
Home সাহিত্যিক / Litterateur > বাউল কবি লালন শাহ্ / Baul poet Lalon Shah (1772 -1890)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 18089 বার পড়া হয়েছে
বাউল কবি লালন শাহ্ / Baul poet Lalon Shah (1772 -1890)
বাউল কবি লালন শাহ্
Baul poet Lalon Shah
Home District: Jhenaidah, Harinakunda
পরিচিতি

দেহ-খাঁচার বন্দী এক অচিন পাখীকে নিয়ে ভাবুকের ভাবনার শেষ নেই। শেষ নেই কেমন করে এই খাঁচার ভিতর সে আসে যায় তা নিয়ে। যাঁর ভাবে ভাবনায় গানের গুঞ্জনে প্রাণের সেই আকুতি মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে- মনের মানুষের সংগে মিলনের কামনা যাঁর দীর্ঘ দিনের-আরশী নগরের পড়শীকে যিনি দেখার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন, তাঁকেই আমরা লালন বলে জানি। তিনি লালন করেছেন আমাদের অন্তর্বাসী অন্তরঙ্গ জনের স্বরূপ সমুদঘাটনের সদিচ্ছা-ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁর অচেনা অধরা রূপকে ভাবে ভাষায় সুরে সঙ্গীতে প্রাণময় করে তুলতে। একতারা হাতে একলা চলা বাউলের এই খুঁজে বেড়ানো মনের মানুষের স্বরূপ জানতে হলে লালনকে না জেনে কি আর উপায় আছে ?
বাংলার বাউল গান যাঁর দরদী দানে সুসমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে; ভাবুকের ভাবনা যাঁর অন্তরের স্পর্শে মুগ্ধ মোহনীয়তা সৃষ্টি করেছে, সেই লালনকে ঘিরে কথা আর কিংবদন্তীর শেষ নেই। শেষ নেই বিতর্ক অনুমান আর গবেষণার- কে তিনি কোথায় কবে তাঁর জন্ম- কোথায় কিভাবে তাঁর জীবনের গোত্রান্তর আর রূপান্তর- কিভাবে কেটেছে তাঁর ভাবভোলা জীবন- রবীন্দ্রনাথের সংগে তাঁর সত্যিকার সাক্ষাৎ ঘটেছিল কিনা- আর কিভাবে তাঁর জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল তা নিয়ে। সেই সব হারানো হদিস হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ করে খোঁজ পাওয়া গেল তাঁরই প্রিয় শিষ্য দুদ্দু শাহের বচন- বিবৃতির আর বিভিন্ন-প্রাসঙ্গিক দলিল-দস্তাবেজ। লালন শাহের পরিচিতি মুলক দুদ্দু শাহের বিবৃতির কিছু অংশ উদ্বৃত করা হলোঃ
এগার শো ঊনআশি কার্তিকের পহেলা
হরিষপুর গ্রামে সাঁইর আগমন হৈলা।
যশোহর জেলাধীন ঝিনাইদহ কয়
উক্ত মহকুমাধীন হরিষপুর হয়।
গোলাম কাদের হন দাদাজি তাহার
বংশ পরষ্পরা বাস হরিষপুর মাকার।
দরীবুল্লা দেওয়ান তার আব্বাজির নাম
আমিনা খাতুন মাতা এবে প্রকাশিলাম।
বারশত ‘সাতানব্বই’ বাংগালা সনেতে
পহেলা কার্তিক শুক্রবার দিবাঅন্তে
সবারে কাঁদায়ে মোর প্রাণের দয়াল
ওফৎ পাইল মোদের করিয়া পাগল।’
লালন শাহের জীবনবৃতান্ত নিয়ে দীর্ঘদিন যাবত যে সমস্ত বাক বিতন্ডা চলে আসছিল, দুদ্দু শাহ’র বিবৃতি, প্রাপ্ত দলিল দস্তাবেজ ও আধুনিককালের গবেষকদের লিখিত গ্রন্থাবলীর উদ্ধৃতি থেকে এসব সমস্যার সমাধান হবে বলেই বোধ হয়।
