
Home শিক্ষক / Teacher > অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হাই / Abdul Hai (1924-1981)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 99914 বার পড়া হয়েছে
অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হাই / Abdul Hai (1924-1981)
অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল হাই
Abdul Hai
Home District: Jessore
Abdul Hai
Home District: Jessore
মুহাম্মদ

উনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকে ভারতবর্ষে চলছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলো, কিন্তু পাকিস্তানের শাসন ব্যাবস্থা পূর্ব পাকিস্তানীদের মনে হতাশার সৃষ্টি করলো। বিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি এই সংগঠন বিভাগীয় সম্পাদক নির্বাচিত হন।
পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ায় অধিকাংশ হিন্দু ভারতে চলে যাওয়ায় মাইকেল মধুসূদন কলেজে শিক্ষকের অভাব দেখা দেয়। আব্দুল হাই ১৯৫১ সালে এই কলেজে অধ্যাপনা আরম্ভ করেন। ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, ফলে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার তাঁকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করে। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী নূরুল আমিনের আদেশে, তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয় এবং নির্বাচন শেষে তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
১৯৫৬ সালের ১০ ডিসেম্বর মোঃ আব্দুল হাই প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমানের অনুরোধে এম, এম কলেজের অধ্যাক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি সেই সময়ে নানা রাজনৈতিক সুবিধার আশ্বাস পেয়েও শিক্ষকতা ত্যাগ করতে সম্মত হননি। দেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালেও তিনি অনুরূপ সুযোগ-সুবিধার আশ্বাস পেয়েও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন নি।
তিনি মেধাবী ছাত্রদেরকে এবং খ্যাতিমান শিক্ষকদেরকে সুযোগ সুবিধা দিয়ে এই মহাবিদ্যালয়ের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা করতেন।
পাকিস্তান সরকারের দ্বিতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় মাইকেল মধুসূদন কলেজ অন্তর্ভুক্ত হলে, কলেজের সার্বিক উন্নয়নের জন্যে তখন প্রয়োজন হলো নতুন গৃহাদি নির্মাণের। এর জন্য কলেজের স্থান নির্ধারণ ও জমি সংগ্রহের ব্যাপারে আব্দুল হাই ও তাঁর পিতা অবুল খায়েরের অবদান বিশেষ স্মরণীয়। কলেজটিকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
১৯৬২ সনে নব নির্মিত ভবনে ডিগ্রী ক্লাস আরম্ভ হয়। অধ্যক্ষ আব্দুল হাই-এর প্রচেষ্টায় কলেজটিতে বাংলা, অর্থনীতি ও ভূগোল বিভাগে সম্মান শ্রেণী চালু করা সম্ভব হয়।
নির্মাণ কাজে অত্যাধিক পরিশ্রমের ফলে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাজনৈতিক পট পরিবর্তিত হওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে নানা চক্রান্তের দানা বাঁধতে থাকে। শেষ পর্যন্ত ১৯৬৬ সালে পাকিস্তান সরকারের পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে তাঁকে গ্রেফতার ও কারারুদ্ধ করা হয়। ১৪ মাস কারারুদ্ধ থাকার পর মুক্তি পেয়ে চাকুরিতে আর যোগদান করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। অত্যাধিক অসুস্থতা ও নিদারূন আর্থিক কষ্টের মধ্যে তাঁর দিন পার হতে থাকে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি প্রত্যক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করেন, ফলে তাঁকে গ্রেফতার করে যশোর সেনানিবাসে নেয়া হয়, কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে প্রস্তুতকৃত অভিযোগের ফাইল খুঁজে না পাওয়ায় তাঁকে সাময়িকভাবে রেহাই দেয়া হয়। অতঃপর তিনি বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে জীবন রক্ষা করেন। ১৯৭২ সনে তাঁর অকৃত্রিম সুহৃদ শেখ মুজিবর রহমান বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলে তিনি তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করেন। শেখ মুজিব প্রদত্ত উচ্চ পদের প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখান করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দৌলতপুর বি, এল মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। তিনি দৌলতপুর কলেজে কয়েকটি ভবন তৈরী করে বিভিন্ন বিষয়ে সম্মান চালু করেন এবং বেদখল জমি পুনরুদ্ধার করেন।
১৯৭৬ সালে তিনি আবার তাঁর প্রিয় মাইকেল মধুসূদন বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পূর্বে তিনি সকলের আনুকুল্যে কলেজ সীমানায় ভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহীদ মিনার স্থাপন করেছিলেন, এবার তিনি শহীদ মিনারের আমূল সংস্কার সাধন করেন। তিনি মহাবিদ্যালয়ে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন।
দেশ ও দেশবাসীর জন্যে কল্যাণকর যে কোন কাজের সাথে তিনি সহযোগিতা করতেন। যশোর উল্শী প্রকল্পেরও তিনি সহযোগিতা করেন।
১৯৮০ সালে বিজয় দিবসে মাইকেল মধুসূদন মহাবিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে তিনি বিদেশে কর্মরত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এই সাথে মহাবিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণে যাঁরা তাঁকে সহযোগিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবিত সকলকেই এই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। অধ্যক্ষ আব্দুল হাই সাহেবের জীবনে এটিই ছিল শেষ সাধারণ আনুষ্ঠান। এই দিনের বক্তৃতাকালে প্রবল আবেগে তিনি ঊর্ধ্বস্বরে কেঁদে ওঠেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বাংলাদেশের কল্যাণ ও সকলের উন্নতি কামনা করেন।
১৯৮০ সালের রমজান মাসে আধ্যক্ষ আব্দুল হাই অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁর অবস্থা ক্রমশঃ অবনতির দিকে যেতে থাকে। তখন তিনি ঢাকার প্রফেসর নূরুল ইসলাম সাহেবের নিকট চিকিৎসার জন্য যান। পরীক্ষা শেষে তিনি জানতে পারেন যে, তিনি মারাত্মক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। চিকিৎসায় কোন ফল হয়নি। ১৯৮১ সালের ১০ জানুয়ারী সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে তিনি পরলোকে গমন করেন। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে তাঁর মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হয়, যশোরবাসী গভীর শেকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অতঃপর ঢাকা থেকে পরদিন ভোরবেলা ট্রাকযোগে মরহুমের মৃতদেহ সঙ্গে নিয়ে তাঁর স্নেহসম্পদ ছাত্র প্রতি মন্ত্রী মোঃ তরিকুল ইসলাম ও যশোরের প্রাক্তন জেলা কমিশনার মহিউদ্দীন খান আলমগীর যশোর এসে পৌঁছান। যশোরে তাঁর সরকারী আবাসিক ভবনে তাঁকে শেষ বারের মত দেখার জন্যে শত শত মানুষ ভিড় করে। মহাবিদ্যালয়ের মাঠে মরহুমের লাশ রাখার পরে তাঁর নিজের গড়া ‘ন্যাশনাল ক্যাডেট কোর’ ‘রোভার’ ও রেঞ্জারগণ তাঁর মৃত দেহের প্রতি শেষ বারের মত সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে। ঐ দিনই তাঁদের পারিবারিক গোরস্থানে বিশেষ সম্মানের সাথে তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়।
মুহাম্মদ আব্দুল হাই তাঁর পরিবারের জন্যে কোন সঞ্চয় রেখে যেতে পারেন নি। তাঁর স্নেহসম্পদ ছাত্র ও শিক্ষকগণ একটি স্মৃতি কমিটি গঠন করেন এবং সাময়িকভাবে একটি তহবিল গঠন করে তাঁর পরিবারকে দেন। স্মৃতি কমিটি মহাবিদ্যালয়ের কলাভবনটির নাম তাঁর নামানুসারে ‘আব্দুল হাই কলা ভবন’ নামাঙ্কিত করে।
তথ্য সূত্র:
শিক্ষালয়ের ইতিকথায় যশোর
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা:
মো: হাসানূজ্জামান (বিপুল)
সর্বশেষ আপডেট:
মার্চ ২০১২