
Home যশোর জেলা / Jessore District > চাঁচড়া রাজবংশ
এই পৃষ্ঠাটি মোট 18673 বার পড়া হয়েছে
চাঁচড়া রাজবংশ
চাঁচড়ার রাজ-বংশীয়রা বাৎস্য গোত্রীয় ‘সিংহ’ উপাধিধারী উওর রাঢ়ীয় কুলীন কায়স্থ। তারা মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত জেমো-কান্দী হতে এ অঞ্চলে আসেন। তাদের পূর্ব ইতিহাস গৌরবময়। জেমো ও কান্দীতে সিংহবংশীদের প্রধান স্থান ছিল। পাইকপাড়ার রাজাগণ কান্দীর সিংহবংশীয় এবং চাঁচড়ার রাজারা জেমোর সিংহবংশীয়।
ষোড়শ শতাব্দীর প্রথমভাগে মাধো বা মধাব সিংহ জেমোত বাস করতেন। কথিত আছে, তার কয়েক বিবাহ এবং পুত্র সংখ্যা ২৭। এর মধ্যে রাঘবরাম সিংহ একজন। রাঘবরামের দুই পুত্র- জ্যেষ্ঠ যজ্ঞেশ্বর ও কনিষ্ঠ ভবেশ্বর। সম্ভবত যজ্ঞেশ্বরের পূর্বনাম রত্নেশ্বর। যজ্ঞেশ্বর বিক্রমাদিত্যের রাজসরকারের আমীন দপ্তরে মুহুরীগিরি করতেন; পরে প্রতাপাদিত্যের সুনজর পেয়ে তার চাকরির উন্নতি হয়। তিনি শেষ পর্যন্ত প্রতাপের বিশ্বস্ত কর্মচারী ছিলেন।
টোডরমল্লের পর যখন খাঁ আজম বঙ্গের সুবাদার হয়ে আসেন (১৫৮২), তখন ভবেশর রায় বঙ্গীয় সেনা - বিভাগে কার্য করতেন। কথিত আছে- খাঁ আজমের সাথে প্রতাপাদিত্যের প্রথম সংঘর্ষ হয়। কোন হয়, তাহা জানা যায় না। ঐ সময়ে সম্ভবত বসিরহাটের কাছে সংগ্রামপুরে এ যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে ভবেশ্বর সিংহ বিশেষ বীরত্ব দেখিয়ে খাঁ আজমের মনস্তুটি করেছিলেন। তিনি যুদ্ধের পর প্রতাপের সঙ্গে সন্ধি করেন এবং পরে বহু বছর জীবিত ছিলেন। তবে বঙ্গের জলবায়ু সহ্য করতে না পেরে তিনি এক বছরের মধ্যে এ দেশ ত্যাগ করেন। প্রতাপাদিত্য যে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে রাজ্যবিস্তার করবেন এবং সর্বপ্রথম উওরদিকেই তার দৃষ্টি পড়বে তা তিনি আশঙ্কা করেছিলেন। এ কারণে তিনি প্রতাপের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য যশোর-রাজ্যের সীমান্তে কেশবপুরের উত্তরধারে ভবেশ্বর সিংহকে কিল্লাদার নিযুক্ত করেন এবং ব্যয় নির্বাহ করতে পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর, ইমাদপুর, মুড়াগাছা ও মল্লিকপুর এই চারটি পরগনার জমিদারী জায়গীর স্বরূপ দিয়ে বাদশাহের নিকট হতে পারে উহার সনন্দ এনে দেন (১৫৮৪)। এটাই চাঁচড়ার জমিদারীর ভিত্তি। তখন হতে ভবেশ্বরের মজুমদার উপাধি হয়। ঐ সময়ে ভবেশ্বর যেখানে এসে ছাঊনি করেন তার নাম হলো-ভবহাটি এবং যেখানে তিনি প্রথম বাস করেন তার নাম হলো- মুলগ্রাম। এই স্থান সৈদপুর পরগণার অন্তর্গত। এখানে তার গড়কাটা বাড়ির চিহৃ এখনও বিলুপ্ত হয়নি। চার বছর পরে এই স্থানে ভবেশ্বরের মৃত্যু হয়।
ভবেশ্বরের দুই পু্ত্র-মহতাবরাম বা মুকুট এবং বিনোদ সিংহ। পিতার মৃত্যুর পর মহতাবই কিল্লাদার হন। সুতরাং মজুমদার উপাধি ও জায়গীর তারই দখলে থাকে। বিনোদ জমিদারী পান না। তার বংশধরগণ নিকটবর্তী দেবিদাসপুরে ও পরে সুখ-পুকুরিয়ার ধারে খড়িঞ্চা স্থানে বাস করেন।
