
Home সাহিত্যিক / Litterateur > গোলাম মোস্তফা / Golam Mostafa (1897-1964)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 18149 বার পড়া হয়েছে
গোলাম মোস্তফা / Golam Mostafa (1897-1964)
গোলাম মোস্তফা
Golam Mostafa
Home District: Jhenaidah, Shailkupa
Golam Mostafa
Home District: Jhenaidah, Shailkupa
পারি

বাংলা সাহিত্যে মুসলিম রেঁনেসার কবি গোলাম মোস্তফার জন্ম ১৮৯৭ সালে যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার শৈলকূপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে। পিতা কাজী গোলাম রব্বানী, পিতামহ কাজী গোলাম সরওয়ার। তাঁরা ছিলেন সাহিত্যানুরাগী-ফারসী ও আরবী ভাষায় সুপন্ডিত।
শিক্ষা জীবন :
কবি গোলাম মোস্তফার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় চার বছর বয়সে নিজগৃহে ও পার্শ্ববর্তী দামুকদিয়া গ্রামের পাঠশালায়। কিছুদিন পরে তিনি ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালাতে ভর্তি হন। দু’বছর এই পাঠশালায় বিদ্যা অর্জনের পরে তিনি ভর্তি হলেন শৈলকূপা উচ্চ ইংরেজী স্কুলে। ১৯১৪ সালে এই স্কুল থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে তিনি প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯১৬ সালে তিনি দৌলতপুর বি. এল কলেজ থেকে আই. এ এবং ১৯১৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বি. এ পাশ করেন। পরে ডেভিড হেয়ার ট্রেনিং কলেজ থেকে বি. টি ডিগ্রীও লাভ করেন।
পেশাগত জীবন :
১৯২০ সালে জানুয়ারী মাসে ব্যারাকপুর সরকারী হাই স্কুলের সহকারী শিক্ষক হিসেবে গোলাম মোস্তফার শিক্ষকতা জীবনের সূচনা হয়। ১৯২৪ সালে ব্যারাকপুর হাই স্কুল থেকে তিনি কলকাতা হেয়ার স্কুলে বদলী হন। দীর্ঘদিন এখানে শিক্ষকতা করার পর তিনি কলকাতা মাদ্রাসায় বদলী হন। সেখান থেকে ১৯৩৫ সালে বালিগঞ্জ সরকারী ডিমনেষ্ট্রেশন হাই স্কুলে বদলী হয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদে উন্নীত হন এবং কয়েক বছর পর উক্ত বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদমর্যাদা লাভ করেন। এই বিদ্যালয়ের তিনিই প্রথম মুসলিম প্রধান শিক্ষক। ১৯৪০ সালে তিনি বাঁকুড়া জিলা স্কুলে বদলী হন। শিক্ষকতা জীবনে বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করার পর ১৯৪৬ সালে তিনি ফরিদপুর জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। দীর্ঘ ত্রিশ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৯৫০ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
সাহিত্য কর্ম :
মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত কবি গোলাম মোসত্মফার অবদান বাংলা সাহিত্যে এক বিরল দৃষ্টান্ত। স্কুল জীবনেই এই কবির সাহিত্য প্রতিভার বিকাশ ঘটে। এ সময় তাঁর ‘আদ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ কবিতাটি মাসিক মোহাম্মদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাঁর প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘রক্ত রাগ’ প্রকাশিত হলে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নীচের দু’লাইন কবিতার মাধ্যমে কবিতার মাধ্যমে কবিকে অভিনন্দিত করেছিলেন-
“তব নব প্রভাতের রক্তরাগখানি
মধ্যাহ্নে জাগায় যেন জ্যোতির্ময়ী বাণী।”
তাঁর পরবর্তী গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘হাসনাহেনা’ (কাব্যগ্রন্থ) ‘খোশরোজ’ (কাব্যগ্রন্থ), ’সাহারা (কাব্যগ্রন্থ)’, ‘বুলবুলিস্তান’ (কাব্যচয়ন) ও ‘রূপের নেশা’ ‘ভাঙ্গাবুক’ ‘একমন একপ্রাণ’ ইত্যাদি উপন্যাসগুলি বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
