
Home সাংবাদিক / Journalist > সাইফুল আলম মুকুল / Saiful Alam Mukul (1955-1998)
এই পৃষ্ঠাটি মোট 100051 বার পড়া হয়েছে
সাইফুল আলম মুকুল / Saiful Alam Mukul (1955-1998)
সাইফুল আলম মুকুল
Saiful Alam Mukul
Home District: Jessore
Saiful Alam Mukul
Home District: Jessore

আর এম সাইফুল আলম মুকুল কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ মরহুম আব্দুর রউফ এর পৌত্র এবং লেখক, সাংবাদিক দৈনিক ‘রানার’ ও সাপ্তাহিক ‘গণমানুষ’-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম গোলাম মাজেদে’র জ্যেষ্ঠ পুত্র। ১৯৫৫ সালের ১৯ মার্চ যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমার (বর্তমান জেলা) কোটচাঁদপুরে দাদার বাড়ীতে জন্মগ্রহণ করেন। পৈত্রিক বাড়ী যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে।
যশোরের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ খান সাহেব আব্দুল আজিজ ছিলেন মুকুলের প্রপিতামহ (দাদার চাচা)। তিনি ছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলায় (যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ও বনগাঁ এলাকা) আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য (MLC)|
মুকুলের দাদা আব্দুর রউফ ছিলেন একজন কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও যশোর জিলা স্কুলের সুপন্ডিত শিক্ষক। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদ হন তিনি।
মুকুলের বাবা গোলাম মাজেদ ১৯৮২ সালে সামরিক আইন জারীর ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে এককভাবেই যে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছিলেন, এরশাদীয় সামরিক শাসনকালে তা ছিল অচিন্ত্যনীয়। দু’দুবার এরশাদ তাঁকে গ্রেফতার করে এবং তাঁর উপর যে দৈহিক, মানসিক এবং অর্থনৈতিক নির্যাতন চালায় তাতে গোলাম মাজেদের জীবনও নির্বাপিত হয়। কিন্তু শহীদ গোলাম মাজেদ সারা বিশ্বের স্বৈরাচার বিরোধী অকুতোভয় এক সৈনিক হিসাবে শহীদের মর্যাদায় আসীন এবং বিশ্বব্যপী মুক্তিকামী মানুষের পরম শ্রদ্ধার পাত্র।
মুকুলের চাচাতো ভাই মো: হাসানূজ্জামান বিপুল বৃহত্তর যশোরকে নিয়ে এই ওয়েবসাইটের প্রতিষ্ঠাতা।
পিতা-মাতার নয় সন্তানের মধ্যে মুকুল দ্বিতীয় এবং ভাইদের মধ্যে প্রথম। মা রাবেয়া খাতুন ছিলেন একজন গৃহিণী এবং দৈনিক রানার পত্রিকার প্রকাশিকা। ২০০৫ সালে দুরারোগ্য ক্যান্সারে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
শিক্ষাজীবন:
১৯৭২ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে এস.এস.সি (বিজ্ঞান) পাশ করেন। ১৯৭৫ সালে যশোর সরকারি মাইকেল মধুসুদন মহাবিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে এইচ.এস.সি (বিজ্ঞান) পাশ করেন এবং ১৯৭৯ সালে যশোর সরকারি সিটি কলেজ থেকে দ্বিতীয় বিভাগে রাষ্ট্র বিজ্ঞানে বি.এ আনার্স পাস করেন।
সাংবাদিকতা:
একসময় মুকুল ছিলেন ঠিকাদার ব্যবসায়ী। পত্রিকায় তখন মাঝে মধ্যে লিখতেন। লেখাপড়া শেষ করে তিনি পিতা শহীদ সাংবাদিক গোলাম মাজেদের হাত ধরে সাংবাদিকতা পেশায় আসেন। ১৯৮২ সালে সামরিক শাসনের সমালোচনা করে প্রতিবেদন লেখায় মিলিটারীদের হাতে গোলাম মাজেদ গ্রেফতার এবং দন্ডিত হয়ে জেলখানায় গেলে পত্রিকার দায়িত্বভার তাঁর ঘাড়ে চাপে। শেষ পর্যন্ত স্বৈরশাষকের অমানুষিক নির্যাতনে পিতা গোলাম মাজেদ শহীদ হলে তিনি সেই থেকে রানার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এরপর থেকে তিনি নিরলসভাবে কলম চালনা করেন অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে। তিনি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আপোসহীন কলম চালনা করে সাংবাদিকতার জগতে একমাত্র প্রতিবাদী সাংবাদিক হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। নির্ভীক সাংবাদিকতা চর্চার মাধ্যমে তিনি দক্ষিণাঞ্চলের সংবাদ জগতে আলোচিত পুরুষে পরিণত হন।