প্রতাপাদিত্যের সাথে মোগল-সংঘর্ষ ক্রমে ঘণীভুত হলে মহতাবরাম মুলগ্রাম ত্যগ করে ৮ মাইল উওরে খেদাপতি নামক স্থানে এসে এক বিস্তীর্ণ বাওড়ের কাছে গড়-বেষ্টিত বিশাল বাড়ী নির্মাণ করে বসবাস করেন। এখনও সেখানে রাজ বাড়ীর ভগ্নাবশের বিদ্যমান। তিনি ঊভয় পক্ষ ঠিক রেখে চলতেন। মহতাবরাম মোগলের জায়গীরদার হলেও প্রতাপের সাথে তার সম্প্রীতি ছিল এবং সম্প্রীতির মূল তাহার জ্যেষ্ঠতাত যজ্ঞেশ্বর। যজ্ঞেশ্বর এই স্থানেই প্রথমে শ্যামরায় বিগ্রহ এনে প্রতিষ্ঠা করেন। এই বিগ্রহের সেবার জন্য প্রতাপ বিস্তীর্ণ দেবোত্তর সম্পত্তি দিয়েছিলেন।
মানসিংহ যখন সৈন্য নিয়ে প্রতাপের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে আসেন, তখন মহতাবরাম তার অধিকাংশ সৈন্য সেখানে নিয়ে গিয়ে তাকে সাহায্য করেন। মোগলের কর্মচারী হিসেবে এটা তার কর্তব্য ছিল। ভবানন্দের মত তার কাঁধে বিশ্বাসঘাতকতার দোষ চাপাইবার কোন কারণ ছিল না। প্রতাপের সাথে সন্ধি করে যখন মানসিংহ ফিরে গেলেন, সম্ভবত : তখনই মহতাব রাজা উপাধি পান। বংশ-পরস্পরায় যেমন ধীরে ধীরে যশোর-রাজ্যের অধিকাংশ পরগণা মহতাবের বংশধরদিগের অধীনে চলে এসেছিল এবং নুরনগর রাজবংশের পতন হয়ে গেল। সেই সময় থেকে তারা যশোহরের রাজা” বলে কীর্তিত হলেন। প্রতাপের পতনের পর ১৬১০ খ্রীষ্টাব্দে যখন ইনায়েৎ খাঁ যশোহর রাজ্যের প্রথম ফৌজদার নিযুক্ত হলেন। তখন মহতাবরামের কিল্লাদার পদ আর থাকলো না এবং তার নিঙ্কর জায়গীরও বন্ধ হলো। তখন ইসলাম খাঁ মহতাবের জায়গীর প্রকৃতভাবে জমিদারীতে পরিণত করে দিয়ে তার রাজস্ব নির্ধারিত করে দিলেন। ৭ বছর এইভাবে রাজস্ব দিয়ে রাজত্ব করার পর মহতাব রায়ের মৃত্যু হয় (১৬১৯)। তিনি পৈতৃক ৪ পরগণার জমিদার ছিলেন। মহতাব রায়ের ৫ পুত্র যথা কন্দর্প, গোপীনাথ, মধুসূদন, শ্রীরাম ও রাজারাম এর কথা উল্লেখ আছে। এর মধ্যে কন্দর্প জ্যেষ্ঠ এবং তিনিই রাজ্যধিকারী হন। অন্য পুত্রদের সন্তান ছিল কিনা জানা যায় না। কন্দর্প রায় ১৬১৯ হতে ১৬৫৮ সাল পর্যন্ত ৩৯ বছর রাজত্ব করেন। তিনি পৈতৃক আমলের চার পরগণা ছাড়াও আর পাঁচটি পরগণা নুতন লাভ করেন- দাঁতিয়া ও ইসলামাবাদ (১৬৪৩), খলিসাখালি (১৬৪৭), বাগমারা ও সাহাজাতপুর। সুতরাং তার মোট জমিদারী ৯ পরগণা। কন্দর্প রায় বাঙ্গালার সুবাদার শাহসুজার সাথে সাক্ষাৎ ও উপহার প্রদান করে বর্দ্ধিত সম্পত্তির সনন্দ গ্রহণ করেন। সেই সময় হতে নিয়ম হয়েছিল যে, প্রত্যেক ক্ষুদ্র জমিদারকে পৃথকভাবে রাজস্ব দিতে হবে না। ঐ সকল জমিদারি নিকটবর্তী একজন প্রবল জমিদারের সমান করে দেওয়া হতো। রাজস্ব তার হাতে দিতে হতো এবং তিনি ঐ রাজস্ব নবাব সরকারকে দিতেন। অনেক সময় ক্ষুদ্র জমিদারগণের রাজস্ব বাকী পড়লে তিনি বাকী টাকার জন্য জমিদারী কোবলা নিয়ে নিজেই রাজস্ব সরবরাহ করতেন। এইভাবে অনেক জমিদারী প্রবল জমিদারের হাতে আসতো। কন্দর্পের পাঁচ পরগণাও এইভাব অর্জিত হয়।


কন্দর্প রায় শেষ বয়সে চাঁচড়া রাজবাটীতে কারুকার্যযুক্ত সুন্দর বাঙ্গালা মন্দির নির্মাণ করে সেখানে তার ইষ্ট- দেবতা শ্যামরায় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং জীবনের অবশিষ্টকাল ধর্মসাধনায় কাটিয়ে দেন।
