
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > কত ভয়াবহ সাংস্কৃতিক পরাধীনতা : আমিরুল আলম খান
এই পৃষ্ঠাটি মোট 7634 বার পড়া হয়েছে
কত ভয়াবহ সাংস্কৃতিক পরাধীনতা : আমিরুল আলম খান
পরাধীন যুগে তো নয়ই, এমন কি, উত্তর-উপনিবেশিক কালেও ভাষা সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শোষণ সম্পর্কে স্বাধীন দেশের নাগরিকদের উপলব্ধি পর্যন্ত ঘটে নি। মাতৃভাষার প্রতি নিদারুণ অবহেলা এবং শব্দভাণ্ডার থেকে প্রতিনিয়ত দেশি শব্দের অবলুপ্তি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় উপলব্ধির অভাব কত ভয়ংকর!
আমার ব্যক্তিগত ধারণা, কেবলমাত্র গত তিন দশকে বাংলা শব্দভাণ্ডার থেকে অন্তত ১০ হাজার বহুল প্রচলিত শব্দ হারিয়ে গেছে যা এদেশের গতরখাটা মানুষ রোজকার কাজে ব্যবহার করত। আর সে স্থান দখল করেছে অপ্রয়োজনীয় ইংরেজি শব্দ। এই তালিকা এতই দীর্ঘ ও মর্মান্তিক যে, বাঙালি গতরখাটারাও এখন ‘মা’ ছেড়ে ‘মম’ ধরেছে। ‘পাঠশালা’ থেকে কবেই পালিয়ে ‘স্কুলে’ ঢুকেছে! শুধু হা-ভাতে কানা-খোঁড়ারা আঁকড়ে আছে ‘মাদ্রাসা’। ‘গুরু’ বা ‘উস্তাদ’ এখন ‘টিচার’। তার গায়ে ‘সাদা জামা’র চেয়ে ‘হোয়াইট শার্ট’ মানানসই। পকেটে ‘কলম’ গোজা নেই, আছে ‘পেন’, পায়ের ‘জুতো’ তার ‘সু’। ‘মোজা’ ভীষণ দুর্গন্ধ হয় বলে সে ‘সকস’ পরে। ‘ভাত’ না খেয়ে ‘রাইস’ খাচ্ছে দেদার। ‘ডিম’ নয়, তার নজর কাড়ে ‘এগ’। সে আবার ‘ভাজি’ খেতে রাজি নয়, খাবে ‘ফ্রাই’, ‘সিদ্ধ’ নয় ‘বয়েল্ড’। ‘মাছে-ভাতে’ বাঙালি এখন ‘ফিশ’ খায়। ‘মাংস’ ‘গোশত’ তার পেটে সয় না; তার রসনা ‘মিট’ চায়। তা কাবাব-কোপ্তা? একটু-আধটু আজও চলে। আরও ভাল ‘রোস্ট,‘চপ’। তাও আবার ‘চিকেন’, ‘মাটন’, বা ‘বিফ’; ভুলেও মুরগি-খাসি-গরু নয়।
সে এখন কাউকে দেখভাল করে না, ‘টেক কেয়ার’ করে। ‘দরখাস্তে’ তার দারুণ অরুচি, সে করে ‘এপ্লিকেশন’। কারো ‘সুপারিশ’ ‘তদবিরে’ তার ভীষণ ঘেন্না, চাই ‘রিকমেন্ডেশন’। ‘নালিশ’ করলে মান যায়, তাই ‘কমপ্লেন’ করে। ‘কেনাকোটা’ বড়ই সেকেলে, সে আধুনিক, তাই ‘শোপিং’ (তবে অধিকাংশ বাঙালি ‘শপিং’ ‘মার্কেটিং’-র পার্থক্য জানে না; তাই তারা কেনাকাটা বলতে বোঝে ‘মার্কেটিং’) করে। আগে টাকা ‘ভাঙাত’ এখন ‘চেঞ্জ’ করে। ‘থলে’ সওদা আনতে পারে না বলে সে ‘ব্যাগ’ ভরে। ‘ঝুড়ি’ বদখত, ‘বাস্কেট’ আহা! ‘নখ’ জান্তব মনে হয়, তার চেয়ে ‘নেইল’ কত সুন্দর! ‘হৃদয়’ বস্তুটি আদিখ্যেতা, ‘হার্ট’ আসল। ‘গানে’ মন ভরে না, ‘মিউজিক’ চাই। কোনো কিছুই ‘উপভোগ’ করার নেই, ‘এনজয়’ করতে পাগলপারা। ‘কথা’ বলতেও ঘেন্না লাগে, ‘টক’ করতে চারপায়ে খাড়া। না, ‘ঘুরাঘুরি’ একদম অপছন্দ, ‘জার্নি’ করে ‘টায়ার্ড’ হয়। ‘বিছানা’য় ঘুম হয় না, তাই ‘বেডে’ যায়। ‘ঘুম’টাও কি নচ্ছার! ‘গুড ড্রিম’ হয়ই না, ‘স্লিপিং পিল’ ছাড়া। সে এখন যত ‘ভোলে’ তার চেয়ে ‘ডিলার্ন’ করে বেশি। ইত্যাদি, ইত্যাদি এবং ইত্যাদি…।
এভাবে চলতে থাকলে, ভয় হয়, মাত্র এক শ’ বছর পর বাংলা ভাষা হয়ত যাদুঘরে ঠাঁই নেবে। আর তখন সে লুপ্ত ভাষার উপর ‘রিসার্চ’ করে এদেশ (এবং বিদেশও) ভরে উঠবে কত না ‘স্কলারে’!
(লেখক : শিক্ষাবিদ; সাবেক চেয়ারম্যান, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, যশোর)