
Home শিল্পী / Artist > ধীরাজ ভট্টাচার্য / Dheeraj Bhattacharya (1905)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 19490 বার পড়া হয়েছে
ধীরাজ ভট্টাচার্য
Dheeraj Bhattacharya
Home District: Jessore, Keshabpur
পরিবারিক পরিচিতি:
বাংলা সাহিত্যে ও চলচ্চিত্রে অজশ্র অনুরাগীর অন্তরলোকে যাঁর ভাবমূর্তি চিরলাবণ্য ও মহিমায় বিরাজমান, তিনি হলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। পঞ্চাশ দশকের গোড়ার দিকে তিনি তাঁর অসামান্য শৈল্পিক প্রতিভায় লক্ষ নরনারীর হৃদয় রাজ্যে হয়ে উঠেছিলেন এক রূপকথার খলনায়ক।
ধীরাজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৫ সালে যশোর জেলার কেশবপুর থানার পাঁজিয়া গ্রামে। পিতা ললিতমোহন ভট্টাচার্য ভবানীপুর মিত্র ইনস্টিটিউশনের শিক্ষক ছিলেন।
১৯৩৪ সালে ধীরাজ বাবু বিয়ে করেন চব্বিশ পরগণার গোপালপুর নিবাসী বিনোদ চৌধুরীর কন্যা শ্রীমতি সরস্বতী চৌধুরীকে। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।
শিক্ষাজীবন:
নিজ গ্রামের পাঁজিয়া স্কুলে ধীরাজ ভট্টাচার্যের শিক্ষাজীবনের সূচনা হয়। পরে তিনি কোলকাতা মিত্র ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ১৯২৩ সালে ম্যট্রিকুলেশন পাস করেন। আশুতোষ কলেজে আই. এস. সি তে ভর্তি হন। কলেজে আই. এস. সি পড়াকালীন সিনেমা ও সাহিত্যচর্চার প্রতি আকৃষ্ট হন, ফলে আর আই. এস. সি পরীক্ষা দেয়া সম্ভব হয়নি।
শিল্পীজীবন:
সুদর্শন চেহারা, ঘন কোঁকড়ানো চুল, ইষৎ ট্যারা হলেও চোখের চাউনিতে মাদকতা। চিত্র পরিচালক জ্যোতিষ বন্দোপাধ্যায়ের পছন্দ হয়ে যায় ধীরাজ বাবুকে। তাঁর সহযোগিতায় ১৯২৪ সালে ম্যাডান কোম্পানীর নির্বাক ছবি ‘সতী লক্ষী’তে প্রথম অভিনয়ের সুযোগ পান।
সিনেমায় অভিনয় করায় বাড়ীতে অশান্তি; আত্মীয় স্বজনের মধ্যে অসন্তোষ। তাই সামাজিক মর্যাদা রক্ষার জন্যে ধীরাজের বাবা ধীরাজকে পুলিশের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে (আই. বি) ভর্তি করে দেন। প্রথম পোস্টিং হয় কোলকাতায়।
কোলকাতার এই ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ থেকে চট্টগ্রামে পুলিশ অফিসারের দায়িত্ব নিয়োজিত হন তিনি। সেখান থেকে বার্মায়। পুলিশের চাকরিতে নানা বিপর্যয়ের কারণে তিনি চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন ধীরাজ।
কোলকাতায় ফিরে পুনরায় সিনেমা জগতে প্রবেশের চেষ্টা করতে থাকেন। ১৯৩০ সালে চিত্র পরিচালক মধু বাবুর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। মধু বাবু তখন তাঁর ছবির জন্যে নতুন মুখ খুঁজছিলেন। মধু বাবু আবিষ্কার করলেন ধীরাজকে। বিখ্যাত অভিনেতা এবং পরিচালক নরেশ মিত্র ও ধীরাজ বাবু দু’জনই যশোর জেলার মানুষ। নরেশ বাবু ধীরাজকে খুব স্নেহ করতেন। তিনি অভিনয়ের ব্যাপারে যতটুকু পেরেছেন তালিম দিয়ে তাঁকে সহযোগিতা করেছেন। যে সমস্ত নির্বাক ছবিতে অভিনয় করে ধীরাজ বাবু তাঁর অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন, সেগুলি ‘সতীলক্ষ্ণী’, ‘গিরিবালা’, ‘বাসবদত্ত’, ‘কালপরিণয়’, ‘মৃণালিনী’, এবং রবীন্দ্রনাথের কাহিনী অবলম্বনে ‘নৌকাডুবি’। শেষোক্ত ছবিটির পরিচালক নরেশ মিত্র।
সবাক যুগে ধীরাজ বাবুর প্রথম ছবি ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’। এরপর থেকেই ধীরাজবাবু একের পর এক অভিনয় করে চললেন। পৌরাণিক ও ধর্মমূলক ছবিতে। ‘যমুনা পুলিন’, ‘চাঁদ সদাগার’, ‘দক্ষযক্ষ’, ‘রাজ নটি’, ‘বসনত্মসেনা’, ‘বাসব দত্তা’, ‘নরনারায়ণ’, ‘কৃষ্ণসুদামা’ ইত্যাদি।
১৯৩৫ সালে ধীরাজ বাবু ‘কণ্ঠহার’, ছবিতে কাননদেবীর বিপরীতে ভিন্নধর্মী একটা ভূমিকা পেলেন। কিছুটা ভিলেন টাইপের রোল, অভিনয় ভালই করলেন। ‘জোয়ার ভাটা’ নামে চার রিলের একটা ছোট ছবিও পরিচালনা করলেন।
ধীরাজ বাবুর বয়স যখন পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই করছে তখনও তাঁকে বিশ বছরের তরুণী নায়িকার বিপরীতে গাছের ডাল ধরে প্রেমের গান গেয়ে বেড়াতে হয়েছে। ওই সময় সাহিত্যিক পরিচালক শৈলজানন্দের ‘শহর থেকে দূরে’, ‘মানে না মানা’ ইত্যাদি নায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি।
১৯৪৭ সালে ‘নতুন ঘর’ ছবিতে তিনি ধীরাজবাবুকে একটি টাইপ রোল দিয়েছিলেন। যশুরে ভাষার সংলাপে এই চরিত্রটিতে ধীরাজ বাবু মাতিয়ে দিলেন। আর তার পরের বছরেই ‘কালো ছায়া’ ছবিতে ভিলেন রোলে একটা নতুন দিগন্ত খুলে গেল ধীরাজ বাবুর সামনে। ১৯৫০ সালে নরেশ মিত্রের ‘কঙ্কাল’ ছবির পর ধীরাজ বাবু বাংলা সিনেমার সর্বোপেক্ষা ভয়াবহ খলনায়ক হিসাবে একের পর এক ভিলেন চরিত্র করে যেতে লাগলেন। ধীরাজ বাবুর সেই সময়কার ছবি গুলোর নাম শুনলেই বোঝা যাবে কি ভয়াল ভয়ঙ্কর রোল তাঁকে করতে হত। ‘মরণের পরে’, ‘হানাবাড়ী’, ‘ডাকিনলার চর’, ‘রাত একটা’, ‘ধূমকেতু’- এই সব ছিল ধীরাজ বাবুর অভিনীত তখনকার ছবির নাম।
ধীরাজ বাবুর ছিল এক আশ্চার্যরকম শিল্প চেতনা বোধ। ১৯৫৫ সালে সত্যজিত রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়েন। এর প্রতি দৃশ্য যেমন ‘ব্যাঙ মরে ঢোল হয়ে জলের উপর পড়ে থাকা; জলের উপর পোকামাকড়ের খেলা; গ্রামের পথ, কাঁশবন; অনেক দূরে হারিয়ে যাওয়া রেলের লাইন, এর সব কিছুই তাঁর শিল্পী মনকে বিশেষ আকর্ষণ করেছিল।
ধীরাজ বাবু ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি বিভিন্ন ছায়াছবিতে অভিনয় করে হাজার হাজার দর্শকের মন জয় করেছিলেন। তাঁর অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছেন।
সাহিত্য সাধনা:
চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি তাঁর সাহিত্য সাধনা অব্যাহত ছিল। দেশ পত্রিকার পাতায় ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ ও ‘যখন নায়ক ছিলাম’ - আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হবার পর পাঠক সমাজে বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করেছিল। তাঁর লিখিত অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থাবলীর মধ্যে ‘মন নিয়ে খেলা’, ‘সাজানো বাগান’ ও ‘মহুয়া মিলন’ উল্লেখযোগ্য।
মৃত্যু:
এই কালজয়ী চিত্র অভিনেতা ধীরাজ ভট্টাচার্য ১৯৫৯ সালে চুয়ান্ন বছর বয়সে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন আর রেখে গেলেন একরাশ স্মৃতি।
তথ্য সূত্র :
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট:
মার্চ ২০১২