
Home দৃষ্টিপাত (Visibility) > হারিয়ে যাচ্ছে যশোরের খেজুর সম্পদ
এই পৃষ্ঠাটি মোট 15769 বার পড়া হয়েছে
‘যশোরের যশ খেজুরের রস’-প্রবাদটি সারা বাংলাদেশে প্রচলিত। যশোরের ঐতিহ্য খেজুর গাছ। এই গাছ যশোরের অন্যতম অর্থকরী সম্পদ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, এক শ্রেণীর অর্থলোভী মানুষের চক্রান্তে বিলুপ্ত হতে চলেছে এই খেজুর সম্পদ। ফলে নিঃশেষ হচ্ছে যশোরের প্রাচীন ঐতিহ্য। জানা যায়, খেজুর গাছের জন্মস্থান মেসোপটেমিয়া তথা ইরাক। বাংলাদেশে যে জাতের বুনো খেজুর জন্মে তার বৈজ্ঞানিক নাম Phoenix Sylvestris. খেজুর গাছ সাধারণত সব ধরনের মাটিতে জন্মায় তবে দোআঁশ ও পলি মাটিতে উৎপন্ন গাছ থেকে বেশি রস পাওয়া যায়। বাংলাদেশের যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়াতে খেজুর গাছ আছে এবং এসব অঞ্চলে খেজুরের রস গুড় পাওয়া যায়। তবে যশোর অঞ্চলে বিশেষ করে খাজুরা এলাকায় যে গুড় পাটালি তৈরি হয় তা বিশ্ববিখ্যাত। বৃহত্তর যশোরের মনিরামপুর, কেশবপুর, চৌগাছা, কোটচাঁদপুর, ঝিকরগাছা, নড়াইল, মাগুরাসহ বিভিন্ন স্থানে খেজুর গাছ থেকে রস, গুড় ও পাটালি উৎপন্ন হয়। খাজুরা নামকরণের মধ্যে খেজুর গাছ ও রস গুড় পাটালির মাহাত্ম রয়েছে। বাংলাদেশের যে কোন জায়গার চেয়ে খাজুরার পাটালির দাম প্রায় বেশি এবং মানে অনেক এগিয়ে। এই পাটালি দেখতে অনেকটা মিছরির মত এবং লালচে বর্ণের। পাটালির সারা শরীর মোটা দানায় ভরা থাকে এবং কখনো কখনো কাচের মত মনে হয়। এ গুড় বাইরের দিকে শক্ত তবে ভিতরে রসে পরিপূর্ণ। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এ পাটালির ব্যাপক চাহিদা। যশোরের খেজুরের গুড় থেকে শুধু গুড় ও পাটালি তৈরি হয় না, অতীতে রস ও গুড় থেকে চিনি উৎপন্ন হতো যা বর্তমান প্রজন্মের কাছে রূপকথার কাহিনী বলে মনে হবে। বহু আগে এ এলাকায় খেজুরের গুড় থেকে চিনি তৈরি ছিল প্রধান শিল্প। ১৯৯১ সালে যশোর কালেক্টরের এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, খেজুর গুড় হতে উৎপাদিত ২০ হাজার মণ চিনির অর্ধেক কলকাতায় চালান দেয়া হয়েছিল। এতে বাংলাদেশ প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত।
আজ থেকে ৩০/৩৫ বছর আর্গে যশোর জেলার প্রতিটি মাঠে খেজুর গাছের বাগান সবার চোখে পড়ত। দেখা যেত গরমের দিনে রাখাল গরু চরাতো আর খেজুর গাছের ছায়ায় বাঁশি বাজাত। গাছের ছায়ায় বসে পথিক তার ক্লান্তি দূর করত। অনেক সময় বিশ্রাম গ্রহণকারী পথচারী খেজুর পাতার পত পত শব্দে নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়ত। মোট কথা, যশোরের পথে ঘাটে, বাড়ির উঠানে যে সারিবদ্ধ খেজুর গাছ ছিল তা আজ আর নেই। আগে শতকরা ৫০/৬০টি পরিবারেরই খেজুর গাছ ছিল। এখন তা শতকরা ২/৩ ভাগে নেমে এসেছে। কয়েক বছর আগে যশোর এলাকায় যে পরিমাণে গাছ ছিল তার বেশীর ভাগই এখন নেই। বর্তমানে বাণিজ্যিক স্বার্থের পরিবর্তে গাছিরা শুধুমাত্র রসনা পরিতৃপ্তির জন্য