এখনও শ্যামরায় বিগ্রহ আছে, কিন্তু সে সুন্দর জোড় বাঙ্গালা নেই। বাড়িতে পুর্ব পোতার একটি আধুনিক মন্দিরে তার পুজা হয়। চাঁচড়া রাজবংশের অনেক জমিদারী হস্তচুত হয়েছে, কিন্ত প্রতাপাদিত্যের প্রদত্ত শ্যামরায়ের দেবোত্তর এখনও আছে এবং সিদ্ধ নিষ্কর স্বরূপ গভর্ণমেন্ট কর্তৃক স্বীকৃত হয়েছে। আজ চাঁচড়া রাজবংশের হীনদশা হলে কি হয়, শ্যামরায়ের সেবা রাজোচিত ভাবেই চলছে। যজ্ঞেশ্বর এবং তার পুত্র ও পৌত্র চাঁচড়াতে বাস করেন। তাদের বসত বাড়ির ভিটা এখনও আছে। যজ্ঞেশ্বরের প্রপৌত্র গোবিন্দ রায় চাঁচড়া ত্যাগ করে লাউড়ী গ্রামে এবং তারপুত্র রামেশ্বর সাঁড়াপোলে এসে বাস করেন। যজ্ঞেশ্বরের বংশধরেরা এখন সাঁড়াপোল, খড়িঞ্চি, মন্ডলগাতি ও রূপদিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে বাস করছেন।
রাজা কন্দর্প রায়ের মৃত্

চিএ
১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে নবাব সায়েস্তা খাঁ পর্তুগীজ ও মগ দস্যুদেরকে পর্য্যুদস্ত ও উৎখাত করে দেশে শান্তি এনেছিলেন। তিনি দ্বিতীয় বার ১৬৭৯ আব্দে ঢাকায় এসে পুনরায় ১০ বছরযাবৎ নির্বিবাদে শাসন করেন। সে সময় দস্যুদুর্বৃত্ত কেউ মাথা উঁচু করেনি। শিল্প-সা


‘শাকে নাগ-শশাঙ্কর্ত্তুস্মরে প্রাসাদ উত্তমঃ।
শ্রীমনোহর রায়েন নিরমায়ি পিণাকিনে।।
শুভমস্তু শকাব্দা ১৬১৮।’
এই সময়ে মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায় প্রবল পরাক্রান্ত হয়ে উঠেন। যশোহর জেলাকে তখন তিনটি ভাগ ধরা যায়: দক্ষিণে চাঁচড়া রাজ্য, পশ্চিমে মামুদশাহী বা নলডাঙ্গা রাজ্য, উত্তর ও পূর্বে ভূষণা রাজ্য। ভৈরব নদের উত্তরাংশ প্রায় সকলেই তিনি দখল করে নেন। সেদিকে মনোহরেরও জমিদারী ছিল; সীতারাম তার রাজস্বের দাবি করেন; চতুর মনোহর রায় উদীয়মান সীতারামের সাথে সদ্ভাব স্থাপন করেন এবং তার কন্যার বিবাহে সীতারামকে নিমন্ত্রণ করেন। উভয়েই উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থ। ঐ সময়ে সীতারাম রাজ্যজয় কাজে অনত্র ছিলেন এবং দুইমাস পরে নি


রাজা কৃষ্ণরামরে মৃত্যুর পর তৎপুএ শুকদের রায় রাজা হন (১৭২৯)। তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামজীবন নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। শুকদেব দুই বৎসর মাত্র ষোল আনা সম্পত্তি ভোগকরেন, পেও উহার বিভাগ হয়। মনোহর রাযের বিধাব রাণী তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি




উভয় আদেশ সাতিশয় সত্বরতার সহিত প্রতিপালিত হইল। বাঘুটিয়ার কাছে বর্তমান অভয়ানগরে হরিরামের নিজের বা

প্রধান সৌন্দর্য এবং দেব-বিগ্রহই ছিল তাহার প্রধান সম্পদ। ধুলগ্রামের বাটীতে নদীতীরে সারি সারি দ্বাদশটি শিবমন্দির এবং অভয়ানগরে নদীর অদূরে এক প্রাঙ্গণের চারিধার বেষ্টন করিয়া একাদশটি শিব-মন্দির নির্মিত হইল। দেওয়ানের বাটী বলিয়া মন্দিরের সংখ্যা একটি কম। ধুলগ্রামের বাটীটি পাকা ও সুদৃঢ় প্রাচীরে বেষ্টিত; উহার সুন্দর তোরণ দ্বার এখন ও বর্তমান আছে। অভয়াদগরের বাটীটির কাঁচা গাঁথুনি ছিল এবং উহা তেমন উচ্চ বা দৃঢ় প্রাচীরে বেষ্টিত ছিল না। উভয় বাটীই পরিখা-বেষ্টিত; একদিকে ভৈরব নদ ও অন্য তিন দিকে গড়খাই ছিল, এখনও তাহার খাত আছে। বাটী নির্মাণের শেষ সময়ে রাজা আসিয়া উবয় বাটী পরিদর্শন করিলেন এবং বলিয়া গেলেন যে, রাজাদিগের অস্থায়ী নিবাস তেমন ভাল হইবার প্রয়োজন নাই,অতএব দেওয়ান যেন ধুলগ্রামের বাটীতে স্থায়ীভাবে বসতি করেন এবং রাজাদিগের জন্য অভয়ানগরের বাটীই যথেষ্ট হইবে। দেশসুদ্ধ লোকে