যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা) আসনে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মহাজোট ও ১৮ দলীয় জোটের একাধিক প্রার্থী মনোনয়ন লাভের আশায় বিভিন্নভাবে দলীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মাঠে নেমে পড়েছেন। পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের মাধ্যমে ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালাচ্ছেন তারা। এ আসনে আওয়ামী লীগ গ্রুপিং আর বিভক্তিতে ডুবে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। অপরদিকে সাংগঠনিক ভিত মজবুত হচ্ছে বিএনপির। ঝিকরগাছা ও চৌগাছা দু’টি উপজেলার ২২টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-২ আসন গঠিত। এ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩,৬২,৪১১। এর মধ্যে ঝিকরগাছা উপজেলায় ভোটার সংখ্যা ২,০৬,০৬৯ এবং চৌগাছা উপজেলায় ভোটার ১,৫৬,৩৪২। ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়ে এ আসন থেকে প্রায় ২১ হাজার ভোটের ব্যবধানে চারদলীয় ঐক্যজোট প্রার্থী মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেনকে পরাজিত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ। বিগত ৪ বছরে বর্তমান এমপির কার্যক্রম সম্পর্কে চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাজান আলী বলেন, আমরা ভোটারদের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম তার তেমন কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারিনি। তাছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে স্থানীয় এমপির যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন। তিনি বলেন, চৌগাছার মানুষের প্রাণের দাবি কপোতাক্ষের ওপর ব্রিজ নির্মাণ না হওয়ায় এলাকায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শাহাবুদ্দিন আহমেদ চুন্নু এমপিকে একজন গণবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন। নিয়মনীতির মধ্যে তিনি এ আসনের উন্নয়ন কার্যক্রমকে অফিসিয়াল কায়দায় পরিচালনায় কিছুটা সফল হলেও গত ৪ বছরে দুটি উপজেলার আওয়ামী লীগের একাধিক বিভক্তি সংগঠনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলেছে বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিমত। এমপিকে সবাই ভদ্র লোক হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তবে গুটিকয়েক সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগ নেতা এমপিকে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সঙ্গে গত ৪ বছরে ব্যাপক দূরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছে বলে দাবি করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান মুসা। দু’টি উপজেলার আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের এসব নেতারা দাবি করেন বিগত সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দু’টি উপজেলা আওয়ামী লীগে একই দলের মধ্যে প্রধানত দুটি পার্থক্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু’টি উপজেলার হাতেগোনা ১০-১২ জন তোষামোদকারী নেতা এমপিকে নিজেদের করায়ত্ত করে নিজ নিজ আখের গুছিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে গেছেন বলেও তাদের অভিমত। আর এসব নেতার রোষানলে পড়ে দলের একটি বৃহৎ অংশ বর্তমান সরকারের প্রথম ২ বছর প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। কিন্তু গত ২ বছর সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সুস্থ হয়ে ‘আমরাই মূল ধারা’ সংগঠনের ব্যানারে জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সফলতা তুলে ধরে এ আসনের ত্যাগী ও তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গণসংযোগ ও তাদের খোঁজখবর নিয়ে রাজনীতির মাঠে আবারও সরব হয়ে উঠেছেন। এতে করে হতাশ নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্যতা ফিরে পেয়েছে বলে দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অভিমত। মহাজোটের শরিক দল জাসদের ঝিকরগাছা উপজেলা শাখার সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রশিদুর রহমান রশিদ বলেন, বর্তমান সরকারের সঙ্গে থাকলেও আমাদের তেমন মূল্যায়ন করা হয়নি। তিনি বর্তমান এমপিকে একজন সৎ লোক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন রাজনীতির মাঠে তার মতো মানুষ এখন আর মানায় না। ৪ বছরে এমপির কার্যক্রম ও আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঝিকরগাছা থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি জালাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, সরকার দলীয় এমপি গত ৪ বছরে চোখে পাড়ার মতো তেমন কোন কার্যক্রম করেনি। তিনি বলেন, কপোতাক্ষ নদ খনন না করে খননের নামে এ এলাকার মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী টিপু বলেন, বর্তমান সময়ে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন ঘটেনি। তিনি নিজেকে আগামী নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন চাইবেন এবং এ জোট থেকে এবার এ আসনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার জোর দাবি জানাবেন বলেও জানান। চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহুরুল ইসলামও উন্নয়নের বিষয়ে একই অভিযোগ করে বলেন, আগামী নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট থেকে তিনি একজন জোরালো মনোনয়ন প্রত্যাশী। তিনি এবার বিএনপি থেকেই জোটের মনোনয়ন দেয়া হবে বলে আশা করেন। ঝিকরগাছা উপজেলা জামায়াতের আমীর মাওলানা আরশাদুল আলম বলেন, তেমন কোন উন্নয়ন তো হয়নি, বরং উন্নয়ন হয়েছে এমপির কাছের লোকদের ভাগ্যের। উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড আবদুর রহিম বলেন, উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়নই এ আমলে হয়নি, এমনকি এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি কপোতাক্ষ নদ খনন না হওয়ায় আমরা হতাশ। তিনি আরও বলেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে আমরা সকল বাম সমমনা দলগুলো এক প্লাটফর্মে এসে প্রার্থী দেব। এলাকার উন্নয়ন হয়নি এবং এমপির বিরুদ্ধে নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ বলেন, এ আসনে যে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে ইতিমধ্যে আমি এসব উন্নয়নের ওপর একটি বই বের করেছি। চাইলে উন্নয়নের তালিকা সমৃদ্ধ এ বইটি আপনাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। তিনি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, আশাকরি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবশেন করবেন। বর্তমান সরকার আমলে ঝিকরগাছা ও চৌগাছায় যেসব উল্লেখযোগ্য উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তা হলো- দুই উপজেলায় ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও করন, ঝিকরগাছা হাসপাতালকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ, ঝিকরগাছায় ৫টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, দুটি উপজেলায় ১৫টির মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ, কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ, ৭ কি. মি. নতুন পাকা রাস্তা ও ১০ কি. মি. কাঁচা রাস্তা, কিছু রাস্তায় মেরামত কাজ, উপজেলা অভ্যন্তরে সার্ভার স্টেশন নির্মাণ, টিআর-এর মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয়, সামজিক প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন, কাবিখার মাধ্যমে মাটির রাস্তাকরণ, নতুন বিদ্যুৎ সংযোগসহ বেশকিছু উন্নয়মূলক কাজ। এ আসন থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোর মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান এমপি ও তথ্য প্রযুক্তিমন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম হাবিব, জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট মনিরুল ইসলাম, লায়ন শহিদুল ইসলাম ও দেওয়ান তৌহিদুর রহমান। এছাড়া মাঝে মাঝে নতুন মুখ চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী এ বি এম আহসানুল হক মনোনয়ন প্রত্যাশায় গণসংযোগ করছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট মোহাম্মাদ আলী রায়হান ও আওয়ামী লীগের টিকিট প্রাপ্তির আশায় লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। ১৮ দলীয় জোট থেকে এবারও জামায়াত দলীয় প্রার্থী মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন, দলের
কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এডভোকেট কাজী মুনিরুল হুদা, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এডভোকেট মোহাম্মদ ইসহাক, ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপির প্রয়াত সভাপতি নাজমুল ইসলামের সহধর্মিণী সাবিরা নাজমুল মুন্নী, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী টিপু, এবং চৌগাছা উপজেলা বিএনপির সভাপতি জহুরুল হক জোটের মনোনয়ন লাভের আশায় গণসংযোগ ও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া দুটি উপজেলায় জাতীয় পার্টি, জাসদ, ন্যাপ-ভাসানী ও কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় কার্যক্রম খুব একটা উল্লেখযোগ্যহারে না চললেও আসন্ন নির্বাচনের আগে এসব দলের কিছু নেতা এলাকায় জনসংযোগ করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে এ আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ৩ থেকে ৪ জনে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করছেন নির্বাচনী এলাকার মানুষ।