
Home রাজনীতিবিদ / Politicians > খান সাহেব আব্দুল আজিজ / Khan Saheb Abdul Aziz (1879-1944)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 17945 বার পড়া হয়েছে
খান সাহেব আব্দুল আজিজ / Khan Saheb Abdul Aziz (1879-1944)
খান সাহেব আব্দুল আজিজ
Khan Saheb Abdul Aziz
Home District: Jessore, Chowgacha
Khan Saheb Abdul Aziz
Home District: Jessore, Chowgacha
পারিবারিক পরিচিতি:
যশোর জেলার রাজনীতির ইতিহাসে খান সাহেব আব্দুল আজিজ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। বৃহত্তর যশোর, খুলনা ও পশ্চিম বঙ্গের বনগাঁ এই বিশাল এলাকায় সম্ভাবত খান সাহেব আব্দুল আজিজই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীন ব্যক্তি। তাঁর আগে আর কেউ ছিলেন কিনা তা না জানা যায় না। এই প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ১৮৭৯ সালে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলায় নারায়নপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা বহরম উদ্দীন বিশ্বাস ও দাদা রতন বিশ্বাস তৎকালীন সময়ে নারায়নপুর গ্রামের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ছিলেন।

পূর্ব পূরুষদের সেই শত বছরের ঐতিহ্য আজও ধরে রেখেছেন পরিবারের পরবর্তী বংশধরগণ। খান সাহেব আব্দুল আজিজের ভাইপো ছিলেন আব্দুর রউফ যিনি একাধারে একজন কবি, সাহিত্যিক, চিকিৎসা বিজ্ঞানী, সমাজসেবক ও একজন শিক্ষাবিদ। ১৯১৯ সালে এন্ট্রান্স, ১৯২১ সালে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯২৩ সালে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগ নিয়ে বি.এ পাশ করেন। তৎকালীন সময়ে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবিভক্ত বাংলায় বি. এ. শ্রেণীতে মাত্র দুই জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন, তার মধ্যে আব্দুর রউফ একমাত্র মুসলমান ছাত্র যিনি এই কৃতিত্বের অধিকারী। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তান আর্মী তাঁকে গুলি করে হত্যা করে।
আব্দুর রউফ এর ছেলে গোলাম মাজেদ যিনি যশোরের এক সময়ের বহুল প্রচলিত দৈনিক রানার পত্রিকার প্র

রাজনৈতিক জীবন:
খান সাহেব আব্দুল আজিজ একাধারে ৩০ বছর ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট, ২২ বছর লোকাল বোর্ডের মেম্বার এবং ১৫ বছর জেলা বোর্ডের (District Council) মেম্বার ছিলেন। এই সময়ে তিনি নিজ এলাকার বহু জনকল্যাণমূলক কাজ করেন, আর এজন্যেই তিনি District Council থেকে গভর্নমেন্ট কর্তৃক খান সাহেব উপাধিতে ভূষিত হন।

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ব্যরিস্টার হয়ে আসার পর ভারতবর্ষে মুসলিমলীগ নামে নতুন একটি দল গঠন করেন। ঐ সময় যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগুনা যৌথভাবে একজন MLC এর অধীনে ছিলো। তৎকালীন সময় এ এলাকায় MLC নির্বাচনের ঘোষণা হলো। নির্বাচনে প্রার্থী হলেন পাঞ্জাবের ফজলে এলাহী। মুসলিম লীগের চেয়ারম্যান হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দী সে সময়ে নিজ দলের মধ্য থেকে MLC নির্বাচনের জন্যে কোন যোগ্য প্রার্থী খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সোহরাওয়ার্দী সাহেব অত্র এলাকা থেকে পাঞ্জাবের ফজলে এলাহীর বিপরীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য একজন MLC প্রার্থীর ঘোষণা দিলেন। কিন্তু ফজলে এলাহীর বিপরীতে কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে সাহস পাচ্ছিলেন না। কোলকাতার গড়ের মাঠে এক মিটিংএ আব্দুল আজিজ ফজলে এলাহীর বিপরীতে নির্বাচন করার জন্য প্রথম ঘোষণা দিলেন। খুলনার খান এ. সবুর ও যশোরের শামসুল হুদা তখন ছাত্রনেতা ছিলেন। সবাই তখন করতালি দিয়ে আব্দুল আজিজকে অভিনন্দন জানালেন। পরদিন গড়ের মাঠে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের উপস্থিতিতে আব্দুল আজিজকে সম্বোর্ধনা দেয়া হলো এবং এর মধ্য দিয়ে তিনি এ নির্বাচনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করলেন।

