
Home উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা / High Ranking officers > সৈয়দ আশরাফ আলী / Syed Ashraf Ali (1940) {M.D. Bangladesh Bank (Rtd.)}
এই পৃষ্ঠাটি মোট 3206 বার পড়া হয়েছে
সৈয়দ আশরাফ আলী / Syed Ashraf Ali (1940) {M.D. Bangladesh Bank (Rtd.)}
সৈয়দ আশরাফ আলী
Syed Ashraf Ali
{Managing Director, Bangladesh Bank (Rtd.)}
Home District: Narail, Lohagara
পারি

বাংলাদেশের ব্যাংকিং অঙ্গনে সুপ্রতিষ্ঠিত ও দক্ষ নির্বাহী পরিচালক হিসেবে খ্যাতি অর্জনকারী সৈয়দ আশরাফ আলী নড়াইল জেলার কৃতি সন্তান। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর ও ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে থাকাকালীন তিনি বৃহত্তর যশোর জেলার শতাধিক বেকার ছেলে-মেয়েদেরকে বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরি দিয়ে অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। দেশের এই গর্বিত সন্তান ১৯৪০ সালে নড়াইল জেলার লোহাগড়া থানায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মরহুম সৈয়দ তোরফান আলী। মাতার নাম সবুরুন নেসা। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সৈয়দ আশরাফ আলী দ্বিতীয়। বড় ভাই স্কুল শিক্ষক ছিলেন। তৃতীয় ভাই বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডাইরেক্টর। চতুর্থ ভাই একজন প্রকৌশলী এবং নড়াইলের নিরিবিলি পার্কের মালিক। ৫ম ও ৬ষ্ঠ ভাই বাংলাদেশ ব্যাংক ও সোনালী ব্যাংকে কর্মরত।
শিক্ষা ও কর্মজীবন:
জনাব সৈয়দ আশরাফ আলীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নড়াইলের লাহুড়িয়া হাফেজ আব্দুল করিম একাডেমী থেকে। এখান থেকেই ১৯৫৫ সালে ১ম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর ৯ বৎসরের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রথম বিভাগে পাশ করেন। ১৯৫৭ সালে বাগেরহাট পিসি কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান নিয়ে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাস্টার্স ডিগ্রী করেন। পরবর্তীতে এম.বি.এ করতে তিনি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী করাচীতে যান।
এম.বি.এ শেষ করার আগেই ১৯৬২ সালে তদানিন্তন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান-এ অফিসার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি তাঁর ব্যাংকিং ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান করতে হয়। যুদ্ধ শেষে ১৯৭২ সালে আফগানিস্তান হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগদান করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে ডেপুটেশনে গাজীপুরস্থ ‘সিকিউরিটি প্রিন্টিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন : ইউএনডিপি, এডিবি, ওয়াল্ড ব্যাংক, ফাউ ইত্যাদি সংস্থায় মাইক্রো ক্রেডিট সংক্রান্ত কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করেন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে পদোন্নতি পেয়ে সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর হিসেবে ১৯৯৮ সালে অবসর গ্রহণ করেন।
২০০২ সালে তিনি ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। অসাধারণ মেধা, দক্ষতা, একনিষ্ঠ যোগ্যতার কারণে বেসরকারী খাতে নবীন প্রতিষ্ঠিত ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন। ২০০৪ সালে সেখান থেকে অবসর নেয়ার পর ২০০৫ সালে তিনি আবার সেবা টেলিফোন কোম্পানির উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। বর্তমানে অবসর জীবনযাপনের মাঝে মধ্যে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কনসালটেন্সি করে থাকেন।
জনাব আশরাফ আলী বাংলাদেশের সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী ব্যাংকের ট্রেনিং একাডেমীতে গেস্ট স্পিকার হিসেবে বহুবার আমন্ত্রিত হয়েছেন। ইনস্টিটিউট অব ব্যাংকিং নামক প্রতিষ্ঠানটির গত ২৫ বছর যাবৎ পরীক্ষক অথবা প্রশ্ন মডারেটর হিসেবে তিনি কাজ করে চলেছেন।
