
Home যশোর জেলা / Jessore District > যশোর নামকরণের অতীত ইতিহাস / Jessore Naming history
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100186 বার পড়া হয়েছে
যশোর নামকরণের অতীত ইতিহাস / Jessore Naming history
যশোর নামকরণ :
যশোর, সমতটের একটা প্রাচীন জনপদ। নামটি অতি পুরানো। যশোর নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত পাওয়া যায়। যশোর (জেসিনরে) আরবি শব্দ যার অর্থ সাকো। অনুমান করা হয় কসবা নামটি পীর খানজাহান আলীর দেওয়া (১৩৯৮ খৃঃ)। এককালে যশোরের সর্বত্র নদী নালায় পরিপূর্ণ ছিল। পূর্বে নদী বা খালের উপর সাকো নির্মিত হতো। খানজাহান আলী বাঁশের সাকো নির্মাণ করে ভৈরব নদী পার হয়ে মুড়লীতে আগমন করেন বলে জানা যায়। এই বাঁশের সাকো থেকে যশোর নামের উৎপত্তি। তবে এই মতে সমর্থকদের সংখ্যা খুবই কম। ইরান ও আরব সীমান্তে একটি স্থানের নাম যশোর যার সাথে এই যশোরের কোন সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। খানজাহান আলীর পূর্ব থেকেই এই যশোর নাম ছিল। অনেকে অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রতাপদিত্যের পতনের পর চাঁচড়ার রাজাদের যশোরের রাজা বলা হত। কেননা তারা যশোর রাজ প্রতাপাদিত্যের সম্পত্তির একাংশ পুরস্কার স্বরূপ অর্জন করেছিলেন। এই মতও সঠিক বলে মনে হয়। জে, ওয়েস্টল্যাণ্ড তাঁর যশোর প্রতিবেদনের ১৯৩ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেছেন, রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের আগে জেলা সদর কসবা মৌজার অর্ন্তভুক্ত ছিল। বনগাঁ-যশোর পিচের রাস্তা ১৮৬৬-১৮৬৮ কালপর্বে তৈরী হয়। যশোর-খুলনা ইতিহাসের ৭৬ পাতায় লেখা আছে “প্রতাপাদিত্যের আগে লিখিত কোন পুস্তকে যশোর লেখা নাই”। সময়ের বিবর্তনে নামের পরিবর্তন স্বাভাবিক। অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই।
আয়তন ও পরিধি :
ভূ-গোলকে ২১’ ৪৫” - ২৩’ ৪৫” উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯’ ১৫” - ৮৯’ ৫৫” পূর্ব দ্রাঘিমাংশের ভূ-ভাগই যশোর। স্মতর্ব্য, এটি রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের যশোর রাজ্যের পরবর্তীকালের যশোর। কোম্পানী আমলের যশোর। অল্প কথায় ‘গংগা ও ব্রহ্মপুত্রের মধ্যভাগে ব-আকৃতি জায়গাকে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সমান তিন ভাগ করলে মধ্য ভাগের পশ্চিম-উত্তর এবং দক্ষিণ-পূর্ব অংশ ছাড়া অবশিষ্টাংশই যশোর’। তখন জেলার দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৪ কিঃ মিঃ (১৪৪ মাইল) এবং প্রস্থ ৭৬’৮ কিঃ মিঃ (৪৮ মাইল) আদি যশোরের আয়তন ছিল ১৪৫৬০ বর্গ কিলোমিটার (৫৬০০ বর্গ মাইল) যার মধ্যে ৪৪৬১’৬ বর্গ কিলোমিটার (১৭৬০ বর্গ মাইল) সুন্দারবন।
