোহাম্মদ ভাই এবং আমি দৌড়ে এসে দেখি আমাদের বাহিনীর ট্রেনার (কামাল প্রতাপ গ্রামের নাম মনে নেই) গুরুতর আহত। বাহিনীর একটা বড় অংশ এদিক সেদিক এমন কি পানির মধ্যেও অবস্থান নেয়। বাহিনীর সকল সদস্যদের একত্রিত করে আবার নলদী গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করি এবং বাহিনীসহ এক বাড়ীতে উঠলাম। যতদূর মনে পড়ে ঐ রাতে আমাদের খাবার জোটেনি। পরদিন সকাল ১০টায় রান্না শুরু হলো, ২টার দিকে যখন আফোটা ভাত বাহিনীর সদস্যরা খেতে শুরু করেছে তখন নড়াইল থেকে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা ৩টি বড় লঞ্চ ভর্তি হয়ে নলদী বাজারে নেমে দ্রুতগতিতে আক্রমণ করে। তখন আচমকা আক্রমণের মধ্যে আমরা পাল্টা আক্রমণের মাধ্যমে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করি। দ্রুততার সাথে আমাদের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে এবং আমি সহ কয়েকজন গাছ বেড়ে খালের পাড়কে আড়াল করে প্রতিরোধের পুনঃপ্রস্তুতি নেই।
কিন্তু ইতোমধ্যেই আমার বা পাশে প্রায় ৫০ গজ দূরে যশোবন্তপুরের কমরেড পল্টুসহ ৯ জন পাক সেনাদের ব্রাশফায়ারে শহীদ হন। যশোরের কমরেড আবু বকর জাফরদৌলা দীপু পাক বাহিনীর ঐ আক্রমণে কোন মতে বেঁচে যান। শহীদ হন তরুন যোদ্ধা নড়াইলের মীরাপাড়া গ্রামের কমরেড কাবিল। হলদা গ্রামের পাশের রাস্তায় আমরা সবাই একত্রিত হই, সিদ্ধান্ত হয় কমরেড শামসুর রহমান ও শেখ সবুর সহ বাহিনীর বড় অংশ শরুশোনা গ্রামে চলে যাবে। আমি কমরেড নুর মোহাম্মদ এবং কমরেড হেমন্ত সরকারসহ ৮০ জন থেকে গেলাম। আমার আত্মগোপন জীবনে আকস্মিক এক বিপদে হলদার অপরিচিত শরৎ বিশ্বাসের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলাম। শরৎ বিশ্বাসকে কমরেড হেমন্ত সরকারকে এক রাতে আশ্রয়ের জন্য অনুরোধ করি এবং কমরেড হেমন্ত সরকার ৭০ হাজার টাকা সহ কিছু সম্পদ নিয়ে থেকে যান। পরের দিন তিনি অন্যত্র চলে যান। ৭০ জনকে নিয়ে ৭টি নৌকা যোগে ব্রাহ্মনডাঙ্গার উদ্দেশ্যে আমরা রওয়ানা দেই। মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার লোহাগড়ার প্রাক্তন এমপি খসরুজ্জামানকে আমি এক পত্র লিখি। লেখার মর্মার্থ ছিল পাক বাহিনীর আক্রমণে আমাদের বাহিনীর অনেকে শহীদ হয়েছেন, তাদের হত্যার বদলা নেবার জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছি। “আপনাদের অঞ্চলে আমাদের পার্টির নেতা ও কর্মীরা থেকে যাচ্ছে।” আশা করি তাদের জীবনের কোন ক্ষতি হবে না। উল্লেখ্য ১৯৭১ সালে ৫০ মাইল লম্বা চওড়া এই বিস্তির্ণ এলাকা আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত পার্টির নিয়ন্ত্রণে ছিল। যার বিস্তারিত বিবরণ যশোরের প্রখ্যাত সাংবাদিক প্রয়াত শামসুর রহমান কেবল এর লেখা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। এর জন্য ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যকরি সভাপতি শাহরিয়ার কবির ও শামসুর রহমান কেবলের কাছে চির কৃতজ্ঞ। ১৪ই অক্টোবর শত্রুহাজারী গ্রামে ঐ অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী জনগণের এক শালিস হয় এবং সেখানে আমাদের সকলকে ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্ত হয়। তারপর দেখলাম লাহুড়িয়ার হবিবর শুরুশুনার হোসেন আলী, ইয়াসিন, জাফর এদের হত্যা করা হলো।
