
Home ধর্ম-সাধক / Religion-saint > হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (রঃ) / Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir (Rh.)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 18425 বার পড়া হয়েছে
হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (রঃ) / Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir (Rh.)
হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (রঃ)
Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir (Rh.)
Hazrat Pir Ali Muhammad Tahir (Rh.)
হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (রঃ) হযরত উলুখ খান জাহান (রঃ) এর একজন অন্যতম শিষ্য ছিলেন। তিনি খাঁটি বাঙালী হয়েও অন্য সবাইকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারে মুহাম্মদ তাহির জন্মগ্রহণ করেন। মুহাম্মদ তাহির ব্রাহ্মণ থাকাকালীন তাঁর নাম ছিল গোবিন্দলাল রায়। তবে তিনি গোবিন্দ ঠাকুর নামেই বেশী পরিচিত ছিলেন।
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) বারোবাজার থেকে যশোরের মুরলী কসবা হয়ে পয়গ্রাম কসবায় গিয়েছিলেন। পয়গ্রাম কসবায় তিনি দশ বৎসর অতিবাহিত করেছিলেন। হযরত খান জাহান আলী (রঃ) এর পরশে গোবিন্দলাল রায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করা পর তাঁর নাম হয়েছিল হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (রঃ)। তিনি খান জাহানের প্রধান সহচর, প্রিয়পাত্র ও আমাত্য ছিলেন। খান জাহানের এদেশীয় শিষ্যগণের মধ্যে তিনি বেশী প্রসিদ্ধ ও জননন্দিত ছিলেন। তাঁর হাতে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল।
খুলনা জেলার দক্ষিণ ডিহিতে উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুরা বসবাস করত। পূর্বে এই গ্রামের নাম ছিল পয়গ্রাম। এখনও সে নাম বিলুপ্ত হয়নি। তুর্ক আফগান আমলের প্রথম দিকে এখানকার ব্রাহ্মণ রায় চৌধুরী বংশ রাজ সরকার হতে সম্মানজনক রায় চৌধুরী উপাধিপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। খান জাহানের সময়ও চৌধুরিগণ সমাজে সম্মানিত ছিলেন। দক্ষিণা নারায়ণ ও নাগর নাথ এই বংশের কৃতি সন্তান ছিলেন। নাগর নিঃসন্তান। দক্ষিণা নারায়ণের কামদেব, জয়দেব, রতিদেব ও শুকদেব নামে চারি পুত্র ছিল।
কামদেব ও জয়দেব নবাগত শাসনকর্তা হযরত খান জাহান আলীর অধীনে উচ্চপদ গ্রহণ করেছিলেন এবং মোহাম্মদ তাহিরের চেষ্টায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে কথিত আছে। পীর আলী তাহাদিগকে জামাল উদ্দীন ও কামাল উদ্দীন খাঁ চৌধুরী উপাধি দিয়ে আমাত্য শ্রেণীভুক্ত করে নিয়েছিলেন। অন্য দুই ভ্রাতা সংস্রব দোষে ব্রাহ্মণ ই থেকে গেলেন। তাহেরের ইসলাম গ্রহণের পূর্বে যে পুত্র সন্তান ছিল তিনিও হিন্দু থেকে যান। তিনিই সর্বপ্রথম হিন্দু পিরালি। এজন্য হিন্দু সমাজ তাহেরকে উপহাস করতো। রতিদেব ও শুকদেব পীরালি ব্রাহ্মণ হিসেবে সমাজে পরিচিত হইলেন। ঐকান্তিক ধর্মনিষ্ঠার জন্য তাহের শেষ পর্যন্ত পীরালি আখ্যায় আখ্যায়িত হন। ইহাই পীরালি সমপ্রদায়ের উৎপত্তির ইতিকথা।
হযরত খান জাহান আলী (রঃ) হযরত পীর আলি মুহাম্মদ তাহির (রঃ) কে পয়গ্রাম অঞ্চলের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন। নবদীক্ষিত কামাল উদ্দীন ও জামাল উদ্দীন প্রচুর সম্পত্তির জায়গীর পেয়ে সিঙ্গিয়া অঞ্চলে বাস করতেন। খান জাহানের পয়গ্রাম ত্যাগের পরেই সম্ভবত তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিল। তিনি তাদের উচ্চ সম্মানে সম্মাতি করেছিলেন। এই দুই ভ্রাতা বাগেরহাটে মাঝে মাঝে যেয়ে খান জাহানের সহিত সাক্ষাত করতেন। বাগেরহাটের পশ্চিমে সোনাতলা গ্রামে আজও কামাল খাঁ নামের দীঘি আছে।
ঘটকদিগের পুঁথিতে মুহাম্মদ তাহিরের পরিচয়ে দেখানো হয়েছে যে, ইসলামের আদর্শে আকৃষ্ট হয়ে নয় কোন নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তিনি মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের হাতে হাজার হাজার অমুসলিম ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন ইসলামের সুমহান আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে।
