
Home সাংবাদিক / Journalist > শিশির কুমার ঘোষ / Shishir Kumar Ghosh (1840-1911)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100145 বার পড়া হয়েছে
শিশির কুমার ঘোষ / Shishir Kumar Ghosh (1840-1911)
শিশির কুমার ঘোষ
Shishir Kumar Ghosh
Home District: Jessore, Jhikargacha
Shishir Kumar Ghosh
Home District: Jessore, Jhikargacha

সংবাদপত্রের অনন্য পথিকৃৎ সুসাহিত্যিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মনীষী শিশির কুমার ঘোষ ১৮৪০ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা থানার পালুয়া মাগুরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। উকিল হরনারায়ণ ঘোষ ও শ্রীমতী আমৃতময়ীর তৃতীয় পুত্র তিনি। তাঁর পূর্বপুরুষের আদিনিবাস তৎকালীন যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার কোটচাঁদপুর থানার জয়দিয়া গ্রামে। প্রপিতামহ রামরাম ঘোষ ঝিকরগাছার পালুয়া মাগুরার মজুমদার পরিবারের সাথে বৈবাহিক এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক জড়িয়ে পড়েন এবং পলুয়া মাগুরায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।
শিশির কুমার ঘোষ যশোর জেলার খাজুরার গুরুচরণ মিত্রের কন্যা ভুবনমোহিনীকে বিবাহ করেন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর সাত বছর পর নদীয়া জেলার হাঁসখালি গ্রামের রামধন বিশ্বাসের কন্যা কমুদিনী দেবীকে দ্বিতীয়বারের মত বিবাহ করেন।
শিক্ষাজীবন:
শিশির কুমার ঘোষ যশোর জিলা স্কুলে কিছুদিন পড়াশুনার পর কলকাতা কলুটোলা ব্রাঞ্চ স্কুলে (বর্তামান হেয়ার স্কুল) ভর্তি হন। ১৮৫৭ সালে সেখান থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করেন। পরবর্তীতে তিনি কিছুদিন কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজেও পড়াশুনা করে নিজের গ্রামে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন:
শিক্ষা বিভাগের ডেপুটি ইন্সপেক্টর আব স্কুলস্ পদে চাকরির মধ্য দিয়েই তাঁর কর্মজীবনের সূচনা।
সাংবাদিকতা:
ছাত্রজীবন থেকেই সাহিত্য ও সাংবাদিকতার প্রতি ছিল তাঁর প্রবল আকর্ষণ। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই সূচনা হয় তাঁর সাংবাদিকতা জীবনের।
নিজ গ্রাম থেকে সংবাদপত্র প্রকাশের মনোবাসনায়, ১৮৬২ সালে তিনি কলকাতার এক বিধবা মহিলার কাছ থেকে ৩২ টাকায় ‘বেলেইন প্রেস’ নমক কাঠ দ্বারা তৈরী একটা মুদ্রাযন্ত্র কিনে পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এই মুদ্রাণযন্ত্রের নামকরণ করেন ‘অমৃত প্রবাহিনী’ যন্ত্র। প্রথমে এখান থেকেই প্রকাশিত হত সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্প ও কৃষি বিষয়ক পাক্ষিক পত্রিকা। ১৮৬২ সালে এর পরিপূর্ণতা রূপ লাভ করে ‘অমৃত প্রবাহিনী’ শীর্ষক পত্রিকাটি প্রকাশের মাধ্যমে।
শিশির কুমার ঘোষ এলাকাবাসীর সহযোগিতায় নিজ গ্রামে একটা বাজারটি স্থাপন করে মায়ের নামে বাজারটির নামকরণ করেন -অমৃতবাজার। এই বাজারটার নামেই তিনি অমৃত প্রবাহিনী যন্ত্র দ্বারা ১৮৬৮ সালে প্রকাশ করেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি মনষ্ক মানুষের বাংলা সাপ্তাহিক মুখপত্র। ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা। তৎকালীন সময়ে এই পত্রিকার বার্ষিক মূল্য ছিল পাঁচ টাকা। পরবর্তীতে পত্রিকাটি ইংরেজী ভাষাতেও প্রকাশিত হতো এবং শেষ অবধি ১৮৯১ সাল থেকে পত্রিকাটি ইংরেজীতেই নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। প্রত্যন্ত পল্লী থেকে পত্রিকাটি প্রকাশের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দেওয়ায় শিশির কুমার ঘোষ কলকাতার এক প্রেস হতে ছাপার কালি তৈরীসহ বিভিন্ন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন এবং কিছু যুবককেও এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসেন।
