
Home সাহিত্যিক / Litterateur > সুফি সাধক কবি জামসেদ শাহ্ চিশ্তী (১৯৫৬)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 2034 বার পড়া হয়েছে
সুফি সাধক কবি জামসেদ শাহ্ চিশ্তী (১৯৫৬)
সুফি সাধক কবি জামসেদ শাহ্ চিশ্তী
Sufi Sadhak Kabi Jamsed Shah Chistey

পারিবারিক জীবনঃ
১৯৫৬ সালের ১০ই মে জেলা-যশোর, উপজেলা-ঝিকরগাছা, ইউনিয়ন-নাভারন, ডাকঘর-গদখালী, গ্রাম-কালীয়ানির সাধারণ কৃষিজীবি পরিবারে মোঃ ওমর আলী মোড়ল ও মাতা মোছাঃ জামিলা খাতুনের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেন তিনি ।পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি সবার বড় । স্ত্রী মোছাঃ খাদিজা খাতুন –গৃহিণী, একমাত্র পুত্র সাইফ ইকবাল মাহমুদ পলাশ ও পুত্রবধূ শারমিন নাহার রিক্তা যথাক্রমে স্কয়ার ও জিস্কা ফার্মাসিউটিক্যালস এর রিসার্স এন্ড ডেভলপমেন্ট ল্যাবরেটরীতে কর্মরত আছেন ।
কবি জামশেদ শাহ্ শৈশব থেকেই দাদা মোঃ কুদরত উল্লাহ মোড়ল এবং একমাত্র চাচা মোঃ আবু তালেব মোড়লের পথ অনুসরণ করে বাউল ভক্ত হন । উপরোক্ত দু’জনই বাউল ভক্ত ছিলেন । শৈশবে এলাকায় যেখানেই বাউল, জারি, ভাব গান হতো সেখানেই তিনি হাজির হতেন ।
কৈশরে কবি যাত্রাদলে অভিনয়ের জন্য খ্যাতিলাভ করেন । এছাড়া সহচরদের সাথে নিয়ে ম্যাজিকের দল গঠন করেন । সন্ধ্যার পরে গ্রামবাসীদের নিয়ে নিয়মিত জমাতেন সাহিত্যপাঠ, পুথিপাঠের আসর ।
বিশিষ্ট অনুবাদক ও মুক্তিযোদ্ধা দাউদ হোসেন এর অতি প্রিয়ভাজন ছিলেন তিনি ।
শিক্ষাজীবনঃ
গ্রামের পাঠশালাতেই তিনি প্রাথমিক লেখাপড়া শুরু করেন । মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রারম্ভে ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় । ক্যাম্পে ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদবহন ও নানাবিধ সহযোগিতার মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেন । পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন ।তবে তিনদিন পর কাকতালীয় ভাবে প্রাণে বেঁচে পালাতে সক্ষম হন তিনি। স্বাধীনতার পর তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চতর শিক্ষার জন্য বি.এ. ভর্তি হন । শেষ বর্ষে থাকাবস্থায় কঠিন এক দূরারগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় অন্ধ ও মুমূর্ষ অবস্থায় উপনিত হওয়ার দরুন তিনি আর পরীক্ষা দিতে পারেননি । প্রায় তিন বছর পর সুস্থ হন তিনি। পরিবারের বড়ছেলে হওয়ায় সংসারের দায়িত্ব চাপ উপেক্ষা করে একাডেমিক লেখাপড়া আর এগিয়ে নিতে পারেননি । তবে তৎকালীন এল.এম.এফ ও ডি.এইস.এম.এস মেডিকেল কোর্স সম্পন্ন করেন ।
কর্মজীবনঃ
কর্মজীবনের শুরুতে কবি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা শুরু করেন, এরপর কিছুদিন মাদ্রাসাতে শিক্ষকতা করেছেন । তবে তিনি চিকিৎসাকেই প্রধান পেঁশা হিসাবে বেছে নেন । পল্লী চিকিৎসক হিসাবে এলাকায় তার অনেক সুখ্যাতি আছে ।
সাধক জীবনঃ