আশ্রিতপালক রাজা বাহাদুরের উদারতা দেখিয়া মোহিত হইল। ১৯ বঙ্গের সেই ভীষণ বিপ্লব ও বিদ্রোহের যুগে কোন প্রকারে আত্নরক্ষা করিয়া নীলকন্ঠ ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করিলেন। তাঁহার মৃত্যুর পর রাজা শ্রীকন্ঠ রায় পৈতৃক রাজ্যের অধিকারী হইলেন। ইংরেজ রাজত্বে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় তিনিই যশোহর জেলার প্রায় এক-চতুর্থাংশের প্রধান জমিদার বলিয়া স্বীকৃত হন। আবার অল্পদিন মধ্যে তাঁহারই সময়ে সে জমিদারী বিলীন হইয়া যায়। এ দুরবস্থার কারণ কি, তাহাই আমরা সংক্ষেপে বিচার করিয়া লইব।
শুকদেব রায়ের সময় হইতে জমিদারীর আয়

এমন সময় লর্ড কর্ণওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তিত হইল। উহাতে পুরাতন ভূম্যধিকারীর জমিদারী থাকুক বা না থাকুক, সে বিষয়ের কোন কথা নাই; রাজস্ব সংগ্রহের দিকেই প্রখর দৃষ্টি পড়িল্। নব বিধানে নির্দিষ্ট দিনে কিস্তী মত খাজনা আদায় না করিলেই জমিদারী নীলামে উঠিতে লাগিল; এই ভাবে শ্রকিন্ঠ রাযের সম্পত্তি মধ্যে পরগনার পর পরগনা বিক্রীত হইয়া গেল। ১৭৯৬ অব্দে রাজস্ব বিভাগ হইতে মলই পরগনা বিক্রয় করিয়া বাকী ওয়াশীল করা হইল। দেনার দায়ে আদালত হইতে রসুলপুর পরগনা নীলাম হইল। পর বৎসর রাঙ্গদিয়া, রামচন্দ্রপুর, চেঙ্গুটিয়া, ইমাদপুর প্রভৃতি পরগণাগুলি বাকি খাজনার নীলামে, সৈদপুর এবং ইশফপুরের কতকাংশ দেনার বিক্রিতে এবং অবশেষে সাহস পরগনা খোস কোবালায় বিক্রীত হইয়া গেল। তখন রাজা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া আত্মরক্ষার জন্য সদসৎ নানা উপায় অবলম্বন করিতে লাগিলেন! তিনি ও তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোপীকণ্ঠ বা গোপীনাথ নিজেরা অবশিষ্ট কতক সম্পত্তি বাটোয়ারা করিয়া লইলেন এবং একজনের কোন অংশ বন্ধকসুত্রে বিক্রয়ের পথে উঠিলে, অন্য ভ্রাতা সরিকরূপে দাঁড়াইয়া নীলাম রদ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন। কতকগুলি তালুক সৃষ্টি করিয়া তাহা বন্দোবস্ত করিয়া কিছু টাকা পাইলেন এবং পরে দখল না দিয়া শেষে বাকী খাজনায় উহা বিক্রয় করিয়া লইতে লাগিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময় গভর্ণমেন্ট অনেকগুলি বৃত্তি ও চাকরাণ মহল বাজোয়াপ্ত করেন; উহার জন্য গভর্ণমেন্টের নামে আদালতে নালিশ করিয়া পরাজিত হইলেন,আর লাভের মধ্যে যথোচিত অর্থদণ্ড হইল। কিন্তু মোট কথা, কোন উপায়ে কিছু রক্ষা হইল না; ১৭৯৮-৯ অব্দে সব সম্পত্তি নানা ভাবে হস্তচ্যুত হইয়া গেল। এমন সময়ে রাজা শ্রীকণ্ঠ একটি নাবালক পুত্র ও বিধবা রাখিয়া দেহত্যগ করিলেন (১৮০২)।
তখন কোম্পানী বাহাদুর কালেক্টর সাহেবের অনুরোধে রাজপরিবারের জন্য মাসিক ২০০,টাকা বৃত্তি মজুর করিলেন। ১৮০৭ অব্দে রাণীর মৃত্যুর পর ঐ বৃত্তি ১৮৬ হইল। সে সময় ও নিঃসন্তান গোপীনাথ ভ্রাতুষ্পুত্র বাণীকণ্ঠের অভিভাবক স্বরূপ বিষয়ের তত্ত্বাবধান করিতেন। পরবৎসর সুপ্রীমকোর্টের মোকদ্দমার ফলে সৈদপুর পরগণার নীলাম রদ হওয়ায় বাণীকন্ঠ জমিদার বলিয়া গণ্য হইলেন এবং সরকারী বৃত্তি বন্ধ হইল। কয়েক বৎসর পরে বিলাত পর্যন্ত আপীল করিয়া ইমাদপুর পরগণার উদ্ধার হইল। গেপীনাথ মৃত্যুর পূর্বে তাহার সকল স্বত্ব ভ্রাতুষ্পুত্রকে লিখিয়া দিয়া যান। ১৮১৭ অব্দে তিন বৎসরের নাবালক পুত্র বরদাকন্ঠকে রাখিয়া রাজা বাণীকষ্ঠ অকালে মৃত্যুমুখে পতিত হন। এই সময়ে সদাশয় টুকার সাহেব (Mr. C. Tucker) যশোহরের কালেক্টর। তিনি চাঁচ্ড়া রাজবংশের দুরবস্থা দেখিয়া বাস্তবিকই মর্মব্যথিত হন এবং উহার কারণ নির্দেশ করিতে গিয়া গভর্ণমেণ্টর শাসননীতির উপর কটাক্ষ করিতে ও ছাড়েন নাই।
