
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > জমে উঠেছে যশোর-২ আসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি
এই পৃষ্ঠাটি মোট 8321 বার পড়া হয়েছে
জমে উঠেছে যশোর-২ আসনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি
যশোর জেলার ৬টি আসনের মধ্যে যশোর-২ (ঝিকরগাছা-চৌগাছা, সংসদীয় আসন-৮৬) আসনে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে

এসব মনোনয়ন প্রত্যাশীদের পোস্টার, ফেস্টুন ও ব্যানারের মাধ্যমে দু’টি উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনের ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রক্রিয়া কয়েক মাস আগে থেকে চলছে।
ঝিকরগাছা ও চৌগাছা দু’টি উপজেলার ২২টি ইউনিয়ন ও ২টি পৌরসভা নিয়ে যশোর-২ আসনটি গঠিত। উপজেলা নির্বাচন অফিস থেকে প্রাপ্ত সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী এ আসনের মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ৬২ হাজার ৪১১ জন। এর মধ্যে ঝিকরগাছা উপজেলায় ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ৬ হাজার ৬৯ জন।
অপরদিকে, চৌগাছা উপজেলায় ভোটার ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৪২ জন। বিগত ২০০৮ সালের ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোট থেকে প্রথমবারের মতো মনোনয়ন পেয়ে এ আসন থেকে প্রায় ২১ হাজার ভোটের ব্যবধানে চার দলীয় ঐক্যজোট প্রার্থী মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেনকে পরাজিত করেন আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ।
২০০১ সালের ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ও সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে প্রায় ১৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে বিজয়ী হন চার দলীয় ঐক্যজোট মনোনীত জামায়াত দলীয় প্রার্থী মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন।
১৯৯১ সালের ৫ম ও ১৯৯৬ সালের ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন থেকে জামায়াত দলীয় প্রার্থী মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেনকে দু’বারই ৪০ হাজারের বেশি ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম।
জরুরী অবস্থায় গ্রেফতার হয়ে ১৬ মাস কারাভোগের পর জেল খেটে শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় বিগত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হন অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। এ আসন সম্পর্কে এ অঞ্চলের মানুষের সাথে এবং দু’টি উপজেলার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের কাছে একেবারেই অপরিচিত নতুন মুখ প্রবীণ কূটনীতিবিদ সাবেক রাষ্ট্রদূত ও বর্তমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে সারাদেশে আওয়ামী লীগের তথা মহাজোটের বিজয়ের ধারায় শরীক হন।
বিগত ৪ বছরে বর্তমান এমপি’র কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাজান আলী বলেন, ‘এখন তো সত্যি কথা বলা মহাপাপ। আমরা ভোটের সময় ভোটারদের কাছে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তার তেমন কিছুই বাস্তবায়ন করতে পারে নি। তা ছাড়া দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে ও সাধারণ মানুষের সাথে স্থানীয় এমপি’র যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকায় দল ও সরকারের ভাবমূর্তি দিন দিন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।’
একই উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক শাহাবুদ্দিন আহমেদ চুন্নু বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পরিবর্তন না হলে ভোট চাইতে যাওয়ার কর্মী পাওয়া যাবে না।’ এ সময় তিনি এমপিকে একজন গণবিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে উল্লেখ করেন।
তিনি আরও অভিযোগ করেন- যে ব্যক্তি সার্কিট হাউজে বসে অফিসিয়াল কায়দায় দল চালান তার পক্ষে আওয়ামী লীগের মতো এতো বড় দল চালানো সম্ভব না।
নিয়মনীতির মধ্যে তিনি এ আসনের উন্নয়ন কার্যক্রমকে অফিসিয়াল কায়দায় রাজনীতি পরিচালনায় কিছুটা সফল হলেও গত ৫ বছরে দু’টি উপজেলার আওয়ামী লীগের একাধিক বিভক্তি সংগঠনকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলেছে বলে স্থানীয় নেতা-কর্মীদের অভিমত।
স্থানীয় সরকার দলীয় এমপি অতিশয় ভদ্র ও রাজনীতির মাঠের সাথে একেবারেই অপরিচিত হওয়ার সুযোগে তার সাথে থাকা গুটিকয়েক সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগ নেতা এমপিকে ভ্রান্ত ধারণা দিয়ে ঝিকরগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাথে গত ৫ বছরে ব্যাপক দুরত্ব সৃষ্টি করে দিয়েছে। এমনটাই দাবি করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. মোস্তাফিজুর রহমান মুসা।
এদিকে, গত দু’বছর সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সুস্থ হয়ে ‘আমরাই মূলধারা’ সংগঠনের ব্যানারে জননেত্রী শেখ হাসিনার ভিশন-২১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রচারণা শুরু করেন। বর্তমান সরকারের বিভিন্ন সফলতা তুলে ধরে এ আসনের ত্যাগী ও তৃণমূল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে গণসংযোগ ও তাদের খোঁজ-খবর নিয়ে রাজনীতির মাঠে আবারও সরব হয়ে ওঠেন। এতে হতাশ নেতা-কর্মীদের মধ্যে প্রাণচঞ্চলতা ফিরে পেয়েছে বলে দলের একাধিক ত্যাগী নেতা-কর্মীদের অভিমত।
মহাজোটের শরীক দল জাসদের ঝিকরগাছা উপজেলা শাখার সভাপতি সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান রশিদুর রহমান রশিদ বলেন, ‘বর্তমান সরকারের সাথে থাকলেও আমাদের তেমন মূল্যায়ন করা হয় নি।’