অনুবাদক হিসেবেও কবি গোলাম মোস্তফার বিশেষ খ্যাতির পরিচয় পাওয়া যায়। আরবী ও উর্দু সাহিত্য হতে নিম্নলিখিত গ্রন্থগুলি ভাষান্তরিত করে বাংলা সাহিত্যকে তিনি সমৃদ্ধ করেছেন। ‘ইখওয়ানুস সাফা’, ‘মুসাদ্দাস-ই-হালী’,- ‘কালাম-ই-ইকবাল’, ‘শিকওয়া’ ও ‘আল-কুরআন’ তাঁর ভাষান্তরিত গ্রন্থগুলির অন্যতম।
এছাড়া, চিন্তামূলক ও যুক্তিবাদের উপর লিখিত আরও কিছু গ্রন্থাবলী তিনি রচনা করেছিলেন। ‘ইসলাম ও কমিউনিজম’, ‘ইসলামে জেহাদ’, ‘আমার চিন্তাধারা’, এগুলি তাঁর গভীর চিন্তাধারার জ্ঞানলব্ধতার ফসল।
কবি গোলাম মোস্তফার ‘বিশ্বনবী’ একটি আশ্চর্যরকমের সফল সৃষ্টি। এই অমর গ্রন্থখানি গদ্যে রচিত হলেও সে গদ্যও কবিতার মত ছন্দময় এবং মধুর। গ্রন্থখানা বিশ্বনবী হয়রত মুহম্মদ (দাঃ) এর একটি সার্থক জীবন চরিত। গ্রন্থটিতে হৃদয়ের আবেগ, আন্তরিক অনুভূতি যে ভাবে বর্ণিত হয়েছে তার তুলনা আমাদের বাংলা সাহিত্যে নিতান্তই বিরল। এর পরবর্তীতে তিনি কোর-অনিক ঘটনার অমিত্রাক্ষর ছন্দে ‘বনি আদম’ নামে একটি মহাকাব্য লিখেছিলেন। যা বাংলা সাহিত্যে এক অমর ও অক্ষয় কীর্তি।
কবি বলতেন বিশ্ব প্রকৃতি ছন্দ ও সুরে পরিপূর্ণ। ছন্দের বৈচিত্র্যে তাঁর ছিল অসাধারণ দখল। কবি নজরম্নল ইসলামের সঙ্গে ছিল তাঁর আত্মিক সম্পর্ক। কবি কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে তাঁদের মধ্যে গড়ে উঠে ঘনিষ্ট সম্পর্ক যদিও লেখনীর মধ্যে উভয়ের চিন্তাধারার ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। কবি নজরুল ইসলাম সম্পর্কে তাঁর লিখিত একটি ছড়া :
কাজী নজরম্নল ইসলাম
বাসায় একদিন গিছলাম
ভায়া গান গায় দিনরাত
হেসে লাফ দেয় তিন হাত,
প্রাণের হর্ষের ঢেউ বয়
ধারায় পর তার কেউ নয়।
এই ছড়াটির মাধ্যমে নজরুল চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে এবং কবির ছন্দ বোধও পরিলক্ষিত হয়েছে।
সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তাঁর উল্লেখযোগ্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। গায়ক ও গীতিকার হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বিশেষ করে ইসলামী গান, গজল ও মিলাদ মাহফিলের বিখ্যাত ‘কিয়ামবাণী’ (রসুল আহবান বাণী) রচনায় তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর অনেকগুলি গান আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠেও রেকর্ড হয়েছিল। এছাড়া নিজের কণ্ঠেও তিনি বেশ কয়েকটি গান রেকর্ড করেছিলেন। তাঁর রেকর্ডকৃত গানগুলোর প্রথম লাইনগুলি নিম্নরূপ :
• হে খোদা দয়াময় রাহমানুর রাহিম
• বাদশা তুমি দীন ও দুনিয়ার
• নিখিলের চির সুন্দর সৃষ্টি
• আমার মুহম্মদ রাসুল
কবি গোলাম মোসত্মফার বাংলা ‘কিয়াম বাণী’ ধর্মীয় মিলাদ মাহফিলে অঙ্গীভূত হয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাঁর লিখিত কিয়াম বাণীর (গজল গীত) চরণগুলি নিম্নে উদ্ধৃত হল :
ইয়ানবী সালাম আলাইকা
ইয়া রাসুল সালাম আলাইকা
ইয়া হাবীব সালাম আলাইকা
সালাওয়া তুলস্নাহ্ আলাইকা।
তুমি যে নূরের-ই-রবি
নিখিলের ধ্যানের ছবি
তুমি না এলে দুনিয়ায়
আঁধারে ডুবিত সবই।
পরলোক গমন :
বাংলা সাহিত্যের সাধক কবি গোলাম মোসত্মফা তাঁর শেষ জীবনের কয়েক বছর ঢাকা শান্তিনগরস্থ নিজ গৃহে (মোস্তফা মঞ্জিল) অতিবাহিত করেন। বেশ কিছু দিন রোগ যন্ত্রণা ভোগ করার পর কবি ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট :
ফেব্রুয়ারি ২০১২ ইং