
Home সাহিত্যিক / Litterateur > অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ / Aghoranath Kabyatirtha (1872-1943)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 9583 বার পড়া হয়েছে
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ / Aghoranath Kabyatirtha (1872-1943)
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ
Aghoranath Kabyatirtha
Home District: Narail, Lohagara
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ প্রাচীন যাত্রাপালাকারদের মধ্যে অন্যতম। আধুনিক যাত্রাপালার আগে বেশি জনপ্রিয় ছিলো ঐতিহাসিক পালা। ঐতিহাসিক পালার আগে বেশি প্রচলিত ছিলো পৌরাণিক যাত্রাপালা। অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ পৌরাণিক যাত্রাপালা রচনা করে অবিভক্ত বাংলায় খ্যাতির শীর্ষে আরোহন করেছিলেন।
জন্ম ও শৈশব:
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ ১৮৭২ সালে বর্তমান নড়াইলে জেলার লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অঘোরনাথের পারিবারিক পদবি ছিলো ভট্টাচার্য। তবে স্থানীয় টোল হতে কাব্যতীর্ঘ পাশ করার পরে তিনি তার কৌলিক পদবি হারিয়ে কাব্যতীর্থ পদবিতে ভূষিত হন। বাল্যকালে পূজাপার্বন উপলক্ষে গ্রামীণ যাত্রা পালার অভিনয় দেখে অঘোরনাথ যাত্রার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। তিনি প্রথম জীবনে এমেসারি যাত্রা পালায় অভিনয় করেন এবং পড়াশুনা চালিয়ে যান। টোল হতে সংস্কৃত বিদ্যা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেন। জীবন ও জীবিকার টানে অঘোরনাথ মাহনগরী কলকাতায় পাড়ি জমান এবং বিদ্যাবুদ্ধি ও পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়ে অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলের হেডপন্ডিত নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য, এই ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়াশুনা করেছিলেন।
পেশা:
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ সারা জীবন শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তবে তার মূল নেশা ছিলো যাত্রা শিল্পের উন্নয়ন করা। প্রথম জীবনে তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল ও পরে লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও মল্লিকপুর দক্ষবালা বিদ্যানিকেতনে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতায় পেশায় থেকে অঘোরনাথ বেশ অর্থ উপাজন করেছিলেন। তিনি তার পৈত্রিক ভিটেয় একটি সুদর্শন দরদালান নিমার্ণ করেছিলেন।
রচিত যাত্রাপালা:
অঘোরনাথ শৈশবের যাত্রাপ্রীতি থেকে যাত্রাপালা রচনা শুরু করেন। তার অধিকাংশ যাত্রা পালায়ই রামায়নও মহাভারতের কাহিনীআশ্রিত। তিনি পৌরাণিক পালা রচনায়ই বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। অঘোরনাথের আমলে নড়াইলের জমিদার বাবু ও হাটবাড়িয়ার জমিদারদেরা যেমন যাত্রা শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তেমনি কোনো কোনো জমিদার যাত্রা দল তৈরি করে এই শিল্পের উন্নয়ন সাধন করেন। জানা যায়, যাত্রাপালাকার অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ নড়াইলের জমিদারদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পালা রচনায় উৎসাহিত হন এবং রচিত পালা প্রচারের ব্যাপক সুযোগ লাভ করেন। নড়াইলের আরেক কৃতি সন্তান কবিয়াল বিজয় সরকার শৈশবে অঘোরনাথের দাতাকর্ণ, ধর্মের জয়, হরিশচন্দ্র, অনন্ত মাহাত্য, যাত্রাপালায় একানে বালকের গান পরিবেশন করে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেন।