একটু পেছনে গিয়ে বলতে হচ্ছে, ১৯৭১ সালে আগস্ট মাসে দ্বিতীয় সপ্তাহের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত প্রবাসী সরকারের কোন মুক্তি বাহিনী বৃহত্তর যশোরের কোন অঞ্চলে ছিল না। ঐ সময়ে ইপিসিপিএমএল’র হাতে একটি লঞ্চ ছিল। যে লঞ্চে করে আলফাডাঙ্গা, বোয়ালমারী, ফরিদপুর, মানিকগঞ্জ, বরিশাল সহ বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তি বাহিনীদের মধুমতি নদী পার করে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়া হত।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার শুরু হলো ২৪ আগস্ট তারিখে আলফাডাঙ্গার মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা শিয়েরবর অঞ্চলের রঘুনাথপুর গ্রামের আমাদের পার্টি কর্মী মাহাবুল, সাহাবুল দু’ভাইকে হত্যা করে। ২৮ আগস্ট তারিখে কমরেড মমতাজ উদ্দিন ও কমরেড মাহমুদকে গণ্ডগ্রাম থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে লোহাগড়ার আড়িয়ারা স্কুল মাঠে হত্যা করে। আমরা যতই মুক্তিবাহিনীর সাথে সংঘর্ষ এড়াতে চেয়েছি কিন্তু বাস্তবে মুক্তিবাহিনীর সাথে লাহুড়িয়া অঞ্চলেও সংঘর্ষ হয়েছে। যদিও ঐ অঞ্চলে তখন আমি ছিলাম না। ঐ সংঘর্ষের সূত্র ধরে মাস্টার আঃ হালিম সৈয়দ পাড়ার মাহমুদের ছোট ভাই (নাম মনে নেই) মজিদ ও এক মহিলা কর্মীকে (নাম মনে নেই) ও বাদশা জমাদারকে হত্যা করে। আব্দুল হালিম মাস্টার ও বাদশা জমাদার আওয়ামী লীগ করতেন। মোহাম্মদপুর থানার দেউলী গ্রামের কুদ্দুস ও তার মেজ ভাই সহ কয়েকজনকে হত্যা করে। এই একই সময়ে নড়াইলের আব্দুল্লাহকেও হত্যা করা হয়। পাকবাহিনী ও রাজাকারদের হাতে মাগুরা ও মোহাম্মদপুরের শহীদ হয়েছেন মাগুরা সরকারি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক কমরেড রায়হান, কমরেড লুতু, কমরেড হেলেনা সহ কয়েকজন। গ্রাম্য শত্রুতাকে কেন্দ্র করে ঐ সময়ে কিছু হত্যাকাণ্ড পার্টির নামে সংগঠিত হলেও তা আসলে পার্টির সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে হয়নি। আমরা প্রতি মুহূর্তে শত উস্কানির মুখে আওয়ামী লীগ ও মুক্তি বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে যেতে চাইনি- এটা ছিল যশোর জেলা কমিটির রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।
আমার জানামতে মুক্তিবাহিনীর কোন সদস্যকে ইপিসিপিএমএল’র বাহিনী হত্যা করে নি। এতদ্সত্ত্বেও অনাকাংখিত যে সকল সংঘর্ষ ঘটেছিল তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইপিসিপিএমএল। কুমড়ী অঞ্চলের সংঘর্ষে এলএমজি চালক আতিয়ার নিহত হয়, মশিয়াপাড়ার কমরেড রউফ ও কমরেড মর্জিনা কমরেড শুকতৈল গ্রামের সাঈদ মাস্টার এরা সকলেই মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন। ঐসব অঞ্চলের সাথে আগস্টের পর আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ ছিল না।