মুকুলের পিতা গোলাম মাজেদের মৃত্যুর পর অপরাধীরা ভেবেছিল তাদের পথের কাঁটা দূর হলো। এবার হয়তো তাদের অপরাধের কথা আর প্রকাশ পাবে না। কিন্তু তাদের এই ভুল ভাঙ্গতে বেশী সময় লাগেনি। গোলাম মাজেদের মৃত্যুর পর তাঁর বড় ছেলে আর.এম.সাইফুল আলম মুকুল পিতার স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেন। তিনি নিজেকে উজাড় করে দেন পিতার লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে। শুরু হয় দ্বিতীয় অধ্যায়। অনেক বাঁধা বিপত্তি উপেক্ষা করে তিনি পিতার দেখিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়েই সামনে এগিয়েছেন। এক মূহুর্তের জন্যেও লক্ষ্যভ্রষ্ট হননি। ফলে অত্যন্ত অল্প সময়ে মুকুল একজন সাহসী সাংবাদিক হিসাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। আর দৈনিক রানার পায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
পত্রিকা সম্পাদনাকালে বহুবার হত্যার হুমকি দিয়েছে সন্ত্রাসীরা তাঁকে। সরকারি কর্মকর্তাগণ তাঁর পত্রিকার বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার শাস্তিমুলক ব্যবস্থা নিয়েছেন। তবুও তিনি একবিন্দু ভীত সন্ত্রস্ত না হয়ে লেখনী চালিয়ে গেছেন।
মুকুল যশোরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান; এবং তিনি সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন তার জন্য চির নমস্য ও চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সাইফুল আলম মুকুল কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি করে লেখেননি। তিনি সব সময় দলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের কথা লিখেছেন।
মুকুলের জীবনের শেষ দিনগুলি:
সাইফুল আলম মুকুল তাঁর সাংবাদিক জীবনের শেষ দিনে (১৫ই জুলাই ১৯৯৮) “দূর নির্বাসনে যাও” শীর্ষক কবিতায় তাই যথার্থই বলেছেন, “....নীতির সুদৃশ্য মোড়কে দুর্ণীতির বিভৎসতা / ভন্ডের উচ্চকণ্ঠে সত্য নির্বাক / ভীড়ামোতে কার্যসিদ্ধি / সত্য দূরে যাও...।”
সাইফুল আলম মুকুলের সম্পাদনায় সর্বশেষ ১৫ই জুন ‘৯৮ দৈনিক রানার বের হয়। ওই সংখ্যায় ১০০ ক্রমিকে ‘সেই সাংবাদিকের কাহিনী’ এবং ৭৩ ক্রমিকে ‘সাংঘাতিক’ শীর্ষক প্রতিবেদন ছাপা হয়। এদিন রানারের হেডপিট (মাস্ট) ছাপা হয় প্রতিবাদ শ্লোগান: “বিচার ছাড়াই ফাঁসি হয়ে যায় / এদেশ আমার নয়। পঙ্কিলতায় আত্নসমর্পন নয় / আত্নঘাতই মর্যাদাকর।” তার নীচে আড়াআড়ি করে ছাপা হয় “দুর নির্বাসনে যাও” শীর্ষক তাৎপর্যপূর্ণ কবিতা। সেই থেকে রানারের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে থাকে।
৩০ আগস্ট রাতে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হবার আগের দিনগুলো তাঁর জীবনের ছিল বড় করুণ। একাধারে প্রশাসনিক কঠোরতা, সন্ত্রাসীদের হুমকি, সাংবাদিকবৃন্দের গোষ্ঠিগত বিবাদসহ অর্থনৈতিক সংকট তাঁকে দারুনভাবে বিব্রত করেছিল। তাই সাময়িকভাবে রানার বন্ধ হয়ে যাবার প্রাক্কালে তাঁর অভিব্যক্তমূলক কবিতাটি একটি নিষ্ঠুর সত্যের প্রকাশ মাধ্যম হয়ে রয়েছে---
