
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > আশার গুড়ে বালি নয়, স্বাদের গুড়ে চিনি ঢুকেছে
এই পৃষ্ঠাটি মোট 7565 বার পড়া হয়েছে
আশার গুড়ে বালি নয়, স্বাদের গুড়ে চিনি ঢুকেছে
‘বউ, গাছ কাটতি যাবো, ঠিলে ধুয়ে দে’ গানটি একসময় যশোর অঞ্চলের গ্রামগঞ্জে শীত মৌসুমে হরহামেশাই শোনা যেতো। আজ আর তেমনটি নেই। একই সঙ্গে চোখে পড়ে না পিঠে ঢুঙি বাঁধা গাছিকেও। হারিয়ে যেতে বসেছে ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ প্রবাদটিও।
আশার গুড়ে বালি নয়, স্বাদের গুড়ে চিনি ঢুকেছে। খটখটে কারখানার চিনি কেড়ে নিয়েছে খেজুরের রসের যশ। যশোর অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক খুশবুময় নলেন গুড়কে করে তুলেছে ঘ্রাণ ও স্বাদহীন। লালচে রঙের কথিত খেজুরের গুড় কিনে ঠকছে ক্রেতারা এবং ক্রমেই তারা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
যশোর অঞ্চলের খেজুরের গুড়ের রয়েছে শত বছরের ইতিহাস আর ঐতিহ্য। ঐতিহাসিক সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোর খুলনার ইতিহাস’ গ্রন্থসূত্রে জানা যায়, একসময় যশোর অঞ্চলের প্রধান কৃষিজ পণ্য ছিল খেজুরের গুড়। এই গুড়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল অর্থনৈতিক নানা কর্মকাণ্ড।
১৯০০-০১ সালে পুরো বঙ্গে খেজুরের গুড় উৎপাদিত হয়েছে ২১ লাখ ৮০ হাজার ৫৫০ মণ। এর মধ্যে কেবল যশোরেই উৎপাদিত হয়েছে ১৭ লাখ ৯ হাজার ৯৬০ মণ, যার দাম ছিল সেই আমলেই ১৫ লাখ টাকা। এই গুড় আমেরিকা-ইউরোপেও রপ্তানি হয়েছে। খেজুরগাছের জন্যই অষ্টাদশ শতাব্দীতে গ্রামগঞ্জে গুড় তৈরির হাজার হাজার কারখানা গড়ে ওঠে।
১৮৬১ সালে প্রথম চৌগাছার তাহিরপুরে কপোতাক্ষ নদের ধারে মি. নিউ হাউস খেজুরের রস দিয়ে চিনি উৎপাদনের যান্ত্রিক কারখানা গড়ে তোলে। এ কারখানায় উৎপাদিত চিনি ইউরোপে রপ্তানি হয়েছে। ১৮৮০ সালে কারখানাটি এমেন্ট অ্যান্ড কোম্পানি কিনে নেয়। ১৮৮৪ সা

পুরো বঙ্গে নলেন গুড়ের সন্দেশের ৯৯ শতাংশ যশোর থেকেই সরবরাহ করা হতো। উপমহাদেশের বিখ্যাত কলকাতার ভিমনাগের সন্দেশ তৈরি হয়েছে যশোরের নলেন গুড় দিয়েই। আজও যশোরের সব মিষ্টির দোকানে তৈরি হচ্ছে নলেন গুড়ের সন্দেশ। কিন্তু নলেন গুড়ের সেই ম-ম খুশবু আর পাওয়া যাচ্ছে না।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা যায়, খেজুরের গুড়ে মেশানো হচ্ছে চিনি। বর্তমানে এক কেজি নলেন পাটালি গুড় হাট-বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা দরে। আর চিনি মেশানো ভেজাল পাটালি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। তরল খেজুরের গুড় বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৮০ টাকা। এ সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা ৫০-৫৫ টাকা কেজি দরে চিনি কিনে খেজুরের রসের সঙ্গে মিশিয়ে ভেজাল খেজুরের গুড় তৈরি করছে। লালচে রঙের দেখতে এই গুড় বাড়িতে কয়েক দিন রেখে দিলে সাদা হয়ে যায়। এর ঘ্রাণ ও স্বাদ নেই বললেই চলে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ বাজারের গুড় ব্যবসায়ী মৃত্যুঞ্জয় কুণ্ডু বলেন, ‘আমরা গুড়ে চিনি মেশাই না। চাষীরা বাড়ি থেকেই চিনি মিশিয়ে আমাদের কাছে গুড় বিক্রি করে। ফলে আমাদের করার কিছু থাকে না।’
এদিকে, গত শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার নিমতলা বাসস্ট্যান্ডে চারটি নকল গুড় ও পাটালি তৈরির কারখানায় অভিযান চালায় ভ্রাম্যমাণ আদালত ও গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় দুই ব্যক্তিকে ৫০ হাজার ও ৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। তাছাড়া ওই চারটি কারখানা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভেঙে দেয়া হয়। অভিযানের সময় ১১৪ বস্তা চিনি, ৭০ মণ গুড়, ২৫ মণ চিটে গুড়, সোডিয়াম সাইক্লোমেট ও বিভিন্ন রং এর উপকরণ জব্দ করা হয়।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মানোয়ার হোসেন মোল্লা জানান, এ অঞ্চলের গুড়-পাটালির বেশ সুনাম আছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ীদের কারণে তা হারাতে বসেছে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান অব্যাহত রাখবো যাতে নকল গুড়-পাটালি তৈরি করতে না পারে।
ঝিনাইদহের সিভিল সার্জন ডা. আব্দুস সামাদ এ ব্যাপারে বলেন, ‘মিষ্টির মধ্যে মিষ্টি ভেজাল দেয়া হচ্ছে। ফলে গুড়ে চিনি মেশানোর বিষয়টি পরীক্ষায় ধরা পড়বে না। চিনি ও গুড় পৃথকভাবে নির্ণয় করা মুশকিল। এ অঞ্চলের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখার স্বার্থেই এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।’