সরকারি কিংবা বেসরকারি কাজে তিনি ভ্রমণ করেছেন পৃথিবীর বহু দেশ। এই ভ্রমণ ছিলো কখনও সরকারি ডেলিগেশন এর মেম্বার হিসেবে, কখনও ট্রেনিং এ, কখনও সেমিনারে আবার কখনও ওয়ার্কশপে। এছাড়াও তাঁর ব্যাংকিং ম্যনেজমেন্ট, ফরেন এক্সচেঞ্জ এবং ইম্পোর্ট ফরেন এর উপরে ট্রেনিং নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। আশি ও নব্বই-এর দশকে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব পালনকালে তিনি আর্থিক খাত সংস্কার, গঠন ও কার্যকরীকরণে অত্যন্ত গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা বিশেষ করে ক্ষুদ্র ঋণ ও গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচিতে তিনি দেশে-বিদেশে আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে কাজ করেন। অবশেষে তিনি বিশ্ব ব্যাংকের অধীনে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃসংগঠন এবং মানব সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। দীর্ঘ ৩৫ বৎসরের অধিককাল বিস্তৃত তাঁর গৌরবময় ব্যাংকিং অভিজ্ঞতায় ঝুলি পূর্ণ।
লেখক আশরাফ আলী:
জনাব আশরাফ আলী তাঁর কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝে নিয়মিত লেখালেখিও করেছেন। তিনি বৈদেশিক-বাণিজ্য এবং তার অর্থায়নের উপর যুগসন্ধিক্ষণমূলক পাঠ্য পুস্তক রচনা করে বিশেষ কৃতিত্বের অধিকারী হয়েছেন। ২০০৫ সালে তাঁর ব্যাংকিং এর উপর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ “ব্যাংকিং ল এন্ড প্যাকটিস” এবং অন্যটি “ফরেইন এক্সচেঞ্জ এন্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট”। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত যাবতীয় তত্ত্ব নিয়ে বইগুলি রচিত হয়েছে, যেগুলি বর্তমানে দেশের অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিভিন্ন ব্যাংকিং কাজে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহারিত হচ্ছে। “ব্যাংকিং ল এন্ড প্যাকটিস” বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়েছে। “ফরেইন এক্সচেঞ্জ এন্ড রিস্ক ম্যানেজমেন্ট” বইটি ইংল্যান্ড, পাকিস্তান ও ইন্ডিয়াসহ কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে রেফারেন্স বই হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
জনাব আশরাফ আলীর কাছে বৈদেশিক বিনিময়ের উপর বই প্রকাশের আগ্রহের কথা জনতে চাওয়া হলে তিনি বললেন ‘পাকিস্তান ও বাংলাদেশ মিলে বহুকাল যাবৎ তিনি ফরেন এক্সচেঞ্জের এর উপর কাজ করেছেন। চাকরি থেকে অবসরের পর তিনি দেখলেন আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকিং এর উপর কোন বই এখনও বাংলাদেশের কেউ প্রকাশ করেনি। ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে ছেলে মেয়েদের জানতে সমস্যা হয়। ফলে বিদেশি বই পড়তে হয়। বিদেশি বই’র পটভূমি ও এনালাইসিস ভিন্ন। বিশেষ করে গত ৪০ বৎসর ধরে আগের পুরাতন বই এখনও চলছে। তাই তিনি আধুনিক ফরেন এক্সচেঞ্জের এর উপর আমাদের দেশের জন্য উপযোগি করে একটি বই প্রকাশ করলে আমাদের ছেলে মেয়েরা উপকৃত হবে।”
সৈয়দ আশরাফ আলী তাঁর পেশা সংশ্লিষ্ট বই লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন ভ্রমণ কাহিনী ও জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে দুটি বই সম্পাদনা করেছেন। প্রকাশিত দু্টি বই হচ্ছে ‘পাকিস্তানে আটকা পড়া দিনগুলি’ এবং ‘রহস্যে ঘেরা কাফিরস্তানের পথে’। প্রথম বইটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটকা পড়াকালীন সময়ে যে অনিশ্চয়তার মাঝে তাঁরা দিন যাপন করেছিলেন এবং কিভাবে তারা পালিয়ে এসেছিলেন তাঁর একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