তিনি বর্তমান এমপিকে একজন সৎলোক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘রাজনীতির মাঠে তাঁর মতো মানুষ এখন আর মানায় না।
এদিকে পাঁচ বছরে এমপি’র কার্যক্রম ও আগামী নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ঝিকরগাছা থানা বিএনপি’র সাবেক সভাপতি জালালউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সরকার দলীয় এমপি গত পাঁচ বছরে চোখে পড়ার মতো তেমন কোন কার্যক্রম করেন নি।’
এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘কপোতাক্ষ নদ খনন না করে খননের নামে এ এলাকার মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে।’
উপজেলা বিএনপি’র সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী টিপু বলেন, ‘বর্তমান সময়ে দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন ঘটে নি।’
তিনি নিজে আগামী নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট থেকে মনোনয়ন চাইবেন এবং এ জোট থেকে এ আসনে বিএনপি’র দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন পাওয়ার জোর দাবি জানাবেন বলেও জানান।
এদিকে, চৌগাছা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি জহুরুল ইসলামও উন্নয়নের বিষয়ে একই অভিযোগ করে বলেন, ‘আগামী নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোট থেকে তিনি একজন জোরালো মনোনয়ন প্রত্যাশী।’ তাকে এবার বিএনপি থেকেই জোটের মনোনয়ন দেয়া হবে বলে আশা করেন করছেন তিনি।
ঝিকরগাছা উপজেলা জামায়াতের আমীর মাও. আরশাদুল আলম বলেন, ‘তেমন কোন উন্নয়ন তো হয় নি। বরং উন্নয়ন হয়েছে এমপি’র কাছের লোকদের ভাগ্যের।’
উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি কমরেড আব্দুর রহিম বলেন, ‘উল্লেখযোগ্য কোন উন্নয়নই এ আমলে হয় নি। এমনকি এলাকাবাসীর প্রাণের দাবি কপোতাক্ষ নদ খনন না হওয়ায় আমরা হতাশ।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগামী সংসদ নির্বাচনে আমরা সকল বাম সমমনা দলগুলো এক প্লাটফর্মে এসে প্রার্থী দিব। এলাকার উন্নয়ন হয়নি এবং এমপি’র বিরুদ্ধে নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ বলেন, ‘এ আসনে যে সকল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড হয়েছে, ইতোমধ্যে আমি এসব উন্নয়নের উপর একটি বই বের করেছি। চাইলে উন্নয়নের তালিকা সমৃদ্ধ এ বইটি আপনাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে।’
তিনি তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে বলেন, ‘আশা করি বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবশেন করবেন। বর্তমান সরকার আমলে ঝিকরগাছা ও চৌগাছায় যে সকল উল্লেখযোগ্য উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে তাহলো- দুই উপজেলায় ৫টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওকরণ, ঝিকরগাছা হাসপাতালকে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে উন্নীতকরণ, ঝিকরগাছায় ৫টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন, দু’টি উপজেলায় ১৫টির মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নতুন ভবন নির্মাণ, কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ, ৭ কি:মি: নতুন পাকা রাস্তা ও ১০ কি:মি: কাঁচা রাস্তা, কিছু রাস্তায় মেরামত কাজ, উপজেলা অভ্যান্তরে সার্ভার স্টেশন নির্মাণ, টিআর-এর মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা, ধর্মীয়, সামজিক প্রতিষ্ঠানে উন্নয়ন, কাবিখার মাধ্যমে নতুন মাটির রাস্তা তৈরি ও পুরাতন রাস্তা মেরামতকরণ, নতুন বিদ্যুৎ সংযোগসহ বেশ কিছু উন্নয়মূলক কাজ।’
এ আসন থেকে আগামী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জোর মনোনয়ন প্রত্যাশী বর্তমান এমপি ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা ফারুক মোহাম্মদ, সাবেক প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান এস এম হাবিব, জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক ও ঝিকরগাছা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাড. মনিরুল ইসলাম, লায়ন শহিদুল ইসলাম ও দেওয়ান তৌহিদুর রহমান।
এছাড়া মাঝে মাঝে নতুন মুখ চৌগাছা উপজেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক আইনজীবী এবিএম আহসানুল হক মনোনয়ন প্রত্যাশায় গণসংযোগ করছেন এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. মোহাম্মাদ আলী রায়হান ও আওয়ামী লীগের টিকিট প্রাপ্তির আশায় লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
১৮ দলীয় জোট থেকে এবারও জামায়াত দলীয় প্রার্থী মুহাদ্দিস আবু সাঈদ মোহাম্মদ শাহাদাৎ হোসেন, দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এ্যাড. কাজী মুনিরুল হুদা, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি এ্যাড. মোহাম্মদ ইসহাক, ঝিকরগাছা উপজেলা বিএনপি’র প্রয়াত সভাপতি নাজমুল ইসলামের সহধর্মিণী সাবিরা নাজমুল মুন্নী, বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা এলাহী টিপু এবং চৌগাছা উপজেলা বিএনপি’র সভাপতি জহুরুল হক জোটের মনোনয়ন লাভের আশায় গণসংযোগ ও লবিং চালিয়ে যাচ্ছেন।
এছাড়া দু’টি উপজেলাতে জাতীয় পার্টি, জাসদ, ন্যাপ ভাষানী ও কমিউনিস্ট পার্টির দলীয় কার্যক্রম খুব একটা উল্লেখযোগ্যহারে না চললেও আসন্ন নির্বাচনের আগে এসব দলের কিছু ভুঁইফোঁড় নেতা এলাকায় জনসংযোগ করছেন।
তবে, শেষ পর্যন্ত জোটবদ্ধ নির্বাচন হলে এই আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ৩ থেকে ৪ জনে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আশা করছেন নির্বাচনী এলাকার মানুষ।