দূর নির্বাসনে যাও -- ... তবুও জঙ্গলে সততা আছে মানুষের সমাজে অভাব প্রকট সহিংসতায়ও ওরা বেজায় সৎ, সাধুতায় মানুষ ভীষন অসৎ সরকার চলে দুর্বৃত্তের শাসনে সততা জঙ্গলে যাও এদেশ তোমার নয়। পিতা, দোহাই তোমার আমাকে দোষ দিও না সত্য এদেশে অবাঞ্চিত সত্য বল্লেই বিপদ। তুমিও বাঁচতে পারোনি, সত্য বলেছিলে বলেই তো ... তবুও গর্বিত, করোনি মাথানত, অসত্যের কাছে। পশুর দাপটী রাজত্বে মনুষ্যত্ব অচল মানুষের অবয়বে পশুরাই মূর্তিমান। চোরেরাই নমস্য, পূজনীয়, সম্মানিত, শ্রদ্ধেয় সত্য পালাও, জঙ্গলে যাও হিংস্রতায়ও সেখানে সততা আছে... সভ্যতায় সততা নেই শঠতাই নাকি সভ্যতা, সমাজ সাহসী নয়, আত্নসমর্পিত দুর্জনে। দুর্বৃত্তের লাথি খেয়েও সালাম ঠোকে নতশিরে, বীরত্বে বেপরোয়া হয় সত্যনিষ্ঠ সাধুজ’নে। জ্ঞানের গরীমা নয় শক্তির বর্বর শাসনে, বেজায় আসক্তি আত্নপ্রতিষ্ঠার সন্ধানে নীতির সুদৃশ্য মোড়কে দূর্নীতির বীভৎসতা, ভন্ডের উচ্চকণ্ঠে সত্য নির্বাক ভাঁড়ামোতে কার্যসিদ্ধি সত্য দুরস্ত যাও বন্যতায়ও বিশ্বাস আছে সভ্যতায় প্রকট অভাব। প্রতারক না হতে পারো দূর নির্বাসনে যাও, ঐ সমাজ তোমার নয় এদেশ তোমার নয় !! সাইফুল আলম মুকুল ১৫.০৬.৯৮ |
মৃত্যু:
সাহসী সাংবাদিক জনাব আর এম সাইফুল আলম মুকুল ৩০ আগস্ট ‘৯৮ রাত ১০টা-১৫ মিনিটে বাড়ী ফেরার পথে বেজপাড়া চিরুনী কলের কাছে সন্ত্রাসীরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অকালে সাংবাদিক মুকুল ঝরে গেলেন। তাঁর পূর্বসূরী, ‘ সাপ্তাহিক গণমানস’ ও ‘দৈনিক রানার’- এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শহীদ গোলাম মাজেদও এভাবে ঝরে যান। যে স্মৃতি সংগ্রামী যশোরবাসীর হৃদয়পটে গেঁথে থাকবে চিরকাল।
দাদা আব্দুর রউফ, পিতা গোলাম মাজেদ এবং নিজে মুকুল বন্দী মানবাত্না মুক্তির জন্য তিন পুরুষ ধরে যে ত্যাগ ও আত্নউৎসর্গের নিদর্শন রেখেছেন বিশ্ব ইতিহাসে তা প্রায়ই বিরল ঘটনা।
গোলাম মাজেদের সুযোগ্য পুত্র সাইফুল আলম মুকুল তাঁর পূর্বপুরুষদের মতই সত্যের জন্যে জীবন উৎসর্গকারী এক মহান সাংবাদিক। তিনি যে সম্মান অর্জন করেছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে এই লক্ষ কোটি টাকার বিনিময়ও ক্রয়যোগ্য নয়। মুকুলের মৃত্যু একটি পরিবারের তৃতীয় প্রজন্মের শাহাদত বরণ। পৃথিবীর ইতিহাসে তিন প্রজন্মে স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্যে প্রাণ উৎসর্গ করার এমন একটি বিরল সৌভাগ্য সম্ভবত আর কোন পরিবার অর্জন করতে পারেনি। মুকুল প্রমান করেছেন, একটি প্রগতিশীল শিক্ষিত পরিবারের সুযোগ্য সন্তান হিসাবে লড়াই ও আত্নদানের মাধ্যমে তাঁর পরিবার বিশ্বের ইতিহাসে একটি অনন্য-সাধারণ পরিবার হিসাবে নন্দিত।
মুকুল জীবদ্দশায় যেমন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে নৃশংসভাবেই খুন করা মানেই তো মুকুল। তাঁর জীবদ্দশায় যেমন অন্যায়ের কাছে কখনও আত্নসমর্পন করেননি ঠিক তেমনই মরেও তিনি প্রমান করলেন পঙ্কিলতায় আত্নসমর্পণ নয়, মৃত্যুই শ্রেয়। কিন্তু একজন নির্ভীক, অকুতোভয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠকে নৃশংসভাবেই খুন করা মানেই তো সংবাদপত্রের উপর সরাসরি নগ্ন হস্তক্ষেপ।
বিবিসির সাবেক প্রতিনিধি আতাউস সামাদ, দৈনিক আজকের কাগজ সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদ, যায়যায়দিনের সম্পাদক শফিক রেহমানসহ বিভিন্ন মহল মুকুল হত্যাকান্ডে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। দেশব্যপী হাজারো সংবাদপত্রসেবীরা, সাংবাদিকরা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ধিক্কার, নিন্দায় রাজপথে নেমেছেন।
অন্যায়-অসত্যের বিরুদ্ধে মসি নিয়ে লড়তে যেয়ে একই পত্রিকার পিতা-পুত্র দু’জন সম্পাদকের আত্নাহুতির নজির এক বিরল ইতিহাসই বটে। শহীদ সাইফুল আলম মুকুলের সাংবাদিক জীবনের শেষ লেখা, “দূর নির্বাসনে যাও” নামক ওই একটিমাত্র কবিতা নিয়ে ইতিমধ্যে গবেষণা হয়েছে। আমেরিকার জাতীয় প্রেসক্লাবের ফলকে উৎকীর্ণ শহীদ আর.এম.সাইফুল আলম মুকুলের নামটিও স্থান পেয়েছে।
তথ্য সূত্র : দৈনিক রানার
সম্পাদনা :
মোঃ হাসানূজ্জামান বিপুল
শামিউল আমিন শান্ত
সর্বশেষ সম্পাদনা:
অক্টোবর ২০১১