এর মধ্যে হঠাৎ করে খুলনা বি. এল কলেজ ও বাগেরহাটের প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজের ছাত্ররা জনাব আজিজের পক্ষে নির্বাচন করতে অসম্মতি জানালেন। কারণ এত বড় একটা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে একজন প্রার্থীর যে পরিমান অর্থের প্রয়োজন হয় তা আজিজ সাহেবের ছিল না। অন্যদিকে নির্বাচনে প্রচারনার জন্য গাড়ীর প্রয়োজন। সেটাও আজিজ সাহেব দিতে ব্যর্থ হন। এই সময় খুলনার খান এ. সবুর, যশোরের শামসুল হুদা ও তসবীর মহলের মালিক বি. সরকারসহ আরও বেশকিছু খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে নির্বাচনী প্রচারনার জন্যে ১০০টি গাড়ী সংগ্রহের প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু সোহরাওয়ার্দি সাহেব এক সাথে এতগুলো গাড়ী সংগ্রহ করা অসম্ভব মনে করলেন। তখন আব্দুল আজিজের পক্ষে নির্বাচন করা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়লো। পরবর্তীতে সোহরাওয়ার্দি সাহেব দিল্লী ও মুম্বাইসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ন শহর থেকে সেই সময়কার ধনী ব্যবসায়ী মাড়োয়ারীদের কাছ থেকে ৯০টি গাড়ী সংগ্রহ করলেন। গাড়ীগুলি যশোর জিলা স্কুলের মাঠ ও টাউন হলের মাঠে রাখা হয়েছিলো। এখান থেকে গাড়ীগুলি বিভিন্ন কলেজসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে নির্বাচনী প্রচারনার জন্যে পাঠানো হলো।
এর মধ্যে এক দিন পাঞ্জাবের ফজলে এলাহী যশোরে এক নির্বাচনী জনসভায় বাঙ্গালীদের প্রতি বিরূপ মন্তব্য করে বললেন “লোভী বাঙ্গালীদের কাছ থেকে তিনি টাকা দিয়েই সব ভোট কিনে নিবেন”। তার এই কথায় বহু বাঙ্গালী ক্ষিপ্ত হয়ে সাবাই এক হয়ে খান সাহেবের পক্ষে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সময় ভোট দেবার অধিকার ছিল কেবলমাত্র যাদের ৫ টাকা ট্যাক্স দেবার মত সামর্থ্য ছিল।
৩ মাস ধরে নির্বাচন চলার পর ফলাফলের দিন খবর আসলো কোলকাতার দিকে সমস্ত সেন্টারে আজিজ সাহেব পরাজিত। এই সংবাদ শোনার পর আব্দুল আজিজ সঙ্গাহীন হয়ে পড়েন। ঐ দিন রাত ২টার সময় সোহরাওয়ার্দী সাহেব ফোন করে জানালেন যে তারা ১৭৪ ভোটে জয়লাভ করেছেন। এই জয়ের ফলে জনাব আব্দুল আজিজ যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগুনার জেলা প্রতিনিধি হিসাবে ৯ বছরের জন্যে বাংলার আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন।
শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক ছিলেন জনাব আজিজের রাজনৈতিক সহযোদ্ধা। ফজলুল হক ছিলেন তৎকালীন মুসলিমলীগের মন্ত্রী, নড়াইলের সৈয়দ নওশের আলী ছিলেন স্পীকার এবং হোসেন সহিদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা ও দলীয় প্রধান।
জনসেবামূলক কর্মকান্ড:
MLC নির্বাচিত হবার পর জনাব আজিজ তাঁর নির্বাচনী এলাকায় বহু ছেলেদেরকে যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি দিয়েছিলেন। কোলকাতায় তাঁর একটি হোস্টেল ছিল যেখানে এ এলাকার শিক্ষিত বেকার ছেলেদের থাকা ও খাওয়ার সুব্যাবস্থা ছিল। তিনি সম্পূর্ণ নিজের টাকায় হোস্টেলটি পরিচালনা করতেন। তাঁর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হচ্ছে তিনি একদিনে প্রায় ৭০০ ছেলের চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের সকল ছেলেদেরকে তিনি ভাইপো বলে পরিচয় দিতেন। এ কারণে একদিন শেরে বাংলার এ কে ফজলুল হক জনাব আজিজ কে বলেই বসলেন “আজিজ তোমার ভাইপো সংখ্যা কত” ?
নিজ গ্রাম চৌগাছা নারায়ণপুরে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র, একটি হাইস্কুল ও ইউনিয়ন কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। তাঁর নির্বাচনী এলাকায় এমন আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা জনাব আজিজ।
বনগাঁ থেকে চৌগাছা ও মহেষপুর পর্যন্ত রাস্তাটি তৈরীর কৃতিত্ব খান সাহেব আব্দুল আজিজের। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাস্তাটি পাকা করার, কিন্তু হঠাৎ মৃত্যুর কারণে সে আশা পূরণ হয়নি। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি নড়াইল-কালিয়ার রাস্তাসহ আরও বহু রাস্তা নির্মাণ করে গেছেন।
মৃত্যু:
৯ বছরের জন্যে খান সাহেব আব্দুল আজিজ যশোর, খুলনা ও চব্বিশ পরগুনা জেলার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন মাত্র ৫ বছর। ১৯৪৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর, রবিবার সন্ধা ৭ টার সময় ব্লাড প্রেসার রোগে আক্রান্ত হয়ে কোলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মার্টিন ওয়ার্ডে তাঁর হয়। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। নারায়নপুর গোরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়। হোসেন সহিদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব তাঁর জানাযায় অংশ নিতে নারায়াণপুরে গিয়েছিলেন। খান সাহেব আব্দুল আজিজ ব্যক্তিগত জীবনে নি:সন্তান ছিলেন।
তথ্য সূত্র:
বিভিন্ন প্রবীণ ব্যক্তির দেয়া তথ্য
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট:
অক্টোবর ২০১১