সংসারের চাপ কবির অন্তরের শক্তিকে বেঁধে রাখতে পারেনি । সুযোগ করে চলে গেছেন লালন শাহ্, খাজা খানজাহান আলী, হযরত শাহ্জালাল (রঃ) ও বিভিন্ন পীর ফকিরের দরবারে ।খুজে বেড়িয়েছেন নিজেকে ।অবশেষে একদিন যশোর গরীব শাঁইর মাজারে দেখা পান বোবা পাগল বেশে সাধনারত অবস্থায় পীর খাজা আব্দুল মান্নান শাঁই এর। খাজা মান্নান শাঁইজীর দরবার শরিয়তপুর জেলার, জাজিরা উপজেলার কঙ্গাপ্রসাদ গ্রামে । কবি জামসেদ শাহ্ উনার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং চিশতিয়া তরিকায় দাখিল হন । শুরু হয় তার সুফি সাথনা তথা আধ্যাতিক জীবন । সাধন জীবনে তিনি প্রভাবিত হয়েছেন বিশেষ করে সুফি দার্শনিক খাজা মনসুর আল হাল্লায (রঃ), হযরত মওলানা জালাল উদ্দীন রুমি (রঃ) এর দ্বারা । ব্যাপক পড়াশোনার ও গবেষণার মাধ্যামে নিজেকে করেছেন সম্মৃদ্ধ । নিজের বাড়িতে অজান্তেই গড়েছেন সম্মৃদ্ধ একটি লাইব্রেরী । যেখানে স্থান পেয়েছে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ইতিহাস, জোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সাহিত্য, কৃষি, বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ, সুফিতত্ত্ব প্রভৃতি ।দ্বীন প্রচার ও সাধন জীবনের চলার পথে সাক্ষাত পেয়েছেন অনেক মহাপ্রাণ, সহযোদ্ধা ও ভাবশিষ্যের । তার বহু ভাবশিষ্যদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মোঃ কিতাব আলী শাহ্, মোঃ আব্দুল আজিজ শাহ্, মোঃ আতর আলী শাহ্, পাগলা সুফিয়ান শাহ্, পাগলা শুকচাঁন শাহ্, ফকির তাহের শাহ্, মোঃ ইসমাইল শাহ্, জাহাঙ্গীর বয়াতি, আলতাফ বয়াতি প্রমুখ ।
কীর্তিঃ
কবির অর্জিত জ্ঞানের জ্যোতি প্রকাশ পেয়েছে তারই রচিত গীতিকবিতা তথা মারফতী গানের মাধ্যমে । এ পর্যন্ত তিনি ১০০০ এর অধিক মৌলিক গান রচনা করেছেন । যেগুলো ‘জামসেদ গীতি’ নামে পরিচিত । যা তার ভক্ত আশেকানরা বিভিন্ন আসরে পরিবেশন করেন । ১৯৯০ সালে তিনি তার নিজবাড়ির অদুরে গড়ে তুলেছেন আশ্রম ‘দারুস সালাম খানকাহ শরীফ’ । যেখানে তিনি তার ভাব শিষ্যদের ‘ইলমে তাসাউফ’ এর জ্ঞান প্রদান করেন । আশ্রমের আঙিনায় গড়ে উঠেছে ‘জামিলা-ওমর বিশ্ব শান্তি মঞ্চ’ । যার প্রতিষ্ঠাতা নাট্য সংগঠন বিবর্তন যশোরের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা সদস্য কবি ও নাট্যকার হাসান হাফিজুর রহমান । যিনি কবি জামসেদ শাহ্ এর সহোদর । এই মঞ্চেই প্রতি বছর ১৬ই আষাঢ় (কবির প্রকৃত জন্ম তারিখ) ও ৩০ এ ফাল্গুন (কবির সুফি খিলাফত এর তারিখ) রাতভর ভক্ত-আশেকান ও এলাকার মানুষ নিয়ে ঔরষ পালিত হয় । পরিবেশিত হয় জামসেদ গীতি, লালনগীত ও বিভিন্ন মারফতী গান ।
কবি নিজে প্রচারবিমুখ হলেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এর সর্বোচ্চ বাংলা সাহিত্য চর্চা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘বাংলা একাডেমী’ নিজ দায়িত্বে বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালাঃ যশোর পুস্তকে ‘বিখ্যাত সাহিত্যিক, গায়ক, শিল্পী ও কবিয়ালের সংক্ষিপ্ত পরিচয় এবং লোকসংগীত’ অনছেদে তাঁর জীবনী ও জামসেদ গীতির বেশ কিছু সংখ্যক পদ প্রকাশ করেছে। বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে কবি বাণী-
তুমি কোথায় আছ,
জ্ঞানের মহাজন,
এই সমাজের কু বাতাসে,
হয় না যেন জ্ঞান হরণ।
কুসংস্কার অপংস্কার,
এই সমাজের যত বিকার
দূর করে দাও হীন আচার
হউক পরিস্কার এই জীবন ।
সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র,
সবার উপর মানব তন্ত্র,
নিরীখ রেখ এহি মন্ত্র,
রবে না ভেদ বিভাজন ।
যত শত, আছে ধর্ম,
সবার মূলে কল্যাণ কর্ম ,
ফকির জামসেদ বলে, বোঝ মর্ম,
ওগো বিশ্বের জন্গণ।