তাঁর দ্বিতীয় বইটি ‘রহস্যে ঘেরা কাফিরস্তানের পথে’। মূলত কাফিরস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের সবচেয়ে উত্তরে পাহাড় ঘেরা রহস্যময় একটা জনপদ। প্রায় আড়াই হাজার বৎসর আগে আলেকজান্ডারের সাথে এখানে একদল সৈন্য এসে আস্তানা গড়েছিলো। তারা লোক চক্ষুর আড়ালে বহু বৎসর যাবৎ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা সবকিছু জিইয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলো। বইটিতে যদিও কাফিরস্তানের রহস্যকে তুলে ধরা হয়েছে, কিন্তু অন্তস্থলে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের যে মনোভাব ছিলো তাঁর একটা বিস্তারিত বর্ননা এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
তিনি নিয়মিত ভ্রমণ কাহিনীসহ বিভিন্ন আর্টিকেল, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ইস্যুসমুহের উপর নিয়মিত জাতীয় দৈনিকসমুহে লেখা-লেখি করেন। ভ্রমণের উপর ভিত্তি করে তাঁর লেখা প্রায় ২০টি গল্প ‘দি ডেইলি স্টার’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলি বহু মানুষের কাছে যথেষ্ট সমাদর পেয়েছে এবং গল্পগুলির একটি নিয়মিত পাঠক গোষ্টি গড়ে উঠেছিলো।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য:
জীবনে অজস্র পুরস্কারের অধিকারী সৈয়দ আশরাফ আলী সদা সহজ, সরল ও সৎভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। বাংলাদেশ ব্যাংক ও ফাস্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ম্যানেজিং ডিরেক্টর থাকাকালীন ব্যাংকিং সেক্টরে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী একজন কর্মকর্তা। সম্পদ গড়ে তোলার একটা বড় সুযোগ ছিলো তাঁর। কিন্তু তিনি সে পথে কখনও পা বাড়াননি। উদারতা ও মানুষকে উপকার করা তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সারাজীবন মানুষের কল্যাণ সাধনের মধ্য দিয়ে একজন মহৎ মানুষ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছেন। জীবনে যা আয় করেছেন তার একটা বড় অংশ গরীব আত্নীয় স্বজনের মধ্যে বিলিয়ে দিয়েছেন। এলাকার মানুষকে সামর্থ অনুযায়ী উপকার করার চেষ্টা করেছেন। চাকরিতে অত্যন্ত বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত থেকে সততা ও ন্যায় নিষ্ঠার সাথে কাজ করলেও একটি স্থানে তিনি কিছুটা স্বদেশ প্রীতি করেছেন, এটা হচ্ছে বৃহত্তর যশোরের প্রায় ৩০০ বেকার ও গরীব ছেলে মেয়েদেরকে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন ব্যাংকে চাকরির সংস্থান। একজন চাকরিজীবির পক্ষে নিজ এলাকার এত মানুষকে চাকরি পাইয়ে দেয়া একটি বিরল ঘটনা।
সাধারণত বড় বড় কর্মকর্তার অফিস রুমে সাধারণ মানুষের প্রবেশ সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু জনাব আশরাফ আলী জনগণের জন্য ছিলেন উন্মুক্ত। অসম্ভব ব্যস্ততার মাঝে জনগণের এই উন্মুক্ত প্রবেশাধিকার যদিও একটু সমস্যা হতো তবুও তিনি সামলে নিয়েছেন। আশরাফ আলীর মতে “বৃহত্তর যশোর এলাকার মানুষের মধ্যে উপকারের মানুষিকতা খুবই কম। তাই তিনি এই গন্ডি থেকে তিনি নিজেকে আলাদা করার চেষ্টা করেছেন”।
ব্যক্তিগত জীবন:
সৈয়দ আশরাফ আলী ১৯৬৬ সালে নড়াইলের মেয়ে আঞ্জুমানারা বেগমের সাথে বিবাহ সূত্রে আবদ্ধ হন। স্ত্রী ১৯৯৫ সালে মস্তিস্কে রক্ত ক্ষরণ হয়ে মারা যান। সৈয়দ আশরাফ আলী চার সন্তানের জনক। বড় মেয়ে অর্থনীতিতে এর্ম পাশ করেন। বর্তমানে তিনি একটি গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর জেনারেল ম্যানেজার পদে চাকরিরত। তার স্বামী সিনিয়র সহকারী সচিব।
বড় ছেলে বেক্সিমকোতে জেনারেল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত। মেঝ ছেলে লন্ডন থেকে এম. বি. এ শেষ করে বর্তমানে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এসিসটেন্ট ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কর্মরত। ছোট ছেলে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি বি এ করে পরবর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. বি. এ করেছেন। বর্তমানে তিনি ব্যাংক অব এশিয়াতে হিসেবে কর্মরত।
তথ্যসূত্র : সাক্ষাৎকার
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন (শান্ত)
তুহিন মাহমুদ
সর্বশেষ সম্পাদনা :
অক্টোবর ২০১১