সুর সাধক বাউল-সম্রাট লালন শাহ বাংলা ১১৭৯ সালের পহেলা কার্তিক, ইংরেজ ১৭৭২ খৃষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের যশোর জেলার ঝিনাইদহ (বর্তমান জেলা) মহকুমার হরিণাকুন্ডু থানার কুলবেড়ে হরিষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা দরীবুল্লা দেওয়ান ও মাতা আমেনা খাতুনের চার ছেলের তৃতীয় সন্তান লালন শাহ্। শৈশবেই ঘটে তাঁর মাতৃবিয়োগ।
বাউলজীবন:
শৈশবকাল থেকে লালন ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির ও সংগীত অনুরাগী। হরিষপুর এলাকায় তখন কবিগান, জারিগানের বিশেষ প্রচলন ছিল। বিখ্যাত বয়াতীদের মধ্যে গানের প্রতিযোগিতা হতো। লালন আহার নিদ্রা ত্যাগ করে দিনের পর দিন এই সব গান শুনে বেড়াতেন। একদিন এই মাদকতায় তিনি বেছে নিলেন ছন্নছাড়া বাউলজীবন।
ভবঘুরে লালনকে সংসারে আকৃষ্ট করার জন্যে তাঁর ভাইয়েরা হরিষপুর নিবাসী গোলাব শাহের কন্যা বিসখা বেগম এর সংগে তাঁর বিবাহ দেন। তাঁর এই স্ত্রী অকালে মৃত্যুবরণ করলে তিনি কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামের মতিজান বিবিকে বিবাহ করেন। মৃত্যুর পরে মতিজান বিবিকে লালনের সমাধির পাশেই সমাধিস্থ করা হয়। কুষ্টিয়াতে এখনও তাঁর কবর লালনের সমাধির পাশেই সংরক্ষিত আছে।
লালনের গুরু ছিলেন সিরাজ সাঁই। সিরাজ সাঁইও একজন খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি তাঁকে গড়ে তোলেন নিজ আদর্শে।
লালনের সুর ছিল আধ্যাত্নিক সাধনার ফসল। বাউল লালন সারাটি জীবন স্রষ্টার নৈকট্য লাভের তীব্র বাসনায় সুর সেধেছেন, রচনা করেছেন অসংখ্য বাউল গান।
‘আমার এ ঘরখানায় কে বিরাজ করে।।
আমি জনম ভ’রে একদিন না দেখলাম তারে।।
নড়েচলে ঈশান কেণে,
দেখতে পাইনে দুই নয়নে,
হাতের কাছে যার ভবের হাট-বাজার,
আমি ধরতে গেলে হাতে পাইনে তারে।।’
লালন শাহ বাংলা লোকসাহিত্যের এক উজ্জ্বল তারকা। তাঁর গানে তিনি অজস্র উপমা ব্যবহার করেছেন। লোকসাহিত্যে তাঁর মত প্রতিভা খুব কমই জন্মেছে।
রবীন্দ্রনাথের অবদান:
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন লালন ভক্ত। সুধীসমাজে রবীন্দ্রনাথই প্রথম লালন গীতিকে উপস্থাপন করে জনপ্রিয় করে তোলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও গ্রন্থে লালন সম্পর্কে তিনি আলেকপাত করেছেন। তিনি তাঁর “ছন্দ” গ্রন্থে লালনের গানের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন। শিলাইদহে থাকাকালীন এই মরমী গায়ক সম্পর্কে তিনি জেনেছিলেন। কবির হৃদয়ে লালন গীতির এত প্রভাব পড়েছিল যে, কবির অনেক সাহিত্যকর্মে তাঁর প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। কবির “জীবন দেবতা” এবং লালনের “অচিন পাখী” সম্ভবতঃ একই চেতনার ফসল।
লালন শাহের গানের সঠিক সংখ্যা আজও নিরুপণ করা সম্ভব হয়নি। রবীন্দ্রনাথের পরে অনেকেই লালনের গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের ২৮৯টি গান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর মধ্যে কুড়িটি গান ১৯১৫ সালে প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