যাহা হউক তাঁহারই চেষ্টার ফলে চাঁচ্ড়া জমিদারী কোট-অব-ওয়ার্ডসের হস্তে যায় এবং রাজপরিবারের বার্ষিক খরচের জন্য ৬,০০০,টাকা রাখিয়া অবশিষ্ট লভ্য হইতে দেনা শোধ ও জমিদারীর উন্নতিসাধনের সুব্যবস্থা হয় (১৮১৮)। কয়েক বৎসর পরে ১৮২৩ খ্রীষ্টাব্দে আমরা দেখিতে পাই গভর্ণর জেনারেল বাহাদুরের আদেশে ১৮১৯ অব্দের নববিধানানুসারে বে-অইনী নিলাম প্রমাণিত হওয়ায সাহস পরগণার কতকাংশ রাজাকে প্রত্যর্পিত হয়। তদবধি পরগণা ইমাদপুর এবং সৈদপুর ও সাহসের কতকাংশ চাঁচ্ড়া রাজের প্রধান সম্পত্তি রহিয়াছে। ১৮৩৪ অব্দে রাজা বরদাকন্ঠ বয়ঃপ্রাপ্ত হইয়া জমিদারী নিজ হস্তে গ্রহণ করেন এবং ৪৬ বৎসর কাল নিরুদ্বেগে সুশাসন করিয়া ১৮৮০ অব্দে পরলোক গমন করেন। রাজা বরদাকন্ঠ সিপাহী-বিদ্রোহের সময় হস্তী ও নানাবিধ যানবাহনের সাহায্য দ্বারা রাজভক্তির পরিচয় দিয়া এবং বিভিন্ন সময়ে স্কুল, হাসপাতাল প্রভৃতি সরকারী সদনুষ্ঠানের সাহায্যকল্পে জমি ও অর্থ দান করিয়া গভর্ণমেন্টের নিকট হইতে উচ্চ প্রশংসার সঙ্গে ঢাল তরবারি খেলাত এবং রাজা বাহাদুর’ উপাধি লাভ করেন (১৮৬৫)।
রাজা বাহাদুরের মৃত্যুর পর তৎপুত্র রাজা জ্ঞানদাকন্ঠ উত্তরাধিকারী হন। তিনি নিজে নিঃসন্তান। কিন্তু তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা কুমার মানদাকণ্ঠের চারি পুত্র ছিল: কুমার সতীশকণ্ঠ,যতীশকণ্ঠ, ক্ষিতীশকণ্ঠ এবং নৃপতীমকণ্ঠ। রাজা জ্ঞানদাকন্ঠ তাঁহার জীবদ্দশায তৃতীয় ভ্রাতুষ্পুত্র কুমার ক্ষিতীশকণ্ঠকে দত্তক পুত্র লন। রাজার মৃত্যুর পর ক্ষিতিশকণ্ঠই জমিদারীর অর্দ্ধাংশের মালিক হন এবং অপরার্দ্ধ তাঁহার অন্য তিন ভ্রাতার মধ্যে বিভক্তি হয়। এক্ষণে মাত্র জ্যেষ্ঠ রাজকুমার সতীশকন্ঠ জীবিত আছেন। ইনি কৃতবিদ্য, সদাশয় এবং সকল সদনুষ্ঠানে উৎসাহশীল। তবে তিনিও বৎসরের অধিকাংশ সময় স্থানান্তরে বাস করেন বলিয়া চাঁচ্ড়ার রাজবাঢী শ্রীভ্রষ্ট হইবার উপক্রম হইয়াছে।
দশমহাবিদ্যাঃ দুর্গানন্দ ব্রক্ষচারীই চাঁচ্ড়ার দশমহাবিদ্যাবাঢীর মন্দির ও বিগ্রহ সমূহের প্রতিষ্ঠাতা। চাঁচ্ড়া গ্রামেই রাঢ়ীয় ব্রাক্ষণ ভরদ্বাজগোত্রীয় দুর্গারাম মুখোপাধ্যায়ের নিবাস ছিল, ব্রক্ষচারি হইলে তাহার নাম হয় দুর্গানন্দ। তিনি শিশুকাল হইতে ধর্মপ্রবণ ছিলেন; প্রবীন বয়সে ব্রক্ষচারীর বেশে ভারতবর্ষের বহু তীর্থ ভ্রমন করেন। কিন্তু কোথাও দেবী ভগবতীর দশবিধ মহামূর্তির একত্র সমাবেশ দেখিতে পান না।২৪ তাই তাঁহার প্রানের এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা হয়, তাঁহার জীবনে এই সকল মহাবিদ্যার মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়া যাইবেন। করুণাময়ীর কৃপাকটাক্ষে তাহার সাধুসংকল্প সিদ্ধ হইয়াছিল। কথিত আছে, স্বপ্নদেশের বলে তিনি এই প্রস্তাব লইয়া মুর্শিদাবাদের নবাব সুজাউদ্দীন এবং চাঁচ্ড়ার রাজা শুকদেবের অনুগ্রহ লাভ করেন। একে শুকদেব ধর্মনিষ্ঠ সদাশয় হিন্দু নৃপতি, তাহাতে নবাবের ইঙ্গিত, সুতরাং তিনি প্রতিষ্ঠার যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করিতে প্রতিশ্রুত হইলেন। ব্রক্ষচরী উপযুক্ত সূত্রধর সংগ্রহ করিয়া