যশোর রাজ্য জনপদের জানা ইতিহাস উজ্জ্বল। বর্তমান জেলা যশোর-ঝিনাইদহ-মাগুরা-নড়াইল-খুলনা-বাগেরহাট-সাতক্ষীরা এবং কুষ্টিয়া ও ফরিদপুরের অংশ বিশেষ এবং বনগাঁ মহাকুমা যশোর রাজ্যভুক্ত ছিলো। খুলনা মহাকুমা বাগেরহাট ও সাতক্ষীরাসহ ১৮৮২ খৃঃ যশোর জেলা হতে আলাদা হয়ে স্বতন্ত্র জেলায় উন্নীত হয়। এই কালপর্ব থেকে প্রাক-পাকিস্তান পর্বে যশোর জেলার আয়তন ছিল ৭৬৫০ বর্গ কিলোমিটার (২৯২৫ বর্গ মাইল) কথিত কালপর্বে যশোর সদর, (১৭৮৮) বনগাঁ ও মাগুরা (১৮৪৫), নড়াইল (১৮৬১) এবং ঝিনাইদহ (১৮৬২) এই পাঁচটি মহাকুমা যশোর জেলাধীন ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হল। বনগাঁ বাদ দিয়ে অন্য চারটি মহাকুমা নিয়ে গঠিত হলো বৃহত্তর যশোর জেলা। যশোর জেলায় যুক্ত হলো বনগাঁর শার্শা ও মহেশপুর থানা। একালে যশোরের আয়তন হলো ৬৫৭৯২ বর্গ কিলোমিটার (২৫৪৭ বর্গ মাইল)। অবকাঠামো ও অপরিবর্তিত প্রশাসনিক ব্যবস্থাধীনে স্বাধীন ও স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটলো। ১৯৮২ সাল উত্তর সামরিক সরকারের পক্ষে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জনাব এইচ এম এরশাদ প্রশাসন গণমুখী করার লক্ষ্যে থানাকে উপজেলায় এবং মহাকুমাকে জেলায় উন্নীত করেন। ঝিনাইদহ জেলা হয় ২৩ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সালে। মাগুরা ও নড়াইল জেলা হয় ১ মার্চ ১৯৮৪ সালে। জেলা ঘোষনার পূর্বে থানাসমুহ উপজেলায় উন্নীত হয়। বর্তমান যশোর জেলার আয়াতন ২৫৬৭.৭৭ বর্গ কিলোমিটার (৯৮৭.২২ বর্গ মাইল)। মহাকুমা গুলোর চেহারা এরকম -
মহাকুমার নাম আয়তন (বর্গ মাইল) থানা ইউনিয়ন
যশোর সদর ৭৬৫.৫০ বঃ মাঃ ০৭ ৭১
বনগাঁ ৬০৭.৮৫ বঃ মাঃ ০৪ ৫৫
মাগুরা ৪৩৭.২৭ বঃ মাঃ ০৪ ৪১
নড়াইল ৪৬৪.৪৪ বঃ মাঃ ০৬ ৪৫
ঝিনাইদহ ৬৪৮.২১ বঃ মাঃ ০৫ ৪৫
মোট = ০৫ ২৯২৫.০০ বঃ মাঃ ২৬ ২৫৭
অতীতের যশোর :
যশোর বাংলাদেশের একটি সুপ্রাচীনতম স্থান। দিগ্বিজয় প্রকাশ গ্রন্থে যশোর তথা দক্ষিণ বঙ্গকে কাননাবৃত্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রাচীনকালে এ জেলায় আর্য, দ্রাবিড়, মঙ্গল ও আদিম অধিবাসীরা বসবাস করত। নিষাদ, কিরাত ও বাগদি জাতির বসবাসও ছিল। এ জেলা অংসখ্য অধিবাসী বৌদ্ধ সম্প্রদায় ছিল। হিন্দু রাজত্বের সময় বৌদ্ধদের জোর পূর্বক হিন্দু ধর্মে দিক্ষীত করা হয়। যোগী, ভড়ং, তাঁতী, মাহিষ্য, কপালি, নমশূদ্র প্রভৃতি জাতির লোকেরা অধিকাংশই বৌদ্ধ ছিল। কায়েস্ত ব্রহ্মণ, বৌদ্য জাতির লোকেরা এখনও এদেশে বসবাস করে।