ঘটকদিগের পুঁথির ভাষায়- খান জাহান মহামান পাতশা নফর যশোর সনন্দ লয়ে করিল সফর।। তার মুখ্য মহাপাত্র মামুদ তাহির মারিতে বামুন বেটা হইল হাজির।। পূর্বেতে আছিল সেও কলিনের নাতি মুসলমানী রুপে মজে হারাইল জাতি।। পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস। যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইল সর্বনাশ।। সুবিধা পাইয়া তাহির হইল উজির চেঙ্গুটিয়া পরগণায় হইল হাজির।। আঙ্গায় বসে আছে উজীর তাহির। কত প্রজা লয়ে ভেট করিছে হাজির।। রোযার সেদিন পীর উপবাসী ছিল। হেন কালে একজন নেবু এনে দিল।। গন্ধামোদে চারিদিকে ভরপুর হইল। বাহবা বাহবা বলে নাকেতে ধরিল।। কামদেব জয়দেব পুত্র দুইজন। বসেছিল সেইখানে বুদ্ধে বিচক্ষণ।। কি করেন কি করেন বলিলা তাহিরে। ঘ্রাণেতে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রের বিচারে কথায় বিদ্রুপভাবি তাহির অস্থির।। গোঁড়ামি ভাঙ্গিতে দোহের মনে কৈলা স্থির দিন পরে মজলিশ করিল তাহির। জয়দেব কামদেব হইল হাজির।। দরবারের চারিদিকে ভোজের আয়োজন শতশত বকরী আর গোমাংস রন্ধন।। পলাভু লসুন গন্ধে সভা ভরপুর। সেই সভায় ছিল আরও ব্রাহ্মণ প্রচুর।। নাকে বস্ত্র দিয়া সবে প্রমাদ গুণিল। ফাঁকি দিয়া ছলে বলে কত পালাইল। কামদেব জয়দেব করি সম্বোধন। হাসিয়া কহিল ধুর্ত তাহির তখন।। জারি জুরি চৌধুরি আর নাহি ঘাটে। ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন শাস্তে আছে বটে।। নাকে হাত দিলে আর ফাঁকি তো চলে না। এখন ছেড়ে ঢং আমার সাথে কর খানাপিনা।। উপায় না ভাবিয়া দোহে প্রমাদ গণিল। হিতে বিপরীত দেখি শরম মরিল।। পাকড়াও পাকড়াও হাক দিল পীর। থতমত হয়ে দোহে হইল অস্থির।। দুইজনে ধরি পীর খাওয়াইল গোস্ত। পীরালি হইল তাঁরা হইল জাতি ভ্রষ্ট।। কামাল জামাল নাম হইল দোহার। ব্রাহ্মণ সমাজে পড়ে গেল হাহাকার।। তখন জাকিয়া দোহে আলী খানজাহান। সিঙ্গির জায়গীর দিল করিতে বাখান।। |
পুঁথিতে পাওয়া যায়, হযরত খান জাহান আলী (রঃ) কোন মুসলমান সুলতানের সনদপ্রাপ্ত প্রশাসক। সেসময় ইসলামের সুমহান আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের হাতে যেসব অমুসলিম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করত তারা পীরালি নামে পরিচিত হত। কোন হিন্দু মুসলমান হলে হিন্দু আত্মীয়রা ঐ বংশের লোকদেরকে সমাজচ্যুত করত। তারা পীরালি ব্রাহ্মণ বা পরালি কায়স্থ নামে পরিচিত হত। এই পীরালিদের কুলিন ব্রাহ্মণ রা ঠাট্টা করে বলত-
“মোসলমানের গোস্ত ভাতে
জাত গেল তোর পথে পথে।”
পীরালি সমপ্রদায় হিন্দু মুসলমান উভয় সমপ্রদায়ের ঐতিহ্য বহন করত। কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবার, সিঙ্গিয়ার মুস্তফী পরিবার, দক্ষিণডিহির রায় চৌধুরী পরিবার, খুলনার পিঠা ভোগের ঠাকুর পরিবার পীরালিদের উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত।
পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের উত্তরসূরী ছিলেন শ্রী চৌতন্য এবং তিনি পীরালি সম্প্রদায়কে বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন। শ্রী চৌতন্যের প্রভাবে নির্যাতিত হিন্দু পীরালি সমাজ একাধারে ইসলাম ধর্ম ও বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে শান্তি খুঁজে পেয়েছিলেন।
হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের চেষ্টায় নবদ্বীপে এত অধিক ব্রাহ্মণ মুসলমান হয়েছিল যে, সেখানে প্রায় ব্রাহ্মণ ছিল না। পুঁথির ভাষায়-
পীরাল্যা গ্রামেতে বৈসে যতেক যবন।
উচ্ছ্ন করিল নবদ্বীপের ব্রাহ্মণ ।।
ব্রাহ্মণ জবনে বাদ যুগে যুগে আছে।
বিষম পীরাল্যা গ্রাম নবদ্বীপের কাছে।।
৮৬৩ হিজরী/১৪৫৯ সালে এই মহান ইসলাম প্রচারক ইন্তেকাল করেন। তাঁর মাযার হযরত খান জাহান আলীর মাযারে পাশেই অবস্থিত। তাঁর মাযারের শিলালিপিতে লেখা আছে, “হাজিহি রওজাতুল মির রিয়অজিল জান্নাতি ওয়া হাজিহি সাখরিয়া তুল লিহাবীহি এসমূহ মুহাম্মদ তাহির ছালাছা সিত্তিনা ওয়া সামানিয়াতা। অর্থাৎ বেহেশতের বাগিচা সদৃশ স্থানে জনৈক বন্ধুর মাযার, নাম আবু তাহির, ওফাত কাল ৮৬৩হিঃ/ ১৪৫৯ খৃষ্টাব্দ।
এই মহান সাধক পীর আলী মুহাম্মদ তাহিরের জন্মস্থান হচ্ছে বৃহত্তর যশোরের অন্তর্গত নড়াইল জেলার পেড়োলি গ্রামে। তাঁর নাম অনুসারে গ্রামটির নাম হয়েছিল ‘পীরালি’। বর্তমানে গ্রামটি পেড়োলি নামে পরিচিত। তিনি আমাদের মাঝে আজীবন বেঁচে থাকবেন। ইসলাম প্রচারের জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য এদেশের মানুষ তাঁকে স্মরণ করবে।
সম্পাদনা :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ আপডেট :
১৮.০৫.১১