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ নিম্নোক্ত যাত্রাপালার নাম জানা যায়: মগধ বিজয় (১৯০৩), দাতাকর্ণ (১৯০৪), সমুদ্রমন্থন (১৯০৪), ধর্মের জয় (১৯১৩), হরিশচন্দ্র (১৯১৪), অনন্ত মাহাত্ম্য (১৯১৬), কুরুপরিনাম (১৯২১), বিজয়বসন্ত বা সৎমা (১৯২১), অদৃষ্ট (১৯২১), চন্দ্রকেতু (১৯২২), মেবার কুমারী (১৯২৩), চিত্রাঙ্গদা (১৯২৩), তরনীর যুদ্ধ (১৯২৪), নহুষ উদ্ধার (১৯২৫), প্রতিজ্ঞা পালন (১৯২৫), রাধাসতী (১৯২৫), তারকাসুর বধ (১৯২৬), নলদময়ন্তী (১৯২৭), শতাশ্বমেথ (১৯২৯), নদের নিমাই (১৯৩৫), প্রহ্লাদ (১৯৩৫), অসুধবজের হরিসাধনা (১৯৩৬), জয়দেব (১৯৩৭),যাজ্ঞসেনী প্রভূতি।
অঘোরনাথের রচিত অধিকাংশ পালাই পৌরাণিক। তবে তিনি উল্লেখযোগ্য কয়েকখানি ঐতিহাসিক যাত্রাপালাও রচনা করেছেন। অঘোরনাথের রচিত পালার বৈশিষ্ট হলো, তার রচিত সংলাপ ছিলো দীর্ঘ তবে সংলাপ জটিল ছিলো না। তার অপ্রচলিত ধারার তানের গান, এখানে বালকের গান, যাত্রাব্যালে, আদি রযাত্মক দ্বৈতসঙ্গীত প্রভৃতির সঙ্গে যোগ সূত্রহীন নিরপেক্ষ। তিনিই যাত্রার নতুন চরিত্রসৃষ্টি করেছেন। এবার আমরা পালাকার অঘোরনাথ কাব্যতীর্থের কুরুপরিনাম পালার একটি গানের গাদ্যিকরূপ উদ্ধৃত করছি:
‘(দিদিলো) বালছি শোনো বালাই শোনো ঠান্ডা এবার হল দেশ বাস্ত্র ঘুঘুর বাচ্চা মামা যমের ঘরে গেল শেষ।
এমন মামার জোড়াটি আর মেলেনা কোথাও, দেখা হলে বাসতে পার কালনেমীও হেরে যায়। কীর্তিধ্বজা উড়িয়ে মামা রাখলে নামটা বেশ।।’
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ পৌরাণিক পালা রচনা কালের এক অবিস্মরণীয় পালাকারের নাম। তিনি সেযুগে যাত্রাপালারচনায় যে ভূমিকা পালন করেছেন তা কোনো ভাবেই মুছে যাবার নয়। পৌরাণিক পালা রচনা করলেও অঘোরনাথ লোকশিক্ষার বিষয়টিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করেন নি।
লেখকঃ
কবি মহসিন হোসাইন
নড়াইল
জন্ম ও শৈশব:
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ ১৮৭২ সালে বর্তমান নড়াইলে জেলার লোহাগড়া উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অঘোরনাথের পারিবারিক পদবি ছিলো ভট্টাচার্য। তবে স্থানীয় টোল হতে কাব্যতীর্ঘ পাশ করার পরে তিনি তার কৌলিক পদবি হারিয়ে কাব্যতীর্থ পদবিতে ভূষিত হন। বাল্যকালে পূজাপার্বন উপলক্ষে গ্রামীণ যাত্রা পালার অভিনয় দেখে অঘোরনাথ যাত্রার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেন। তিনি প্রথম জীবনে এমেসারি যাত্রা পালায় অভিনয় করেন এবং পড়াশুনা চালিয়ে যান। টোল হতে সংস্কৃত বিদ্যা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে বিশেষ পরিচিতি অর্জন করেন। জীবন ও জীবিকার টানে অঘোরনাথ মাহনগরী কলকাতায় পাড়ি জমান এবং বিদ্যাবুদ্ধি ও পান্ডিত্যের পরিচয় দিয়ে অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুলের হেডপন্ডিত নিযুক্ত হন। উল্লেখ্য, এই ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পড়াশুনা করেছিলেন।
পেশা:
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ সারা জীবন শিক্ষকতা পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। তবে তার মূল নেশা ছিলো যাত্রা শিল্পের উন্নয়ন করা। প্রথম জীবনে তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারি স্কুল ও পরে লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও মল্লিকপুর দক্ষবালা বিদ্যানিকেতনে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। শিক্ষকতায় পেশায় থেকে অঘোরনাথ বেশ অর্থ উপাজন করেছিলেন। তিনি তার পৈত্রিক ভিটেয় একটি সুদর্শন দরদালান নিমার্ণ করেছিলেন।
রচিত যাত্রাপালা:
অঘোরনাথ শৈশবের যাত্রাপ্রীতি থেকে যাত্রাপালা রচনা শুরু করেন। তার অধিকাংশ যাত্রা পালায়ই রামায়নও মহাভারতের কাহিনীআশ্রিত। তিনি পৌরাণিক পালা রচনায়ই বিশেষ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। অঘোরনাথের আমলে নড়াইলের জমিদার বাবু ও হাটবাড়িয়ার জমিদারদেরা যেমন যাত্রা শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন তেমনি কোনো কোনো জমিদার যাত্রা দল তৈরি করে এই শিল্পের উন্নয়ন সাধন করেন। জানা যায়, যাত্রাপালাকার অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ নড়াইলের জমিদারদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় পালা রচনায় উৎসাহিত হন এবং রচিত পালা প্রচারের ব্যাপক সুযোগ লাভ করেন। নড়াইলের আরেক কৃতি সন্তান কবিয়াল বিজয় সরকার শৈশবে অঘোরনাথের দাতাকর্ণ, ধর্মের জয়, হরিশচন্দ্র, অনন্ত মাহাত্য, যাত্রাপালায় একানে বালকের গান পরিবেশন করে বিশেষ সুখ্যাতি অর্জন করেন।
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ নিম্নোক্ত যাত্রাপালার নাম জানা যায়: মগধ বিজয় (১৯০৩), দাতাকর্ণ (১৯০৪), সমুদ্রমন্থন (১৯০৪), ধর্মের জয় (১৯১৩), হরিশচন্দ্র (১৯১৪), অনন্ত মাহাত্ম্য (১৯১৬), কুরুপরিনাম (১৯২১), বিজয়বসন্ত বা সৎমা (১৯২১), অদৃষ্ট (১৯২১), চন্দ্রকেতু (১৯২২), মেবার কুমারী (১৯২৩), চিত্রাঙ্গদা (১৯২৩), তরনীর যুদ্ধ (১৯২৪), নহুষ উদ্ধার (১৯২৫), প্রতিজ্ঞা পালন (১৯২৫), রাধাসতী (১৯২৫), তারকাসুর বধ (১৯২৬), নলদময়ন্তী (১৯২৭), শতাশ্বমেথ (১৯২৯), নদের নিমাই (১৯৩৫), প্রহ্লাদ (১৯৩৫), অসুধবজের হরিসাধনা (১৯৩৬), জয়দেব (১৯৩৭),যাজ্ঞসেনী প্রভূতি।
অঘোরনাথের রচিত অধিকাংশ পালাই পৌরাণিক। তবে তিনি উল্লেখযোগ্য কয়েকখানি ঐতিহাসিক যাত্রাপালাও রচনা করেছেন। অঘোরনাথের রচিত পালার বৈশিষ্ট হলো, তার রচিত সংলাপ ছিলো দীর্ঘ তবে সংলাপ জটিল ছিলো না। তার অপ্রচলিত ধারার তানের গান, এখানে বালকের গান, যাত্রাব্যালে, আদি রযাত্মক দ্বৈতসঙ্গীত প্রভৃতির সঙ্গে যোগ সূত্রহীন নিরপেক্ষ। তিনিই যাত্রার নতুন চরিত্রসৃষ্টি করেছেন। এবার আমরা পালাকার অঘোরনাথ কাব্যতীর্থের কুরুপরিনাম পালার একটি গানের গাদ্যিকরূপ উদ্ধৃত করছি:
‘(দিদিলো) বালছি শোনো বালাই শোনো ঠান্ডা এবার হল দেশ বাস্ত্র ঘুঘুর বাচ্চা মামা যমের ঘরে গেল শেষ।
এমন মামার জোড়াটি আর মেলেনা কোথাও, দেখা হলে বাসতে পার কালনেমীও হেরে যায়। কীর্তিধ্বজা উড়িয়ে মামা রাখলে নামটা বেশ।।’
অঘোরনাথ কাব্যতীর্থ পৌরাণিক পালা রচনা কালের এক অবিস্মরণীয় পালাকারের নাম। তিনি সেযুগে যাত্রাপালারচনায় যে ভূমিকা পালন করেছেন তা কোনো ভাবেই মুছে যাবার নয়। পৌরাণিক পালা রচনা করলেও অঘোরনাথ লোকশিক্ষার বিষয়টিকে কোনোভাবেই উপেক্ষা করেন নি।
লেখকঃ
কবি মহসিন হোসাইন
নড়াইল