লালনগীতি আপাতদৃষ্টিতে উপেক্ষিত বলে বোধ হলেও তাঁর একতারার সুর আজও বিশ্ববরেণ্য, আন্তজার্তিক লোকসাহিত্যের আসরে আলোচনার বিষয়বস্তু। লালন মাটির কবি মানুষের কবি, তাই মাটির মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠে তাঁর গান আজও ভেসে বেড়ায়।
আমার মনের মানুষের সনে।
মিলন হবে কত দিনে।।
চাতকে প্রায় আহর্নিশি
চেয়ে আছে কাল শশী
হব বলে চরণ দাসী।
তা হয়না কপাল গুণে।।
পরলোক গমন:
বাউল শিরোমণি লালন শাহ দীর্ঘায়ু ছিলেন। তিনি বাংলা ১২৯৭ সালের ১লা কার্তিক, ইংরেজী ১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর ১১৬ বছর বয়সে মৃত্যুমুখে পতিত হন। কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া গ্রামে তাঁর মাজার।
ঝিনাইদহে লালনের বসতবাড়ি:
ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুরে লালন শাহ’র জন্মভূমি সংরক্ষণ ও সরকারী স্বীকৃতির দাবিতে হরিণাকুন্ডু বাউল একাডেমী সোচ্চার হলেও লালন শাহ’র জন্মভূমি সংস্কারের বিষয়ে উদ্যোগ নেয়নি কেউ। বাউল সম্রাট লালনের নিজ গ্রাম হরিশপুর আজও উপেক্ষিত হয়ে আছে। এখন আর কেউ জানেন না বাউল সম্রাট লালন এ গাঁয়েরই দরিদ্র গরিবুল্লা দেওয়ান ও আমেনা খাতুনের ঘরে জন্মেছিলেন। লালনের জন্মস্থানও পৈতৃক ভিটা বাঁশ বাগানের নিচে বন জঙ্গলে ঢেকে গেছে। ১৯৮৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর হরিণাকুন্ডু উপজেলা পরিষদ লালনের বাস্তুভিটায় একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করে সে বেদি ওস্মৃতিফলকটিও আজ ধ্বংস্তুপে পরিণত হয়েছে। লালনের দীক্ষাগুরু এ গাঁয়েরই আরেক বাউল সাধক দরবেশ সিরাজসাই ও পান্জু শাহ’র ম্জার ও রয়েছে হরিশপুরে ।
বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্য প্রমাণে দেখা গেছে লালন শাহ’র জন্মস্থান হরিশপুরে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অধ্যাপক মুহম্মদ আবু তালিব ও লালন গবেষক ড. খোন্দকার রিয়্জুল হক তাদের গবেষণায় প্রমাণ করেছেন লালনের জন্মস্থান হরিশপুরেই। বিশিষ্ট লালন গবেষক মুহম্মদ আবু তালিব ১৮৮১ ও ১৮৮২ সালে তৎকালীন ঝিনাইদহ মহাকুমার অধীন শৈলকুপা সাব-রেজিষ্টার অফিসে লালন শাহ্’র আনুকুলে সম্পাদিত হওয়া দুটি দলিল উদ্ধার করেন। উল্লেখ্য; তৎকালীন হরিণ্কুন্ডুতে কোন সাবরেজিষ্টার অফিস ছিল না। হরিণাকুন্ডু থানার যাবতীয় জমি কেনাবেচা ও রেজিষ্ট্রি হত শৈলকুপা সাবরেজিস্ট্রার অফিসের মাধ্যমে।