নিজ বাঢীর এক প্রকান্ড নিম্ব বৃক্ষের খন্ড কাষ্ঠ হইতে বিগ্রহগুলি প্রস্তুত করাইলেন।
দশমহাবিদ্যার দশটি মাত্র বিগ্রহ নহে, মূর্তির সংখ্যা তদপেক্ষা অধিক। উত্তরের পোতার প্রধান মন্দিরে পুর্বদিক হইতে আরাম্ব করিয়া যথক্রিমে এই ষোলটি বিগ্রহ আছেন : গনেশ, সরস্বতী, কমলা, অন্নপূর্ণা, ভুবনেশ্বরী, জগদ্বাত্রী, ষোড়শী, মহাদেব, কালী, তারা, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, ধূমাবতী, বগলা ও মাতঙ্গী এবং ভৈরব। পশ্চিমের মন্দিরে কৃষ্ণ রাধিকা, রাম, সীতা, লক্ষ্ণণ, হনুমান,এবং শীতলা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত হইলেন। পূর্ব পোতায় ভোগগৃহ এবং দক্ষিণে নহবৎখানা নির্মিত হইল; নহবৎখানার নিম্ন দিয়া মন্দিরপ্রাঙ্গণে যাইবার সদর দ্বার। বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে সেবার ব্যবস্থাও হইল। শুকদেব ও শ্যামসুন্দর উভয়ে স্বীকৃত হইলেন যে, প্রত্যেকের অধিকারভুক্ত জমিদারীতে প্রত্যেক প্রজার নিকট হইতে বার্ষিক একসের চাউল ও ৫ গন্ডা কড়ি হিসেবে আদায় করিয়া লইয়া দশমহাবিদ্যার সেবার জন্য দেওয়া হইবে। শ্যামসুন্দর ও তাঁহার পুত্রের মৃত্যুর পর চারি আনি অংশ মীর্জা সালাহ্-উদ্দীনের হস্তে গেলে, তিনিও অধিকদিন জীবিত ছিলেন না। তৎপত্নী্ম মন্নুজান্ খানম্ সম্পত্তির অধিকারিণী হইলে, ১১৭৭ সালে তিনিও উক্ত প্রস্তাবে সম্মত হন। চারি আনি অংশের দেয় বৃত্তি বার্ষিক ৩৫১ টাকা স্থির হয়; উহা ১২৪২ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ৬৫ বৎসর কাল রীতিমত পাওয়া গিয়াছিল। তৎপরে হুগলীর মোতউল্যার প্রস্তাবে উক্ত বৃত্তি গভর্ণমেন্টের রাজস্ব বিভাগ হইতে নামঞ্জুর হয়।২৫ রাজা শ্রীকন্ঠ রায়ের রাজত্বকালে ১১৮৮ সালে (১৭৮২ খ্রীঃ) তিনি চাউল পয়সা বৃত্তির বদলে ৬০০০ বিঘা জমির দেবোত্তর সনন্দ লিখিয়া দেন। কিন্তু চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পর সে দেবোত্তর সম্পত্তি গভর্ণমেন্ট কর্তৃক বাজেয়াপ্ত হয়।
দুর্গানন্দের মৃত্যুর পর তৎপুত্র যশোমন্ত এবং পরে যশোমন্তের দুই পুত্র হরিশ্চন্দ্র ও কৈলাসচন্দ্র ক্রমান্বয়ে সেবায়ৎ হন। কৈলাসচন্দ্রের সময়ে দেবোত্তর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হইল, তিনি গভর্ণমেন্টের নিকট ঐ বৃত্তিমহল খারিজা তালুক স্বরূপ বন্দোবস্ত করিয়া লন। কিছু দিন পরে তাহাও বাকী খাজনায় নীলাম হইয়া গেলে, অর্দ্ধাংশ চাঁচ্ড়ার রাজা এবং অপরাদ্ধৃ নরেন্দ্রপুরের ব্রাক্ষণ জমিদার মহিমচন্দ্র মজুমদার খরিদ করেন। তদবধি তাঁহারা সেবার জন্য কিছু কিছু মাসিক বৃত্তি দিতেন।
মহিমচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁহার বৃত্তি বন্ধ হইয়াছে, এখন চাঁচ্ড়া রাজ সরকার হইতে সামান্য কিছু পাওয়া যায়।২৬ কৈলাস ব্রক্ষচারী নিঃসন্তান; তাহার জীবদ্দশায় তাঁহার একমাত্র ভ্রাতুষ্পত্র শশিভূষনের মৃত্যু ঘটিলে, কৈলাসচন্দ্র শেষ বয়সে যাবতীয় সম্পত্তি স্বীয় গুরুদেব চন্দনীমহল-নিবাসী যজ্ঞেশ্বর ভট্রাচার্য মহোদয়কে লিখিয়া দেন। ভট্রাচার্য মহাশয় এক্ষণে পরলোকগত। তাহার ব্রাতারা এক্ষণে দশমহাবিদ্যার সেবায়ৎ আছেন। এখন নিষ্কর সম্পত্তি ও লোন আফিসের গচ্ছিত টাকার সুদ বাবদ মোট বার্ষিক ৫/৬ শত টাকা আয় আছে; উহা এবং সমাগত পুজার্থিগণের নিকট হইতে যাহা পাওয়া যায়, তদ্বারা কষ্টে বিগ্রহগণের সেবা ও অতিথি সৎকার চলিতেছে।
দুর্গোৎসবের সময় দশমহাবিদ্যার বাড়িতে এবং চাঁচ্ড়ার রাজবাটীতে চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিপদাদি কল্পারম্ভ করিয়া সপ্তশতী চন্ডীত্ত যেমন পঠিত হয়, কবিকঙ্কণকৃত চন্ডী পূঁথিত্ত তেমনি পাঠ করা হইয়া থাকে । এইজন্য রাজা শ্রীকণ্ঠ রায়ের সময়ে কবিকঙ্কণ চণ্ডীর যে পূথি লিখিত হইয়াছিল, উহা এখনও দশমহাবিদ্যার বাড়িতে আছে। পুথিখানি ১১৮৪ সালের ১৮ বৈশাখ লিখিত হয়। আর একখানি পূথি সেখানে আছে, উহার নাম শীতলা-মঙ্গল। উহা পরগণে ইমাদপুরের অন্তর্গত আম্দাবাদ নিবাসী রামেশ্বও ঘোষ বিশ্বাস কর্তক কবিতাকারে রচিত। উহা পরগণে ইমাদপুরের অন্তর্গত আম্দাবাদ নিবাসী রামেশ্বর ঘোস বিশ্বাস কর্তৃক কবিতাকারে রচিত। উহার শেষ ভাগে আছে;
‘বাণ বসু রস ইন্দু শক পরিমিত
হেনই সময় হৈল শীতলার গীত,
অর্থাৎ ১৬৮৫ শক বা ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দে এই পুস্তক রচিত হয়। এ পূথিখানি এখনও মুদ্রিত হয় নাই।
অভয়ানগরঃ এই স্থানটি অভয়ানাম্নী বিধবা রাজকন্যার সম্পত্তিভুক্ত করিয়া দেওয়া হয় বলিয়া ইহার নাম অভয়ানগর। কথিত আছে, এখানকার একাদশটি শিবলিঙ্গের প্রত্যেকের নামে ১২০০ বিঘা নিষ্কর দেওয়া হয়। প্রতিদিন দেবসেবায় যাহা ভোজ্য উৎসষ্ট হইত, উহা পূজান্তে সিধা ভাগ করিয়া গ্রামস্থ প্রত্যেক ব্রাহ্মণ বাটীতে রীতিমত পেরিত হইত এবং তদ্বারা প্রায় ৩০ ঘর ব্রাহ্মণ পরিবারের সংসার নির্বাহ হইত। এখনও অভয়ানগরে সে সকল ব্রহ্মণ বাস করিতেছেন, কিন্ত নৈবেদ্র আর পান না। অভয়ানগরের রাজবাটী ভাঙ্গিয়া পড়িয়া বিলুপ্তপ্রায় হইয়াছে। কিন্তু মন্দিরগুলি এখনও খাড়া আছে। ঐ প্রাঙ্গণে উত্তরের পোতার মন্দিরটি সর্বাপেক্ষা বড়, তন্মধ্যে যে প্রকাণ্ড শিবলিঙ্গ ছিল, তাহার ভগ্নাংশগুলি এখনও আছে। পূর্ব পশ্চিমে প্রত্যেক দিকে সারি সারি চারিটি ও সদর তোরণের দুই পার্শ্বে দুইটি- এই মোট একাদশটি মন্দির। অনেকগুলির মধ্যে শিবলিঙ্গ এখনও বর্তমান; এবং ২/৩টির নিত্য পূজা হওয়ার কথা, ব্যবস্থাও আছে, কিন্তু কার্যত নিত্যপূজা হয় না; বৃত্তির টাকা রাজসরকারে খরচ লেখা পড়ে এবং এখানকার বৃত্তিভুকগণ ফাঁকি দিয়া খায়। রাজসরকার হইতে এদিকে দৃষ্টি নাই। আহা হউক,মন্দিরগুলি বেশ দৃঢ় এবং বড় মন্দিরটি বড় সুন্দর; এমন কারুকার্যখচিত সুন্দর মন্দির নিকটবতী স্থানে আর নাই। মন্দিরটি বাহিরের মাপ ২৪'-৪" x ২২'-৩"; ভিত্তি ৩'-৪"; সন্মুখে সাধারণ পদ্ধতিমত তিনটি খিলানের পশ্চতে একটি ৪'-৭" বিস্তৃত খেলা বারান্দা এবং ভিতরে গভমন্দির, দুই পাশ্বে ৩'-১০" বিস্তৃত আর্বত বারান্দার আছে। এই মন্দিরগুলির চতুষ্পার্শ্ব দিয়া প্রাচীর বেষ্টিত ছিল, উহার ভগ্নাবশেষ আছে প্রাচীরের বাহিরে পশ্চিমোত্তর কোণে বিস্তীর্ণ পুকুর ছিল এবং পুকুরের দক্ষিণে অনেক দুর লইয়া রাজবাটীর ভগ্নাবশেষ কতকগুলি বরজ ও বাগানের মধ্যে বিলুপ্ত হইবার মত হইয়াছে। এখনও অনেক স্থানে স্তু্তুপাকার ইট আছে, আরও অনেক ইট গ্রামবসীরা কিনিয়া লইয়া নিজ বাটীতে গৃহ নির্মান করিয়াছেন।