১৪ অক্টোবর রাতে ব্রাহ্মণডাঙ্গার নদী পার হয়ে ভোরে কামাল প্রতাপ গ্রামে কাফিদের বাড়িতে পৌঁছার সাথে সাথে ৭টি নৌকা যোগে কালিয়ার পেড়লী অঞ্চলের দিকে রওয়ানা দেই। প্রথম নৌকায় কমরেড নুর মোহম্মদ ও আমি সহ কয়েকজন ছিলাম। প্রত্যেক নৌকায় সকলকে বলা ছিল যে কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে আমরা পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছি। ভাগ্য ভাল যাবার পথে চাচুড়ী রাজাকার ঘাঁটিতে ঐ সময়ে তারা ছিল না এবং নড়াইল শহরে চলে গিয়েছিল।
পেড়লীর সাত বাড়িয়া গ্রামে নৌ পথে আমরা যখন পৌছাই তখন ইপিসিপিএমএল’র বাহিনী আমাদেরকে আক্রমণের জন্য গুলি ছুড়তে গিয়ে আমাকে দেখে ফেলে। দ্রুততার সাথে তারা দৌড়ে এসে কম্পমান অবস্থায় আমাকে এবং নুর মোহম্মদ ভাইকে জড়িয়ে ধরে। যাবার সাথে সাথেই ঐ সময়ই গাজীর হাটের মধুমতি নদী দিয়ে চিত্রার পাড়ে পেড়লীর দিকে যখন এগোয় তখন গানবোট নিয়ে পাকবাহিনী আক্রমণে এগিয়ে আসে। তখন আমরা অনন্যোপায় হয়ে ধান ক্ষেতে আশ্রয় নেই। ঐ অঞ্চলে কমরেড সুধাংশু দে কমরেড বৈদ্যনাথ বিশ্বাস খুলনার কমরেড রণজিৎ চক্রবর্তী ও বাচ্চু, কমরেড হাসান, কমরেড নাজিম জবেদ আলী ও মঞ্জু কায়সারসহ এই অঞ্চলের বাহিনীর একটি অংশকে পেলাম।
ঐ সময়কালে আমিও কমরেড নুর মোহম্মদ বারবার বলার চেষ্টা করেছিলাম এই অঞ্চলে প্রতিরোধ গড়ে তুলে শেষ রক্ষা হবে না। বাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে যার যার মতো আত্মরক্ষার কৌশল গ্রহণ নিতে হবে। কিন্তু কেউই রাজি ছিল না। শেষ পর্যন্ত ৩১ অক্টোবর তারিখে সকাল বেলায় জামিলডাঙ্গার পথে ও বিষ্ণুপুর এর দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে সাত বাড়িয়া গ্রামের বড় অংশ মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে যায়। ঐ দিন যুদ্ধে কমরেড আকর শহীদ হন এবং কমরেড নাজিম উদ্দিন গুরুতর আহত হন। ঐ রাতেই পেড়লী অঞ্চল ত্যাগ করব এ কারণে পার্টির স্থানীয় একটি অংশ আমাকে এবং নুর মোহম্মদ ভাইকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। সন্ধ্যার দিকে আমাদের গুলির নৌকা নিখোঁজ। যে নৌকার দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদপুর এর হরেকৃষ্ণপুর গ্রামের আলীকদর সাহেব। এই ঘটনার পর রাগে ক্ষোভে আমি যখন নৌকা উদ্ধারে এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন কমরেড হাসান ও জবেদ আলী আমাকে এসে প্রশ্ন করে “আপনি কি কিছু বোঝেন না।” উল্টো আমি প্রশ্ন করি, আপনারা কেন আমাকে ঘিরে আছেন? তখন কমরেড হাসান ও জবেদ আলী আমাকে বলে আপনাকে এবং নুর মোহম্মদ ভাইকে হত্যার জন্য ভিমরুলসহ কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়েছে।
শোনার সাথে সাথে যেহেতু কমরেড নুর মোহম্মদ একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে লাহুড়িয়ার কমরেড জাফরসহ কয়েকজনকে নদীর ওপার সাত বাড়িয়া থেকে পার করে আনার জন্য পেড়লীর খাল পাড়ে অবস্থান করছেন সেখানে আমি দৌড়ে গিয়ে কমরেড নুর মোহম্মদকে ঘটনা বলি। কাকতালীয়ভাবে কমরেড জাফররা ঐ সময়ে এসে হাজির হয়। ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যায় কমরেড শুধাংশু দে কমরেড বৈদ্যনাথ বিশ্বাস ও মঞ্জু তারা খুলনার ডোবা অঞ্চলে দিকে চলে যায়। কমরেড আকরকে কবরস্থ করতে করতে রাত ৩টা বেজে যায়। ফলে ওখান থেকে রওয়ানা দিতে শ্যামনগর খালপার হতে সকাল ৭-৮টা বেজে যায়। এবং শেষ পর্যন্ত আকরপুর ধানক্ষেতে সারাদিন কাটাই। পেড়লী থেকে কায়সার খড়রিয়ার মুক্তিবাহিনীকে আমাদের ঐ পথে যাবার খবর জানিয়ে দিয়েছিল। যদি বিলম্ব না হত তা হলে আমাদের মৃত্যু ছিল অবসম্ভাবী। যদিও কায়সারকে ১৯৭২ সালে ১৫ জানুয়ারি রাতে খড়রিয়া গ্রামে আওয়ামী লীগের লোকেরা হত্যা করে। আমি এবং নুর মোহম্মদ ভাই ঐ রাতেই খড়রিয়া হয়ে কেটলা গ্রামে পৌছি।
১ নভেম্বর রাতে আকপপুরের এক পরিত্যক্ত বাড়ীতে রাত যাপন করি। ২ নভেম্বর রাতে বন খলিশাখালী গ্রামে অবস্থান করি। ৩ নভেম্বর বিকাল বেলা বাহিনীর সদস্যদের বুঝাবার চেষ্টা করি- এখন বাহিনী রূপে থাকার কোন যুজি নেই। সেই সময় ইব্রাহিম (কেবের) ও শাহজাহান বলেন, আপনারা যারা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তারা আপনাদের আত্মীয় স্বজনের বাড়ীতে আশ্রয় পাবেন কিন্তু আমাদের মতো ভূমিহীন ও কৃষক কর্মীদের বুকে ইপিসিপিএমএল’র পোস্টার লাগিয়ে নওয়াপাড়া রাজাকার ঘাঁটিতে যেয়ে হাজির হওয়া ছাড়া পথ নেই। যদিও ইব্রাহিম (কেবের) পাকা বাড়ী করে এখনও বহাল তবিয়তে বেঁচে আছেন। শ্রমিক নেতাও হয়েছেন কিন্তু মার্কসবাদী রাজনীতিতে নেই। উল্লেখ্য আহত কমরেড নাজিমকে কিছু টাকা দিয়ে কোলার ডাক্তার বৈদ্যনাথ বিশ্বাস এর উপর ছেড়ে দিয়ে বলেছিলাম বেঁচে থাকলে দেখা হবে। ৩ নভেম্বেই আনুষ্ঠানিকভাবে বাহিনী ভেঙ্গে দিয়ে এবং সকলকে কিছু কিছু টাকা দিয়ে আত্মরক্ষা করতে বলি। বেঁচে থাকলে দেখা হবে এটাই ছিল শেষ কথা।
কমরেড জাকির হোসেন হবি ছোট্ট একটি পিস্তল নিয়ে দৌলতপুরের উদ্দেশ্যে চলে যায়। ৩ নভেম্বর রাতে আমি নুর মোহম্মদ ভাই কমরেড দীপুসহ কয়েকজন নলদীর চর গ্রামে এক বাড়িতে এসে আশ্রয় নেই। সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন ও মিজানুর বাগভাঙ্গা গ্রামে খোকামিনাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয় এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। ৪ নভেম্বর রাতে মিজান ও খোকন এসে বলে ৫ হাজার টাকা দিতে হবে তা হলে আমরা বেচে যাব। তাদেরকে ৫০০০ হাজার টাকা দিয়ে দেওয়া হয়। সাইফ হাফিজুর রহমান খোকনের আব্বা নড়াইলের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন সে কারণে সম্ভবত খোকন বেচে যায়। ৪ নভেম্বর রাতে বীড় গ্রামের বিষ্টু দা এসে বললেন, যদি কমিউনিস্ট পার্টির বীজ রাখতে চাস্ তাহলে পথ আমার চেনা আছে চল ভারতে যাই। বিষ্টু দা’র কথায় সাড়া দিয়ে আমি, নুর মোহম্মদ ভাই, দীপু, কমরেড সুধাংশু ও দিঘীরপাড় গ্রামের (কমরেডদের নাম মনে নেই) সহ ৭ জন বাঘারপাড়া থানার বাসুড়ি গ্রামে এক বাড়ীতে এসে উঠি। ৫ নভেম্বর রাতে ঐ বাড়ী থেকে রওয়ানা দিয়ে দিঘীর পাড়ে এক বাড়ীতে কয়েকটি অস্ত্র ছিল তা রেখে দিঘীর পাড়ের কমরেডকে সহ রেখে যাই। ভোর হতে না হতেই গরিবপুর বর্ডার পার হয়ে নদীয়া জেলায় বিষ্টু দার পরিচিত এক আত্মীয়ের বাড়ীতে আশ্রয় নেই। ২ দিনের মধ্যেই কমরেড অমল সেন আমাদের সাথে এসে সাক্ষাত করেন এবং কিছু আলোচনা করে চলে যান।