লালন সম্পর্কে বিভিন্নভাবে গবেষকরা লিখেছেন লালন নিজের থেকেই তার নিজ গ্রাম হরিশপুরের স্বনামধন্য বাউল সাধক দরবেশ সিরাজ সাঁইয়ের শিষ্যত্ব লাভ করেন। এক সময় বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়ায় তার সঙ্গীরা তাকে ত্যাগ করেন। তখন তিনি কুষ্টিয়ার ছেওড়িয়ায় কালী নদীর ধারে যান। এরপর লালন ছেওড়িয়াতেই অবস্থান করতে থাকেন। এখানেই তিনি সাধনকর্মের মাধ্যমে প্রতিভার বিকাশ ঘটান। দিনদিন ছেওড়িয়া লালন তীর্থে পরিণত হয়। বর্তমানে বাউলদের প্রধান তীর্থক্ষেত্র হচেছ কুষ্টিয়ার ছেওড়িয়ায়। ইংরেজী ১৭৭২ সালে জন্মগ্রহণ করেন লালন শাহ। ১১৬ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে ১৭ অক্টোবর রাতে তিনি মারা যান। বর্তমানে লালন উৎসব ছেওড়িয়া কেন্দ্রিক হয়ে পডেছে। লালনের জীবদ্দশায় প্রতি বৎসর শীতকালে একটি মহোৎসব করতেন তিনি। সেখানে লালন শিষ্য ও তার সম্প্রদায়ের লোকেরা সবাই একত্রিত হয়ে সাইজির সঙ্গে সঙ্গীত ও আলোচনায় মিলিত হতেন। এখনো প্রতি বৎসর এ সময় ছেওড়িয়াতে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনায় লালন উৎসব পালিত হয়। সমাগম ঘটে লাখো ভক্তের। কিন্তু কালের বিবর্তনে লালনের জন্মস্থান হরিশপুর লালন তীর্থভূমি থেকে হারিয়ে গেছে। এখানে পালিত হয় না লালন উৎসব। তবে এবার ১ মে হরিণাকুন্ডুতে শুরু হচেছ লালন মেলা। হরিশপুরের প্রবীণদের মুখে শোনা য়ায়; দেশ স্বাধীনের পর কয়েক বৎসর লালন স্মরণ উৎসব হয়েছিল। এক সময় তা বন্ধ হয়ে য়ায়। তবে দেশ বিদেশের লালন গবেষকরা এ বাউল সম্রাটের স্মৃতি খুঁজে পেতে মাঝেমধ্যেই হরিশপুরে আসেন এবং বাউল সম্রাটের জন্মস্থানের দৈন্যদশা দেখে হতাশ হন। সরেজমিন লালনের স্মৃতিচিহ্ন খুঁজতে গিয়ে অনেকটা বেগ পেতে হয়। গ্রামের প্রবীণ ব্যাক্তিদেরমুখে শুনতে শুনতে বাঁশ বাগানের মধ্যে জঙ্গলাবৃতস্থানে খুঁজে পাওয়া য়ায় একটি জরাজীর্ণ বেদী। এখানেই লালনের পৈতৃক ভিটা ছিল বলে চিহ্নিত করেন গবেষকরা। লালনের দীক্ষাগুরু দরবেশ সিরাজ সাইয়ের মাজার আছে হরিশপুরের স্কুলের পাশে। সিরাজ সাইয়ের আধস্তন পঞ্চম পুরুষের কয়েকজন বাস করেন গ্রামটিতে। তারা হলেন বারেক সর্দার, নজির সর্দার, আক্কাস সর্দার, আবুল সর্দার, গণি সর্দার ও মকবুল সর্দার। তাদের অবস্থা করুন; দরিদ্রতার মধ্যে বসবাস করছেন তারা। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে জীবিকানির্বাহ করেন। দরবেশ সিরাজ সাইয়ের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ বারেক সর্দার ক্ষোভের সাথে বলেন; যে লালনকে নিয়ে সারাবিশ্বে তোড়পাড় চলছে সেই লালনের দীক্ষাগুরুর খোঁজ কেউ রাখে না। দীর্ঘদিন অবহেলিত থাকার পর সম্প্রতি লালন গুরু সিরাজ সাইয়ের কবরটি পাকা করা হয়েছে। মাযার বলতে যা বোঝায় সে রকম কিছুই হয়ে ওঠেনি এখানে। লালনের নিজের বাস্তুভিটাটিও সংরক্ষণ করার উদ্যোগ কেউ নেয়নি ।
তথ্য সূত্র :
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
খুলনা-যশোর-কুষ্টিয়া
লেখক : কাজী শওকত শাহী
ও
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সর্বশেষ আপডেট:
অক্টোবর ২০১১
ইউনুস আলী