ধুলগ্রামে দেওয়ানের বাটীঃ নদীকূলে দ্বাদশটি শিবমন্দির ও উহার মধ্যস্থানে সদর দ্বার ও বাঁধা ঘাট ছির। প্রাঙ্গণে প্রবেশ করিলে উত্তরের পোতায় কাঁলিমন্দির ও দক্ষিণে নহবৎখানা ছিল।১৭ ঐ প্রাঙ্গণেরই পুর্ব পোতায় পুর্বদ্বারী জোড় বাঙ্গালায় গোপীনাথ ও রাধিকা বিগ্রহ ছিলেন। এই মন্দিরে মাএ সন্মুখের একটি দীর্ঘ ও প্রস্থ দেওয়াল আছে, উহার পশ্চাতের সমস্ত অংশ,কালীমন্দির ও দ্বাদশটি শিবমন্দির সব নদীগর্ভে নিমজ্জিত হইয়া বিনষ্ট হইয়াছে। গোপীনাথের জোড়বাঙ্গালার প্রাঙ্গণে উত্তরদিকে একটি গৃহে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা বিগ্রহ ছিলেন, কিত্ত সে গৃহ এক্ষণে নাই। সেই দিকে একখানি খড়ের ঘরে কালীমূর্তির পূজা হইতেছে। ঐ প্রাঙ্গণের দক্ষিণদিকে দোলমঞ্চ এবং একটি প্রাচীন তমালবৃক্ষ এখন ও বতমান আছে;
পুর্বপোতার বড় মদিরে রাম সীতার ও হনুমান বিগ্রহ ছিলেন। এই বড় মন্দিরটিই এক্ষণে বিদ্যমান আছে এবং তাহারই ভিতর গোপীনাথ ও রাধিকা, এবং জগন্নাথ, সুভদ্রা, বলরাম ও অনেকগুলি শালগ্রাম নিত্য পূজিত হন। এই মন্দিরের বাহিরের মাপ ২৩’-৬দ্ x ২১’-৪”; সন্মুখে তিনটি খিলানের পশ্চাতে ১১’-৬” x ৪’-১” পরিমিত একটি খোলা-বারান্দা আছে। গর্ভমন্দিরের সন্মুখের দেওয়ালে ইষ্টকে বহু কারুকার্য ও জীবজনত্তর ছবি আছে। উহা হইতে তাৎকালিক অবস্থার ইঙ্গিত পাওয়া যায়।২৮ গোপীনাথের জোড়-বাঙ্গালার যে দেওয়াল এখনও দাঁড়াইয়া আছে, তাহাতে নিম্নলিখিত ইষ্টক-লিপি আছে :
‘ক্ষিতি মুনি রস চন্দ্রে শাকবর্ষেহতিভাগ্যাৎ
হরিহর-পদযুগ্মং শ্রীযতুং স প্রণম্য।
বৃষগত দিননাথ মিত্র-বংশোদ্ভবোহন্ধো
রচয়তি হরিরামো গোপিকানাথমঞ্চম । । শকাব্দা ১৬৭১/১১/২৩’
ক্ষিতি=১,মুনি=৭,রস=৬,চন্দ্র=১;অঙ্কের বামগতিতে ১৬৭১শাক বা ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দ, অর্থাৎ ১৬৭১ শতাব্দের জ্যৈষ্ঠমাসে মিত্রবংশীয় অন্ধতুল্য হীররাম সৌভাগ্যবশে শ্রীযুক্ত হরিহর পাদদ্বয়ে প্রণাম করিয়া গোপীনাথের এাই মন্দির নির্মাণ করেন। গোপীনাথ নামক শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহের পদপ্রান্তে লিখিত আছে :
‘বাঞ্ছাপ্রদ গোপীনাথ ত্বয়ি যাচে।
চিত্তং হরিরামস্যাস্তাং তব পাদে।।
এইরূপ রাধিকার পাদপদ্মে লিখিত আছে-‘যাচে তব পাদে ভক্তিং হরিরামঃ।” হরিরামের ইষ্টমুর্তিদ্বয় এখনও তাঁহার ভক্তির কাহিনী অক্ষুন্ন রাখিয়াছেন। হরিরামের বংশ দেওয়ান বংশ, পুরুষানুক্রমে তাহার বংশধরেরা চাঁচ্ড়া সরকারে দেওয়ানী প্রভৃতি উচ্চপদে নিযুত্ত ছিলেন; চাঁচ্ড়া-রাজের পতনকালেও শিবনাথের পুত্র দীননাথ পেশ্কার ছিলেন।দীননাথের তৃতীয় পুত্র খগেন্দ্রনাথ মিত্র এম, এ, প্রেসিডেন্সী কলেজের দর্শন শাসেত্রর প্রধান অধ্যাপক, সাহিত্যপরিষদের প্রধান সেবক, ভারতীয় ব্যবস্থাপক সভার সভ্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য, নিজ যেমন সুলেখক, তেমননি সুরসিক ও সুগায়াক ।
সূত্র:
যশোর-খুলনার ইতিহাস
সতীশ চন্দ্র মিত্র