আধুনিক যশোর জেলা ও প্রতাপাদিত্যে যশোর এক নহে। প্রাচীন ইতিহাসের সংক্ষিপ্ত রূপই আজকের এই যশোর জেলা। ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত মুড়লী কসবা তথা যশোর টলেমী বর্ণিত গঙ্গারেজিয়া। যশোরের সাথে জড়িয়ে আছে হযরত খানজাহান আলী, গাজী-কালু, গরীব শাহ ও বোরহান শাহ্-এর মত মহাপুরুষদের নাম। খান জাহান আলী বহু পূর্ব থেকেই যশোর ও বারোবাজার হিন্দু বৌদ্ধ জাতির প্রাণকেন্দ্র ছিল বলে অনুমিত হয়। যদিও সেযুগের ইতিহাস কুয়াসাছন্ন। ময়নামতি, মহাস্থানগড় ও পাহাড়পুরের ন্যায় বারবাজারে সুপ্রাচীন ইতিহাস। যশোরে সর্বত্র ইতিহাসের খনি বিদ্যমান। যশোরের ভরত ভায়না, শৈলকুপা, মির্জানগর, বেড়বাড়ি প্রভৃতি অতিপ্রাচীন স্থান। ভরত ভায়নায় সুউচ্চ মৃত্রিকার ঢিবি বিদ্যমান যা বৌদ্ধ আমলের ভরত রাজার বাড়ি হিসেবে পরিচিত। গৌঢ় বঙ্গের একটি ঐতিহাসিক টাকশাল ছিল মুহম্মদাবাদে (উত্তর যশোর)। হোসেন শাহ, নসরত শাহ এই টাকশাল থেকে মুদ্রাংকন করেছিলেন। বাংলার অন্যতম স্বাধীন সুলতান শেরশাহ যশোর থেকে ভূষনা (ফতেহবাদ) পর্যন্ত একটি দীর্ঘ রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। এই রাস্তা দিয়ে সে যুগে ডাক চলাচল করত। সম্ভাবত শেরশাহ এই ডাক চলাচলের প্রবর্তন করেন। বেরইল গ্রামের নবগঙ্গার তীরে একটি ডাক চৌকির অফিস ছিল। যা বর্তমানে চৌকির ভূঁই নামে পরিচিত। ঝিনাইদহ জেলার শৈলকুপার শাহী মসজিদ, যশোর জেলার অন্যতম প্রাচীন কীর্তি। যশোর শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত মুড়লী প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থান। এখানে হাজী মুহাম্মদ মহসীনের প্রতিষ্ঠিত ইমামবাড়া অবস্থিত। এই স্থানে পশ্চিমে চাঁচড়া রাজবাড়ি। দানশীল জমিদার কালিবাবু যশোর কলিকাতা রাস্তা নির্মাণ করে স্মরনীয় হয়ে আছেন। রামনগরে অবস্থিত খানজাহান খনিত দীঘি যাহা পিকনিক কর্ণার নামে পরিচিত। মীর্জানগর ও ত্রিমোহনীতে ইতিহাসের অনেক উপাদান রহিয়াছে। নওয়াপাড়া শিল্প বাণিজ্যের জন্য বিখ্যাত ছাতিয়ানতলা মুন্সী মেহেরুল্লার জন্মভূমি। বাসুড়ী গ্রামে খানজাহান খনিত একটি বিশাল একটা দিঘী দেখা যায়। সাগরদাড়ি কপোতাক্ষ নদীর তীরে মাইকেল মধুসুদন দত্তের জন্মভূমি। শোলখাদা গ্রামে বৈজ্ঞানিক ডাক্তার নীল রতন ধরের জন্মভূমি। ঝিনাইদহে বাঘা যতিন এর জন্মভূমি। বিজয়পুরে রাজা মুকুট রায়ের খনিত দীঘি যা ঢোল সমুদ্র নামে পরিচিত। হরিশংকর পুরে প্রখ্যাত গনিতজ্ঞ কে. পি বসুর জন্ম