কমরেড আব্দুল মতিন মুনিরের নেতৃত্বে কমরেড তোজ, কমরেড শান্তি, কমরেড আসাদ, কমরেড মানিক এবং ধোপাদী গ্রামের শহীদ কমরেড রফিক এর ভাইপো সিরাজুল ইসলাম সহ যারা কেশবপুর অঞ্চলে লড়েছেন এবং শেষে খুলনা জেলার ডুমরিয়া অঞ্চলে চলে যান তাদের লড়াই সম্পর্কে বিস্তারিত আমার জানা নেই। শুধু মাত্র এতটুকুই জানি যখন ডুমুরিয়া অঞ্চলে আত্মরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছিল না তখন কমরেড আব্দুল মতিন মুনীর যশোর শহরে অন্যদের আশ্রয়ের ব্যবস্থার জন্য আগেই চলে আসেন। যশোরের কমরেড হাফিজুর সাতক্ষীরায় মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়।
২৩ অক্টোবর কমরেড তোজ, শান্তি, আসাদ, মানিক শহীদ কমরেড রফিকের ভাইপো ফেরার পথে চিরি টোলায় যে বাড়ীতে আশ্রয় নেয় তাদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণে গ্রেফতার হন এবং তাদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শুধুমাত্র কমরেড রফিকের ভাইপো বেঁচে যায় যার সাথে ১৯৭২ সালে ধোপাদী গ্রামে আমার আত্মগোপন জীবনে দেখা হয় এবং কথা হয়। লোমহর্ষক ঐ হত্যার কাহিনী বর্ণনা এবং তার পালিয়ে আসা হৃদয়বিদারক ঘটনা এক করুন মর্মস্পর্শী পরিবেশ তৈরি করে। যার ফলে আলোচনা আর এগোয় না।
পেড়লী অঞ্চল থেকে ১লা নভেম্বর তারিখে পেড়লী পীর পরিবারের কমরেড আজিজুর রহমান, কমরেড বাকী বিল্লাহ, সাতবাড়ীয়ার টুকুসহ ৩৩ জনকে মুক্তিবাহিনী গ্রেফতার করে কালিয়ার কলাবাড়িয়া গ্রামে নিয়ে হত্যা করে। ধোপাদী গ্রাম থেকে যাবার পথে কমরেড খবির উদ্দিন ও কমরেড রফিককেও হত্যা করা হয়।
সেপ্টেম্বরের কোন এক সময়ে খাজুরা ও কালিগঞ্জের বাহিনীর সদস্যরা ফেরার পথে সীমাখালীতে ৪৬ জন গ্রেফতার হয় এবং রাজাকাররা তাদের সকলকেই হত্যা করে। কয়েকদিনের ব্যবধানে আড়পাড়ার পথে খাজুরা অঞ্চলের কমরেডদের যাবার পথে ১২ জনকে রাজাকাররা হত্যা করে।
পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে বৃহত্তর যশোর জেলার ইপিসিপিএমএল’র নেতা-কর্মীদের বিরোচিত লড়াই ও জীবনদানের লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। তৎকালীন ইপিসিপিএমএল’র একাংশের নেতা কমরেড আব্দুল হক এর দুই কুকুরের লড়াইয়ের তত্ত্ব যশোর জেলা কমিটি কখনই গ্রহণ করেনি। তার পরেও কমরেড আব্দুল হক যখন আগস্ট মাসে জেলায় আসেন তাকে ঘেরাও দমনের মধ্যে আমার নেতৃত্বে ৭ জনের আত্মঘাতী স্কোয়াড নিয়ে ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী এ্যাড. মিয়া মোহনের বাড়ীতে পৌঁছে দেই। আমাদের জীবন নিয়ে ফেরার কোনই সুযোগ ছিল না। নানা কৌশল অবলম্বন করে বেঁচে যাই, সে আলোচনায় এখানে যাচ্ছি না।
কমরেডদের এই রক্তের ঋণ শোধ করার জন্যই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি শেষ চেষ্টা করে। মৃত্যুর মধ্যদিয়েই সমাপ্তি ঘটাতে চাই। দীর্ঘদিন পর এ লেখায় কিছু শহীদের নাম সহ ছোট খাট ঘটনা বাদ পড়ে গেলে ক্ষমা চেয়ে এ লেখার সমাপ্তি টানতে চাই।
সবশেষে কমরেড কাবুলকে অসংখ্য ধন্যবাদ তাগাদা দিয়ে এ লেখা লিখিয়ে নেয়ার জন্য।
সম্পাদনা:
বিমল বিশ্বাস
বিশিষ্ট বামপন্থি রাজনীতিবিদ
০৮.১১.১২