খেজুর গাছ ব্যবহার করার কারণে খেজুর গাছ শূন্য হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, বেশ কয়েক বছরের ব্যবধানে খেজুর গাছ ইট ভাটার জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া গ্রাম বাংলার অধিকাংশ দরিদ্র মানুষ রান্নার কাজে খেজুর গাছের পাতা বা ডাল জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে যার ফলে অপ্রাপ্ত বয়সে অনেক খেজুর গাছ মরে যাচ্ছে। তাছাড়া উইপোকা ও গন্ডারপোকা গাছের ছালে ও সুরঙ্গ করে খেজুর গাছ ধ্বংস করে ফেলে। খেজুরের রস যশোরের যশ হলেও তা আজ বিলুপ্তি পথে মানুষের নিষ্ঠুর কঠারাঘাতে।
শরতের শেষ দিক থেকে যশোর জেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামে খেজুর রস আহরণের প্রস্তুতি শুরু হয়। প্রস্তুতির প্রথম পর্যায়ে গাছ তোলা, দ্বিতীয় পর্যায়ে চাচ দেয়া, গাছ ভালভাবে শুকিয়ে গেলে তৃতীয় পর্যায়ে বিশেষ উপায়ে গাছে বাশের নল আটকানো হয়। রস সংগ্রহের জন্য গাছে ভাড় আটকাতে লাগানো হয় বাঁশের খিল বা দড়ি। তারপর থেকে পালা করে ধারালো দা দিয়ে পরিমাণ মত গাছ কেটে আহরণ করা হয় রস। আ্যালুমিনিয়াম বা মাটির বড় পাত্রে রস জ্বাল দিয়ে গুড় ও পাটালি তৈরি করা হয়। এই গুড় থেকে বিশেষ উপায়ে তৈরি হতো মূল্যবান খেজুরের চিনি।
শীতের সকালে প্রতিটি বাড়িতে রস, গুড় আর পাটালি খাওয়ার ধূম পড়ে যায়। নতুন গুড়ের সুবাসে সমস্ত এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। অনেক সময় শহরের পেশাজীবীরা রসের পায়েশ আর পিঠা খাওয়ার জন্য গ্রামে ভিড় জমায়। শীতের সারা মওসুমে চলে রসের পায়েস আর পিঠা খাওয়ার আতিথেয়তা। সে সময় বাঙালি সংস্কৃতির এক সুন্দর রূপ ফুটে ওঠে। তবে বর্তমানে এরকম দৃশ্য কিছুটা হলেও কমেছে।
গ্রামের অনেক দিনমজুর খেজুর গাছ কেটে রস ও গুড় বিক্রি করে তাদের সংসার চালাত। অবস্থাপন্নরা তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত গুড় পাটালি দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করে প্রচুর নগদ অর্থ লাভ করত। কিন্তু বর্তমানে খেজুর শিল্প সংকটজনক অবস্থার ভিতর দিয়ে অতিক্রম করছে।
বর্তমানে এই খেজুর সম্পদ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশের অন্যান্য স্থানের চেয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বিশেষ করে যশোর অঞ্চলে প্রচুর খেজুর গাছ জন্মাত। কোন রকম খরচ ও পরিচর্যা ছাড়াই অযত্ন অবহেলায় বেড়ে উঠত খেজুর গাছ। অর্থকরী এই খেজুর গাছকে অন্যান্য গাছের মত তেমন পরিচর্যা করতে হয় না। এই গাছ গরু ছাগলে নষ্ট করার ভয় তেমন একটা থাকে না। এর চারা বর্ষাকালে রোপন করলে সহজেই বেঁচে যায়। চারার জন্য বীজতলার কোন প্রয়োজন নেই। খেজুরের বীজ যেখানে পড়ে সেখানেই চারা গজিয়ে বড় হয়। তবে পরিকল্পনা মাফিক বপন করলে ৫/৭ বৎসরের মধ্যে রস আহরণের উপযোগী হয়। সাধারণত ছোট গাছের চেয়ে বড় গাছের রস বেশি সুস্বাদু এবং গুড়, পাটালি ও বেশি চিনি উৎপাদিত