স্থান যশোরের কোট চাঁদপুর চিনি শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। মহেশপুরে সূর্য বংশীয় রাজাদের শাসন কেন্দ্র ছিল। লোহাগড়ার বড়দিয়া পাট ব্যবসায়ী কেন্দ্র। কালিয়া বাংলাদেশের মধ্যে একটি বৈদ্য প্রধান স্থান। লোহাগড়া ও সালনগরে জোড় বাংলা মন্দির নামে বিখ্যাত। বিদ্যানন্দকাটি গ্রামে খানজাহান আলী খনিত বিরাট আকার দীঘি অবস্থিত।
মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারের পতনের পর ১৭৭২ সালে কোম্পানী সরকার যশোর বা মুড়লী কসবায় রাজস্ব সংগ্রহের জন্য একজন কালেক্টর নিয়োগ করেন। ১৭৮২ সালে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট যশোরের জন্য নিযুক্ত হয়। সে সময় যে কোর্ট কাছারী স্থাপিত হয় তাকে লোকে মুড়লীর কাছারী বলত। ১৭৮৯ খৃষ্টাব্দে এই অফিস মুড়লীর পাশ্ববর্তী কসবা বা সাহেবগঞ্জে স্থাপিত হয়। তখন থেকে এই স্থানের নাম স্থায়ীভাবে যশোর হয়। এভাবে মুড়লী কসবার নাম ধীরে ধীরে ইতিহাসের পাতা থেকে পর্দার অন্তরালে চলে যায়।
জেলার বৃটিশ প্রশাসন চালুর সময় ১৭৮১ সাল। পরিচিত ত্রিমোহনীর নিকট মীর্জানগর সমৃদ্ধ ছিল এবং সেখানে থানা ছিল। পরে ১৮৬৩ খৃঃ পর্যন্ত ত্রিমোহনীতে থানা থাকে। বনগাঁ পিচের রাস্তা ১৮৬৬-১৮৬৮ কালপর্বে তৈরী হয়। ১৭৮৬ সালে চাঁদখালীতে কোর্ট ছিল, মিঃ ফোস্টার যার বিচারক ছিলেন। ৫ আগস্ট ১৭৮৮ তারিখে মহাকুমা কোর্ট যশোরের মুরলিতে স্থানান্তরিত হয়। এটি বাংলার প্রথম মহাকুমা। ১৮৬৪ সালে যশোর মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয়। অনেক ভাঙ্গা-গড়ার স্বাক্ষী হয়ে যশোর আপন ঐতিহ্যে উজ্জ্বল হয়ে আছে। মুরলিতে থানার পত্তন হয় ১৭৮২ সালে। সেকালে প্রশাসনিক একক ছিল থানা। সংগত কারণে থানার পত্তন প্রসংগ স্বাভাবিক।
যশোর জেলার চিনি শিল্পের জন্য বিখ্যাত। কোটচাঁদপুর চিনি উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র ছিল। তৎকালে চিনির ব্যবসায় খুব লাভবান ছিল। বিলাত হতে ইংরেজ ব্যবসায়ীরা এসে কুঠির শিল্প হস্তক্ষেপ করে। চৌগাছা, কেশবপুর, নারিকেলবাড়িয়া ও ঝিকরগাছায় চিনি উৎপাদনের কারখানা ছিল। গুড় চিনি ছাড়া যশোরে বস্ত্র শিল্পের খ্যাতি ছিল। ইংরেজ আমলের প্রথম দিকে ঘরে ঘরে চরকা ছিল। চরকা দ্বারা সূতা কেটে কাপড় বোনা হত। তাঁতীরা ঘরে ঘরে তাঁত শিল্পের উন্নতি সাধন করেছিল। ভৈরব তীরে নীলগঞ্জের হাটে প্রচুর বস্ত্রের আমদানী হত।
তথ্য সূত্র :
বিভিন্ন গ্রন্থ হতে সংগৃহীত
সম্পাদনা :
হাবিব ইবনে মোস্তফা
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট :
নভেম্বর ২০১১