নীল বিদ্রোহী লেখনি:
১৮৭৪ সালে মহাত্মা শিশির কুমার ঘোষ তাঁর পত্রিকায় নীল বিদ্রোহকে বাংলাদেশের প্রথম বিল্পব বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। এর প্রতিকারের স্বপক্ষে লেখনী দ্বারা জনমত গড়ে তোলার প্রচেষ্টা করেন। পত্রিকাটি বাংলার বাইরেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। শিশির কুমার ঘোষের সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী ভূমিকায় ইংরেজ সরকারও বিচলিত হয়ে পড়েন। তারা তাঁকে অর্থের লোভ দেখায়। শিশির কুমার ঘোষ এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন- “দেশে অন্তত একজন সৎ সাংবাদিক থাকা উচিত।” তাঁর এ ধরণের মনোবৃত্তির কারণে তিনি বৃটিশ সরকারের রোষানলে পড়েন এবং ১৮৬৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হয়, মামলা থেকে অবমুক্তি লাভ করে তিনি প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতি শুরু করেন। তাঁরই উদ্যোগে ১৮৭৫ সালে গঠিত হয় ইণ্ডিয়ালীগ।
সমাজ সংস্কারক:
সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও শিশির কুমার ঘোষের অবদান স্মরণযোগ্য। পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের উদ্যোগে যে বিধবা বিবাহ চালু হয়েছিল - তার স্বপক্ষে তিনি কলম ধরেছিলেন। ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায় শিশির কুমার ঘোষ লিখেছিলেন, “আমাদের দেশে যতটি প্রকাশ্য বেশ্যা আছে, অনুন্ধান করিলে জানা যাইবে যে তাহাদের মধ্যে শতকরা নব্বই জন বিধবা, বৈধব্য যন্ত্রণা সহ্য করিতে না পারিয়া বেশ্যা হইয়াছে। বিধবা বিবাহে জাতি কেন যায় বুঝিনা। এই সহস্র সহস্র বিধবা নারীর দুঃখ দেখিয়া এদেশীয়গণের বুক পাষাণ হইয়া গিয়াছে কিন্তু তাহাদের বুক পাষাণ হইয়াছে বলিয়া বিধবাদিগের দুঃখ কমে নাই।”
সাহিত্যচর্চা:
প্রথিতযথা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শিশির কুমার ঘোষ নাট্যচর্চাসহ সাহিত্য অঙ্গনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গীয় নাট্যশালা স্থাপনে তাঁর অবদান বিশেষ স্মরণীয়। ১৮৭৩-৭৪ সালে তাঁর রচিত প্রহসন নাটক ‘বাজারের লড়াই’ ও ‘নয়শো রূপেয়া’ নাটক দুটি তাঁর পরিচালনায় মঞ্চায়িত হয়। পরবর্তীতে তিনি শ্রী অমিয় নিমাই চরিত্র (৬ খণ্ডে প্রকাশিত) ও ইংরেজিতে Lord Gouranga Ges এবং Salvation for All গ্রন্থ রচনা করেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
এই কৃতিমান লেখকের প্রকাশিত গ্রন্থসমূহ - ‘শ্রী কালাচাঁদগীতি’ (কাব্য), ‘শ্রী নিমাই সন্যাস’ (নাটক), ‘সর্পাঘাতের চিকিৎসা’ ও ‘সংগীত শান্ত্র’। জীবন সায়াহ্নে বৈষ্ণব ধর্মানুরক্ত হয়ে তিনি শ্রী শ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা, শ্রী শ্রী গৌর বিষ্ণুপ্রিয়া পত্রিকা, হিন্দু স্পিরিচুয়্যাল ম্যাগাজিন প্রভৃতি প্রকাশ করেন।
মৃত্যু:
বাঙ্গালীর নবজাগরণের পথিক শিশির কুমার ঘোষ ১৯১১ সালের ১০ই জানুয়ারী ৭২ বছর বয়সে দেহত্যাগ করেন। তাঁর অবর্তমানে ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা মতিলাল ঘোষ। পরবর্তী সময়ে পত্রিকাটি কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
তথ্য সূত্র:
যশোরের যশস্বী, শিল্পী ও সাহিত্যিক
লেখক : কাজী শওকত শাহী
সম্পাদনা:
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
সর্বশেষ আপডেট: মার্চ ২০১২