হয়। এই গাছ অত্যন্ত শক্ত ও আঁশযুক্ত। এই গাছ ২০/৩০ হাত পর্যন্ত লম্বা হতে দেখা যায়। তবে আমরা যে পরিমাণ গাছ জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করি সেই পরিমাণ গাছ লাগাই না। যা কিছু লাগাই তাও আবার পরিকল্পিতভাবে লাগাই না। রেলপথ, সড়কপথ ও নদীর দু’ধারে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় গাছ লাগানো যেতে পারে। সাধারণত ৪/৫ হাত দূরত্বে ৬০ থেকে ৯০ সেন্টিমিটার গর্ত করে মাটি ভালভাবে রোদ খাইয়ে এক মাস পর ছাই, মাটি ও গোবর (১:১:১) দিয়ে পূরণ করতে হবে। এর পর গাছ লাগাতে হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ছায়া ও রোদ এবং শুষ্ক মৌসুমে সেচ ও বর্ষার সময় পানি নিষ্কাশণের ব্যবস্থা করে প্রতি বছরই জৈব ও অজৈব সার প্রয়োগ করলে খেজুর গাছে বেশি রস পাওয়া যায়।
যশোরের পল্লীবধূরা এক সময় খেজুর পাতা দিয়ে বিভিন্ন প্রকার নকশা করা পাটি, ঝুড়ি, ঝাড়ু ও অন্যান্য জিনিস তৈরি করত। সেসব জিনিস সযত্নে বাজারজাত করা হতো। বিদেশীরা খেজুর পাতার কারুকার্যখচিত বিভিন্ন জিনিস দেখে মুগ্ধ হত। এখনও কোথাও কোথাও এ সবের প্রচলন আছে তবে অনেক কমে গেছে এসব জিনিস পত্রের ব্যবহার। কিন্তু বর্তমানে যশোরের এ অর্থকরী সম্পদ এক শ্রেণীর অর্থলোভী মানুষের চক্রান্তে বিলীন হতে চলেছে। প্রতি বছর হাজার হাজার গাছ কেটে ইটের ভাটায় পোড়ানো হচ্ছে। এতে করে হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে প্রকৃতি আর বিলুপ্ত হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, খেজুর রস ও গুড় উৎপাদকেরা নানাভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে। পুঁজির অভাব, জ্বালানী সংকট, উৎপাদন উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, বাজারজাত করণের সংকটে খেজুর গুড় শিল্পের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নানাবিধ সমস্যার মধ্যদিয়ে অতিক্রম করছে। যশোর অঞ্চলে যেহেতু প্রচুর পরিমাণে খেজুর গাছ জন্মে, সেজন্য যশোরের ঐতিহ্য খেজুরের গুড় শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে যদি তুলা উন্নয়ন বোর্ডের মত খেজুর উন্নয়ন বোর্ড গঠন করে পরিকল্পিতভাবে সড়ক ও রেল লাইনের ধারে, অনাবাদী জমিতে খেজুর গাছ রোপন করার সরকারি বেসরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় তবে সহজেই যশোরের গৌরব আর ঐতিহ্যের প্রতীক খেজুর সম্পদকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। অর্থকরী খেজুরের রস, গুড়, পাটালির আগের রমরমা অবস্থা আবারো ফিরে আসবে। ‘যশোরের যশ খেজুরের রস’ প্রবাদটি আবারো প্রতিষ্ঠিত হবে, প্রতিষ্ঠিত তবে কবির বাণী-
“খর্জ্জুর বীথি নারিকেল তরু মাঠ-ঘাট-প্রান্তর ফুলে ফলে ভরা দিগন্ত প্রসারী সীমান্ত জেলা আমাদের- এ যশোহর” |
তথ্য সংগ্রহ :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
সম্পাদনা :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
০১.০৪.২০১১